শৈবলিনী পর্ব ১২

0
908

#শৈবলিনী—১২
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★ভাদ্রের প্রখর গরমে জনজীবন বিধ্বস্ত। গগন চিঁড়ে বের হয়েছে কাঠফাটা রোদ্দুর। লোকাল বাসের যাত্রা শেষ করে ভার্সিটিতে এসেছে নূর।ক্যাম্পাসের মাঠ জুড়ে রোদের তান্ডব। স্বস্তির আশায় গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঘামে ভেজা কপালটা একটু মুছে নিলো। সাইড ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো অর্ধেকটা। কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেয়ে ক্লাসের দিকে এগুলো সে। শিখা আর গিয়াস দুজনেই নাকি আজ আসবেনা। শিখার জ্বর আর গিয়াসের কোনো ফ্যামিলি ফাংশন আছে তাই আসেনি। দুজনকে ছাড়া কেমন খালি খালি লাগছে নূরের। ও নিজেও আসতোনা। তবে ওই নায়কের কাজের জন্য আসতে হলো। কথা যেহেতু দিয়ে ফেলেছে তাই আসতে তো হবেই। আর এখনতো তারওপর আবার ঋণ শোধ করার দায়িত্বও আছে।তাই না এসে উপায় নেই।

ক্লাস শেষে নূরের কিছু নোটের প্রয়োজনে সে লাইব্রেরীর দিকে গেল। লাইব্রেরি ক্যাম্পাসের অন্য ভবনে। এই ভবনে ক্লাস হয়না। শুধু জরুরি এক্সাম,প্রফেসরদের মিটিং আর ভার্সিটির পারিপার্শ্বিক কাজ করা হয়।এইজন্য এদিকে জনসমাগম একটু কম থাকে। লাইব্রেরী আছে তিনতলায়। সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে করিডর দিয়ে হেঁটে লাইব্রেরির দিকে যেতে নিলেই হঠাৎ কারোর চিল্লানোর মতো আওয়াজ এলো। আওয়াজ টা পাশের ফাঁকা রুম আসছে এটা বুঝতে পারলো নূর। ঘটনা কী জানার জন্য ধীরে ধীরে রুমের দিকে এগিয়ে গেল নূর। রুমের দরজা আস্তে করে হালকা খুলে ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখলো, কয়েকটা ছেলে মিলে একটা মেয়েকে হ্যারাস করার চেষ্টা করছে। ছেলেগুলো ভার্সিটিরই, ছাত্র রাজনৈতিক দলের উশৃংখল ছেলেগুলো । যাদের কাজই মাস্তানী করা। মেয়েটাকেও চিনতে পারলো নূর। মেয়েটা আর কেউ নয়,সবসময় নূরকে খোঁচা মেরে কথা বলা সেই ধনীর দুলালী, অবনী। নিজের চোখের সামনে কোনো মেয়ের সাথে খারাপ কিছু হতে দেখে চুপ থাকার মতো মেয়ে নূর না। এক ধাক্কায় দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো নূর। নূরকে দেখে অবনী কেঁদে উঠে বলল,
–নূর,প্লিজ বাঁচাও আমাকে। প্লিজ হেল্প মি।

নিজেদের কুকর্মে ব্যাস্ত থাকা ছেলেগুলো নূরকে দেখে ভড়কে গেল। হুমকি দিয়ে বলল,
–এই মেয়ে দেখছিস না প্রাইভেট কাজ চলছে। যা ভাগ এখান থেকে। নাকি তোরও ওর সাথে যোগদান করার শখ হয়েছে! মাল খারাপ না। আয় তোরেও এন্টারটেইন করি।

