#সন্ধ্যায়_সন্ধি
#মম_সাহা
পর্বঃ২
রাতে,
চাঁদ বারান্দায় দাড়িয়ে আছে। কবুতর গুলোকে আদর করছে।তার এই এক দুর্বলতা। ভীষণ পাখি প্রেমী।এই যে ছাদে কত কবুতর, সে এই কবুতর দেখার লোভেই তো ছাদে যায়।মানুষটাকে না বলতেও কেমন বুঝে গেলো যে চাঁদের ও এক জোড়া কবুতর লাগবে।
এই তো একটু আগেই তেজ ভাইয়া বারান্দায় কবুতরের খাঁচাটা কেমন সুন্দর করে লাগিয়ে দিয়ে গেলো,জেনো তেজ ভাইয়ার বারান্দা থেকেও ছোঁয়া যায়।ও হ্যাঁ বলতেই ভুলে গেছি আমার আর তেজ ভাইয়ার বারান্দা পাশাপাশি। আমার বারান্দায় কি হয় তা তেজ ভাইয়া দেখতে পায় আবার তেজ ভাইয়ার বারান্দায় কি হয় সেটা আমি দেখতে পাই।কেমন মিরাক্কেল তাই না?
অন্যদিকে বারান্দা এক সাথে পরাটা কোনো মিরাক্কেল না।এটা তেজের কেরামতি। যেদিন চাঁদরা এই ফ্লাটে শিফ্ট করে সেদিনই তেজও তার ঘর শিফ্ট করে এই রুমটাতে আসে। কিন্তু চাঁদ টের ও পায় নি।
চাঁদ আর তেজেরা একই এলাকায় থাকতো কিন্তু আলাদা বাড়িতে। তেজের মা বাবার জোড়াজুড়িতে চাঁদ রা তাদের পাশের ফ্লাটে শিফ্ট করে।।
যাই হোক চাঁদের কবুতর দুটির খুব সুন্দর নাম দিয়েছে তেজ।একটার নাম সন্ধ্যা আরেকটার নাম সন্ধি।নাম গুলো একটু অদ্ভুত। চাঁদ এই নাম দেওয়ার পিছনে কারণ জানতে চেয়েছিলো।কিন্তু বিশেষ কোনো লাভ হয় নি।তেজের কাছে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় নি। কিন্তু চাঁদের কাছে নাম গুলো খুব সুন্দর লেগেছে।
বর্তমানে চাঁদ এক মনে কবুতর গুলোর দিকে চেয়ে আছে আর সে খেয়াল করছে কবুতর গুলো একজন আরেকজনকে ভীষণ অপছন্দ করে।ঝগড়া লেগেই আছে।চাঁদও আনমনে হেসে উঠে।
এর মাঝেই চাঁদের মা হাজির হয়।মায়ের প্রাণ চাঁদ। ওনার চাঁদ ছাড়াও আরো দুটো ছেলেমেয়ে আছে কিন্তু চাঁদের প্রতিই বোধহয় টান তার বেশি।ছোট বেলা মেয়েটা মরতে মরতে বেচেঁ এসেছে।এর পর থেকেই মেয়েটাকে নিয়ে সবাই ভয়ে থাকে।আবার সবার ছোট বলে চোখের মনি হয়েই থাকে।
এই তো একটু আগে চাঁদের বাবা এসে নিজের স্ত্রী এর সাথে কি রাগারাগি টাই না করলেন। কেনো মেয়েকে সে দেখে রাখতে পারলো না? অনেক কষ্টে চাঁদ বাবাকে থামিয়েছে।
চাঁদের মা চাঁদের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন- চাঁদমনির কি কবুতে গুলো খুব পছন্দ?
চাঁদ ও মায়ের প্রশ্নে উৎফুল্লের সাথে উত্তর দেয়- হ্যাঁ মা আমার খুব পছন্দ হয়েছে।চাঁদের মা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
– জানো তো মা আমাদের খুব পছন্দে যারা মূল্য দেয় আমাদের উচিত তাদের মূল্য দেওয়া। তারা কি চায় সেটা বোঝা।এই যে তুমি অতিরিক্ত ছটফট করে তারপর একটা ব্যাথা পাও এতে আমরা সবাই কষ্ট পাই এমনকি তোমার তেজ ভাইয়াও। আমরা সবাই তোমাকে আদর করি তোমার পছন্দ অপছন্দ কে মূল্য দেই।তোমার কি উচিত না আমাদের জন্য নিজের একটু খেয়াল রাখা?
