শ্রাবণ সন্ধ্যা পর্ব:-০২
#আমিনা আফরোজ
শেষ বিকেলের গোধূলি লগ্নে রক্তিম সূর্য পশ্চিম কোণে ঢলে পড়েছে মাত্র। পাখিরা তাদের নীড়ে ফেরার তাড়নায় রক্তিম আকাশে এদিক-ওদিক উড়ে বেড়াচ্ছে। এমন গোধূলি লগ্নে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে সন্ধ্যা আর নেহাল। নেহাল তার শীতল চাহনিতে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সন্ধ্যার দিকে। এই দৃষ্টিতে কোন কঠোরতা নেই,আছে শুধু একরাশ ভালোবাসা আর হারানোর ভয়। পিনপতন নীরবতার রেশ কাটিয়ে নেহাল বলে উঠলো,
–“কেমন আছো সন্ধ্যা?”
সন্ধ্যা ভীরু ভীরু চাহনিতে নেহালের দিকে একবার তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিচু স্বরে বলল,
–“জি ভালো আছি।”
–“আমি কেমন আছি জানতে চাইবে না?”
সন্ধ্যা নেহালের প্রশ্নের জবাবে কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। সন্ধ্যাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবারও বলতে শুরু করল,
–“আমি ভালো নেই সন্ধ্যা। সবসময় তোমাকে হারানোর ভয় তাড়া করে বেড়ায় আমাকে। তোমাকে হারানোর ভয়ে রাতে আমার ঘুম হয় না। সারারাত নির্ঘুম কাটে আমার।”
সন্ধ্যা তখনও চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। নেহাল আবারও বলতে শুরু করল,
–“তোমাকে এতটাই চাই যে তোমাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য নিজেকে পুরোপুরি বদলে ফেলেছি।সব ধরণের খারাপ কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছি শুধু তোমাকে একান্তই নিজের করে পাবার আশায়।এখন আমাকে আপন করে নিতে আর কোন সমস্যা হওয়ার কথা না।”
সন্ধ্যা নিচু স্বরে বলল,
–“আসলে….
সন্ধ্যাকে ওর কথা শুনে নেহাল ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল,
–“আসল-নকল বুঝি না আমি। তুমি রাজি থাকলে আমি আজই আমার বাবাকে বলে তোমার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাব।”
বিয়ের কথা শুনে সন্ধ্যা আতকে ওঠে বলল,
–“আমাকে এই বিষয় নিয়ে ভাবার জন্য আর একটু সময় দিন।”
নেহাল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
–“ঠিক আছে তোমাকে দুই দিন সময় দিলাম।ভেবে দেখ কি করবে।”
সন্ধ্যা ওর মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে বাড়ির দিকে চলে গেল। নেহাল সন্ধ্যার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
–“তোমার সিদ্ধান্ত যাই হোক না কেন তোমাকে তো আমারই হতে হবে। কেননা তুমি বিনা আমি শূর্ণ্য। আর এই শূন্যতাকে পূর্ণ করতে তোমাকে আমার প্রয়োজন, খুব প্রয়োজন।”
কথাগুলো বলে নেহালও ওর বাড়ির দিকে চলে গেল।ফেলে গেল একরাশ দীর্ঘশ্বাস।
রাত তখন বারোটা বাজে। গ্রামে বারোটা মানেই অনেক রাত। চারিদিকে শুনশান নিরবতা বিরাজ করছে। দক্ষিণা মৃদুমন্দ বাতাস বইছে।সেই সাথে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে।পূর্ণিমার চাঁদের আলোতেই অন্ধকার কেটে আলোয় ভরে উঠেছে চারদিক। এমন চাঁদনী রাতে জানালার পাশে একাকী দাঁড়িয়ে আছে সন্ধ্যা। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। চোখে ঘুমের লেশমাত্র নেই। মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে হাজারো চিন্তা। বিকেলের কথাগুলো ক্রমাগতই ভাবাচ্ছে ওকে। দুদিন পর কি জবাব দেবে নিহাল ও? সন্ধ্যা এখনো নেহালের কথা বাসার কাউকে বলে নি। সন্ধ্যা ওর বাবাকে আর কোন প্রকারের বাড়তি চাপ দিতে চায় না। এমনিতেই সন্ধ্যাকে নিয়ে ওর বাবা অনেক দুশ্চিন্তায় থাকেন।
সন্ধ্যার ভাবনার সুতো কাটে জারার প্রশ্নে। জারা ঘুম ঘুম চোখে বলল,
–“আপা তুমি ঘুমাওনি এখনও?”