নূরের চোখ মুখ লাল বর্ণ হয়ে উঠলো। অগ্নিশর্মা হয়ে সে বলল,
–ছেড়ে দে ওকে।

–আচ্ছা? না দিলে কী করবি শুনি? যা দিলাম না ছেড়ে। পারলে ছাড়িয়ে নে।

–অ্যাজ ইউর উইশ। পরে বলিসনা আমি ওয়ার্ন করিনি।

–উউউউউ…আমরা তো ভয় পেয়ে গেলাম। এখন কে বাঁচাবে আমাদের।
তিরস্কার করে বিশ্রী ভাবে হাসতে লাগলো সবাই। দলের ভেতর থেকে একজন এগিয়ে এলো নূরের দিকে। সয়তানি হেঁসে নূরের শ,রী,রে হাত লাগাতে নিলেই নূর,খপ করে লোকটার হাত ধরে ফেলে, পেছন দিকে ঘুরিয়ে হাতটা পটাস করে পিঠের দিকে মুচড়ে দিয়ে হাঁটুর ভাজে লাথি মেরে দিলো। লোকটা পা ভেঙে নিচে পড়ে গেল। এবার আরেকজন তেড়ে এলো। নূর নিজের সাইড ব্যাগের ভেতর থেকে স্ক্রু-ড্রাইভার বের করে আক্রমনকারীর হাঁটুর ওপর ঘেচাং করে ঢুকিয়ে দিয়ে আবার বের করে নিলো। লোকটা আর্তনাদ করে হাঁটু চেপে ধরে নিচে পড়ে গেল। এবার আরও দুজন একসাথে এলো। নূর একটার পেট বরাবর ঘুষি মারলো, আরেকটার মেইন পয়েন্ট বরাবর সজোরে দিলো লাথি মেরে। লোকটা তার পয়েন্ট চেপে ধরে কাতরাতে কাতরাতে নিচে পড়ে গেল। সবগুলোকে কপোকাত করে নূর অবনীকে ছাড়িয়ে বাইরে নিয়ে এলো। নিচে এসে একটা বেঞ্চে বসিয়ে পানির বোতলটা এগিয়ে দিলো অবনীর দিকে। অবনী পানি খেয়ে কাঁদো কাঁদো সুরে বলল,
–আম সরি নূর। আমি তোমাকে কতো কটুবাক্য শুনিয়েছি তবুও তুমি আমার এতবড় উপকার করলে। থ্যাংক ইউ সো মাচ নূর। তুমি না আসলে আজ আমার সাথে কী হতো ভাবতেই কলিজা কাঁপছে।

–কেন? কেন কারোর আসার অপেক্ষা করছিলে তুমি? যেটা আমি করেছি সেটা চাইলে তুমিও করতে পারতে। শুধু সেই সাহস আর মনোবল আনতে হবে। একটা কথা মনে রাখবে, এটা সিনেমা না। এখানে তোমাকে বাঁচাতে দেয়াল ভেঙে কোনো হিরো আসবেনা। এটা বাস্তব জীবন। আর বাস্তব জীবনে নিজের সাহায্য নিজেকেই করতে হয়। আজ নাহয় আমি সময়মত এসে গিয়েছিলাম তাই তোমাকে বাঁচাতে পেরেছি। কিন্তু যদি আমি না আসতাম তখন? তাই নিজের বল নিজে রাখো। অন্যায়কে শক্ত হাতে দমন করা শেখ। মেয়েরা চাইলে সব পারে।

–ঠিক বলেছ নূর। আমি মনে রাখবো তোমার উপদেশ।

–হুমম,তো আরম্ভ এদের দিয়েই করো। এদের আইনের আওতায় এনে চরম শাস্তির ব্যবস্থা করো। নাহলে এরা কাল আবারও কোনো মেয়ের ক্ষতি করবে।

–হ্যাঁ, আমি আজই বাবাকে বলে এদের শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করবো।

–ঠিক আছে,এখন তাহলে যাই আমি। তুমিও বাসায় গিয়ে রেস্ট নাও।

–ধন্যবাদ নূর। তুমি সত্যিই অনেক ভালো। জীবনে কখনো তোমার কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হলে অবশ্যই আমাকে বলবে। তোমার কোনো কাজে আসতে পারলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করবো।

