সমাপ্তির_শেষটা #পর্ব_১

0
1279

#সমাপ্তির_শেষটা
#পর্ব_১
_______________________________________

হাত বাড়িয়েও বাবাকে ছুঁতে পারলাম না । শুধু দেখতেই পারলাম । কারণ বাঁধা হয়ে ছিল ল্যাপটপের স্ক্রিন । পারবোই বা কিভাবে? বাবা তো বাংলাদেশে । আর আমি পৃথিবীর সেই আরেক প্রান্ত কুয়েতে ।
ভেতর থেকে ঠেলে শুধু কান্না আসছিল । ফলস্বরূপ দু’চোখের কার্ণিশ বেয়ে টপটপ করে ঝরছিল অশ্রুরা । হঠাৎ করে স্ক্রিন থেকে বাবার মুখটা সরে গেল । সেখানে দেখা গেল দাভাইয়ের মুখ । উশকু খুশকু হয়ে আছে চুলগুলো । মুখটা মলিন । চোখগুলো টকটকে লাল দাভাইয়ের । আধ ভাঙা কণ্ঠে বলল,
“তোকে কি সাদ্দাফ সত্যি আসতে দিবে না? বাবার এই অবস্থা জানার পরেও কিভাবে তোকে আটকায় ও?”

কোনো উত্তর দিতে পারলাম না আমি । কি বলবো? কিভাবে বলবো সাদ্দাফের বলা কথাগুলো? দাভাই যে মানতে পারবে না ।
এমনিতেই আজ একমাস যাবৎ হাসপাতালে বাবার জন্য । তার উপরে সাদ্দাফ যেসব কথা বলেছে সেসব বলার মতো ক্ষমতা আমারই নেই । মাথা নিচু করে কাঁদছিলাম শুধু ।

“কাঁদিস না নূহা । আমি সাদ্দাফের সাথে কথা বলবো ।”
“কোনো লাভ নেই দাভাই । ব্যর্থ চেষ্টা করার কোনো মানেই হয় না । শুধু শুধু আবার আরেক ঝামেলা বাঁধবে । তার থেকে ভালো আমিই আবার কথা বলবো। ”
আমার উত্তর শুনে চুপ করে রইলো দাভাই । কোনো উত্তর দিল না । খুব ধীরে একটা দীর্ঘশ্বাসের মুক্তি পেল ।

“দাভাই বাবাকে আরেকবার দেখাও। ”
নিশ্চুপে দাভাই ক্যামেরাটা শুধু বাবার দিকে ঘোরালো । সাদা বেড, গায়ে সাদা চাদরে বুক পর্যন্ত ঢাকা, মুখে লাগানো অক্সিজেন মাক্স । নিথর হয়ে পড়ে আছে আমার দুনিয়া । আমার বাবা । হ্যাঁ, আমার বাবা । আর সহ্য হলো না । হুট করে কল কেটে দিলাম । কষ্টগুলো রন্ধ্যে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ে অবশ করে ফেলল আমায় । সেই কষ্টের আংশিক রূপ চোখের জল হয়ে ঝরে পড়তে লাগল । হাঁটুতে মুখ গুজে ফুঁপাচ্ছিলাম । এক এক করে মনে পড়ছিল সব ।

