শ্রাবণ ধারা ২ পর্ব ১০

0
518

#শ্রাবণ_ধারা-২
#পর্ব-১০
#সাদিয়া

নিকষকৃষ্ণ অন্ধকারে ছেয়ে আছে পুরো রুম। রুমের কোথাও আলোর ছিটে ফোটা নেই। রুমে এক কোনায় একটা খাট রাখা আছে। ওই খাটের উপর জ্ঞানহীন অবস্থায় পড়ে আছে ধারা। কিয়ৎক্ষণ পর পিটপিট করে চোখ খুলে তাকায় ধারা। না সে চোখের সামনে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেখতে সক্ষম হচ্ছে না। চোখের রড আর কোণ কোষ গুলোতে সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগ করেও সে চোখের সামনে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই আবিষ্কার করতে পারলো না। হাল ছেড়ে দিলো ধারা। তার বুঝতে বাকি নেই তাকে নামজুল এখানে নিয়ে এসেছে। কেন নিয়ে এসেছে তা জানা নেই ধারার। খট করে দরজা খোলার আওয়াজ পেতেই ধারা নিজের চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো।

দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো নাজমুল। সে ধীর পায়ে ধারার দিকে এগিয়ে গেলো। আলতো হাতে ধারার মাথায় হাত বুলালো। নাজমুল ধারার কপালে ঠোঁট ছুঁয়াতে যাবে এমন সময় ধারা ফট করে চোখ তুলে তাকালো। ধারাকে এমন হুট করে তাকাতে দেখে নাজমুল কিছুটা ঘাবড়ে গেলো। সে তাড়াতাড়ি করে ধারার কাছ থেকে দূরে সরে এলো। ধারা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে নাজমুলের দিকে। ধারাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে নাজমুল বোকা ভাবে হাসলো।

—আমাকে এভাবে এখানে নিয়ে এসেছেন কেন নাজমুল ভাই?

নাজমুল ধারার কথায় পাত্তা দিলো না। সে ধারার দিকে একটা কাগজ এগিয়ে দিলো।
ধারা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
—কি এটা?

নাজমুল সহজভাবে উত্তর দিলে,তোমার আর শ্রাবণের ডিভোর্স পেপার।

আঁতকে উঠলো ধারা। তার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো।
—ক..কি বলছেন আপনি?

—হুম ঠিক বলছি। আট বছর আগে তো তোমাদের ডিভোর্স হয়নি তাই না। কোনো সমস্যা না এখন হবে। তুমি সাইন করে দাও।

—ন..না আ..আমি সাইন করবো না।

—কেন? কেন করবে না? তুমি কি ভুলে গেছো শ্রাবণ তো তোমার সাথে আট বছর আগে কি করেছিলো? কিভাবে অপমান করেছিলো তোমায়। তুমি কি সব ভুলে গেলে ধারা?

—না নাজমুল ভাই আমি কিছু ভুলিনি। শ্রাবণ আমার সাথে কি কি করেছিলো সব মনে আছে আমার। সেই সাথে আমি এটাও জানি শ্রাবণ কেন করেছিলো এসব। আর কার কথায় করেছিলো।
ধারার শেষ কথায় নামজুল হকচকিয়ে যায়।
—ক…কি জানো তুমি?

ধারা তাছ্যিল্য করে হাসলো।
—আট বছর আগে আপনি শ্রাবণকে হুমকি দিয়েছিলেন তাইনা। আপনার কথাতেই শ্রাবণ আট বছর আগে ওইসব কাজ করেছিলো। এতো এতে মিথ্যা বলেছিলো।

—না না ধারা তুমি ভুল ভাবছো। আমি শ্রাবণকে কিছু করতে বলিনি। শ্রাবণ নিজে বাঁচতে তোমাকে সব মিথ্যে বলেছে। মিথ্যা সব মিথ্যা ধারা।

—কথাগুলো যদি আমাকে শ্রাবণ বলতো তাহলে আমি সেগুলোকে মিথ্যা বলেই ভাবতাম। কিন্তু কথা গুলো যে আমাকে শ্রাবণ বলেনি।

শ্রাবণ বলেনি কথাটা শুনে নাজমুল ভ্রু কুঁচকালো। আট বছর আগের তার আর শ্রবণের মধ্যকার কথা সে আর শ্রাবণ ছাড়া কেউ জানে না। যদি কথা গুলো ধারা শ্রাবণের মাধ্যমে না জেনে থাকে তাহলে সে কিভাবে জানলো?

—শ্রাবণ বলেনি?

—না।

—তাহলে কে বলেছে?

—অপরাধী নিজে তার অপরাধ স্বীকার করেছে নাজমুল ভাই।

নাজমুল বিস্ফোরিত নয়নে ধারার দিকে তাকালো।

—মা…মানে?