–ঠিক আছে। আসি এখন।

–আদিত্য নিজের ভ্যানে বসে স্ক্রিপ্ট পড়ছিলো। তখনই দরজা খুলে কেউ ভেতরে ঢুকলো। মাথা তুলে সামাইরাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে এলো আদিত্যের। মেয়েটা ইদানীং বেশিই বিরক্ত করছে আদিত্যকে।প্রয়োজন, অপ্রয়োজনে নানান বাহানায় চলে আসে ওর ভ্যানে।সেদিন এতো কথা শোনালাম তাও যেন গায়ে লাগেনি এর। মায়ের আহ্লাদ পেয়ে যেন এর আশকারা আরও বেড়ে গেছে। ছবির শুটিং শেষ না হওয়া পর্যন্ত এরসাথে কোনো হার্শ আচরণ করতে পারছেনা। তাই অগত্যা বরদাস্ত করতে হচ্ছে একে। আদিত্য গম্ভীর কন্ঠে বলল,
–সামাইরা, তোমাকে কতবার বলেছি নক না করে এভাবে হুট করে ঢুকে পড়বেনা। ডোন্ট ইউ নো দিস ইস মাই প্রাইভেট স্পেচ!

সামাইরা হাসিমুখে সামনে এসে বলল,
–আরে আদিত্য, কী তোমার আমার লাগিয়ে রেখেছ? আমাদের মাঝে এখন আর কীসের প্রাইভেসি? কিছুদিন পরতো আমরা এক হতে চলেছি।

আদিত্য কপাল কুঁচকে বলল,
–হোয়াট রাবিশ আর ইউ টকিং??

–এমন ভাব করছ যেন কিছু বোঝোই না। আরে রেহনুমা আন্টি কী এমনি এমনি আমাকে ডিনারে ইনভাইট করেছিল! সেতো আমাদের সাথে আনার জন্যই এসব করছে। সত্যি বলতে আমিতো অনেক খুশি। আমাদের জুটিটা রিয়েল লাইফেও বাস্তব হতে চলেছে।

রাগে হাতের মুঠো শক্ত হয়ে গেল আদিত্যের। নিজেকে যথাযথ শান্ত রাখার প্রচেষ্টা করে সে বলল,
–দেখ সামাইরা তুমি বোধহয় বেশিই ধারণা করে ফেলেছ। তুমি যা ভাবছ তা কখনো হ…

আদিত্যর কথার মাঝে সামাইরা বিঘ্ন সৃষ্টি করে, আদিত্যর দিকে আরও এগিয়ে আসতে আসতে আবেদনে হাসি দিয়ে বলল,
–তোমাকে কিছু বলতে হবে না আদিত্য। আমি সব জানি। আমি জানি আমি যেমন তোমাকে পছন্দ করি তেমনি তুমিও আমাকে পছন্দ করো। শুধু মুখে বলোনা। রাগ দেখাও। আমাকে পরিক্ষা করো। তবে আমিও সকল পরিক্ষা দিতে রাজি। দেখি কতো নাজেহাল করতে পারো আমাকে।
কথা বলতে বলতে সামাইরা একসময় আদিত্যর খুব কাছে এসে ওর গলা জড়িয়ে ধরলো। এবারে আদিত্যের রাগ শেখরে পৌঁছে গেল। সে সামাইরাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার জন্য হাত উঠাতেই হঠাৎ দরজার সামনে থেকে কেউ বলে উঠলো।
–ওহ সরি,আমি বোধহয় ভুল সময়ে চলে এসেছি।

সামনে তাকিয়ে নূরকে দেখে আদিত্যর শিরদাঁড়া অবশ হয়ে এলো। নূর নিশ্চয় ওকে আবারও ভুল বুঝলো। আদিত্য ঝটকা মেরে সামাইরাকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দিলো। আদিত্য কিছু বলবে তার আগেই সামাইরা নূরের উদ্দেশ্যে কর্কশ গলায় বলে উঠলো।
–এই মেয়ে,কে তুমি? আর তোমার সাহস কী করে হলো এভাবে ঢুকে পড়ার? সেলিব্রিটি দেখলেই হুঁশ থাকেনা তোমাদের তাইনা?

