শ্যামাঙ্গণা-১৪

0
333

শ্যামাঙ্গণা-১৪
————-

পোড়া রোদ্দুরে নগ্ন পায়ে বাগানে পায়চারি করছে ঝুমুর। সকালের মতো তার হাতে এখন আর বই নেই। বই পড়ে আছে অবহেলায় জারুল গাছের নিচে। কিয়ৎক্ষণ পূর্বে শাওমির কথাগুলো শুনে মন এতটাই বিষিয়ে গেছে যে বইয়ের প্রতি ভালোবাসাও সে অনুভব করতে পারছে না। সবকিছুর প্রতিই বিষ বিষ অনুভূতি হচ্ছে।

বিরক্তিতে ঝুমুর অনবরত পায়চারি করছে। শাওমি তাকে রেখে বাসায় ঢুকেছিল কিন্তু সে যখন ফিরছে না দেখলো না তখন তাকে ডাকতেও এসেছিল। কিন্তু ঝুমুরের গমগমে গলায় ‘ লিভ মি এলোন ‘ কথাটা শুনে আর সাহস করতে পারেনি কিছু বলার। বাধ্য হয়ে সে মনোয়ারা বেগমকেই ডেকেছিল কিন্তু তিনিও হাজার বলে নাতনীকে ঘরে ফেরাতে পারেননি। উপরন্তু ঝুমুর বিরক্তিতে ঠাসা মুখে বলেছে ‘ আমার সময় হলে আমি আসবো ‘

পড়ালেখার প্রতিও মন বসছে না ঝুমুরের। অথচ পড়তে বসা দরকার। পড়াশোনাকে অবহেলা করলে তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। সে তার অমনির তাকে ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে না। এসব জানে ঝুমুর তবুও মনকে তো আর মানানো যায় না। মন তো ঘুরে ফিরে ভালোবাসা নামক বিশ্রী অনুভূতিটার জন্যই কাদে।

স্কার্টের পকেটে দশ টাকা ছিল। ঝুমুর ঠিক করলো কিছু একটা খেয়ে আসা যাক দোকান থেকে। ঝুমুর বাগান ছেড়ে বেরিয়ে এলো। বিল্ডিংয়ে ঢুকে জুতো পড়ে আবার বেরোলো। গলি পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠে এলো। কিছুদূর হাঁটার পরই পরিচিত,চেনা জানা দোকানটা চোখে পড়লো। ঝুমুর এগিয়ে গেলো সেইদিকে।

ঝুমুরকে এহেন অবেলায় দোকানে দেখে হাসলেন নাফিসা বেগম। পান খাওয়া মুখে বললেন ‘ কেমন আছো ঝুমুর ? হঠাৎ এই সময় ? মন খারাপ নাকি ? ‘
মহিলার কোনো প্রশ্নের উত্তরই দিলো না ঝুমুর। আপাতত উত্তর দেওয়ার চেয়েও খাওয়ার জন্য কিছু একটা খুঁজে বের করা দরকার। ঝুমুর কিছুক্ষণ আশপাশ চোখ বুলিয়ে দেখলো ম্যাংগো বার আছে। ও হাত বাড়িয়ে সেদিকে ইশারা করে বললো ‘ ওটা দিন ‘

নাফিসা বেগম ঝুমুরের ভাব গতি লক্ষ্য করছেন। মেয়েটা উনার মেয়ের সাথেই ইন্টার ফাইনাল ইয়ারে পড়ে তবে উনার মেয়ে আঁখি প্রাইভেট কলেজে আর ঝুমুর পাবলিকে। আঁখি আর ঝুমুর একই ক্লাসে হলেও আঁখির থেকে ঝুমুর অনেকাংশে বুদ্ধিমতী এবং গুণী। মেয়েটার গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা হলে কি হবে ? গুণ তো তার ঠিকই আছে যার কোনোটাই নাফিসা বেগমের মেয়ে আঁখির নেই।

ঝুমুরের কথা শুনে নাফিসা বেগম ম্যাংগো বার বের করে বললেন ‘ এটা পনেরো টাকা ‘
ঝুমুর একবার হাতে থাকা দশ টাকার নোটের দিকে তাকালো আরেকবার নাফিসা বেগমের হাতে থাকা ম্যাংগো বারের দিকে। যদি পারতো দশ টাকার নোটকে জাদুবলে পনেরো টাকা করে দিতে তাহলে কতই না ভালো হতো। ঝুমুর চাইলেই বাকিতে নিতে পারে কিন্তু সেটা তার এথিক্সের বাইরে।

