#শুকতারা (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#পর্ব-৫
#হালিমা রহমান
দুটো ভালো খবর একসাথে পেয়ে মনটা খুব ভালো হয়ে গিয়েছিল রায়হানের।সূচির আকস্মিক দুর্ঘটনার গ্লানি মন থেকে একটু একটু করে কাটছিল।অপরিসীম শোকের মাঝেও একটা সান্ত্বনা, সব অন্যায়ের শেষ হয়েছে।অপরাধী ধরা পড়েছে।এবার তার বিচার হবে।ফয়সালকে রিমান্ডে নেওয়ার দৃশ্যটাও মনে মনে এঁকেই ফেলেছিল।একের পর এক আঘাতে কাত হয়ে পড়ছে শয়তানটা। চামড়ায় কেটে কেটে বসে যাচ্ছে অফিসার শাহাবুদ্দিনের দেওয়া আঘাত।একদিনের রিমান্ডেই সারা শরীরে দাগ বসে যাচ্ছে ফয়সালের, যন্ত্রণায় চিৎকার করছে– যেমনটা করেছিল ওদের বাড়িতে চোখের উপরে বড় হওয়া সূচি।আসামীর শাস্তি নিশ্চিত, অতএব স্বস্তিও চৌকাঠে। চিরকাল শোক নিয়ে বেঁচে থাকা সাহিদা বেগমের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলতে পারবে,সূচির গল্প শেষ।যে ট্র্যাজেডির শুরু হয়েছিল সূচির বিয়ের মাধ্যমে তা শেষ হয়েছে ফয়সালের শাস্তির মাধ্যমে।একজন অতৃপ্ত মৃত মানুষের জন্যে এর চেয়ে বেশি আর কী করা যায়?
কথার পরেও কথা থাকে।গল্পটা এভাবে শেষ হলেও হতে পারতো কিন্তু আপাতত তা হচ্ছে না।একে রবি ঠাকুরের সেই বিখ্যাত উক্তি, শেষ হয়েও হইলো না শেষের সাথে অনায়াসে মিলিয়ে দেওয়া যায়।এপক্ষ-ওপক্ষ টানাটানি করে কেবল এর আয়ুই বাড়াচ্ছে।ঘটনার রেশ কাটছে না কিছুতেই।
দুর্নীতির ফল কোনোদিন ভালো হয়েছে? প্রাচীন প্রশ্ন,উত্তরটাও ঐ একই আসে। এ এক অন্তঃসারশূন্য ভেলকি যার আগাগোড়া সম্ভাবনার বিপুল চাদরে মোড়ানো কিন্তু ভিতরে আসলে কিছুই নেই।এই ঘৃণ্য শব্দটা ক্ষনিকের জন্য আশা জাগায় বটে তবে দীর্ঘমেয়াদে এর কার্যকারিতা ঘুণ ধরা কাঠের মতোই,কোনো কাজে লাগে না।এক্ষেত্রে ঠিক তাই হলো।সাধ্যমত ফয়সালকে শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছে রায়হান।কিন্তু যেই পথে গেছে তাকে ঠিক ভালো বলা যায় না।অনৈতিক দুর্নীতি কবে কার ভালো করেছে যে এবার করবে? ঘুষের টাকার জোরে ভেসে আসা বিপদ কাটানো সহজ। টাকা অথবা ক্ষমতা– দুটোর একটা থাকলেই চলে।এদিক দিয়ে আবার ফয়সালের পাল্লা ভারী।সফল খামারি হিসেবে তার হাতে টাকার অভাব নেই।তবে এবারে অর্থ নয়,কাজে লাগলো দ্বিতীয়টা।ক্ষমতার জোরে এবারের মতো ফাঁড়া কাটলো।থানা-পুলিশকে চেহারা দেখিয়ে আবার ফিরে এলো মায়ের কোলে।শুরু থেকেই বলছি তবে।
