সন্ধ্যে_নামার_আগে (পর্ব_১) #লেখা_সুমাইয়া_আক্তার_মনি

0
865

‘ সব সম্পর্কের বাঁধন থেকে মুক্তি দিয়ে অজানা গন্তব্যের দিকে ছুটে চলল স্মিতা। সাথে নিয়ে যাচ্ছে কিছু স্মৃতি, কিছু গল্প। ‘

এয়ারপোর্টে এসে বারবার পিছু তাকিয়ে প্রিয় মানুষগুলোর কথা স্মরণ করছিল আর চোখের পানি মুছল স্মিতা। প্রিয় দেশ, প্রিয় মানুষ ছেড়ে চলে যাচ্ছে সে। বহুদূরে চলে যাবে। যেখান থেকে এই অভাগীকে কেউ খুঁজে পাবে না। ডান হাতে ট্রলি আর বাঁ হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে ভেতরে চলে আসলো। কিছুক্ষণ পরেই পাখির মত উড়ে যাবে সে। সুখ-দুঃখ এই অভ্র মেঘের আকাশটাতে বিলিয়ে দিয়ে যাবে। এবং নিয়ে যাবে কিছু গল্প।

.
.

সমস্ত যন্ত্রণা বুকের মধ্যে রেখে জোরপূর্বক হেসে দিল উপস্থিত থাকা মানুষটিকে দেখে। ঝাঁপিয়ে পড়ল জেরিনের বুকে৷ স্মিতাকে সান্ত্বনা দেওয়ার মত কিছু পেল না জেরিন। শুধুই মাথার উপরে হাত রেখে শব্দ করে বলল,’ এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে কান্না করবি! না-কি বাড়িতে যাবি?’

জেরিনের কথা শুনে ঈষৎ হেসে চোখ মুছল স্মিতা। জেরিন এবারে শব্দ করেই হাসল। বলল, ‘ তোর নামের মতোই তুই।’
জবাবে স্মিতা এবারেও হাসল।

বাড়িতে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খাবার খাওয়ার পরে স্মিতার রুমে এসে আঁট ঘাট বেঁধে বসল জেরিন। স্মিতা তখন থাই গ্লাসের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চোখ বুলাচ্ছিল। জেরিনের উপস্তিতি পেয়ে পিছনে ফিরে তাকাল একবার। তারপরে আবারও বাইরের দিকে তাকাল।
ওকলাহোমা রাজ্যে এই তুলসাহ শহরটি। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত। সাত তলা উপর থেকে নিচের দিকে চোখ বুলিয়ে এই শহরটিকে দেখছে স্মিতা। জেরিন একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ওর কাঁধে হাত রেখে বাইরের দিকে তাকাল। খানিকটা নড়েচড়ে গেল স্মিতা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে জেরিন শুধালো,’ এমন উদাসীন হয়ে আছো কেন?’

‘এমনি।’

‘এমনি এমনি কেউ এভাবে থাকে?’ জেরিনের কথা শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে জানালা ভেদ করে বাইরে তাকাল স্মিতা। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছল । চোখ-মুখ শান্ত।

