শ্রাবণ ধারা ২ পর্ব ৩

0
632

#শ্রাবণ_ধারা-২
#পর্ব-৩
#সাদিয়া

পুরো হাসপাতালে শ্রাবণ ধারাকে খুঁজছে কিন্তু কোথাও পাচ্ছে না। শ্রাবণ বুঝতে পারছে না ধারা কোথায় চলে গেলো। ধারার ডিউটি টাইমও শেষ হয়নি যে সে চলে যাবে। কোথায় আছে ধারা? ধারাকে খুঁজতে খুঁজতে শ্রাবণ ক্লান্ত হয়ে হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের বাইরে বসে পড়ে। তার শরীর চলছে না আর। সাথে মাথাটাও চিনচিন ব্যাথা করছে। চোখ দুটো বন্ধ করলো শ্রাবণ। তখনই সে শুনতে পেলো পরিচিত এক কণ্ঠস্বর। শ্রাবণ ফট করে চোখ খুলে তাকলো। কণ্ঠস্বর অনুসরণ করে শ্রাবণ সেদিকে এগিয়ে যায়।

—বাবু তুমি মেডিসিন কেন নিচ্ছে না? মেডিসিন সঠিকভাবে না নিলে তুমি ঠিক হবে কিভাবে বলো তো? আর ঠিক না হলে এই পঁচা জায়গা থেকে বেরুবে কি করে?

—সুস্থ না হলে পঁচা জায়গা থেকে বের হতে পারবো না?

—না সোনা পারবে না। ওই আঙ্কেলগুলো তোমাকে বের হতেই দেবে না। তাই জলদি জলদি মেডিসিন গুলো নাও আর পানি দিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নাও।

—কিন্তু ওগুলো তো মজা না।

—মজা না হলেও খেতে হবে। আচ্ছা তুমি যদি জেদ না করে সবসময় মেডিসিন নাও তাহলে আমি তোমাকে এত্তোগুলো চকলেট দিবো। এখন তিতলি বাবুর কি চকলেট চায়?

বাচ্চাটি জোরে জোরে মাথা ঝাকালো।
—তাহলে তো আগে মেডিসিনগুলো খেতে হবে।

ধারার কথায় তিতলি নামের বাচ্চাটি ওষুধ খেয়ে নিলো। বাচ্চাটির মা ধারার দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতাপূর্ণ হাসি দিলো। তিতলিকে ঘুম পাড়িয়ে ধারা বাইরে বের হতেই দেখতে পেলো ওয়ার্ডের সামনে শ্রাবণ দাঁড়িয়ে আছে। শ্রাবণকে দেখেই ধারার তখনকার দৃশ্য মনে পড়ে গেলো। সাথে সাথে তার চোখ ভরে উঠলো তপ্ত অশ্রুতে। অশ্রু গড়িয়ে পড়ার আগেই ধারা তা মুছে নিলো। কিন্তু তা শ্রাবণের দৃষ্টিগোচর হয়নি। ধারা শ্রাবণের সাথে কোনো কথা না বলে প্রস্থান করে।
—আমি কেন সবাইকে এতো কষ্ট দি-ই? কেন সবাই আমার জন্য এতো কষ্ট পায়?

.
নিজের কেবিনে ফিরে এসে থেকেই অনবরত চোখ মুছে চলেছে ধারা। সে বুঝতে পারেছেনা তার এতো কষ্ট কেন হচ্ছে? কেন সে এতো কষ্ট পাচ্ছে? তার তো কষ্ট পাওয়ার কথা না তবে কেন সে কষ্ট পাচ্ছে। কেন তার চোখের জল বাঁধ মানছে না।

—আমি আর কষ্ট পাবো না। পাবো না আর কষ্ট। সে তো নিজের জীবনে খুব ভালো আছে সুখে আছে তাহলে আমি কেন অতীত ধরে বসে আছি? কেন কষ্ট পাচ্ছি তার জন্য। আর কষ্ট পাবো না আমি তার জন্য। তার জন্য আর চোখের জল বিসর্জন দেবো না। অনেক হয়েছে আর না।

ডিউটি আওয়ার শেষ হতেই ধারা হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার পথে সে ক্লিনিক থেকে তিথিকে পিক করে।

—প্রথম দিন কেমন কাটলো ডা.ধারা?

ধারা নিশ্চুপ।
—কি হলো ধারা কথা বলছিস না কেন? প্রথম দিন কেমন কাটলো।

কিয়ৎকাল নিরবতা পালন করে শান্ত কণ্ঠে ধারা বলে,
—শ্রাবণ স্যার বিয়ে করে নিয়েছে তিথি।
ধারার কথায় তিথি অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়। ধারার মুখশ্রী তখনও বেশ শান্ত।
—এ কথা তোকে কে বলেছে ধারা?