চাঁদ মায়ের কথায় হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ালো।সেও জানে তাকে সবাই কতটা ভালোবাসে কিন্তু সে কি করবে।তার হাঁটাচলা ভালো না চেষ্টা করেও শান্তশিষ্ট ভাবে চলতে পারে না।
চাঁদের মায়ের হঠাৎ মনে পড়লো সে চাঁদকে খেতে যাওয়ার জন্য ডাকতে এসেছিলো আর এখানে মেয়ের সাথে গল্প জুড়ে দিলো।।তাই মিসেস নিলিমা সানে চাঁদের মা চাঁদকে বললো খেতে আসতে।
চাঁদের কোনো হেলদুল নেই। খাওয়ার কথাটা শুনেও না শুনে বসে থাকার অভ্যাস তার।চাঁদের মা মেয়ের দুষ্টমি বুঝতে পেরে মেয়েকে টেনে দাঁড় করিয়ে বারান্দা থেকে বের করতে চাইলে চাঁদ আহ্লাদী সুরে বলে উঠে
– মা জানোতে ভাইয়া বিকেলে আইসক্রিম এনেছে তার অর্ধেক আমি খেয়েছি।আমার পেট একদম ভরা।এক দুইদিন না খেলেও খুদা লাগবে না।ওমা আমি খাবো না
– কে খাবে না শুনি।পাশের বারান্দা থেকে ধমকের সুরে বললো তেজ।
চাঁদ তো মনে মনে যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়।
তেজ আবারো ধমক দিয়ে বললো- যা চাঁদ গিয়ে খাবার কমপ্লিট কর।আমি জেনো আর এক্সট্রা কথা না শুনি।খাবার শেষ করে আবার বারান্দায় এসে দাড়াবি যা।
চাঁদকে আর পায় কে।সে এক দৌড়ে ডাইনিং টেবিলে।নিলিমাও বোনের ছেলের দিকে একটা কৃতজ্ঞতার হাসি দেয়।এই ছেলেটা তার মেয়েকে বড্ড আগলে রাখে।
তেজও খালামনির হাসির কারণ বুঝে মুচকি হাসি দিয়ে ভরসা দেয় চাঁদের দুনিয়ায় তেজ সবসময়ই থাকবে। তাদের চিন্তার কারণ নেই।
ডাইনিং টেবিলে,,
চাঁদের বাবা তার দুই মেয়েকে দুই পাশে নিয়ে বসেছেন।চাঁদের এক পাশে বাবা অপর পাশে ভাই।বাবা খাইয়ে দিচ্ছে তাকে।আর ভাই আর আপু সে নিয়ে কি ঝগড়া।অবশ্য সবটাই মজা করে।হাসিখুশিতে তাদের খাবারের পর্ব শেষ হলো।চাঁদের নিজেকে বড্ড সুখী মানুষ মনে হয়।কিন্তু ভয় হয় এত সুখ সইবে তো জীবনে?
চাঁদের মাথায় এখন ঐ একটা জিনিসই ঢুকে গেছে।এত সুখ তার জীবনে সইবে তো।এই চিন্তায় সে খাবার শেষ করেছে।আর বারান্দায় যায় নি।শুয়ে পড়েছে কিন্তু হুম নেই চোখে।
রাত তিনটে__
চাঁদ বিছানায় এপিঠ ওপিঠ করেও যখন ঘুমাতে ব্যর্থ তখন সে ভাবলো বারান্দায় গিয়ে পাখি গুলোর সাথে সময় কাটানো যাক।যেমন ভাবনা তেমন কাজ।আপুর পাশ থেকে উঠে বারান্দায় রওনা দিলো।
বারান্দায় এসে পাখি গুলোর খাচাঁয় হাত দিয়ে দাড়িয়ে রইলো।সে ভাবনায় এতটা ব্যস্ত ছিলো,যে পাশের বারান্দায় একটা মানুষ তার দিকে বিষ্ময়ের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে সেটা খেয়ালই করে নি।
হ্যাঁ পাশের বারান্দায় তেজ বসে আছে।সে অনেক রাত অব্দি অফিসের কাজ করে।কিন্তু চাঁদ বারোটার মাঝেই ঘুমিয়ে পড়ে।আজ এত রাতে চাঁদকে বারান্দায় আসতে দেখে অতি অবাকই হয়েছে। তবে এটাও বুজেছে যে চাঁদ মহারানীর নিশ্চয়ই কিছু নিয়ে মন খারাপ। নাহয় এত অন্য মনস্ক থাকতো না।তাই সে গলা পরিষ্কার করলো শব্দ করে চাঁদের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য।
পাশের বারান্দায় কিছু একটা শব্দ শুনে চাঁদ ভালোই চমকে গেছে।ভয়ও পেয়েছে বোঝা গেছে।চাঁদের এমন অবস্থা দেখে তেজ ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলছে,
– রিল্যাক্স চাঁদ আমি। আমি তেজ,ভয় পেয়ো না।
চাঁদও স্বস্তি পেলো তেজকে দেখে না হয় এখনই ভয়ে কলিজাটা ছিড়ে পরে যেতো।তেজ চাঁদকে স্বাভাবিক হতে দেখে বললো,
– কি এমন ভাবছিলেন ম্যাডাম যে সামনের বারান্দায় জলজ্ব্যান্ত মানুষটাকে চোখে পড়লো না।
– চাঁদ তাড়াতাড়ি বলে উঠলো “কই না তো,তেমন কিছুই না।
– তেমন কিছু না হলে যেমন কিছুই হোক সেটাই বলো।
-আরো না ভাইয়া সত্যি বলছি তেমন কিছুই না।
এবার তেজ ধমকের সুরে বললো তুই কি আমাকে বলবি নাকি আমার তোকে দিয়ে বলাতে হবে।
চাঁদও বুঝলো আজ আর তার রক্ষে নেই।তাই সে আরেকটু বারান্দার গ্রিলের সাথে এসে দাড়ালো।এতে চাঁদ তেজের আরেকটু কাছে চলে গেলো।
কাছে গিয়েই বললো,
-ভাইয়া তোমরা সবাই আমাকে কত ভালোবাসো আদর করো।আমার নিজেকে অনেক সুখী মনে হয়।কিন্তু আজকাল ভয়ও হয়।এত সুখ আমার কপালে সইবো তো?