সন্ধ্যা জারার কথা শুনে জানালার পাশ থেকে সরে এসে বলল,
–“ঘুম আসছিল না তাই জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম।”
–“কি হয়েছে তোমার আপা?”
–“কই কিছুই হয়নি তো।”
–“কিছু না হলে তোমার মুখখানা এমন শুকনো শুকনো লাগছে কেন?”
জারার এমন পাগলামি কথা শুনে সন্ধ্যা বলল,
–“থাক তোকে আর পাকনামি করতে হবে না। ভালো মেয়ের মতো ঘুমিয়ে পড়। কালকে তো তোর স্কুল আছে।সকাল সকাল ঘুম থেকে না উঠলে আম্মা কিন্তু তোকে বেধড়ক পিটাবে। তখন কিন্তু আমি তোকে বাঁচাতে পারবো না।”
–“হায় আল্লাহ, আপা তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আম্মার কথা মনে করে দেওয়ার জন্য। আমি তো আম্মার কথা ভুলেই গেছিলাম।”
সন্ধ্যা মৃদু হেসে যার মাথায় হালকা চাপড় দিয়ে বলল,
–“পাগলি মেয়ে, ঘুমা এখন।”
সন্ধ্যা জারার পাশে শুয়ে পড়ল। জারা সন্ধ্যাকে জড়িয়ে ধরে আবারো পাড়ি জমালো ঘুমের রাজ্যে। আর সন্ধ্যা বাকিটুকু আকাশ-কুসুম চিন্তা করে না ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিল।
অন্যদিকে নেহাল বাড়িতে গিয়ে সোজা নিজের ঘরে চলে গেল। নেহালের ঘরে যাবার কিছুক্ষণ পরেই ওর বাবা সামাদ মিয়াও নেহালের ঘরে প্রবেশ করেন। নেহালের আচরণ ওনার ভালো লাগছে না। একটা মাত্র ছেলে ওনার। ছেলেকে নিয়ে কত স্বপ্ন রয়েছে তার। কিন্তু নেহাল গত ছয় মাস ধরে ওনার কোন কাজে থাকে না। সারাক্ষণ চুপচাপ গুরু গম্ভীর হয়ে থাকে, নিজেকেও অনেক বদলে ফেলেছে। তাই ছেলের সাথে সামনাসামনি কথা বলতে এসেছেন ওনি। ছেলের এমন বদলে যাওয়ার কারণ জানতেই হবে তাকে। সামাদ মিয়া নেহালের ঘরের সামনে এসে বললেন,
–“আব্বা আমি কি ঘরে আইতে পারি?”
নেহাল এসময় ওর বাবাকে ঘরের সামনে দেখে বেশ অবাক হয়ে গেল। মৃদু স্বরে বলল,
–“জী বাবা ভেতরে আসেন।”
সামাদ মিয়া নেহালের ঘরে এসে চেয়ার টেনে নিহাল এর সামনে বসে পড়লেন। ছেলের সাথে কি কথা দিয়ে শুরু করবেন তা ভেবে পাচ্ছেন না তিনি। বাবাকে চিন্তিত দেখে নেহাল বলল,
–“বাবা এত রাতে আপনি আমার ঘরে এলেন যে। কিছু বলবেন কি?”
–“না মানে আব্বা আপনি এখনও ঘুমান নি ক্যান?
–“চাকরির জন্য পড়ছিলাম বাবা । সামনেই পরীক্ষা তো তাই।”
চাকরির কথা শুনে সামাদ মিয়া অবাক হয়ে বললেন,
–“আপনি চাকরি করবেন ক্যান আব্বা? আমার যত সম্পত্তি আছে সবই তো আপনার। এতেও যদি আপনার না হয় তবে আরও সম্পত্তি দিব আপনাকে। সারা জীবন পায়ের উপর পা তুলে খেতে পারবেন। এসব চাকরি-বাকরি করন লাগতো না আপনার আব্বা।”
নেহাল ওর বাবার কথা শুনে বলল,
–“আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই বাবা। নিজের আলাদা একটা পরিচয় করে তুলতে চাই।”
–“কিন্তু আব্বা….