যখন আমি কলেজের গন্ডি পেরোই তখনই হুট করে সাদ্দাফের সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে যায় আমার । বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে সাদ্দাফ । ইঞ্জিনিয়ার । কুয়েতের নাগরিক । দেখতে শুনতে সুপাত্রই বলা যায় । এত ভালো প্রস্তাব কেউ সহজে কি হাতছাড়া করে? করে না । যদি করতো তাহলে আজ আমি হয়তো আমার পরিবার, আমার বাবার থেকে দূরে থাকতাম না । প্রতিমুহুর্তে কষ্টের অনলে জ্বলতাম না । অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাবার খুশি, পরিবারের খুশির জন্য নিজের জীবনকে বিসর্জন দিতে হলো । মেয়েদের জীবনটাই এমন । নিজের কাছের মানুষদের মুখে হাসি ফোটাতে নিজের হাসিকে ভুলে যেতে হয় । পরিবারের মুখে প্রশান্তির হাসি দেখলে নিজের শত কষ্ট লুকিয়ে নিজেও হাসতে পারে দিব্যি ।
বিয়ের ছয়মাসের মাথায় সাদ্দাফ আমাকে নিয়ে পারি জমিয়েছিল কুয়েতের আকাশে । আমার মতামতের কোনো দাম ছিল না তখন । পরিবারের উপর একটা চাপা অভিমানে গুমড়ে ছিলাম । বিয়ের সময় সাদ্দাফের পরিবার কথা দিয়েছিল আমি যতদূর পড়াশোনা করতে চাই করাবে । কথা দিয়েছিল আরো অনেক কিছুই । প্রথম কয়েক বছর সব ঠিকই ছিল । খুব আদর যত্নে রেখেছিল । কিন্তু সব কিছুর মধ্যেও কিসের যেন একটা কমতি ছিল । একা একা লাগতো আমার । খুব বেশি মিস করতাম সবাইকে । বিশেষ করে বাবাকে । যেই আমি বাবার হাতে ছাড়া একবেলা খাবার মুখে তুলতাম না, রাতে বাবা মাথায় হাত না বুলিয়ে দিলে ঘুমাতাম না সেই আমি বছরের পর বছর কাটাতাম সুদূর কুয়েতে । সব মেয়েকেই একদিন না একদিন নিজের পরিবার ছেড়ে যেতে হয় । অচেনা অজানা কিছু মানুষদের নিয়ে সংসারের মায়াজালে আবদ্ধ হতে হয় । পর মানুষগুলোকেই আপন করে নিতে হয় আপনদের থেকে দূরে গিয়ে । এটাই তো বাস্তবতা । কিন্তু আমার মতো এমন দূর্ভাগ্য মনে হয় কারো নেই যে কিনা বাবা মায়ের কাছ থেকে এত দূরে যে একটু চোখের দেখাও দেখতে পারে না ।
ইচ্ছে হলেও ছুটে যেতে পারে না । যখন আমি বারান্দায় বসে আকাশ দেখতাম তখন মনে হতো বাবা আমার পাশে । নীল আকাশে মেঘেদের একেক সময়ের একেক রূপে যেন দেখতাম বাবার হাসি হাসি মুখটা । তখন সারাদিন একা কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাতাম । মাঝে মধ্যে সাদ্দাফ এসে শান্তনার হাত রাখতো মাথায় । চাইতো আমাকে সামলে নিতে । আমিও একটু একটু করে সামলে নিচ্ছিলাম নিজেকে । কিন্তু তারপরই হঠাৎ করে সব বদলে যেতে লাগলো । বদলে গেল সাদ্দাফ । ছোট ছোট কথায় ঝগড়া, অকারণেই রাগারাগি, সময়তে ওর রাগের সমাপ্তি হতো আমার গায়ে হাত তুলে । দিন দিন দূরে ও সরে যেতে লাগল । হুট করে আমার পড়াশোনাও বন্ধ করে দিল ও । আওয়াজ তুলে সেদিন জিজ্ঞেস করতে পারিনি কেন আমার স্বপ্ন ভেঙে দিতে চাইছে? ওয়াদা করে কেন আজ সেই ওয়াদা ভাঙছে । নীরবে সব শুধু মেনে নিতে হয়েছে । এসব কিছুর মধ্যে নতুন একজনের আগমন বার্তা জানলাম । আমার মাঝে আরো একজন প্রাণের অস্তিত্ব অনুভব করি । সাদ্দাফকে যখন এই সংবাদ দেই তখন ও এমন ভাবে আমার দিকে তাকিয়েছিল যেন এই সংবাদে খুশির বদলে ওর মন কালো মেঘে ছেয়ে গেল । ওর সেদিনের সেই দৃষ্টি আমার ভেতরকে আরো একবার কষ্টে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল । তাও নিজেকে সামলে চলছিলাম । কিন্তু জানতাম না যে এইছিল আমার জীবনে বেদনার নীল বিষে ছেয়ে যাওয়ার শুরু ।
যখন আটমাস চলছিল আমার তখন হঠাৎ করেই খবর এলো আমার ছোটভাই নিহান এক্সিডেন্ট করছে । অবস্থা খুবই খারাপ । বাঁচার সম্ভাবনা খুব কম । নিহানকে ছোট থেকেই খুব বেশি ভালোবাসতাম । আমার নয়নমণি ছিল আমার ছোটভাই নিহান । যখন সেই নয়নমণি এক্সিডেন্ট করেছে শুনি তখন আমার অবস্থা কেমন হয়েছিল সেটা একমাত্র আমি আর আমার সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন । দেশে আসার জন্য, নিহানকে দেখার জন্য পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলাম । কিন্তু সেইসময়টাতে আমি আমার পাশে কাউকে পাইনি । যখন আমার পাশে খুব বেশি প্রয়োজন ছিল সাদ্দাফের ।
উল্টো পেয়েছিলাম অবহেলা । তার দু’দিন পর খবর এলো আমার পিচ্চি নিহানটা সবাইকে ছেড়ে দূর আকাশের তারা হয়ে গেছে । খবরটা শুনতেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলি আমি ।

আমার ভাইটা যখন মারা যায় তখন ওর মুখটা দেখতে পারিনি । এতটাই অভাগীনি আমি । আমাকে দেশে আসতে দেয়নি সাদ্দাফ । আর আজ আবার সেই দিন ঘুরে এসেছে আমার জীবনে । আমার বাবা আজ শয্যাশায়ী । ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজে আছেন। এইসময়টা বাবার কাছে থাকার কথা আমার কিন্তু আমাকে সংসারের বেড়াজাল দিয়ে বেঁধে রেখেছে সাদ্দাফ । ওকে দেখলে এখন মনে হয় কোনো অনুভূতিহীন নিষ্ঠুর অচেনা এক ব্যক্তি । কোনো মানুষ হয়তো এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে না যতটা সাদ্দাফ হয়েছে ।