_____________
অতীত

আকাশটা অভ্র মেঘে ছেয়ে আছে। মাঝে মাঝে নীলের সমারোহ। সাথে আছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। বাড়ির চারিপাশ ঘিরে রয়েছে ছোটো-বড়ো সুপুরি গাছ, নারিকেল গাছ ও তাল গাছ। মাটি থেকে প্রায় এক হাত উপর পর্যন্ত চুনের প্রলেপ দেওয়া। এরজন্য গাছগুলোর সৌন্দর্য আরও বেশি ছড়িয়ে পরেছে। সাথে বাড়ির সৌন্দর্যটাও। দাদুবাড়িতে যখন আসবে তখনই নানানভাবে এই সৌন্দর্যগুলোকে ক্যামেরাবন্দি করে সায়ন্তন। আজকেও তার বিপরীত হয়নি। হঠাৎই আকাশটা কালো মেঘে ছেয়ে গেল। বৃষ্টি শুরু হবে হয়তো। অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়। এমন সময়ে ইলশেগুঁড়ি শুরু হয়ে গেল। বড়ো বড়ো পা ফেলে বাড়ির মধ্যে ছুটে গেল সায়ন্তন। সদর দরজায় পা রাখতেই তীব্র বেগে মেজাজ পরিবর্তন হয়ে গেল। যে একটু আগেও একজন প্রকৃত প্রেমী ছিল। সে এখন একজন রগচটা মানুষ। শার্টে পরা গুড়িগুড়ি বৃষ্টির পানি ঝাড়তে ঝাড়তে ঘরে প্রবেশ করেই বেশ শব্দ করে সদর দরজা লাগাল।
সায়ন্তের উপস্থিতি পেয়ে সবাই হকচকিয়ে গেল। অপ্রতিভ হয়ে তাকিয়ে রইল ওর দিকে।
উচ্চতায় পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি৷ ফর্সা, কালো ঘন চুল। জোড়া ভ্রু, তবে চোখ দুটো বেশ শান্ত থাকে। এই শান্ত চোখের পিছনেই যেন সমস্ত রাগ লুকিয়ে রাখে সায়ন্তন। যেকোনো মুহূর্তে শান্ত চোখ দুটো অশান্ত হয়ে যায়। তবে তখনও স্থির থাকে দৃষ্টিগুলো। শুধু চোখের মণির পরিবর্তন হয়। রেগে গেলে হালকা নীল বর্ণের মণি লাল বর্ণের আকার ধারণ করে।
যেমন, ধাতব ক্লোরাইডকে বুনসেন বার্ণারের জারণ শিখায় ধরলে এটি বাষ্পে পরিণত হয়ে শিখার বর্ণের পরিবর্তন করে, তখন দেখতে ইটের ন্যায় লাল বর্ণের হয়। ঠিক তেমনই কোনো ঝামেলা দেখলেই সায়ন্তনের মণির পরিবর্তন তেমন হয়। বিশেষ করে বাবা-মায়ের ঝামেলা গুলো সহ্যই করতে পারে না। বেশ কয়েকবার বারণ করেছে তবুও তারা শুনেনি। একেরপর এক ঝামেলায় বেঁধেই থাকবে। আজকে বৃষ্টির জন্য এক পর্যায়ে ছুটে আসতে হল তাই আবারও সেই পরিবার ঝামেলা চোখে পরেছে। না হলে ওর উপস্থিতি থাকলে এসবের কিছুই হত না। তাই হঠাৎই ওর উপস্থিতি নাড়িয়ে দিল সবাইকে। এবার কেন জানি সায়ন্তন কোনো রিয়াক্ট করল না। শান্ত ভাবে ওর ছোট ভাই স্পন্দনকে জামাকাপড় গোছাতে বলল।
সায়ন্তনের এমন কথায় নিশ্চুপ হয়ে গেল সবাই। ভাই ভক্ত স্পন্দন চুপচাপ জামাকাপড় গোছাতে থাকল। কিছুক্ষণ পরে সায়ন্তনের বাঁ হাত ধরে ওর পাশে এসেই দাঁড়াল স্পন্দন। একভাই অনার্স তৃতীয় বর্ষে আরেক ভাই কেবল সেভেনের বার্ষিক পরীক্ষা দিল। তবে বড়ো ভাইকে ছাড়া স্পন্দন কিছু ভাবতেই পারে না। ভাববেই বা কীভাবে! সবকিছুতেই তো বড়ো ভাই ঝাঁপিয়ে পরে। তাই চুপচাপ ভাইয়ের হাত ধরে দাঁড়াল।

স্পন্দনের হাত ধরে যখনই সদর দরজার দিকে আসবে তখনই ওর মা সায়ন্তনের নাম ধরে ডাক দিল।

‘এই আবহাওয়ার মধ্যে কোথায় যাচ্ছিস বাবা?’

সায়ন্তন মাথা ঘুরিয়ে বলল, ‘তোমরা শান্তিতে তর্ক কর, এরজন্য যাচ্ছি। ছেলে বড়ো হলে যে চুপচাপ থাকতে হয় এমনটা তো করছো না। তাই আমরা নিজেরাই চুপ হচ্ছি। ‘ সায়ন্তনের কথায় নিশ্চুপ হয়ে গেল সবাই। বাঁধা দেওয়ার আগেই সায়ন্তন গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে ভাইকে নিয়ে চলে আসল। ওর বাবা-মা, ফুফু, দাদি নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল।

