শ্রাবনসন্ধ্যা পর্ব:-০১

0
7285

শ্রাবনসন্ধ্যা পর্ব:-০১
#আমিনা আফরোজ

লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে বধু বেশে বিয়ের আসরে বসে আছে সন্ধ্যা। তবে সন্ধ্যার এতে কোন অনুভূতি নেই আছে শুধু অপারগতা, হতাশা আর ঘৃণা। আজকে আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢেকে আছে ঠিক সন্ধ্যার মনের মত শুধু পার্থক্য আকাশ তার কষ্টগুলো বৃষ্টির মাধ্যমে বের করে দিতে পারলেও সন্ধ্যার মনের কোনে জমে থাকা কষ্ট গুলো বের করার উপায় নেই।

সন্ধ্যাদের বাড়ি লক্ষ্মীপুরে । সন্ধ্যারা দুই বোন। সন্ধ্যাই বড় । সন্ধ্যার ভালো নাম তাসনিয়া তাবাস্সুম সন্ধ্যা । ও এবার ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। সন্ধ্যার ছোট বোনের নাম তাসনিম জারা।জারা ক্লাস এইটে পড়ে। সন্ধ্যার বাবা গ্রামের একজন স্কুল শিক্ষক এবং মা গৃহিনী। সন্ধ্যার বাবার খুব ইচ্ছে ছিল তিনি তার মেয়েকে অনেক পড়ালেখা পড়াবেন। কিন্তু তার শখটা অপূর্ণই রয়ে গেল।

সন্ধ্যা দেখতে শ্যামলা বর্নের হলেও মুখে কেমন মায়া আছে। কাজল কালো মায়াবী দুটি চোখ, সন্ধ্যা হাসলে ওর গালে টোল পড়ে এতে করে ওকে আরো বেশি সুন্দর লাগে। সন্ধ্যার চুলগুলো বেশ লম্বা, কোমর অব্দি। সন্ধ্যা রূপে যেমন গুণেও তেমন যাকে বলে সর্বগুণ সম্পন্ন।

সন্ধ্যার দিনকাল বেশ ভালই কাটছিল তবে বিপত্তি ঘটে দশম শ্রেণীতে ওঠার পর থেকে। গ্রামের চেয়ারম্যান এর ছেলে নেহালের কুনজর যখন পড়ল সন্ধ্যার উপর।

নেহাল লক্ষীপুর গ্রামের চেয়ারম্যান এর একমাত্র বখাটে ছেলে। পুরো নাম অভ্র আহমেদ নেহাল। নেহাল দেখতে সুদর্শন, সুঠাম দেহের অধিকারী। বয়স আনুমানিক একত্রিশ। নেহালের রুপ থাকলেও গুণের দিক থেকে খারাপ। প্রায় বছর সাতেক আগে নেহাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স মাস্টার্স শেষ করে গ্রামে ফিরে এসেছে। বর্তমানে নিহাল সারাদিন বাজে ছেলেদের সাথে আড্ডা দেয় আর রাতে নেশা করে পড়ে থাকে। নিহালের মধ্যে বর্তমানে ভালো গুণ নেই বললেই চলে। ওর সবথেকে খারাপ গুণ হচ্ছে মেয়েদের সাথে রাত কাটানো। কোন মেয়েকে ভালো লাগলেই তাকে তুলে নিয়ে আসে বাগান বাড়িতে। তবে নেহাল আগে এমন ছিল না। কোন মেয়ের সম্মানহানি তো দূরের কথা মেয়েদের দিকে কটু দৃষ্টিতেও তাকাতো না ও। আজ থেকে সাত বছর আগে নেহাল ওর কলেজের এক মেয়েকে খুব ভালোবাসত । মেয়েটার নাম ছিল তৃষা। নিহান আর তৃষার সম্পর্কের কথা ওদের কলেজের প্রায় সবাই জানত। বেশ ভালই কাটছিল ওদের দিনকাল কিন্তু বিপত্তি ঘটে বিয়ের সময়।তৃষার বিয়ের দিন নেহালের চেয়েও বেশি টাকাওয়ালা ছেলের সাথে পালিয়ে যায় আর নেহালকে চিঠিতে জানিয়ে দেয় তৃষা ওকে কখনো মন থেকে ভালোবাসে নি বরং তৃষা নিহালকে সম্পত্তির লোভে বিয়ে করতে চেয়েছিল। তৃষার এমন বিশ্বাসঘাতকতায় মেয়ে জাতির উপর থেকে মন বিষিয়ে উঠেছিল নিহালের। সেই থেকে মেয়েদের ওপর থেকে সব শ্রদ্ধা সম্মান উঠে গিয়েছিল ওর।তারপর তৃষাকে ভোলার জন্যই নেশায় জড়িয়ে পড়ল। আর সেই থেকেই শুরু হল নিহালের অন্ধকার জীবনের সূচনা।