জীবন ক্ষণস্থায়ী। এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে সুন্দরভাবে বাঁচতে হলে সবাইকেই কিছু নিয়ম নীতির বেড়াজালে আটকে বাঁচতে হয়। এসব বেড়াজালে আটকে থাকতে থাকতে একসময় তারা হাপিয়ে যায় কিন্তু জীবিকা নির্বাহের তাড়নায় কিংবা সুষ্ঠু জীবনে বেচেঁ থাকার জন্যই তাদের এসব মেনে নিতে হয়।

ঝুমুর তার ক্ষণস্থায়ী জীবনে সাধারণ কিছু এথিকসের উপর নির্ভর করে চলে। এসবের মাঝেই কারোর কাছ থেকে ধারে কিছু না নেওয়া তার অন্যতম এথিক্স। ধারে কোনোকিছু নেওয়াতে ঝুমুরের বিবেক এবং রুচি উভয়তেই বাধে। তাই ঝুমুর ঠিক করলো সে নিবে না। ঝুমুর নাফিসা বেগমের উদ্দেশ্যে বললো ‘ তাহলে থাক রেখে দেন। পরে এসে নিয়ে যাবো। ‘

ঝুমুরের কথায় নাফিসা বেগম মুখটা বেজার করে ম্যাংগো বার ঢুকিয়ে রাখলেন কারণ উনি জানেন ঝুমুর মরে গেলেও ধার করে উনার থেকে জিনিসটা নিবে না। ঝুমুরকে উনি বিগত দশ বছর যাবত দেখছেন। এই দশ বছরে উনি অন্তত এতটুকু টের পেয়েছেন ঝুমুর আর সব মেয়েদের থেকে আলাদা। তার মধ্যে প্রচন্ড দায়িত্ব জ্ঞান বোধ এবং আত্ম সম্মান আছে যা তাকে কখনোই মাথা নুয়াতে দেয় না।

‘ আন্টি আপনি ওকে ওটা দিয়ে দিন। টাকা আমি দিয়ে দিচ্ছি। ‘

ঝুমুর খালি হাতেই বেরিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে পিছন ফিরলো। ফাহমানকে দোকানের সামনে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ওর কপালে ভাঁজ পড়ল। ওর সকালের রাগ এবং মন খারাপ ভাবটা আবারও ফিরে এলো। কি দরকার ছিল মানুষটার এখন তার সামনেই আসার ? লোকটার কি কোনো টাইম সেন্স নেই ? যখন তখন যার তার সামনে চলে আসে। প্রথমে তার সামনে আসলো এরপর তার প্রিয় সখীর সামনেও এলো।

আর যতবারই আসে ততবারই মারকাটারি এক লুক নিয়ে সামনে আসে যা দেখে যে কোনো মেয়েই মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারে না। বেশভূষা, চাল চলন, আচার ব্যবহার সব সাধারণ। অথচ ব্যক্তিত্বটা এতই ধারালো যে যেকোনো মেয়েকে দুই মিনিটের মধ্যে নিজের দিকে আকর্ষিত করতে পারে। হাসিটা মারাত্মক রকমের অসভ্যও বটে। এই হাসির প্রেমেই তো পরেছিল ঝুমুর।

তবে আজ ফাহমানের অসভ্য মার্কা হাসি এবং ধারালো ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়ল না ঝুমুর। ফাহমানের সামনের কালো চুলগুলো কপালে হুটোপুটি খাচ্ছে। তার নাকে মুখে পড়ন্ত দুপুরের সূর্যও আছড়ে পড়ছে। কিন্তু ফাহমানের এই সৌন্দর্যে ঝুমুরের ইস্পাতের মতো শক্ত কঠিন মন এবার আর গললো না। সে পুনরায় নিজের ফেরার পথে পা বাড়ালো।

ফাহমান শসা কেনার কাজে বেরিয়েছিল। আজ আবার তার অফ ডে বলা যায়। শসা কিনেই সে বাড়ি ফিরছিল কিন্তু ঝুমুরকে দোকানে দেখে থেমে গেলো। দ্রুত পা চালিয়ে দোকানের কাছে আসতেই সম্পূর্ণ ঘটনা বুঝে ফেললো। কিন্তু তাকে দেখার পরও ঝুমুরের এরকম প্রত্যাখ্যান করে এড়িয়ে যাওয়ায় সে অবাক। নাফিসা বেগমকে টাকা মিটিয়ে দিয়ে ম্যাংগো বার নিয়ে ঝুমুরের পিছু পিছু ছুটলো।

‘ আরে…আরে আমাকে ফেলে কোথায় যাও ?’