এমন কটুকথা শুনে নূরের মাথা গরম হয়ে গেল। সে প্রতিত্তোরে কিছু বলতে যাবে তার আগেই গর্জে উঠলো আদিত্য।এমনিতেই সামাইরার ওপর চরম পরিমানে রেগে ছিলো আদিত্য।তারওপর আবার সামাইরার নূরের সাথে এমন আচরণে আদিত্যর রাগ এবার আসমান ছুলো। সে ক্রোধিত কন্ঠে বলল,
–শাট আপ সামাইরা! জাস্ট শাট আপ। তোমার সাহস কী করে হলো নূরের সাথে এভাবে কথা বলার! নূর এমনি আসেনি এখানে। ওকে আমি আসতে বলেছি। আমার জন্য এসেছে ও। আমার কাজে হেল্প করার জন্য।

আদিত্যর হঠাৎ এতো ক্রোধ দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেল সামাইরা। সামান্য কোথাকার মেয়ের জন্য আদিত্য এতো কেন ওভার রিয়্যাক্ট করছে? কে এই নূর? তবে আপাতত আদিত্যর রাগ কমানোর জন্য বলে উঠলো।
–সরি আদিত্য, আমি জানতাম না। আসলে আগে কখনো দেখিনি তো।

–সরি আমাকে নয়,নূরকে বলো। সে সরি টু হার।
সামাইরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও আদিত্যর কথা রাখতে নূরের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে ছোট্ট করে বলল,
–সরি।

সামাইরার সাথে নূরও একটু অবাকই হলো আদিত্যের হঠাৎ এতো রাগ দেখে। তাই আপাতত সে আর কিছু বললো না। আদিত্য নিজের ক্রোধকে একটু প্রশমিত করে নিয়ে সামাইরার উদ্দেশ্যে বলল,
–সামাইরা তুমি যাও এখন। আমি কাজ করবো।

সামাইরা এখন আর আদিত্যের কথা অমান্য করার সাহস পেল না। তাই মাথা নেড়ে চুপচাপ বেড়িয়ে গেল যাওয়ার আগে তীক্ষ্ণ চোখে পরখ করলো নূরকে। কে এই মেয়ে? যারজন্য আদিত্য এতো রেগে গেল? সত্যিই শুধু কাজের জন্য এসেছে, নাকি অন্য কিছু? শুধু সামান্য এসিস্ট্যান্ট এর জন্য কী আদিত্য এতটা পজেসিভ হবে? কই আজপর্যন্ত তো কখনো কোনো মেয়ের জন্য এতটা রাগতে দেখিনি। তাও আবার এমন বস্তির মেয়ের জন্য। দেখতেই কেমন জংলী জংলী দেখা যায়। এর নড় নক্ষত্র খুঁজে বের করতে হবেই।

সামাইরা চলে গেলে আদিত্য চোখ বুঁজে নিজেকে একটু শান্ত করে নিলো। নূরকে ভেতরে এসে বসতে বললো। নূর এসে ডিভানে বসলো। আদিত্যর ভেতর ভেতর কেমন অস্থিরতা কাজ করছে। নূর নাজানি ওর আর সামাইরার ব্যাপারে কী ভাবছে! এমনিতেও মেয়েটা আমাকে সবসময় ভুলই বোঝে।এমনিতেও তার মনে নায়কদের নিয়ে খুব নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে সে। আর আজকের এই ঘটনা নিশ্চয় তার ধারণা আরও গাঢ় দিবে। নূর অতি স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
–তো আজ কী করবো?

আদিত্য নূরের দিকে আরচোখে তাকিয়ে একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
–নূর,তুমি যেমনটা ভাবছ আসলে তেমনটা না। আসলে তখন….

আদিত্যর কথা শেষ হওয়ার আগেই নূর স্বাভাবিক সুরে বলল,
–আমি কিছুই ভাবছিনা। আপনি আপনার পার্সোনাল জীবনে কী করলেন বা করলেন দ্যাট ইজ নন অফ মাই কনসার্ন। আমি এখানে শুধু কাজ করতে এসেছি দ্যাটস ইট। তার বাইরে কোনোকিছু জানার বা বোঝার, ইচ্ছে বা প্রয়োজন কোনোটাই নেই আমার। আর তাছাড়া নায়কের কাজই লুচ্চামি করা, এতে এতো ভাবার কী আছে!

শেষের কথাটা বিড়বিড় করে বললো নূর।তবে আদিত্যর কানে সেটা ঠিকই এলো। কথাটা কেমন আত্মসম্মানে লাগলো আদিত্যর। সে এবার নূরের পানে পূর্ণ দৃষ্টি রেখে বলল,
–মিস নূর,তুমি একটু বেশি বলে ফেলছনা! নায়কদের নিয়ে এইযে এমন মহান ধারণা পোষণ করে রেখেছ, তা এর কোনো স্পেসিফিক কারণ আছে? না মানে,এর আগে তুমি কয়জন নায়ককে জানতে বা তাদের কাছ থেকে দেখেছ তুমি?