—আজকে হাসপাতালে তার বউ এসেছিলো।

—শ্রাবণ ভাই তোকে বলেছে ওটা তার বউ ছিলো?

—বলতে হবে কেন তিথি? আমি কি কোনো বাচ্চা নাকি। একটা মেয়ে তো আর এমনি এমনি তার কোলে উঠে তার গলা জরিয়ে ধরে বসে থাকবে না। তাই না?

—তার মানে তোকে তিনি বলেনি যে ওটা তার বউ ছিলো।
এবার ধারা বিরক্ত হয়।
—না।

তিথি যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

.
রাতে খাবার পর্ব শেষ করে রুমে আসে ধারা আর তিথি। তিথি বিছানা করছে ঘুমাবে বলে। আর ধারা নিজের ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে।

—এই ধারা কি করছিস?

ল্যাপটপের দিকে তাকিয়েই ধারা জবাব দিলো,
—বাসা খুঁজছি।

—বাসা খুঁজছিস মানে?

—বাসা খুঁজছি মানে বাসা খুঁজছি। এখানে আর কতোদিন থাকবো বল।

—এখানে থাকতে তোর কি সমস্যা ধারা? এমনিতে তো বাসায় আমি আর আম্মুর থাকি। তোর কি এখানে কোনো সমস্যা হচ্ছে ধারা?

—না সমস্যা হবে কেন? এইভাবে এখানে থাকাটা কেমন দেখায় না।

—তুই আমাদের কি মনে করিস ধারা। তুই এখান থেকে গিয়ে কোথায় থাকবি? তোদের বাসায় তো যাবি না। একা থাকবি? এই শহরে একা থাকার মনে বুঝিস তুই? আর তুই চলে যাতে চাইবি আর আমরা তোকে যেতে দেবো। ভাবলি কিভাবে তুই। দেখ এইসব ফাউল চিন্তা ভাবনা ছেড়ে ঘুমাতে আয়। এখান থেকে তোর কোথাও যাওয়া হচ্ছে না।

পরদিন সকালে যথাসময়ে হাসপাতালে চলে যায় ধারা। হাসপাতালে ঢুকতেই শ্রাবণের মুখোমুখি হয় সে। শ্রাবণকে দেখে একটু অন্য রকম লাগছে। মনে হচ্ছে রাতে ঘুম হয়নি তার। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে তার সাথে ফুলেও আছে। ধারা বেশি মাথা না ঘামিয়ে নিজের কেবিনে চলে গেলো। লাঞ্চ টাইমের আগ পর্যন্ত বেশ কয়েকটা পেশেন্ট দেখা হয়ে গেছে তার। লাঞ্চ টাইমে সে হাসপাতালের ক্যাফেটরিয়ায় বসে এক কাপ কফি হাতে। ধারা কফিতে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছে চর আশপাশটা ভালো করে দেখে নিচ্ছে। তার দুই টেবিল পরেই শ্রাবণ বসে আছে। ফোনে কারো সাথে কথা বলছে। মনে হচ্ছে কোনো টেনশনে আছে। ধারা ভ্রু কুঁচকায়।

—তুমি আমাকে একথা এখন বলছো ইডিয়েট। তোমাকে আমি মাসে মাসে টাকা কেন দি? উফফ রাসেল তুমি বুঝতে পারছো না সে এখন বসে থাকবে না। আমি তাকে খুব ভালো করে চিনি। বসে থাকবে না সে। সে যে কি কি করতে পারে তার ডেমো সে আট বছর আগে দেখিয়েছে। আমি এখন কি করবো রাসেল। কি করা উচিত আমার?

ওপাশ থেকে কি বলা হয়েছে তা শুনতে না পেলেও শ্রাবণের প্রত্যেকটা কথা ধারা শুনেছে।

—সত্যটা কেউ বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় তোমার? তাও এতোগুলো বছর পর? আর আমার কাছে কি প্রমান আছে? আছে কোনো প্রমান? না নেই! এখান আমার কিছু করার নেই। সে কি করবে এটাই শুধু দেখে যেত হবে এখন আমাদের। আর একটা কথা তুমি কিন্তু তার দিকে টুয়েন্টি ফোর সেভেন আওয়ার নজর রাখবে। মনে রাখবে নাজার হাটি তো দূর্ঘটনা ঘাটি!