নিহাল গ্রামে ফিরে এসে ওর বাবার বেআইনি কাজেও জড়িয়ে পড়েছিল। চাঁদা তোলা, মেয়েদের উত্যক্ত করা এসব নিহালের নিত্যদিনের কাজ কারবার হয়ে ওঠে।নেহালকে কেউ কিছু বলে না ওর বাবার জন্য। শোনা যায় নিহালের বাবার নাকি মানুষকে খুন করতেও উনার হাত কাঁপে না। বড় সাংঘাতিক লোকটা। বাবা-মার আদরে বাঁদর হয়ে গেছে নেহাল। কাউকে তোয়াক্কা করে না ও। যখন যা ইচ্ছা তাই করে বেড়ায়। তবে সন্ধ্যার বিষয়টা আলাদা নিহালের কাছে। সন্ধ্যাকে ভালোবাসে ও, সন্ধ্যাকে বিয়ে করতেও রাজি নেহাল। এই প্রস্তাব সন্ধ্যা কেও দিয়েছে নেহাল। তবে প্রতিবারই প্রত্যাখ্যান হয়েছে তবুও হাল ছাড়েনি নেহাল।

সন্ধ্যার সাথে নিহাল এর দেখা হয় এক বছর আগে। বসন্তের প্রথম দিন ছিল সেদিন। প্রকৃতি সবে শীতের আমেজ ছেড়ে নতুন রূপে জেগে উঠেছে তখন। চারিদিকে গাছের নতুন পাতা, পলাশ শিমুল -গাছে রঙের খেলা, আর কোকিলের কুহু কুহু ডাকে মানব মনে অন্যরকম এক অনুভূতি দোলা দেয়। নেহালের মনেও হয়ত সেদিন এই অনুভূতির সঞ্চার ঘটেছিল।

সেদিন ও নেহাল প্রতিদিনের মতই ওর বন্ধুদের সাথে স্কুলের সামনে আড্ডা দিচ্ছিল। স্কুলের সামনে আড্ডা দেওয়া ওদের বহুদিনের পুরনো অভ্যাস ছিল। আড্ডা দেওয়ার সময় নেহালের চোখ আটকে যায় বাসন্তী রঙের শাড়ি পড়া একটি মেয়েকে দেখে। নেহাল দেখে শ্যামলা বর্ণের একটি মেয়ে বাসন্তী রঙের শাড়ি পড়ে গুটি কতেক মেয়ের সাথে হাসতে হাসতে এগিয়ে যাচ্ছে স্কুলের দিকে।নেহাল যেন মেয়েটির ওই হাসিতেই আটকে গেছে।পুরো পৃথিবী যেন থমকে গেছে ওর কাছে। তৃষা চলে যাবার পর থেকে আর কোন মেয়ের প্রতি এমন অনুভূতি জাগে নি ওর। কিন্তু এই মেয়েটিকে দেখার পর নেহালের শুধু মনে হচ্ছিল এই মেয়েটিকে না পেলে ওর জীবন ব্যর্থ।

স্কুলের অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর নিহাল সেই মেয়েটিকে খুঁজে কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাকে আর পায় না। তারপর থেকেই নেহাল প্রায় প্রতিদিনই স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো আর দূর থেকে সন্ধ্যাকে দেখত। ধীরে ধীরে সন্ধ্যার প্রতি ওর ভালো লাগা আরো বেশি গভীর হতে লাগল। অন্যরকম মায়া জন্ম নিল সন্ধ্যার প্রতি। একদিন সন্ধ্যাকে না দেখলে পাগল হয়ে যেত নেহাল। দিনরাত সন্ধ্যার বাসার সামনে পড়ে থাকত। সন্ধ্যাকে ঘিরেই নেহালের দুনিয়া ছিল।

সন্ধ্যাকে দেখার প্রায় মাস দুয়েক পরে এক পড়ন্ত বিকেলে নেহাল ওর মনের কথা বলে দেয় সন্ধ্যাকে। প্রতিদিনের মত সেদিন ও সন্ধ্যা স্কুল শেষ করে বাড়ির দিকে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে নেহাল এসে সামনে দাঁড়ায়। শ্রদ্ধা ভীরু চোখে নেহালের দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে। সন্ধ্যাকে ভয় পেতে দেখে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল,

–“আমি কি বাঘ না ভাল্লুক যে আমাকে দেখে এত ভয় পেতে হবে?”