–কাউকেই না।

–তাহলে তুমি কীভাবে বলতে পারো যে নায়করা কেমন হয়?

–এটা আবার জানার কী আছে। নায়করা কী করে তা বোঝার জন্য তাদের কাছ থেকে জানার দরকার নেই। এমনিতেই বোঝা যায়। সুন্দরী মেয়েদের সাথে ঢলাঢলি করার জন্যই এই লাইনে আসে ছেলেরা।

–তুমি কিন্তু আমার প্রফেশনের ইনসাল্ট করছ নূর। তোমার কাছ থেকে এটা অন্তত এটা আশা করিনি।যেখানে তুমি মেয়ে হয়েও মেকানিকের কাজ করে নিজের আলাদা একটা ব্যাক্তিত্ব তৈরি করেছে, সেই তুমি এমন কথা বলছ! প্রফেশন যেটাই হোক, সেটাকে সম্মান করা উচিত। তুমি যেমন তোমার গ্যারেজে মেহনত করো তেমনি আমরাও করি। চাইলেই কেউ নায়ক হতে পারে না। এরজন্য অনেক স্ট্রাগল করতে হয়। ইচ্ছে মতো খাবার খেতে পারিনা, ইচ্ছে মতো যখন খুশি তখন কোথাও যেতে পারিনা,নিজের পার্সোনাল লাইফ নিয়ে সবসময় চিন্তিত থাকতে হয়। কখন কোন নিউজ বানিয়ে ফেলে সেটা নিয়ে সবসময় তৎপর থাকতে হয়। মন চাইলেই যা খুশি তাই করতে পারিনা আমরা। মেহনত কমবেশি সব প্রফেশনেই করতে হয় নূর।নায়িকাদের সাথে ক্যামেরার সামনে যা করি সেটা আমাদের কাজের একটা পার্ট ছাড়া আর কিছুইনা। হ্যাঁ হয়তো কিছুলোক আছে যারা এগুলোর সুযোগে অনেক অযাচিত কাজ করে। তাই বলে সবাইকে এক দাঁড়িপাল্লায় মাপা ঠিক না। এমন কোনো প্রফেশন নেই যেখানে তুমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারবে যে,এই প্রফেশনের শতভাগই সৎ লোক। হাজিদের মাঝেও পাজি আছে,আবার গুন্ডা বাহিনীর মাঝেও সৎ লোক আছে। তাই না জেনে কোনো প্রফেশনকে একতরফা জাজ করা ঠিক না। নায়ক বলেই যে সবাই খারাপ এই ধারনাও অনুচিত।

—দেখুন আপনি কেন এতবড় পাঁচ পাতা সমান ভাষণ দিলেন তা আমি বুঝতে পারছি।তো শুনুন, আমি কোনো প্রফেশনকে ছোট করছিনা। সব প্রফেশনকেই সম্মান করি আমি। আর আপনার প্রফেশনকেও আমি খারাপ বলছিনা। তবে,আমি আমার জীবনে আমার জীবনসঙ্গী হিসেবে এই প্রফেশনের লোক চাইনা। এখন আপনি বলবেন কেন, তাহলে শুনুন। আমি চাই আমার জীবনসঙ্গী এমন কেউ হবে যার জীবনে একমাত্র নারী বলতে শুধু আমিই থাকবো। সে প্রফেশনালই হোকনা কেন। আমি চাইনা সে বাইরে গিয়ে মেয়েদের সাথে রাস্তা ঘাটে নেচে নেচে গান গাঁক।সে কাজের ক্ষেত্রেই হোকনা কেন। হয়তো আমার কথা অনেক ন্যারো মাইন্ডেড মনে হচ্ছে। তবে আমি এরকমই। আমি অতি সাধারণ একটা মেয়ে, আর আমার চাওয়াটাও সাধারণ। আমার কোনো ফেমাস ব্যাক্তির দরকার নেই।আমি কারোর লাখো অপশনের মধ্যে একটা হতে চাইনা। বরং আমি কারোর ওনলি অপশন হতে চাই।

আদিত্য ফোঁৎ করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
–আমি আগেই বলেছি মিস নূর,মানুষ যেটা সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করে সেটাই তার ভাগ্যে যোটে। আপনার সাথেও এমন কিছুই হতে চলেছে।

–এখন এসব প্রেম গবেষণা ছেড়ে যাক? নাকি আমি চলে যাবো?