ফাহমান দ্রুত পা চালিয়ে ঝুমুরের দিকে এগিয়ে গেলো। ঝুমুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটতেই লক্ষ্য করলো ঝুমুরের মুখের ভাব গম্ভীর। ঝুমুরের হঠাৎ রেগে যাওয়ার কারণ ধরতে অপারগ সে। তাও জিজ্ঞেস করলো ‘ কি ব্যাপার ? মহারানী কি রেগে নাকি ?’

ফাহমানের কথার জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না ঝুমুর। সে নিরবে পথ চলতে ব্যস্ত। তার এই নিরবতা ফাহমানের মনে হয় মনে ধরলো না। সে হতাশা ভরা গলায় বলল ‘ তুমি কি রেগে অঙ্গণা ? রেগে থাকলে সরাসরি বল আমার অপরাধ কি ? তুমি তো জানো আমি তোমার রাগ করে থাকা সহ্য করতে পারিনা। আর যাই হোক তোমার নিরবতা আমায় বড্ড পোড়ায়। ‘

ফাহমানের কথায় মনে হয় ঝুমুরের লোহার ন্যায় শক্ত মনের বরফ একটু হলেও গললো। ঝুমুর অভিমানী গলায় বললো ‘ অপরাধ আপনার না আমার। এমন একজনকে পছন্দ করলাম যাকে যেই দেখে সেই প্রেমে পরে যায়। আমারই কপালের দোষ সব নাহলে আমার ছোটবেলার সখী যে মনে প্রাণে কোরিয়ান সে নাকি আমার বাঙালি প্রেমিককে দেখে প্রেমে পড়ে গেছে এটা সম্ভব ? ‘

ঝুমুরের কথা মন দিয়ে শুনলো ফাহমান। এবার সে ধরতে পারলো কেন ঝুমুর রেগে অভিমানে মুখ ফুলিয়ে রেখেছিল। ও আলতো হেসে বললো ‘ কোরিয়ান, চাইনিজ, ইউরোপিয়ান কিংবা বাঙালি যেই প্রেমে পড়ুক না কেন দিনশেষে কিন্তু এই ডাক্তার সাহেব আপনারই প্রেমে মত্ত ডাক্তার সাহেবা। ‘
ঝুমুর যেন এবার আরও খানিকটা শান্ত হলো। তার চোখে মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সে আলতো হেসে মাথা নেড়ে বললো ‘ এমন হলে আমি চাই এই ডাক্তার সাহেব সবসময় তার ডাক্তার সাহেবার প্রেমেই মশগুল থাকুক। ‘

ফাহমানও ঝুমুরের কথার জবাবে হেসে দিল। ঝুমুরের দিকে ম্যাংগো বার এগিয়ে দিয়ে বললো ‘ এবার আমার থেকে এটা নিতে কোনো আপত্তি নেই তো ? ‘
ঝুমুর অবশ্য আর আপত্তি করলো না। সে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে প্যাকেটটা নিলো। রাতের কামড়ে প্যাকেট খুলে তাতে কামড় বসালো। ঝুমুরের ছোট ছোট কামড়ে খাওয়া দেখে ফাহমান মনে মনে বললো ‘ অথচ আপনি যদি জানতেন এই ডাক্তার সাহেব সবসময় আপনাকেই ভালোবেসে এসেছে তাহলে আর এই কথা বলতেন না। ‘