বাড়ি থেকে স্টেশন খানিকটা দূরে আছে। তাছাড়া ঢাকাতে গেলে উঠবেই-বা কোথায়! ঘরের চাবি তো ওর মায়ের কাছে। থাকতে হবে হোটেলেই। তাই নিজের বিভাগেই ঘুরেফিরে সময়টা কাটিয়ে দিবে। রাগ কমলে না হয় বাড়িতে যাবে। কিছুদূর হাঁটার পরে একটা সিএনজি পেল। চালক একটু নড়বড়ে হলেও বহুকষ্টে দুই ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে পর্যটন এলাকার কাছেই রিসোর্টে উঠল৷ ভাগ্য ভালো ছিল বিধায় রুম পেয়ে গেছে। তড়িঘড়ি করে স্পন্দনের শার্ট চেইঞ্জ করে নিজেও ফ্রেশ হয়ে নিল। ইলশেগুঁড়িতে আর যাই হোক না কেন! ঘুমটা বেশ ভালোই হয়। আইপ্যাড নিয়ে গেমসের জগতে পাড়ি জমালো স্পন্দন। ততক্ষণে সায়ন্তন বিছানায় শুয়ে ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে। দুই মিনিট পরেই আবারও হকচকিয়ে উঠল সে। তড়িঘড়ি করে মায়ের ফোনে মেসেজ দিয়ে জানাল, ‘শুধু শুধু কান্না আর চিন্তা যেন না করে। দুই ভাই বেশ ভালো আছে নতুন সংসারে। কিছুদিন ঘুরাঘুরির পরে সংসার গুছিয়ে আবারও তার কাছেই ফিরে যাবে। ‘ মেসেজটি দিয়েই মৃদু হাসল সায়ন্তন।
ওর মা আফসানা বেগমও ছেলের এমন মেসেজ পেয়ে খুশিতে ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টানলেন।

__________________

সায়ন্তনের ছোটো এবং স্পন্দনের বড়ো একজন বোন ছিল। মাত্র চার বছর বয়সেই পরলোকগমন করে। দাদু বাড়িতে যখন এসেছিলো তখন ওর বাবা-মায়ের এমন তর্কাতর্কির মধ্যে বোনের খেয়াল রাখেনি কেউ। ছোটো ছোটো পায়ে সে বাড়ি অতিক্রম করে ডোবার কাছে গিয়ে একা-একা খেলতে থাকে। তার পরমুহূর্তেই হদিস পায়নি। সবাইকে ছেড়ে চলে যায় সে। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে তার দেখা মিলে ঠিকই তবে অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছিল তখন। এই নিয়ে প্রায় বছরখানেক মনমালিন্য হলে তারপরে সংসার গোছগাছ। তাই স্পন্দনকে চোখে চোখে রাখে সায়ন্তন। তার প্রাণপ্রিয় ভাইয়ের জন্য কোনো রিস্কে যায় না। ওদের বাবা আর্থিকভাবে বেশ পরিপূর্ণ। নিজের ফ্যাক্টরি, দুই-তিনটা গুদাম রয়েছে। এসবের পাশাপাশি তার আরেকটা পেশা আছে এবং তা হল রাজনীতি নিয়ে বেশ দাপট। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও এই রাজনীতি সায়ন্তনের মায়ের পছন্দ নয়। একেবারেই এসব সহ্য করার ক্ষমতা নেই তার। ঢাকাতে থাকলে ফ্যাক্টরি নিয়ে, গুদাম নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তবে সিলেটে গ্রামের বাড়িতে আসলে অতিরিক্ত মাথা ঘামায়। এর ঝামেলা,ওর ঝামেলা এসব নিয়ে সে ব্যস্ত ভীষণ। মাঝেমাঝে জনগণের কথার সম্মুখীন হতে হয়, যদি মনমতো বিচার না পায়। মূলত সায়ন্তনের মায়ের প্রধান সমস্যা এই কথাগুলোই। পুরো রাজকার্য শেষ করে বিচার করবে তবুও কথার সম্মুখীন হতে হবে! এসব মানতে রাজী নয় তিনি। এর বিরোধিতা করলেই দুজনের মধ্যে লঙ্কাকাণ্ড বয়ে যায়। সায়ন্তন যতক্ষণ বাড়িতে থাকবে ঠিক ততক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে থাকবে, সায়ন্তন যাওয়ার পরমুহূর্তেই আবার শুরু হয়ে যায়। এসব নিয়ে নিজের কপাল নিজের চাপড়ানো ছাড়া আর কিছু চোখে পরে না সায়ন্তনের। এর জন্য এক বোনকে হারালো। তবে এখন প্রানপ্রিয় ভাইকে হারাতে রাজী নয়। এতবড়ো ছেলের কথা যদি না-ই শুনে তাহলে কীই-বা করার আছে তাঁর! নিজেই রেগে চলে এসেছে এরজন্য। সাথে ভাইকে নিয়েই এসেছে।