–আরে না না চলে কেন যাবে! কাজ করবো তো।
আদিত্য ল্যাপটপ অন করে একটা সীন দেখিয়ে বলল,
–এখানে বন্ধুদের সাথে আড্ডার একটা সীন আছে, দেখতো এখানে কোনো কারেকশন করতে হবে কিনা।
নূর ল্যাপটপ টা ধরে নিজের দিকে ঘুরাতে নিলে হাতে কেমন ব্যাথা পেল। নূর হাতটা সরিয়ে এনে তাকিয়ে দেখলো হাতের কব্জিতে আঘাত লেগেছে। হয়তো তখন ওই বদমাইশ গুলোর সাথে মারামারি করতে গিয়ে লেগেছিল। নূর আর সেটা মালুম না করে কাজে মনযোগ দিতে চাইলো। তবে পারলোনা সে, তার আঘাত যে এতক্ষণে আদিত্যর নজরেও পড়ে গেছে। নূর মালুম না করলেও আদিত্য উদ্বিগ্ন হয়ে গেল। অতি উদ্বেগ নিয়ে সে বলল,
–কী হয়েছে হাতে? দেখি।

নূর স্বাভাবিক সুরে বলল,
–কিছুই হয়নি। কাজে মনযোগ দেন।

আদিত্যর রাগ হচ্ছে। সে আবার বলল,
–নূর হাতটা দেখি।

–বললাম তো কিছু হয়নি।

–নূর আমি হাতটা দেখাতে বলেছি।

–প্রয়োজন নেই।

ব্যাস, হয়ে গেল। আদিত্যর ক্রোধে মাথা গরম হয়ে গেল। আদিত্য এবার নিজেই নূরের হাতটা খপ করে ধরে নিজের সামনে নিয়ে আসতে আসতে গর্জে উঠে বলল,
–আই সেড, শো মি ইউর হ্যান্ড নূর।

আদিত্যর এই হঠাৎ পরিবর্তিত রুপ দেখে কিছুটা থতমত খেয়ে গেল নূর। চোখ রাখলো আদিত্যের পানে। আদিত্যর অশান্ত নজর নূরের হাতে। হাতের ক্ষতস্থান পর্যবেক্ষণ করতে ব্যাস্ত সে। ক্ষত দেখতে দেখতে আদিত্যর মুখমণ্ডল কেমন কঠিন হয়ে উঠছে। শক্ত হয়ে ফুলে উঠছে তার চামড়ার আবরণে ঢাকা রগগুলো। ক্রোধিত নজর মেললো নূরের পানে। চোয়াল শক্ত করে থমথমে গলায় সে বলল,
–কিছুই না? এটা তোমার কাছে কিছুই না?হাতের অবস্থা দেখেছ! কেমন ভয়ংকর লাল হয়ে ফুলে আছে। কীভাবে হলো এটা? আর এটা নিয়ে তুমি চুপচাপ বসে আছ!

নূর নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল,
–ছাড়ুন, এমন আহামরি কিছু হয়নি।গ্যারেজে কাজ করতে গিয়ে এমন চোট দিনে হাজার বার লেগে থাকে।এসব নিয়ে এতো ন্যাকামি করার সময় নেই আমার। একাই ঠিক হয়ে যাবে। এতো ওভার রিয়্যাক্ট করার কিছু নেই।