—আরে আরে এতো তোতলাচ্ছেন কেন নাজমুল ভাই। বি ইজি!

—বললে না তো কে বলেছে এইসব তোমাকে?

—বললাম তো অপরাধী নিজে তার অপরাধ স্বীকার করেছে।

—ম..মানে?

—জ্বী নাজমুল ভাই। আপনি নিজে বলেছেন এই কথাগুলো। মনে আছে ওইদিন নদীর পাড়ে আমাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে কি সুন্দর নিজের অপকর্মের কথা অনায়াসে বলে গেলেন। কেন করলেন এমন নাজমুল ভাই? কি দোষ করেছিলাম আমরা। একে অপরকে ভালোবাসার জন্য এতো বড় শাস্তি দিলেন আমাদের? কেন করলেন এমন বলুন?

শেষ কথাটা ধারা এক প্রকার চেচিয়ে বললো। ধারা এমন চিৎকারে নাজমুল কিছুটা কেঁপে উঠলো। সে জেনতেন ভাবে নিজেকে সামলে নিলো। তেজি কণ্ঠে বলে উঠে,
—তো কি করতাম আমি? তোমাকে ভুলে যেতাম? ভুলে যেতাম নিজের ভালোবাসাকে? নিজের ভালোবাসাকে বিসর্জন দিয়ে তোমাকে আরেক জনের হাতে তুলে দিতাম? শোনো মেয়ে আমি তোমার ওই শ্রাবণের মতো এতো মহান নই। আমি আমার ভালোবাসার ভাগ কাওকে দিতে প্রস্তুত নই। তুমি শুধু আমার হবে। শুধু আমার। তোমার সবটা জুড়ে শুধু আমি থাকবো আর কেউ না। ওই শ্রাআণ তো নয়ই। ওই শ্রাবণের ছায়াও আমি তোমার জীবনে পড়তে দিবো না। নাও এখন ভালে মেয়ের মতো এই ডিভোর্স পেপারে সেই করে দাও।

—আমি কিছুতেই সেই করবো না। মরে গেলেও না।

—মরার কথা বলে না সোনা। তুমি কেন মরবে? মরবে তো শ্রাবণ। তুমি যদি সই না করো তবে ওই শ্রাবণকে আমি উপরে পাঠিয়ে দেবো।

—অতঃপর সবাই আমার চল্লিশাতে মজা করে খাসির মাংসের কাচ্চি খাবে!

তৃতীয় কোনো ব্যক্তির পরিচিত কণ্ঠস্বর পেয়ে নাজমুল এবং ধারা সামনে তাকিয়ে দেখলো শ্রাবণ প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে তার কালো রঙের রোদ চশমা। যদিও রুমের মধ্যে রোদের ছিটে ফোটাও নেই। শ্রাবণকে দেখে জেনে ধারার জানে পানি এলো। সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।

—তুই এখানে কিভাবে এলি?

—রাস্তা পর্যন্ত গাড়ি দিয়ে আর ভেতর পর্যন্ত এই যে আমার এ-ই পা দুটো দিয়ে হেঁটে এসেছি। তুমি কি গো নাজমুল ভাই শহর থেকে এতো দূরে নিয়ে এলে ওকে যে আসার সময় আমার গাড়ির পেট্রোল শেষ হয়ে গেছিলো। তাই তো আমার আসতে দেরি হলো।
শ্রাবণের এমন হেয়ালি নাজমুলের পছন্দ হলো না।

—তুই কিভাবে জানলি আমরা এখানে আছি?

—তোমার খবর কে রাখে? আমার উপর আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। আমি আমার বউয়ের কাছে এসেছি। ওই যে আমার বউয়ের গলায় সুন্দর লকেটটা দেখতে পাচ্ছো এটাতে জিপিএস ট্রেক্যার আছে। ওটার মাধ্যমেই জানতে পারলাম তুমি আমার বউকে নিয়ে কোথায় এসেছো। আমার অনুমতি ছাড়া আমার বউটাকে এখানে নিয়ে এলে। একবার অনুমতি তো নেবে। তা না করে অজ্ঞান করে নিয়ে আসলে ওকে। ভেরি ব্যাড ম্যানার হু।

—তুই কি এখানে ফাজলামো করতে এসেছিস?