সকালে ইশতিয়াকের হাতে মার খাওয়ার পরে মাথাটা ঠিক কাজ করছিল না।সূচির মৃত্যুটাই অবিশ্বাস্য। সূচির মতো মারধরে অভ্যস্ত মেয়েও যে মার খেয়ে মরতে পারে এই কথাটাই যেন বিশ্বাস হতে চায় না।এর উপরে উপরি পাওনা হিসেবে ছিল তেজি ইশতিয়াকের শক্ত হাতের আঘাত।আঘাতগুলোকে নাক-মুখের উপরে আছড়ে পড়া পাথরের মতোই মনে হচ্ছিল।শেষ ঘুষিতে কাত হয়ে পড়ে যাওয়ার পরে সে ভেবেছিল, এই শেষ।ভবলীলা সাঙ্গ।আর চোখ তুলে তাকানোর সুযোগ হবে না।কিন্তু সময় গড়াতেই বুঝলো ভাগ্য সুপ্রসন্ন। ভূমির অসুস্থতাই ওর সৌভাগ্য।ভূমিকে নিয়ে ব্যস্ত হয় পড়লো ইশতিয়াক,হুমায়রা;পরাজিত সৈনিকের মতো মাটিতে পড়ে থাকা ফয়সালের মাথায়ও তখন ভিন্ন চিন্তা।সূচির মৃত্যু সংবাদকে লাথি দিয়ে সরিয়ে জায়গা করে নিলো নিজের ভাবনা।নতুন ভোরেই যে তান্ডব শুরু হয়েছে তা এতো সহজে শেষ হবে না তা বেশ জানা।সবে গেল ইশতিয়াকের পালা।এরপরে আছে সূচির বাবা।লোকটা নিষ্ঠুর খুব।মেয়েকে মারতেই যার হাত কাঁপে না,সেখানে ফয়সাল তো খুব দূরের কথা।বাপের ছোট মেয়ে,জীবিতাবস্থায় যতোই দুচ্ছাই করুক না কেন মেয়ের মৃত্যুটা তার প্রাণে বাজবে।রক্তের টান বলেও একটা কথা আছে।বাপের প্রাণে সব সইলেও ওটা সইবে না।মমিন শেখ হাতের কাছে পেলে ঠিক কী করতে পারে তা ভাবলেও গায়ে কাটা দেয়।এরপরে আছে সূচির বাড়ির লোক।ওদের বাড়ি বড়,মমিন শেখের বন্ধু-বান্ধবের অভাব নেই বাজারে।গণপিটুনির ভয়ও আছে।এরপরে আসে থানা-পুলিশ।মেরে-ধরে পুলিশের কাছে দিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।এতোগুলো বিপদের কল্পিত ছায়ামূর্তিরা সকাল সকাল নাচছিল চোখের উপরে।এতোকিছু ঠেলে-ঠুলে মৃত সূচির জন্যে শোক জাগলোই না মনে।পিটপিট করে চেয়ে চেয়ে ইশতিয়াকের গতিবিধি লক্ষ করছিল ফয়সাল।ভূমিকে নিয়ে বেরিয়ে যেতেই নাক চাপা দিয়ে উঠে দাঁড়ালো কষ্ট করে।রক্তে ভেসে যাচ্ছিল হাতের তালু।তা ভাসুক,ওতোদিকে নজর দেওয়ার সময় নেই।যে মরেছে সে বেঁচেছে।বসে বসে সূচির কথা ভাবলে চলবে না।বাঁচার অধিকার ফয়সালেরও আছে।শুধু শুধু মার খেয়ে মরবে কেন? যঃ পলায়েতে স জীবতি–অতএব সকাল সকাল গ্রাম ছাড়লো ফয়সাল।পাশের গ্রাম শিবচরে মামা বাড়ি।সেখানে রোমেলা বানু আছে,মামা রমিজ শিকদার আছে।অভিভাবক ছাড়া আর কাউকে ভরসা হলো না সে মুহূর্তে। মায়ের আঁচলটাই তখন সবচেয়ে নিরাপদ।
মামাবাড়িতে ফয়সাল যখন পা দিয়েছে তখন ঘড়ির কাঁটা পৌনে সাতটার একটু এদিক ওদিকে।তেরো বছর বয়সী মামাতো বোন রুমি উঠোনে হেঁটে হেঁটে পড়ছিলো।ফয়সালকে দেখে চমকে উঠলো।চিৎকার করে বললো, ” ছোট ভাইয়া,এই অবস্থা কেন তোমার? এতো রক্ত কেন? ও আব্বু,ও ফুপু দেখে যাও।”
রুমি গমগমা গলায় ছুটে বেরিয়ে এলো সবাই।ফয়সালকে কেউ আশা করেনি এই সকালে।রোমেলা বানু উড়ে গেলেন ছেলের কাছে।নাকের নিচ থেকে বেয়ে পড়া রক্তে দিশেহারা হয়ে গেলেন।ছেলের মুখ,মাথা, বুকে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ” কী হইছে আব্বা তোমার? এই অবস্থা ক্যান?”