সন্ধ্যা নিচু স্বরে বলল,

–“জি তেমন কিছু না।”

–“তো কেমন কিছু।”কথাটি বলে নেহাল নিচের ঠোঁট কামড়ে হেসে উঠলো।

সন্ধ্যা নেহালের কথার উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে রইল। সন্ধ্যা পারত পক্ষে কারো সাথে তেমন একটা কথা বলে না আর ছেলেদের সাথে তো আরও কথা বলে না। রাস্তার মাঝখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে বেশ অস্বস্তি হচ্ছে সন্ধ্যার। কিন্তু নেহালকে এ ব্যাপারে কিছু বলতেও পারছে না ও। সন্ধ্যাকে এভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নেহাল বলল,

–“সন্ধ্যা আমি হয়তো গুছিয়ে কথা বলতে পারি না। তবে আমি যা বলি তা মন থেকেই বলি। আমি জানি না কিভাবে কাউকে মনের কথা বলতে হয়। শুধু বলব আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারব না। তোমাকে ছাড়া আমার সব কিছু শূন্য লাগে। শুধু বলব তোমাকে আমি ভালোবাসি। নিজের থেকেও খুব বেশি ভালোবাসি তোমায়।”

নেহালের কথা শুনে সন্ধ্যা যেমন অবাক হয়ে গিয়েছিল তেমনি ভয়ও পেয়েছিল।নেহালের সম্পর্কে তা জানে তাতে নেহাল কে সচেতন করতে পারছে না ও। এদিকে সন্ধ্যাকে চুপ থাকতে দেখে নেহাল বলল,

–“আমি তোমাকে আজই উত্তর দিতে বলছি না। তাই চিন্তা করার কোন কারন নেই। তুমি ভেবেচিন্তে উত্তর দিও।”

সন্ধ্যা নেহালের কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,

–“দেখুন আমি আপনাকে যা বলব তা হয়তো আপনার ভালো লাগবে না। তবুও আমাকে বলতে হবে। আমি আপনার প্রস্তাবে রাজি নই।শুধু আমি কেন কোন মেয়ে আপনার প্রস্তাবে রাজি হবে বলে মনে হয় না।”

সন্ধ্যার কথা শুনে নেহালের হাসি মুখ নিমিষে গম্ভীর হয়ে গেল। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো,

–“”কেন? কি নেই আমার মাঝে?”

সন্ধ্যা প্রশ্নের জবাবে বলল,

–আপনার কাছে কি আছে আর কি নেই তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ কথা আপনি কেমন। আপনি বলেন তো আপনার যদি কোন বোন থাকতো আসে যদি কোন নেশা করা, চরিত্রহীন ছেলেকে ভালোবাসত তাহলে কি আপনি মেনে নিতেন।”

–“হয়তো না।”

–“ঠিক এই কারনেই আমি আপনাকে মেনে নিতে পারবো না। সব মেয়ে চায় সে তার স্বামীর পরিচয় মেনে গৌরবের সাথে দিতে পারি।আমি ও চায় আমার স্বামী যেন স্বচরিত্রের লোক হয়।কেউ যেন তার উপর আঙ্গুল তুলে বলতে না পারে সে খারাপ। আশাকরি আপনি আমার কথাগুলো বুঝতে পেরেছেন।”

নেহাল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,

–“আমি যদি ভালো হয়ে যায় তবে তোমার আপত্তি নেই তো?”

–“আপনি আগে ভালো হয়ে তো দেখান। রাজি হওয়ার ব্যাপারটা না হয় পরে দেখা যাবে।”

–“ঠিক আছে।”

এই কথা বলে নেহাল আর অপেক্ষা না করে চলে গেল নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে। নেহাল দৃষ্টিগোচর না হওয়া পর্যন্ত সন্ধ্যা ঠায় দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। নেহাল পথের বাঁকে অদৃশ্য হতেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বাড়ির পথে রওনা দিলো সন্ধ্যা। সেদিনের পর থেকে আর কোথাও দেখতে পায়নি সন্ধ্যা। সন্ধ্যা ভাবল হয়ত নেহাল ওর প্রস্তাব শুনে ভয় পেয়ে ওর জীবন থেকে চলে গিয়েছে। মনে মনে বেশ খুশি হল সন্ধ্যা।তবে উপরওয়ালা বোধহয় সন্ধ্যার নিয়তিতে অন্য কিছু লিখে রেখেছিলেন। ঠিক মাস ছয়েক এর মাথায় নেহাল আবার সন্ধ্যার সামনে এসে দাড়ালো। এবার দেখা যাক ভাগ্য তাদের কোন দিকে টেনে নিয়ে যায়।

চলবে

(নতুন একটি গল্প শুরু করলাম। জানিনা কেমন হয়েছে। কতটুকু গুছিয়ে লিখতে পেয়েছি তাও জানি না। গল্পটা কেমন হয়েছে জানাবেন আর ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ভালো থাকবেন সবাই ।হ্যাপি রেটিং ??)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here