সামাদ মিয়াকে তার কথা শেষ করতে না দিয়েই নেহাল বলে উঠলো,
–“আর কোন কিন্তু বলো না বাবা। আমি আমার পরিশ্রমের দ্বারা নিজের পরিচয় গড়ে তুলবো এটাই আমার শেষ কথা।”
সামাদ মিয়া ছেলের কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর গুরু গম্ভীর স্বরে বললেন,
–“আপনার এমন বদলে যাওয়ার পিছনে আসল কারণটা কি আব্বা?”
নেহাল ওর বাবার প্রশ্নের জবাবে বলল,
–“প্রতিটি মানুষ তার জীবনে আলোর কিরণ খুঁজে যাতে সে আলোর কিরণে তার জীবনের অন্ধকার কেটে যায়। আমিও সেই আলোর কিরণের দেখা পেয়েছি বাবা। তার জন্যই নিজেকে শুদ্ধ করে নিচ্ছি। যেন আমার অন্ধকার জীবনের কলঙ্ক কিরনের গায়ে
না লাগে।”
–“কে সে?”
–“ওর নাম সন্ধ্যা।”
–“কোন গ্রামে থাকে?”
–“আমাদের গ্রামে থাকে। আশরাফ কাকার মেয়ে ।”
–“ওও।দেখেন আপনি যা ভালো বুঝেন।”
এরপর সামাদ মিয়া নেহাল কে আর কিছু না বলে চলে গেলেন। কারণ তিনি জানেন নেহাল কে বলে কিছুই হবে না। নেহাল ওর সিদ্ধান্ত থেকে কখনই ফিরে আসবেনা। যা বলার আশরাফ মিয়াকেই বলতে হবে। মনে মনে ঠিক করলেন আগামীকালকেই আশরাফ মিয়াকে ডেকে পাঠাবেন তিনি। তিনি তার ছেলেকে ওনার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে দেবেন না। ছেলে দূরে গেলে তার প্রভাব ও যে কমে যাবে।কেননা ওনার সব বেআইনি কাজে নেহাল ছিল ওনার ডান হাত।
ভোরে আজানের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল সন্ধ্যার। বিছানা থেকে নেমে কল পাড়ের দিকে চলে গেল অজু করতে। অজু করে নামাজ পড়ে করে কুরআন নিয়ে বসলো সন্ধ্যা। এইটা সন্ধ্যার প্রতিদিনের কাজ। কোরআন পড়া শেষ করে সন্ধ্যা ওর মাকে সাহায্য করতে চলে গেল। তখন পুব আকাশে সবেমাত্র লাল সূর্যের উদয় হয়েছে। সূর্যের কিরণ ছড়িয়ে পড়েছে পুরো গ্রামে। এমন সময় বাড়িতে আগমন ঘটল মিন্টুর।সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করল,
–“তোমার বাপ ঘরে আছে নি?”
সন্ধ্যা মিন্টুকে দেখে মনে মনে বলল,
–“এ লোক এত সকালে আমাদের বাড়িতে কি করছে? আর বাবাকেই বা খুজছে কেন?”
সন্ধ্যাকে চুপ করে থাকতে দেখে মিন্টু আবারো
বলে উঠলো,
–“কি গো মেয়ে কথা কও না ক্যান?ঘরে আছে নি তোমার বাপ।”
–“জি আছে।”
–“তাইলে একটু ডাইকা দাও।”
–“আচ্ছা।”
সন্ধ্যা ঘরে গিয়ে ওর বাবাকে মিন্টুর কথা বললে আশরাফ মিয়া পাঞ্জাবি গায়ে বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। তারপর উঠানে দাঁড়িয়ে থাকা মিন্টুকে উদ্দেশ্যে বললেন,
–“কি খবর মিন্টু মিয়া? এত সকাল সকাল আমার বাড়িতে আইলা?”
মিন্টু তার পান খাওয়া দাঁতে হেসে বলল,
–“চেয়ারম্যান সাহেবের ডাক পড়ছে। আপনারে যাইতে কইছে হেই।”
আশরাফ মিয়া চিন্তিত হয়ে বললেন,
–“ঠিক আছে চলো তাহলে। হুইনা আসি কি কয় হেই।”
–“হ চলেন।”
তারপর আশরাফ মিয়া আর মিন্টু বেরিয়ে পড়লেন চেয়ারম্যান এর বাগান বাড়ির দিকে। সন্ধ্যাও অপলক দৃষ্টিতে সেদিকেই তাকিয়ে রইল।
চলবে
(কেমন হয়েছে জানাবেন আর ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। হ্যাপি রিডিং ??)
আগের পর্বের লিংক
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=130656038872911&id=100057855461251