” ওরা আমাকে মেরেছে আম্মা।”
“কারা? কাগো এতো সাহস? কোন বেজন্মারা এমন করলো?”
” সূচিরা।”
বসার ঘরের খাটে সোজা হয়ে শুয়ে আছে ফয়সাল।কপালের উপরে বাম হাতটা আড়াআড়ি ফেলে রাখা।প্রাথমিক চিকিৎসার শেষে খাওয়া-দাওয়া সাঙ্গ করে শুয়ে আছে চুপচাপ।অদ্ভুত এক অবসন্নতা ঘিরে ধরেছে ওকে।এলোমেলো ভাবনারা মাথায় ঘুরছে।সে সূচির কথা ভাবছে না,আসন্ন বিপদের কথা ভাবছে না,আঘাতের কথা ভাবছে না,পরিস্থিতির কথা ভাবছে না।ভাবছে বিয়ের আগের কথা।যখন মায়ের আদেশ-নির্দেশই ছিল তার অস্তিত্ব। একটা বাড়ি,একটা খামার,একটা মা ছাড়া আর কেউ তার ছিল না।তখনকার কথা ভাবে যখন সে কারো বর ছিল না, ছিল কেবল মায়ের বাধ্য ছেলে।তখন মা-বউ দুদিক থেকে টানা-হেঁচড়া করে তাকে ক্লান্ত করে তুলতো না।দিনভর কাজ করে রাতেরবেলা শান্তির ঘুম ঘুমাতে পারতো।কেউ কানের কাছে অভিযোগ করতো না,একটু শান্তির আশায় অষ্টপ্রহর ঘ্যানঘ্যান করতো না।কত সুন্দর ছিল তখনকার দিনগুলো! ফয়সাল তখন কত সুখী ছিল!
রোনেলা বানু বসে আছেন মাথার কাছে।ছেলের চুলে হাত বুলিয়ে ফোসফোস করছেন আহত সাপের মতো।মাঝেমাঝে তাচ্ছিল্য করছেন ছেলেকে।
” তোরে বাড়িতে আইসা মাইরা গেল আর তুই কিছু করতে পারলি না! ভাত খাওয়াই না তোরে? বান্দির ঝিয়ের চুলগুলি যদি আমি এইবার না ছিঁড়ছি যায়া।দেহিস তুই।কত সাহস! কালকেই পিঠের উপরে দুইডা দেওন উচিত আছিলো।তোর লেগাই দিতে পারলাম না।পোদ্দারি কইরা আমারে পাঠায়া দিলি এই বাড়িতে।বউয়ের কত বড় গার্জেন হইছোছ তুই! তুমিও কম জানোয়ার না।”
মুখখানি ভারী গম্ভীর করে রমিজ শিকদার এলেন।ভাগ্নের খাটের পাশে চেয়ার টেনে বসলেন।বিয়ের পর থেকে এই চারমাসে বোনের বাড়ি যাওয়ার সুযোগ হয়নি।তার ভেবেছিলেন কিছুদিন পর যেয়ে এবাড়িতে নিয়ে আসবেন নতুন বউকে। দাওয়াত করে খাওয়ানো হয়নি এখনো।কিন্তু এর আগেই এতো কান্ড।কাল বোন আসায় অবাকই হয়েছেন তিনি। খুটে খুটে প্রশ্ন করেছেন কী হয়েছে।রোমেলা বানু যা বলেছেন তা খুব একটা বিশ্বাস হয়নি।বোনকে চেনা আছে তার।বউদের সাথে তার আচরণ কেমন তাও জানেন।তাই বোনের কথা বা অভিযোগ কোনোটাতেই খুব একটা পাত্তা দেননি।ভেবেছিলেন ফয়সালকে জিজ্ঞেস করবেন।এর পেছনে নিশ্চয়ই আরো কান্ড আছে।
” ব্যাপারটা কী হলো ফয়সাল? তোকে তোর দুলাভাই মারলো কেন?”