___________

সকালবেলা আকাশটা হাসছে৷ মেঘগুলো কত সুন্দর ভাবে নিজেদেরকে সাজিয়ে রেখেছে। শুভ্র, নীলের মাঝেমাঝে একটু কালো মেঘের সমারোহ দেখা যায়। সাথে লাল বর্ণের মেঘও এসে জমা হচ্ছে।
দুই ভাই খাওয়াদাওয়ার পরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য বের হল। খানিকটা পথ এগিয়েছে তারা। তখনই দেখা মিললো এক বৃদ্ধার। ঘাসের উপরে পা চেপে বসে আছে আর আর্তনাদ করছে। বৃদ্ধাকে কান্না করতে দেখে এগিয়ে গেল সায়ন্তন ও স্পন্দন। পা কেটে যাওয়ায় অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল বৃদ্ধা। জুতো বিহীন ধূলোময়লায় ভরা পা। হাড্ডিসার দেহ। সাদা চুলের বৃদ্ধার চোখের কোটর গভীর হয়ে আছে। পা থেকে রক্ত ঝড়ছে। হয়তো খালি পা থাকায় কিছুর সাথে লেগে কেটে গেছে। সায়ন্তন শুধালো, ‘কীভাবে কেটেছে?’

চাপা স্বরে বৃদ্ধা বলল,’ ইটের খোয়ায় মনে হয়। ‘

হাতের কাছে কিছু নেই যা দিয়ে রক্ত থামাবে। পকেট থেকে রুমাল বের করে বৃদ্ধার কাটা পা বেঁধে দিল। তারপরে শুধালো, ‘ বাড়িতে যেতে পারবেন?’

বৃদ্ধা চুপ রইল। বৃদ্ধার থেকে কোনো জবাব না পেয়ে সায়ন্তন পৌঁছে দিল বৃদ্ধাকে। তখন চাপা স্বরে বৃদ্ধা বলল,’ একটু চা-পানি খেয়ে যাও।’
সায়ন্তন চলে আসতে চাইলে বৃদ্ধার মুখের চাহনি দেখে বসল। একটা মায়াভরা মুখ। মনে হয়, কতকিছু থেকেও নেই তার। একটা চাপা কষ্ট নিয়ে সে বেঁচে আছে। সায়ন্তন ও স্পন্দনকে বসতে দেখে খুশি হল বৃদ্ধা। কারো নাম ধরে ডেকে চা-বিস্কুট আনতে বলল।
ডোবার উপরে ছোট মাচা করা কাঠের ঘর। চারিপাশে, উপরে টিনের ছাউনি। শুধু নিচটাতেই কাঠের পাটাতন করা। দু-তিনটে রুম হতে পারে। রোয়াকের খাটের উপরে বসে বসে চারিপাশ দেখছিল সায়ন্তন। তখনই একজন নাস্তা নিয়ে হাজির হল। বাড়ন্ত বয়স। শ্যামবর্ণের অধিকারী। চোখ দুটো ডাগরডাগর। সায়ন্তনকে দেখেই ভূত দেখার মত ঘনঘন চোখের পলক ফেলেই চলে গেল সে৷ রোয়াক পেরিয়ে ঘরের ভেতরে এসে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল স্মিতা।

সায়ন্তনেরও একই অবস্থা। ভূত দেখার মত হা হয়ে আছে। তবে পরিস্থিতি সামলে বৃদ্ধার সাথে কথায় মেতে উঠল।

#চলবে
#সন্ধ্যে_নামার_আগে (পর্ব_১)
#লেখা_সুমাইয়া_আক্তার_মনি

( অনেকদিন লেখা থেকে বিরতি নেওয়ায় ছন্দ খুঁজে পাচ্ছি না। তাই নতুনভাবেই শুরু করলাম। মন্তব্য জানাবেন।)
পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here