সরোবরে প্রেম
লেখনীতেঃশ্যামকন্যা
পর্ব:১৫
সকালের নরম আর আরামদায়ক রোদ প্রিয়তার মুখ ছুঁয়ে দিচ্ছে। অর্ণব আলতো হাতে প্রিয়তার মাথার নিচে হাত দিল। আরেক হাতে গাল আগলে ধরলো। প্রিয়তা জেগে গেল। অভিমানে তার চোখের কোণায় পানি জমলো। অর্ণব বললো,
“ঘুরতে যাবে, যেখানে আমি, তুমি ছাড়া কেউ থাকবে না। ”
প্রিয়তার মন খারাপ যেন নিমিষেই উবে গেল। সে উপর নিচে মাথা নামিয়ে বললো,
“অবশ্যই যাব।”
ইদানীং অবনীর প্রায়শই জ্বর লেগে থাকছে। গায়ে কেমন ফুসকুড়ি উঠেছে লাল বর্ণের। বগলের নিচে বেশ ব্যাথা হয়। গায়ের ওজনটাও কমছে দিনদিন। ওর রিসেন্ট বয়ফ্রেন্ড বারবার প্রেশার দিচ্ছে দেখা করার জন্য। ছেলেটার নাম রাসিফ। ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড অর্ণবের থেকেও ভালো। অবনী তপ্ত শ্বাস ফেলে। প্রিয়তা হয়তো নিজেকে বাঁচিয়ে ফেলেছে। তবে অবনী অবশ্যই প্রিয়তাকে ছাড় দেবে না। ছোট থেকেই প্রিয়তা সবসময় অবনীর থেকে এগিয়ে। সবার মুখে প্রিয়তার প্রশংসা। অবনীর গায়ে জ্বালা ধরে যায়। এবার রাসিফকে বিয়ে করে অবনী অবশ্যই প্রিয়তার থেকে এগিয়ে থাকবে।
অর্ণব হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়েছে। সেটাও একদিনের। প্রিয়তা রাগ করতে পারেনি। মানুষটা তার জন্য কাজ ফেলে যাচ্ছে এটাই অনেক। অর্ণবের পরণে স্কাই ব্লু শার্ট আর জিন্স। চোখে সানগ্লাস। প্রিয়তা পিংক কালারের একটা জামা পড়েছে। মাথায় উড়না দেয়া। ওরা যাচ্ছে শহর থেকে খানিকটা দূরে নির্জন একটা রিসোর্টে। ট্রেন আসার হুইসেল বাজলে দুজন উঠে বসে। ওরা একটা এসি কেবিন বুক করেছে। অর্ণব প্রিয়তার হাত মুঠোয় পুরে এগোয়।
দুপুরের মধ্যে ওরা রিসোর্টে পৌঁছে যায়। ছবির মতো সুন্দর জায়গা। রিসোর্টের ছাদে লাল টালি। একদম মানানসই। প্রিয়তা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। নির্ধারিত রুমে এসে প্রিয়তা গোসলে যায়। অর্ণব তুলোর মতো নরম বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। খানিক পরেই প্রিয়তা বাথরুমের দরজা কিঞ্চিৎ ফাঁক করে বলে,
“এই শুনছেন, তোয়ালেটা দিন না।”
অর্ণব হালকা হেসে তোয়ালে হাতে এগিয়ে আসে। প্রিয়তার হাত ধরে বলে,
“ইশ! কি রুপ দেখাচ্ছো বলো তো বউ। একদম ঝলসে যাচ্ছি। ”
প্রিয়তা তোয়ালে নিয়েই দরজা লাগিয়ে দেয়। অর্ণবের লাগামছাড়া কথায় তার নিশ্বাসের গতি বেড়ে যায়।
গোসল শেষ হলে প্রিয়তা কফির ব্যবস্থা করে। ততোক্ষণে অর্ণবও ফ্রেশ হয়ে চলে এসেছে। দুজনে বারান্দায় বসে। প্রিয়তা হুট করে কফির মগ রেখে অর্ণবের কোলে উঠে বসে। গলা জড়িয়ে বলে,
“ডাক্তার সাহেব, ধীরে ধীরে আমি আপনার প্রেমে পাগল হয়ে যাচ্ছি। কি জাদু করেছেন বলুন তো।”
অর্ণব মুখটা মলিন করে বলে,
“তুমি আমায় নিয়ে ভীষণ পোসেসিভ হয়ে গিয়েছ, প্রিয়ু। আগে এমন ছিলে না। হঠাৎ আমার কিছু হয়ে গেলে নিজেকে সামলাবে কিভাবে?”