” মারব না? ঐটা তো ঐ নষ্টার জামাই।বউয়ের ভাউড়া এক্কেরে।নিশ্চিত ঐ ভূমিই শিখায়া দিছে।বাপের মতের বিরুদ্ধে যায়া…
” আহ বুবু, চুপ করো তো।কিছুই জানো না যখন তখন কথা বলো না।বয়স হয়েছে, এবারে মুখটা ভালো করো।ফয়সাল তুই বল।আরে,উঠা লাগবে না।তুই শুয়ে শুয়েই বল।”
” ওরা এসেছে সকালে মামা।ভূমি আর ওর স্বামী।আমাকে বললো সূচিকে ডেকে দিতে।কিন্তু সূচি তো ঘরে ছিল না।আমি কোথা থেকে ডাকব?”
” বউমা ঘরে ছিল না কেন? কোথায় ছিল?”
” ও কাল রাতে সুইসাইড করেছে মামা।নদীতে ডুবে গেছে।”
” কী বললি!”
উত্তেজনায় ঘাম দেখা দিলো রমিজ শিকদারের কপালে। কথাটা যেন বিশ্বাস হতে চায় না।বিয়ের সময় দু-একবারই দেখেছিলেন মেয়েটাকে।রোমেলা বানুর দিকে চেয়ে বিরবিরিয়ে বললেন,
” সূচি সুইসাইড করেছে বুবু! শুনলে তুমি?”
বিস্মিত রোমেলা বানু মাথা নাড়লেন।তিনি শুনেছেন।নির্বিকার মুখে বসে থাকা ফয়সালকে ঠ্যালা দিয়ে নিজেও প্রশ্ন করলেন,” কী কছ? সত্যি কইতাছোছ? হঠাৎ মরতে যাইব ক্যান? আমারে নিয়াই তো সব সমস্যা।কিন্তু আমি তো কালকে বাসায় আছিলাম না।তাইলে মরব ক্যান?তুই মিথ্যা কইতাছোছ না তো?”
মাথা নাড়ে ফয়সাল।
” না আম্মা,সত্যি বলছি।সেই খবর পেয়েই ওরা আমাকে মারলো।”
” ওরা জানলো কী করে?”
” সূচি চিঠি লিখেছিলো।”
” সেখানে লিখেনি কেন মরেছে?”
” লিখেছে।”– থেমে শ্বাস নেয় ফয়সাল।তারপরে মাথা নিচু করে বলে, ” কাল সন্ধ্যায় ওকে বাড়িতে নেওয়ার পরে আমার মাথা খুব গরম ছিল।সারদিন খামারে কাজ করেছি।ভাতের একটা দানাও পেটে পড়েনি।তার উপরে বিকালের কান্ড।খালি পেটে আমার মাথা ঠিক থাকে না।সেখানে এতোগুলো ধকল গেল, বুঝতেই পারছো মামা।মাথা ঠিক ছিল না।”
” মাথা ঠিক ছিল না বলে মেরেছিস বউকে?সত্যি বলবি ফয়সাল।”
ঢোক গিলে দু-দিকে মাথা নাড়ে ফয়সাল।বেমক্কা জোরের সাথে বলে, ” আমাকে তোমার তেমন মনে হয় মামা?বিশ্বাস করো একটুও মারিনি।ওকে ঘরে রেখে তপুদের বাড়ি চলে গিয়েছিলাম রাগ করে।ওখানে খেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়ে গেছিলাম।বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হলো। এসে দেখি ও নেই। ”
” তুই যদি কিছু না করিস তো মরলো কেন?”
