গোসল সেরে বের হতেই প্রিয়তা অর্ণবকে বিছানার উপর বসে থাকতে দেখলো। খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“নক করা ছাড়া আমার রুমে ঢুকেছেন কেন?”
“তোমার রুমে ঢুকতে আমার নক করতে হবে? তুমি আমার হবু বউ।”
“বউ এখনো হয়ে যাইনি। সম্পর্ক পূর্ণতা পাওয়ার পর অধিকার খাটাবেন।”
সদ্যস্নান করা প্রিয়তার দিকে অপলক তাকিয়ে ছিল অর্ণব। বডিওয়াশ আর শ্যাম্পুর অপূর্ব সুবাসে মেয়েটাকে কি স্নিগ্ধ লাগছে। ধপ করে বুকের সাথে মিশিয়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে অর্ণবের। অবদমিত ইচ্ছেটা চাড়া দিয়ে উঠতেই অর্ণব চোখ সরিয়ে ফেলে। ম্লান গলায় বলে,
“তোমার রাগের কারণটা বলবে, প্রিয়ু।”
প্রিয়তা তেতে উঠলো। বললো,
“আমাকে এই নামে ডাকবেন না। বাধ্য করবেন না বিয়েটা ভেঙে দিতে।”
অর্ণবের চোখ লাল হয়ে আসলো। সে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাগ সংবরনের চেষ্টা করলো। এরপর বললো,
“আমি কি করেছি একবার বলবে?”
“আপনি আমার থেকে লুকিয়ে অন্য মেয়ের সাথে দেখা করেছেন যে কিনা আমারই কাজিন। অবিশ্বাস হচ্ছে আমার আপনাকে। কথা বলতে রুচিতে বাঁধছে। ”
“এক ঝটকায় এসব বলে দিও না, প্রিয়তা। পরে নিজেই আফসোস করবে।”
“আপনাকে সহ্য হচ্ছে না, অর্ণব। প্লিজ আমাকে একা থাকতে দিন।”
বুকে পাথরচাপা দিয়ে টলতে টলতে বেরিয়ে এলো অর্ণব। প্রিয়তা অন্যবারের মতো অর্ণবের মাথায় হাত নেড়ে চুল এলোমেলো করে দেয়নি। দিলে দেখতে পেত জ্বরে ক্লিষ্ট হচ্ছে সুদর্শন যুবকের সম্পূর্ণ শরীর।
বসার ঘরের কাছে আসতেই প্রিয়তার মা সেলিনা বেগম বললেন,
“খেয়ে যাও, বাবা। তোমার পছন্দের বিরিয়ানি রান্না করেছি।”
অনিচ্ছা সত্ত্বেও অর্ণব খেতে বসলো। তেঁতো লাগছে ভীষণ। পাছে প্রিয়তার মা কষ্ট পাবেন ভেবে প্লেটের খাবার টুকু অনেক কষ্টে পেটে চালান করে। তৎক্ষনাৎ বেরিয়ে যায় প্রফেসর হাউস থেকে।
বাসায় পৌঁছাতেই অনি ছুটে আসলো। বললো,
“ভাবি যে আজ একবারও কল করলো না, ভাইয়া।”
“হয়তো মনে পড়েনি। আমি খেয়ে এসেছি। মাকে বলে দিস।”
“আচ্ছা, তুই ঘুমুতে যা।”
রুমে এসে অর্ণব এসি কমিয়ে ঘর ঠান্ডা করে ফেলল। এরপর ফোনে নোটপ্যাড বের করে লিখলো,
“কেন আমাকে এতো কষ্ট দাও, প্রিয়ু। তোমায় ছাড়া থাকতে আমার খুব কষ্ট হয়। নিশ্বাস আটকে আসে। আমাকে ছেড়ে কোথাও যেও না, প্রিয়ু। আমি শেষ হয়ে যাব।”
একফোঁটা স্বচ্ছ জল গড়িয়ে পড়লো মোবাইল স্ক্রিনে।
রুমের কোণা থেকে গিটারটা নিয়ে বসে পড়ে অর্ণব। খানিকেই ঝংকার তোলে,
“ভুলভাল ভালোবাসি, কান্নায় কাছে আসি
ঘৃণা হয়ে চলে যাই থাকি না
কথা বলি একা একা, সেধে এসে খেয়ে ছ্যাঁকা
কেন গান তাও আবার বুঝি না
খুব কালো কোনো কোণে
গান শোনাবো গোপনে
দেখো যেন আর কেউ শোনে না”
গান শেষ হতেই অর্ণবের হাত জ্বলতে শুরু করলো। গিটারের তার এতোটাই জোরে চেপেছে যে হাত বেশ ভালোই কেটেছে। হাতটা বুকের উপর রেখে অর্ণব আওড়াতে থাকে, খুব ভালোবাসি, প্রিয়ু।”
গভীর রাতে আসমা চৌধুরী সন্তপর্ণে ছেলের রুমে প্রবেশ করেন। ছেলের অবস্থা দেখে তিনি আঁতকে উঠেন। গিটার সরিয়ে হাত ভালোভাবে ব্যান্ডেজ করে দেন। মনে মনে নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন,
“তবে কি একমাত্র ছেলের জন্য তিনি ভুল মেয়ে পছন্দ করলেন?”