ফোনটা কেটে শ্রাবণ পকেটে ঢুকিয়ে কফির কাপে চুমুক দিতেই তার কপালে বিরক্তির ভাজ পড়লো। কফিটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। শ্রাবণ আরো একটা কফি অর্ডার করলো।

অপর দিকে ধারা শ্রাবণের বলা কথাগুলো ভাবছে। সে ভাবতে চাইছে না কিন্তু তবুও সে ভাবছে। কি হয়েছিলো আট বছর আগে? আট বছর আগে তো শুধু শ্রাবণ স্যার আমাকে মিথ্যা অপবাদই দিয়েছিলো। আর কি ঘটেছিলো? আর তিনি কার কথা বলছেন? কে কি করবে? তিনি কাকে এতো ভয় পাচ্ছেন? উফফ কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। কি হচ্ছে এসব।

কফির সাথে হালকা কিছু খেয়ে ধারা নিজের কেবিনে ফিরে যায়। কেবিনে আসতেই তার পা থেমে যায়। এতোগুলো বছর পর সে এই মানুষগুলোকে দেখছে। আচ্ছা কেমন আছে তারা? ভালো আছে তো তাকে ছাড়া?

—ধারা!

বাবার ডাকে ধারার শরীরটা কেঁপে উঠলো। কিন্তু সে কোনো কথা বলে না।

—কথা বলবি না মা?

—কেমন আছো তোমরা?

—আমরা আছি।

—তা এখানে কি মনে করে?

—দেশে আসার পর তো একবারো আমাদের সাথে দেখা করতে আসলি না তাই আমরাই এলাম।

ধারা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

—এখনও আমাদের ক্ষমা করতে পারিসনি তাই না?
মলিন কণ্ঠে কথাটা বলে ধারার বাবা।

—তোমাদের প্রতি আমার কোনো ক্ষোভ নেই বাবা।

—তাহলে ফিরে চল।

—না বাবা এটা সম্ভব নয়। আমি ওই বাড়িতে ফিরতে পারবো না।

—কেন পারবি না? ওটা তো তোর নিজের বাড়ি।

—না মা ওই বাড়িতে আমি যাবো না। অনেক কষ্টে আমি নিজের কালো অতীত থেকে বেরিয়েছি। হয়তো পুরোটা না। তবে আমি ওই বাড়িতে ফিরতে পারবো না। ওই বাড়িতে গেলেই আমার সাথে ঘটা প্রত্যেকটা নির্মম ঘটনা আমার মনে পড়ে যাবে। আর আমি চাই না তা ঘটুক।

ধারার বাবা-মা তাকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু ধারা নিজের সিদ্ধান্তে অনঢ়। ব্যার্থ হয়ে ধারার বাবা-মা চলে গেলো।
বাবা-মা চলে যেতেই চেয়ারে বসে কান্নায় ভেঙে পড়ে ধারা।
—কেন শ্রাবণ স্যার কেন? কেন এমন করলেন আমার সাথে? কেন এতোবড় শাস্তি দিলেন আমাকে? আপনাকে ভালোবাসার জন্য এমন শাস্তি পাবো জানলে কখনো আপনাকে ভালোবাসতাম না আমি। কখনও না।

ধারার কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে ধারার কথাগুলো শুনলো শ্রাবণ। ধারার বাবা-মাকে চোখে পানি নিয়ে চলে যেতে দেখে প্রচন্ড রাগ নিয়ে ধারার কেবিনে আসছিলো শ্রাবণ। কিন্তু ঢোকার আগে ধারার কথাগুলো শুনে সে আর ভেতরে ঢুকলো না।
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে শ্রাবণ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। গাড়ি চালিয়ে শহর থেকে অনেকটা দূরে চলে আসলো সে। একটা খোলা জায়গায় গাড়ি থামালো। গাড়ির সিটে মাথা হেলিয়ে নিরবে চোখের জল ফেলছে শ্রাবণ।
—আমি কেন এতো অভাগা? কেন? ভালোবাসা কি কোনো অপরাধ? কেন আমার ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না? কেন পায় না? আমার কি ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার নেই? কেন সবসময় আমার সাথেই এমন হয়? আমার তো কোনো দোষ ছিলো না তবে কেন আমি আজ সবার চোখে দোষী? আমি যা করেছিলাম সব তো নিজের ভালোবাসাকে বাঁচাতে করেছিলাম। তবে কেউ আমাকে কেন বুঝলো না? কেন বুঝলো না?
এক পর্যায়ে শ্রাবণ গাড়িতে ঘুমিয়ে যায়।

আপরদিকে নিজের কেবিনে বসে চোখের জল ফেলছে ধারা। এমন সময় কারো ভরাট কণ্ঠে কানে আসে তার।
—ধারা?

চোখের জল মুছে সামনে তাকাতেই সামনের লোকটিকে দেখে ধারা অবাক হয়। এই সময় তাকে এখানে ধারা কল্পনা করেনি।

#চলবে….ইনশাআল্লাহ
(শ্রাবণকে কি শাস্তি দেওয়া যায়?)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here