চাঁদের এমন আশঙ্কাজনক প্রশ্ন দেখে তেজ মনে মনে অবাকই হয়।তার ছোট্ট চাঁদ যে কত উল্টা পাল্টা ভাবনা মাথায় আনতে পারে সেটা ভেবেই সে মনে মনে হাসে।কিন্তু বোঝায় যাচ্ছে মেয়েটা অতিরিক্তই টেনশন করছে।টেনশন কমাতে হবে।
তাই সেও গ্রিলের দিকে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বলে,
– দেখো চাঁদ ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবা ভালো।কিন্তু এতটাও ভাবা কখনো উচিত নয় যে তোমার বর্তমানটা নষ্ট হয়।আর যা হচ্ছে হতে দেও।যা হবে সেটাও তোমার হতে দিতেই হবে।এটাই উপরওয়ালা ইচ্ছা।কিন্তু তুমি যদি ভবিষ্যত নিয়ে এত ভাবো তাহলে তোমার বর্তমান নষ্ট হবে এছাড়া আর কিছুই না।তোমার উচিত এখন যতটুকু সুখ পাচ্ছো সব টুকুই লুটে নেওয়া জেনো ভবিষ্যতে সুখ না পেলেও আফসোস থাকবে না। আর ভবিষ্যতে সুখ পাবে না কেন বলছি।তোমার সাথে আমরা আছি সবসময়। আর আমরা আছি মানেই তোমার সুখ আছে।
চাঁদও বোধহয় এতক্ষনে মনটাকে শান্ত করতে পারলো।এ মানুষটার প্রত্যেক টা কথাই তার কাছে ঔষুধের ন্যায় কাজ করে।হঠাৎ ই চাঁদের মাথায় একটা কথা আসে সন্দিহান দৃষ্টিতে তেজের দিকে চেয়ে বলে,
– আচ্ছা ভাইয়া আপনি ঘুমান নাই কেনো এখনো?
তেজ ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়।এই মেয়ের মতিগতি দেখে।কই থেকে কই চলে গেলো সে।
তেজ ছোঠ ছোট চোখ করে বলে- তাতে তোর কি? সেই কৈফিয়ত কি আমায় তোকে দিতে হবে নাকি?
চাঁদ চুপ করে যায়।সত্যিই তো তাকে কি সব বলা লাগবো নাকি।সে কে?
চাঁদের আবার বিষন্নতা হানা দেয়।সে বলে- না ভাইয়া আমি কৈফিয়ত চাই নি।জিজ্ঞেস করেছিলাম কৌতুহল বশত।না বললে নাই বললেন।কৈফিয়ত দেওয়ার মতন কেউ না আমি সেটা আমার ও খুব ভালো করে জানা আছে।
চাঁদ এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে রুমে চলে গেলো।তেজকে কিছু বলারও সুযোগ দেয় নি। তেজও বোকা বনে গেলো।সেও বুঝতে পেরেছে চাঁদ হয়তো মজা টা বুঝতে পারে নি কষ্ট পেয়েছে।আর এই মেয়ে এই কষ্ট নিয়ে থাকলে আজ রাতে আর ঘুমাবে না।
তাই তেজ রুমে গিয়ে ফোনটা আনে।একবার কথা না বললে এ মেয়ে তিল কে তাল ভেবে ফুলে থাকবে।তাই সে চাঁদের ফোনে কল দেয় আর অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে চাঁদের ফোন ব্যস্ত বলছে।তেজ তাজ্জব বনে যায়। এত রাতে কার সাথে কথা বলছে চাঁদ?
চলবে,,,,,,