নূরের ব্যাখায় আদিত্যর ক্রোধ আরও বাড়লো বৈ কমলো না। ক্রোধের বশবর্তী হয়ে আদিত্য দুই হাতে নূরের দুই বাহু চেপে ধরে নিজের মুখের একেবারে কাছাকাছি এনে ক্ষিপ্ত স্বরে বলল,
–তোমার জন্য এটা কিছু না হতে পারে, কিন্তু আমার অনেক কিছু। অনেক কিছু মানে অনেক কিছু। তোমার সামান্য থেকে সামান্য ব্যাথাও আমার কাছে অনেক কিছু। তোমার চুল পরিমাণ কষ্ট হলেও আমার দুনিয়া ছন্নছাড়া হয়ে যায়, বুঝতে পেরেছ তুমি! না, তুমি কী করে বুঝবে! তুমি তো চোখ থাকতেও অন্ধদের কাতারে পরো। তা না হলে কী আর আমার যন্ত্রণাগুলো এভাবে আনদেখা করতে তুমি! এই চোখের ভাষা একবার হলেও পড়তে তুমি। এই হৃদয়ের দহন একবার হলেও আঁচ করতে তুমি। কিন্তু না,তুমিতো পণ করে নিয়েছ,এই দহনে পোড়াতে পোড়াতে একেবারে নিঃশেষ করে দিবে আমাকে। ঠিক আছে দাও, যত খুশি পোড়াও। কিচ্ছুটি বলবোনা আমি। আমাকে যত ইচ্ছে আঘাত করো, তবে তোমার কিছু হলে সহ্য করবোনা আমি। কিছুতেই না।তোমার কিছু হলে পুরো দুনিয়ায় আগুন লাগিয়ে দিবো আমি।
এন্ড আই মিন ইট। এটাকে কোনো ফিল্মি ডায়লগ ভাবার ভুল করবেনা মোটেও।

আদিত্যর এই রুপ আজ প্রথম দেখছে নূর। লোকটার চোখের ভাষায় কেমন আকুলতা দেখতে পাচ্ছে সে। কেমন প্রখর সেই দৃষ্টি। তাকালেই ঘোর লেগে যায়। লোকটা কী সত্যিই আমার জন্য এতটা ব্যাকুল হচ্ছে! তার এতো ক্রোধের হেতু কী শুধুই আমার আঘাত। নাহ! মোহে ডুবলে হবেনা আমাকে। নূর আবারও হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই আদিত্য হুমকি দিয়ে বলল,
–চুপ,একদম চুপ। নট আ সিঙ্গেল ওয়ার্ড। তোমার এসব গুন্ডীপনা অন্যদের সামনে চলবে আমার সামনে না। সো ডোন্ট ওয়েস্ট ইউর এনার্জি। এখন চুপচাপ এখানে বসে থাকো। একপাও নড়বে না।

প্রতিত্তোরে সত্যিই যেন নূর কিছু বলতে পারলোনা। লোকটার ভাবসাব আজকে তাকে কেমন ভাবাচ্ছে। আদিত্য উঠে গিয়ে ক্যাবিনেটের ড্রয়ার থেকে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে এসে আবার নূরের সামনে বসলো।প্রথমে তুলোয় স্যাভলন লাগিয়ে নূরের হাতের ক্ষত পরিস্কার করতে লাগলো।খুব মনযোগ সহকারে একবার স্যাভলন লাগাচ্ছে তো তিনবার করে ফু দিচ্ছে। চিন্তাগ্রস্ত মুখমণ্ডল ঘেমে একাকার। মনে হচ্ছে সে কারোর ওপেন হার্ট সার্জারী করছে। একটুও এদিক ওদিক হলে রুগীর জান চলে যাবে। আবার নূরকেও আস্বস্ত করে বলছে,
–একটু জ্বলবে, কষ্ট করে একটু সহ্য করো হ্যাঁ।

আদিত্যর এমন ভীতিগ্রস্ত চেহারা দেখে নূরের ভীষণ হাসি পেল। আবার আমাকে বলছে যেন ভয় না পাই। অথচ লোকটাকে কে বোঝাাবে এগুলো তো নূরের কাছে ভাতমাছ। আদিত্য স্যাভলন লাগানো শেষে পেইন কিলার স্প্রে করে দিলো। নূর তাকিয়ে দেখছে আদিত্যকে। লোকটার এতো ব্যাকুলতা কী সত্যিই আমার জন্য? সত্যিই কী তার কপালের ওই চিন্তার ভাজ, ঘর্মাক্ত মুখমণ্ডল, অশান্ত চোখের ওই অস্থিরতা সবই কী আমার জন্য? নাকি কোনো ছলনা?

চলবে…..

(আইডি রেস্ট্রিকশনের কারণে কাল গল্প পোস্ট করতে পারিনি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here