প্রিয়তা কাতর চোখে তাকায়। চোখ দিয়ে ঝুপঝুপিয়ে কান্না নামে। সে অর্ণবকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আপনার আগে আমার মরণ আসুক।”
অর্ণব প্রিয়তার মাথা শক্ত করে বুকে আঁটকে রাখে। বলে,
“বাচ্চামো করো না, প্রিয়ু। নারী মানে কি জানো? নারী মানে শক্তি। তুমি আমার শক্তি। আমি থাকি বা না থাকি আমার ভালোবাসা সারাজীবন তোমার সাথে থাকবে। তোমায় আগলে রাখবে। নিজেকে ভীষণ শক্ত করে গড়ে তুলবে, প্রিয়ু। যেন যেকেউ চাইলেই তোমায় ভেঙে দিতে না পারে।”
প্রিয়তা চুপটি করে শুয়ে থাকে অর্ণবের বুকে। সে কি কখনোও পারবে অর্ণবকে ছাড়া নিশ্বাস নিতে?
অর্ণব ঘোর লাগানো দৃষ্টিতে প্রিয়তার দিকে তাকায়। ঠোঁটকাটার মতো বলে,
“আজ ননস্টপ আদর করবো বুঝলে। বিরক্ত করার ছুঁতো নেই তোমার কাছে।”
প্রিয়তা অস্ফুট সুরে বলে,
“বেহায়া, অসভ্য কোথাকার। ”
অর্ণব মেকি রাগ দেখিয়ে বলে,
“স্বামীকে এসব কি বলছো? ছিহ। আর অসভ্য না হলে বাচ্চার বাপ হবো কিভাবে?”
প্রিয়তা লজ্জায় মুখ নামিয়ে ফেলে। অর্ণব বলে,
“উফ, এই লজ্জারাঙা মুখেই তো ঘায়েল হয়েছি শতবার।”
সেই মুহূর্তে আকাশ কালো হয়ে আসে। আকাশ যেন মাথার উপর ভেঙে পড়বে। প্রিয়তা আহ্লাদী সুরে বলে,
“বৃষ্টিতে ভিজবো চলুন না।”
“জ্বর আসবে তো।”
“আপনার ছোঁয়ায় ঠিক হয়ে যাব।”
অর্ণব হাসে। কাঠের সিড়ি বেয়ে রিসোর্টের ছাদে চলে যায় দুজন। ক্যাটস এন্ড ডগ বৃষ্টি শুরু হয়। আজ বোধহয় ভাসিয়ে নিয়ে যাবে সব। প্রিয়তা দুহাত মেলে বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে। বেসুরো গলায় বলতে থাকে,
“আজ ঝরঝর মুখর বাদল দিনে”
অর্ণব মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখে বৃষ্টিকন্যাকে। বৃষ্টির একেকটা ফোঁটা যেন মুক্তোর দানা। অর্ণবের ভীষণ হিংসা হয়। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো কি সুন্দর তার বউকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। সে এগিয়ে এসে খপ করে প্রিয়তার হাত ধরে বলে,
“আর ভিজতে হবে না। এই বৃষ্টি আমার সতীন।”
প্রিয়তা আগামাথা কিছুই বুঝতে পারে না। রুমে এসে জামা পাল্টে নেয়।
রাতে অর্ণবের জ্বর আসে। মুখ লালবর্ণ ধারণ করে। প্রিয়তা এগিয়ে এসে অর্ণবের শুকনো ঠোঁটে চুমু খায়। অর্ণব জ্বরের ঘোরে বলে,
“আমায় ছোবে না, নিশি। তোমার ছোঁয়া আমার ভালো লাগে না। ”
প্রিয়তার বুক কেঁপে উঠে। সে কথা বলতে ভুলে যায়। জ্বরের ঘোরেই অর্ণব প্রিয়তার কাছাকাছি চলে আসে। অভ্যাসমতো জামা খুলে ফেলে প্রিয়তার। ছুঁয়ে দেয় প্রতিটি লোমকূপ। প্রিয়তা মরার মতো পরে থাকে। সে এখন অনুভূতিশূণ্য।
চলবে…..