প্রশ্নটা মনের ভেতর খচখচ করতে থাকলো। তিনি স্বামী আমিন চৌধুরীকে এ ব্যাপারে জানাবেন। ৩৫ বছরের সংসারে স্বামীকে ছাড়া তিনি আজ পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। স্বামীও তার সাথে সব বিষয়ে আলাপ করে পরিকল্পনা করেন।
সকালের নরম রোদ জানালা গলে প্রিয়তার পা স্পর্শ করলো। আরামে আবারও চোখ বন্ধ করলো প্রিয়তা। সেলিনা বেগম চেঁচাতে লাগলেন। বললেন,
“ভার্সিটি আটটায়, এখন বাজে সাড়ে সাতটা। তুই ঘুমা আরও। আমি তোকে আরেকটা কাঁথা এনে দেই।”
মায়ের অমৃত বাণী শুনে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে প্রিয়তা। কোনোরকম ফ্রেশ হয়ে খেতে বসে। টেবিলের একটা চেয়ারে কাব্য পরোটা নিয়ে খোঁচাচ্ছিল। প্রিয়তা ওকে ঘাটালো না। মা আর কাব্যকে নিয়েই প্রিয়তার সংসার। বাবা অনেক আগেই দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেছেন।
ভার্সিটি পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রিয়তার আটটা বেজে যায়। ওর তিনজন বন্ধু নৌশিন, সারা আর জাবির ওর জন্য অপেক্ষা করছিল। প্রথম ক্লাসটা মিস দেয় চারজনেই। উদ্যত হয় ক্যাফেটেরিয়ার উদ্দেশ্যে।
চায়ের আড্ডায় মেতে উঠে বন্ধুমহল। সারা বলে উঠে,
“কাল তো তোর জন্মদিন, দুলাভাইয়ের সাথে ঘুরতে যাবি নাকি!”
প্রিয়তা গা-ছাড়া ভাবে উত্তর দেয়,
“উনার কথা মাঝখানে টানলে আমি চলে যাব।”
জাবির বললো,
“বিয়ের আগেই ঝগড়া শুরু করে দিলি! তোরা মেয়েরা পারিসও বটে।”
তিনজনই তেতে উঠলো। নৌশিন বললো,
“কে বলেছে তোকে মেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব করতে?”