—-

শর্ট নোটিসে ঝুমুর জানতে পেরেছে আজ তাদের উত্তরার সি শেলে যেতে হবে কারণ একটা ওয়েডিং ইনভাইটেশন আছে তাদের। বিয়েটা মনোয়ারা বেগমের জায়ের বোনের মেয়ের বিয়ে। পাত্রীর মা সপরিবারের ঝুমুরদের নিমন্ত্রণ করে গেছেন কয়েক দিন আগেই। কাজের চাপে এই দাওয়াতের কথা বলতে ভুল গিয়েছিলেন মনোয়ারা বেগম। অন্যদেরও কারোর মনে ছিল না তাই ঝুমুরের আর জানা হয়নি।

কথাটা শোনামাত্র ঝুমুর বিরক্ত হলেও তার বিরক্ত ঠেলে অপ্রকাশিত রেখে নিঃশব্দে পুরোটা মেনে নিলো। সপরিবারে যেহেতু যেতে বলেছে তাই শাওমিও যাবে ওদের সাথে। যদিও শাওমিকে দেখে ঝুমুরের সকালের কথাটা মনে পড়ে গেলো কিন্তু নিজের সখিকে কি আর এড়িয়ে যাওয়া যায় ? তাই সে এড়িয়ে না গিয়ে শাওমিকে সঙ্গে করে বিয়েতে পড়ে যাওয়ার জন্য শাড়ি বেছে নেওয়ার কাজে মন দিল।

হালকা পিয়াজি রংয়ের মধ্যে গাঢ় পিয়াজী রংয়ের পাড় দেওয়া সুতি শাড়ি পড়েছে ঝুমুর। হাতে সিলভার ব্রেসলেট এবং কানে ঝুমকা। লম্বা চুলগুলো পিঠের উপর ছেড়ে দেওয়া। ঠোঁটে হালকা নিউড লিপস্টিকও লাগিয়েছে সে। সবশেষে চোখের কোণে গাঢ় করে কাজল টেনে নিল ঝুমুর। এবার যেন সাজটা সম্পূর্ণ লাগছে। আলমারির নিচের ড্রয়ারটা খুলে লাইট পিংক ফ্ল্যাট হিলের জুতো নামিয়ে নিলো ঝুমুর।

ঝুমুর জুতো পড়তে পড়তেই লক্ষ্য করলো শাওমি বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। শাওমির পরনে হাঁটু অব্দি ফুল স্লিভ ব্ল্যাক টপস সঙ্গে ব্লু জিন্স। গলায় ছোট রেড স্টোনের লকেট আর হাতে গোল্ডেন ওয়াচ। শাওমির চুলগুলো স্ট্রেট করে ছেড়ে দেওয়া। শাওমি নিজেকে আয়নায় দেখে নিতে ব্যস্ত আর ঝুমুর জুতো পড়তে।

মনোয়ারা বেগম ফোন হাতে ঘরে ঢুকলেন। ঝুমুরের দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন ‘ তোর মামণি ফোন করেছে। তোর সঙ্গে কথা বলবে ? কথা শেষ হলে ফোন দিয়ে যাস। ‘

তানিয়া শাহজাহান ফোন করেছে শুনে ঝুমুর দ্রুত ফোনটা কানে ধরলো। ফোনের ওপার থেকে তানিয়া শাহজাহান বললেন ‘ আজ কোন শাড়িটা পড়েছিস রে বুড়ি ? তোর সাজটাও বল। দুজনে একই রকম সাজবো। দেখিস আজ কেউ আমাদের দেখে চিনতেই পারবে না। তোর আপিই তো টাস্কি খেয়ে যাবে। ‘

ঝুমুর হাসলো তানিয়া শাহজাহানের কথায়। বললো ‘ তুমি যে পিয়াজি রংয়ের সুতি শাড়ি দিয়েছিলে ওটা। চুলগুলো ছাড়া আর চোখের নিচে কাজল দিয়েছি। কানে ঝুমকা আর হাতে সিলভার ওয়াচ। এবার শান্তি ? এখন দেখি তুমি কত ভালো সাজতে পারো আমার মত। ‘

‘ বুড়ি একটা ছবি পাঠা তো। ‘

তানিয়া শাহজাহানের কথায় ফোন কেটে ঝুমুর ছবি তুললো তারপর ছবিটা তানিয়া শাহজাহানকে সেন্ড করে দিলো। সবশেষে আরেকবার আয়নায় নিজেদের দেখে দুই সখি বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।

চলবে….
মিফতা তিমু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here