সরোবরে প্রেম
লেখনীতেঃশ্যামকন্যা
পর্ব:১৬
সারারাত প্রিয়তা চোখের পাতা এক করতে পারে না। চোখদুটি বেশ লাল এবং জ্বলছে। অর্ণব ঘুম ভেঙে প্রিয়তার মুখ দেখে চমকে উঠে। জিজ্ঞেস করে,
“কি হয়েছে, প্রিয়ু?”
প্রিয়তার চোখে জল খেলে। সে বলে,
“কাল রাতে আপনি জ্বরের ঘোরে নিশির নাম নিয়েছেন।”
অর্ণব নিশ্বাস ফেলে বলে,
“ও নতুন ইন্টার্ন। সারাক্ষণ কাছে আসার ছুতো খুঁজে। ওয়াটসঅ্যাপে মেসেজগুলোও ওর পাঠানো। তাই হয়তো ওর নাম বলে ফেলেছি। এটা নিয়ে তুমি কাঁদতে বসে যাবে? কখনো আমার উপর এতোটা উইক হয়ে যেও না প্রিয়ু।”
প্রিয়তা চোখের পানি মুছে বলে,
“আমি কয়েকটা দিন একা থাকতে চাই। আমাকে এখান থেকে আব্বুর বাসায় দিয়ে আসুন।”
অর্ণব সাইড টেবিলে সজোড়ে একটা ঘুষি বসায়। কেঁপে উঠে প্রিয়তা। অর্ণব বলে,
“সম্পর্কে সবার আগে বিশ্বাস দরকার। যেটা তোমার আমার প্রতি ঠুনকো। আমার বিশ্বাস হয় না বিয়ের দিন তুমি অবনীর কবল থেকে আমায় বাঁচিয়েছিলে। যাও তুমি বাপের বাড়ি। তবে মনে রাখবে আমি তোমায় আনতে যাব না। নিজে থেকে আমায় বিশ্বাস করতে পারলে তবেই ফিরে আসবে।”
প্রিয়তা চুপ করে সায় জানায়।
সন্ধ্যা নামছে প্রকৃতিতে। সূর্যের লাল আভা ছড়িয়ে যাচ্ছে চারিপাশে। প্রিয়তা পিচ কালারের শাড়ি পরে রিসোর্ট থেকে বেরিয়েছে। তার মাথা ধরে আছে। অনেকক্ষণ কাঁদতে পারছে না। অর্ণব সেই থেকে মুখে রা কাটেনি। রিকশা থেকে প্রিয়তা নামতেই অর্ণব বলে,
“মামা, রিকশা ঘোরান।”
অর্ণবের প্রস্থান হতেই প্রিয়তার চোখে বৃষ্টি নামে।
বাসায় পৌঁছে অর্ণব ডাইনিং থেকে গ্লাস ছুঁড়ে মারে ফ্লোরে। আসমা চৌধুরী ছুটে আসেন। উৎকন্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করেন,
“প্রিয়তা কোথায়? আর গ্লাস ভেঙেছিস কেন?”
অর্ণব উত্তর দেয়,
“আমার টাকায় কেনা গ্লাস আমি ভাঙতেই পারি, মা। আর প্রিয়তা ওর মায়ের সাথে থাকবে।”
“এসব কোন ধরনের আচরণ, অর্ণব। মেয়েটা আসার পর থেকে তুই কেমন হয়ে গিয়েছিস। আমি মা হয়ে তোর জন্য এই মেয়ে কিভাবে পছন্দ করলাম?”