” বিকালে ওর বাবা ভরা মজলিসে ওকে মেরেছিল।হয়তো সেই ধাক্কাটাই সামলাতে পারেনি।রাগ-ক্ষোভ-অপমানে মরেছে।”
কথাটা ঠিক বিশ্বাস হয় না রোমেলা বানুর।অস্ফুটে বলেন, ” কী কছ ফয়সাল? ওর বাপে তো আগেও মারতো।বিয়ার পরেও তো দুইবার ফোনে ধমকাইছে অনেক।তহন তো মরে নাই।কালকে বিকালে মারলো দেইক্ষাই আত্মহত্যা করলো!”
মায়ের অবিশ্বাস ঘা মারে ফয়সালকে।মনে হলো সবাই মিলে জোর করে ওকেই দোষী বানানোর চেষ্টা করছে।কপাল চেপে হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো, ” তুমি কেন অবিশ্বাস করছো আমাকে? কেন এখন ঐ মেয়েটার কথা ভাবছো? তোমাকে তো এসব মানায় না।তুমি তো ওকে ভালবাসতে না।তুমি যদি ওকে অথবা আমাদের সংসারটাকে একটু ভালোবাসতে তাহলে তো আজকে এমন হতো না।কেন তুমি কালকে ওকে জুতো ছুঁড়ে মারতে গেলে? তুমি জানতে না যে ওর জ্বর? জানতে,সবই জানতে।তবুও বাড়াবাড়ি করেছো নিজের শাসন বজায় রাখতে।একটা মানুষ একটু বেলা করে ঘুম থেকে উঠতে পারে না? কী হয় উঠলে? মানুষের জান আগে নাকি ঘরের কাজ আগে? একটা মেয়েই আরেকটা মেয়ের বড় শত্রু।তোমার জন্যেই আজ আমাদের এই অবস্থা।আমি তো বিয়ে করতে চাইনি।জোর করে করিয়েছো।যখন সব ভুলে আমি সংসার করতে চাইলাম তখন আবার তোমার বাড়াবাড়ি।শাসনের রশি কিছুটেই ঢিলা করবে না।তোমার জন্য আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেল।তুমিই দোষী। এখন এসেছো আবার আমাকে অবিশ্বাস করতে! তোমার তো আনন্দে নাচার কথা।মরেছে ভালো হয়েছে, আপদ গেছে।”
একটানা এতোগুলো কথা বলে থামলো ফয়সাল।হয়রান হয়ে গেছে।দোষের ডালা মায়ের মাথায় তুলে দিয়ে স্বস্তি পাওয়ার চেষ্টা করলো।এতে যদি নিজেকে একটু ভারহীন মনে হয়।
____________________________
পুলিশ যখন এসেছে তখন ফয়সাল ঘুমিয়ে ছিল।ব্যাথাগুলো বেড়েছে বলে দুপুরের ভাত খাওয়া হয়নি।ক্লান্ত শরীরের ভার বিছানায় বিলিয়ে দিয়ে মরার মতো ঘুমাচ্ছিল।সেই ভারী ঘুম থেকেই টেনে তুলে ধরে নিয়ে গেল পুলিশ।মাটিতে আছড়ে পড়লেন রোমেলা বানু।সঙ্গে বুক ফাটা আর্তনাদ,
” আমার পোলা নির্দোষ।ও কোনো ভুল করতে পারে না।ওরে ওরা ফাসাইতাছে।”
অফিসার শাহাবুদ্দিনের পথ আগলে দাঁড়ালেন রমিজ শিকদার।গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন,
” আমার ভাগ্নের অপরাধ?”