জাবির হেসে বললো,
“কারণ কোনো ছেলের সাথে আমার এতোটা ম্যাচ হয়না। ”
চারজনেই হেসে উঠলো। প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠলো ক্যাফেটেরিয়ার বাতাস।
ঘুম থেকে উঠে অর্ণব হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়। আজ তার মর্নিং ডিউটি। রাস্তায় বাইকে যাওয়ার সময় সে গন্ধরাজ ফুলের তীব্র সুবাস পায়। একটু খুঁজতেই গাছটাও পেয়ে যায়। একটা বাসার বাগানে সামান্য বড় গাছে একটাই ফুল ফুটে আছে। সে খুব সাবধানে ফুলটা চুরি করে আনে। হসপিটালে এসে একটা গ্লাসে পানি ঢেলে ফুলের ডাট ভিজিয়ে রাখে। এখনও খুব সুন্দর গন্ধ ছড়াচ্ছে। অর্ণব মলিন হাসে। তার জ্বর এখন নেই বললেই চলে। সকালে উঠে আজ প্রিয়তার মুখটা দেখেনি বলে বুকটা ফাঁকা লাগছে।
অর্ণব আর প্রিয়তার বিয়েটা পারিবারিক ভাবেই ঠিক হয়। প্রিয়তার মা ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। মেয়েটার ওদিকে পড়ার শখ। স্বামীর পেনশনের সামান্য ক’টা টাকায় সংসার চলেই না। ভাইয়েরা মাঝেমধ্যে সাহায্য করেন। যদিও তিনি কখনোই ভাইদের কাছে হাত পাতেননি। মেজ ভাই হুট করে প্রিয়তার জন্য সম্বন্ধ নিয়ে আসে বড় ঘর থেকে। ছেলে ডাক্তার। ছোট একটা বোন আছে। ঝামেলাহীন পরিবার। প্রিয়তার মা মেয়ের জন্য এমন একটা ঘরই চাইতেন। ওদের বিয়ে ঠিক হয়েছে এক বছরের কাছাকাছি। প্রিয়তার জেদের জন্য বিয়েটা হচ্ছে না। প্রিয়তা পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে করতে চায়। পড়ছেও নিজের টিউশন করানোর টাকায়। অর্ণবেরও কোনো আপত্তি নেই। বরং এই আকাশচুম্বী আত্মসম্মানের জন্য সে প্রিয়তাকে ভালোবেসে ফেলেছে।
সন্ধ্যায় অর্ণব প্রিয়তাদের বাসায় আসে। কাব্যর সাথে খানিকক্ষণ গল্প করে জানতে পারে প্রিয়তা ছাদে আছে। হুট করে অর্ণবও ছাদে চলে যায়। রেলিঙের পাশে প্রিয়তা খোলা চুলে দাঁড়িয়ে আছে। অর্ণব কাছে গিয়ে বলে,
“চুলের শ্যাম্পুটা আবার বদলেছো?”
প্রিয়তা কেঁপে উঠে। বলে,
“আপনাকে আমার শ্যাম্পু মুখস্থ করতে বলিনি।”
অর্ণব হতাশ চোখে তাকায়। গন্ধরাজ ফুলটা প্রিয়তার কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে নিচে চলে আসে।
সেলিনা বেগম আজ অর্ণবের পছন্দ চিংড়ি মাছ রান্না করছেন। ছেলেটা ওনার বেশ পছন্দের। প্রয়োজনের বেশি কথা বলে না কিন্তু তাকে ভীষণ সম্মান করে। এখনকার যুগে এমন ছেলে পাওয়া দুষ্কর। তাছাড়া ছেলেটা তার মেয়েকে চোখে হারায়। একবার প্রিয়তার সামান্য জ্বর হলো। অর্ণব সারারাত প্রিয়তার হাত ধরে বসে রইলো। মাথায় পানি ঢাললো। প্রিয়তাকে খাওয়াতে গিয়ে নিজের খাওয়ার কথাই ভুলে গেল। মেয়ের ভাগ্য তবে এবার খুলছে। তিনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়েটা দিতে চান। নাহয় বিপদের শেষ থাকবে না। মেয়েটাও বড্ড অবুঝ। মা কেন তাড়াহুড়ো করে বিয়ে দিতে চাইছে সে যদি একটু বুঝতো!
রাত বারোটা বাজে। অর্ণব বাসায় ফেরেনি আজ। আজ প্রিয়তার তেইশতম জন্মদিন। ছাদে তেইশটা টাটকা গোলাপ দিয়ে সে প্রিয়তাকে বলে,
“উইল ইউ বি মাইন ফর এভার?”
প্রিয়তার চোখের কোণায় পানি। কি উত্তর দিবে সে?
#সরোবরে প্রেম
#লেখনীতে:শ্যামকন্যা
পর্ব:০১
চলবে?