বলেই আসমা চৌধুরী ফুপিয়ে কাঁদলেন। অর্ণব এগিয়ে এসে বলল,
” প্রিয়তাকে ছোট করে কথা বলবে না, মা। আমার সহ্য হয় না। ”
বলেই ধুপধাপ পা ফেলে অর্ণব রুমে চলে যায়।
প্রিয়তা অনেকক্ষণ রুমে বসে আছে। সেলিনা বেগম ডাকতে ডাকতে ক্লান্ত। কাব্যও বোনকে ডাকলো দরজা খুলতে। অবশেষে প্রিয়তা দরজা খুললো। সে সোজাসাপটা মাকে বলল,
“মা, ভাত দাও। সকাল থেকে কিছু খাইনি।”
প্রিয়তা ভাত খেতে বসেছে। পাবদা মাছের ঝোল আর লেবু মাখিয়ে ভাত গিলতে বেশ লাগছে। সেলিনা বেগম ঠান্ডা মাথায় বললেন,
“মা, তুই যা বিবরণ দিলি তাতে তো অর্ণবের দোষ দেখি না। তুই আরো কয়টা দিন থেকে ওর কাছে চলে যা।”
প্রিয়তা ভাত চিবুতে চিবুতে বলল,
“গাড়ি ডাক, আমি খেয়েই বের হব। দরকার হলে তোমার জামাইয়ের পায়ে পড়ে থাকবো।”
“এসব কি ধরনের কথা? ”
” ঠিক কথাই বলছি, মা। আসলেই তো ওনার দোষ নেই। ”
“কাল সকালে যাবি। এতো রাতে এসব কি কথা। ”
“যেতে হলে আমি এখুনি যাব। নাহয় আর কখনো যাব না। ”
প্রিয়তা খেতে খেতে সেলিনা বেগম অর্ণবকে ফোন করেন। অর্ণব প্রিয়তাকে কল দিয়ে বলে,
“কাল সকালে নিয়ে আসব, এতো রাতে পাগলামি করো না। তোমার পাগলামিতে আমি অতিষ্ঠ। ”
প্রিয়তা হেসে ফোন নামিয়ে রাখে। সে আরো খানিকটা ভাত নেবে। আজ তরকারিটা বেশ হয়েছে।
প্রিয়তা খাওয়া শেষে আপেল আর একটা ছুরি নিয়ে রুমে চলে যায়। দরজা লাগিয়ে একটা কাগজে চিঠি লিখতে বসে।
“প্রিয় অর্ণব,
আপনাকে আমি কতোটা ভালোবাসি তা কখনো বোঝাতে পারব না, ডাক্তার সাহেব। আপনার নিশ্বাসের শব্দে আমি প্রাণ ফিরে পাই। আপনার বুকের শব্দে আমার হৃদয়ে কাঁপন ধরে। আপনি যখন চোখ দিয়ে আমায় ছুঁয়ে যান, আমি তখন বোয়ালখালীতে আপনার মন ছুঁয়ে আসি। আপনার সামান্য অনুপস্থিতি আমাকে পুড়িয়ে অঙ্গার করে ফেলে। আপনি জানেন, আপনার চোখে কি অপরিসীম মায়া? সেই চোখে বারবার মরতে আমি একটুও ক্লান্ত হই না। আপনার ছোঁয়া আমার শরীরে কি শিহরণ জাগায় আপনি জানেন না। আপনার হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে আমি শত জনম পার করে দিতে পারি। আপনার আশেপাশে কারো উপস্থিতি আমাকে কষ্ট দেয়। শ্বাসকষ্টের মতো কষ্ট, সাথে তীব্র বুক ব্যাথা। তবুও আপনি আমায় বুঝলেন না। কথা দিয়ে আমায় কষ্ট দিলেন। আমি সব সহ্য করে ফেলতে পারি, তবুও আপনার দেয়া কষ্ট আমার সহ্য হয় না। আমি কখনো আপনি ছাড়া অন্য কাউকে এতোটা ভালোবাসতে পারব না, কখনোই না।
ইতি
একজন পাগল।
প্রিয়তা খুব সাবধানে গায়ের উড়না খুলে নিজের মুখটা বেঁধে নেয়। এরপর ছুরিটা হাতে নিয়ে ক্যাচ করে টান দেয় বা হাতের শিরায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়। প্রিয়তা চিৎকার করতে পারে না। চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরে। রাতের আকাশে ভেসে যায় দুঃখগুলো।
চলবে?
রেসপন্স পেলে রাতে আরেকটা পর্ব আসবে।