—আরে ধুর না। আমি তো আমার বউকে নিয়ে যেতে এসেছি। ও বউ আসো।

ধারা খাট থেকে নেমে শ্রাবণের কাছে যেতে নিলে নাজমুল তার বাহু ধরে আটকে দেয়।

—ও ভাই তোমার সমস্যা কি গো? কথায় কথায় এমন আমার বউকে ধরো কেন? তখন কোলে তুলে নিয়ে এলে কিছু বলি নি কারণ তখন বউ আমার অজ্ঞান ছিলো এখন আমার হাতে ধরেছো। হে গো তোমার বউ তোমাকে তার হাতে ধরতে দেয় না।

শ্রাবণের একেকটা কথায় ধারার বিরক্তির লেভেল তরতর করে বাড়ছে। ধারা বুঝতে পারে না ছেলে মানুষ এমন বাচাল স্বভাবের কি করে হয়। ছেলেরা তো একটু গম্ভীর ধরনের হয়, ধারা এটলিস্ট তাই জানতো।

—ভেবেছিলাম তোদের ডিভোর্স করিয়ে ধারাকে আমি বিয়ে করবো। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ডিভোর্সের থেকেও বেটার অপশন পেয়ে গেছি।

শ্রাবণ চকচকে চোখে জিজ্ঞেস করলো,সত্যি! কি অপশন পেয়েছো গো?

—তোকে মেরে তারপর ধারাকে বিয়ে করবো।

—ওয়াও! বিধবা বিবাহ করবে। ইউ আর গ্রেট নাজমুল ভাই। তুমি তো ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মুখ উজ্জ্বল করে দিলে গো।

শ্রাবণের একের পর এক ফালতু কথায় অতিষ্ট হয়ে ধারা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,শ্রাবণ!
শ্রাবণ এবার চুপ করলো। নাজমুল কাউকে একটা ফোন করলো। ফোন করে দঁড়ি নিয়ে আসতে বললো। ধারা নাজমুলের কথায় চমকে উঠলো কারণ সে ঠিক বুঝতে পারছে দঁড়ি দিয়ে শ্রাবণকে বাঁধা হবে। ধারা শ্রাবণের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো শ্রাবণের কোনো হেলদোল নেই। সে মুখ দিয়ে শিস বাজাচ্ছে আর আশপাশটা মনোযোগ সহকারে দেখছে।

একটু পর মোটা মতন দুটো লোক এসে শ্রাবণকে বাঁধলো। শ্রাবণ মোটা দুই লোকের দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকালো। শ্রাবণের থেকে ইতিমধ্যে তার ফোন কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

.
বড় একটা কারখানা মতন ঘরে শ্রাবণকে বাঁধা অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছে।
—আরে ভাই আস্তে করে টানুন তো। একে তো বেঁধেছেন এমন শক্ত করে তার উপর গরুর মতন টানছেন। রিডিকউয়াস!
শ্রাবণের কথায় লোক দুটো চটে গেলো। শ্রাবণ তাদের আসার পথে অনেক জ্বালিয়েছে। তারা এতো মোটা কেন এই প্রশ্ন করতে করতে তাদের মাথা খারাপ করে দিয়েছে। যাইহোক শ্রাবণকে এনে একটা চেয়ারে বসানো হলো। চেয়ারে বসিয়ে আবার বাঁধা হলো। শ্রাবণ চেয়ারে বসে বসে মনের সুখে সিটি বাজাচ্ছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে না তাকে এখানে বন্দি করা হয়েছে।
একটু পর নাজমুল এলো ধারাকে নিয়ে। ধারাকে দুটো মহিলা ধরে রেখেছে। নাজমুল শ্রাবণের দিকে এগিয়ে এলো। তার হাতে একটা রিভলবার।
—ব্রো তোমার রিভলবারের কি লাইসেন্স আছে?

নাজমুল রাগি চোখে তাকালো শ্রাবণের দিকে।
—এই তোর ভয় করছে না?

—আজব প্রশ্ন। যেখানে তুমি অর্গান স্মাগলিংয়ের মতো কাজ করে বিনা ভয় ডরে খোলামেলা ঘুরে বেড়াও সেখানে কিছু না করে আমি কেন ভয় পেতে যাবো।

—বাহ্ এটাও জেনে গেছিস তোরা?

—কি করবো বলো। কম তো বাঁশ দাওনি তুমি আমাকে। তাই তেমার ব্যপারে একটু আধটু খবর রাখা আমার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে বলে আমার মনে হলো এই আরকি।

—আফসোস জেনেও তোরা আমার কিছু করতে পারবি না। কারণ তোদের কাছে কোনো প্রমাণ নেই। অনেক কথা হয়ে গেছে এবার মরার জন্য প্রস্তুত হ।
শ্রাবণ চোখদুটো বন্ধ করলো।
—আজ যদি আমি এখান থেকে বেঁচে ফিরি তাহলে ওই রাসেলের একদিন কি আমার একদিন। এই আহাম্মকের জন্য আজ আমি গান পয়েন্টে। চট্টগ্রাম থেকে আসতে এতো সময় লাগে।

নাজমুল ট্রিগার চাপতে যাবে ওমনি পিছন থেকে “বাবা” বলে কেউ চিৎকার করে ডেকে উঠে। শ্রাবণ সিডরের গতিতে চোখ খুলে তাকায় আর তখনই তার মুখে হাসি ফুটে উঠে।

#চলবে….ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here