“আম্মু…”
আদরের কণ্ঠ শুনে কান্না বন্ধ করে মাথা উঠিয়ে তাকালাম । ছোট্ট ছোট্ট পায়ে আদর কাছে এসে আমার কোলে বসল । ছোট্ট হাত তুলে আমার চোখে পানি মুছে দিতে দিতে বলল,
“আম্মু কাদে না । নানুবাই টিক হয়ে যাবে ।”
বলতে বলতে ওর চোখও পানিতে টলমল হয়ে উঠল । ওকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে আবারও নীরব কান্নায় ভেঙে পড়লাম আমি । আদর আমার ছেলে । এই মাসেই ওর বয়স পাঁচ বছর হলো । আমার এই ছোট্ট ছেলেটা আমার কষ্ট অনুভব করতে পারলো । শুধু পারলো না ঐ নিষ্ঠুর মানুষটা । কাল রাতে যখন বাবার কাছে যাওয়া কথা সাদ্দাফকে বলি তখন গর্জে উঠে সাদ্দাফ । উল্টো পাল্টা যা পারে বলে যায় । একবার শুধু বাবাকে দেখতে যেতে চাওয়ায় উত্তর দেয়, যেতে হলে চিরতরের জন্য যেতে হবে ফিরতে পারবো না আর কোনোদিন । প্রতিবাদ করায় রাগের মাত্রা বেড়ে যায় ওর আর থাপ্পড় মারে আমাকে । এতটাই জোরে যে মুহুর্তেই ঠোঁট কেটে রক্ত বেরিয়ে আসে । সাদ্দাফের এমন ভয়ংকর রূপ দেখে দূরে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপছিল আমার ছেলেটা। হেঁচকি তুলে কাঁদছিলও । তৎক্ষনাৎ সাদ্দাফ আলমারি ঘেটে আমার পাসপোর্ট নিয়ে চলে যায় । যাতে আমি কোথাও চলে না যেতে পারি ।
অনেক খুঁজেছি আমার সাথে ওর এমন ব্যবহারের কারণ । কিন্তু উত্তরে শুধু শূণ্যই মিলেছে । পাইনি খুঁজে কোনো কারণ । খুঁজে খুঁজে একসময় ক্লান্ত হয়ে বাদ দিয়েছি সব । জীবনের খুব বড় আর কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম সেদিন । তাতে যা হওয়ার হোক । সেটাই মেনে নিব ।
__________________________
প্লেন বাংলাদেশের মাটিতে ল্যান্ড করতে হয়তো আর কতক্ষণ । তারপর কিছুক্ষণ পরেই হয়তো দেখতে পারবো আমার প্রিয় মুখগুলোকে । প্লেনের জানলা দিয়ে বাহিরে তাকালাম । মেঘের রাজ্য দিয়ে উড়ে চলছে । ছোটবেলায় বাবা আমাকে বলতেন,
“তোকে নিয়ে একদিন মেঘের রাজ্য ঘুরতে যাব । এক টুকরো মেঘের উপর তোকে বসিয়ে দিব। আর তুই ভেসে বেড়াবি । মেঘের একটা মুকুটও তোকে পড়িয়ে দিব । তখন তোকে রূপকথার মেঘের রানীর মতো লাগবে।”

বাবা বলতেন আর আমি চোখ বড় বড় করে শুনতাম । কিন্তু বড় হওয়ার পরও যখন আমাকে একই কথা বলতেন আমি শুনতাম আর খিলখিল করে হাসতাম । সেই কথাগুলো খুব মনে পড়ে এখন । আর চোখের কোণে জমা হয় অশ্রুকণা । আদর আমার কোলের মধ্যেই গুটিশুটি হয়ে ঘুমাচ্ছে । ওর মাথায় একবার হাত বুলিয়ে দিলাম ।
গত কয়েকদিন অনেক চেষ্টার পর কাল লুকোছুপি করে বেরিয়ে আসি সাদ্দাফ নামক কারাগার থেকে । এবং আসার সময় সব সম্পর্কের ইতি টেনে দিই । এমন সম্পর্কের কোনো ভিত্তি নেই যেখানে…..।
_________________________
দীর্ঘ এগারো বছর পর পা রাখলাম দেশের মাটিতে । কতকিছু পাল্টে গেছে । নেই আর আগের মতো । অচেনা লাগছে সবকিছু । জীবনটাই তো অচেনা হয়ে গেছে । সেই সাথে খুব কাছের মানুষগুলোও হয়তো । সময় কত কিছুই না করতে পারে । একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে ।
দাভাইকে কল করে ঠিকানাটা জেনে নিলাম হসপিটালের । বাড়তি কথা বলার কোনো সুযোগ দেইনি । আদর চারপাশে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে আর এটা ওটা প্রশ্ন করছে । ওর খুশির সীমা নেই । ওর নানুভাইকে দেখবে । মামাকে দেখবে সেই খুশিতে আত্মাহারা ।

যখন হসপিটালে পৌঁছালাম তখন…….
.
.
.
চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here