” ভিক্টিমকে মারধর করেছে কাল।”
” মিথ্যে কথা।”
” আপনার কথার সাক্ষ্য-প্রমাণ থাকলে থানায় আসবেন।”
এখানেই তো সমস্যা।তার কাছে মুখের কথাই আছে,প্রমাণ তো নেই।শিবচরে যথেষ্ট পরিচিত রমিজ শিকদার।প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক।খুব প্রাচীন শিক্ষক বলে সবাই তোয়াজ করে।চিরকাল আদর্শ নিয়ে বেঁচেছেন।গন্ডায় গন্ডায় ছেলেমেয়ে তার হাতে মানুষ হয়ে আজ সমাজের মাথা হয়ে বসেছে।স্বাভাবিকভাবেই তার বাড়িতে পুলিশ হানা দিতেই সারা গ্রামে ছড়িয়ে গেল খবরটা।সবাই ভাবলো রমিজ মাস্টারকে ধরতে এসেছে পুলিশ।ছুটে এলো গণ্যমান্য অনেকে।একগাদা প্রশ্নের মুখে অস্থির কন্ঠে ঘোষণা দিলেন রমিজ শিকদার,
” আমাকে না,আমার ভাগ্নেকে ধরে নিয়ে গেছে।”
ছুটে আসা মানুষদের মাঝে তার পুরোনো ছাত্র মুকুলও ছিল।মুকুল আবসার,চেয়ারম্যানের ছেলে।উঠতি বয়স থেকেই রাজনীতি করছে।পৌর ছাত্রসংগঠনের সভাপতি।এমপির পেয়ারের লোক।তার ডানহাত বলা চলে মুকুলকে।গ্রামে তার দাপট আছে।ময়-মুরুব্বিদের সাথে দাপট দেখায় না বটে তবে বিরোধীদলীয় ছেলে-পেলেদেরকে হুমকি-ধমকি দিয়ে তটস্থ রাখে সবসময়। সেই মুকুলই শ্রদ্ধা করে শিক্ষক রমিজ শিকদারকে।ছোটবেলায় আদর দিয়ে পড়িয়েছেন বলে প্রিয় শিক্ষকের বিপদে-আপদে এগিয়ে আসার চেষ্টা করে।এবারেও এলো।ভীড়ের মাঝ থেকে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলো, ” কী হয়েছে স্যার?”
” আর বলো না,একটা মিথ্যা মামলায় ফেঁসে গেছে আমার ভাগ্নে।”
” সমস্যাটা কী?”
আগাগোড়া সমস্যা খুলে বললেন রমিজ শিকদার।সব শুনে ভ্রু কোঁচকায় মুকুল।ভাবুকের মতো বলে,
” ঘুষখোর শাহাবুদ্দিন এতো তাড়াতাড়ি স্টেপ নিলো! নিশ্চিত মেয়েপক্ষের কাছ থেকে টাকা খেয়েছে।আপনি চিন্তা করবেন না স্যার।আমি দেখছি বিষয়টা।”
আশার আলো দেখেন রমিজ শিকদার।মুকুলের ক্ষমতা তিনি জানেন।অনুরোধের সুরে বলেন,
” একটু দেখো বাবা।এসব থানা-পুলিশের কিছুই বুঝি না।ও ঘরে বুবুটা কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়েছে।কি যে করি!”
” আপনি একদম টেনশন নিয়েন না স্যার।একটা ফোনই যথেষ্ট। বেশি তিড়িংবিড়িং করলে এমপি স্যারকে দিয়ে ফোন দেওয়াব।বাপ বাপ বলে ছেড়ে দেব।আগে জানলে নিতেই দিতাম না।আমাদের ছেলেপেলেদেরকে তো ধরতেই পারে না।গরাদে ভরার আগেই জামিন।ঐ ঘুষখোর শালা ধরার কে?”
মুকুল কথা রেখেছে।বোঝা গেল তার দাপটে শাহাবুদ্দিনও প্রভাবিত হয়।দলাদলি নেই দুজনের মাঝে।ছাত্রসংগঠনের প্রত্যেকটা ছেলেকে চেনা তার। অফিসার যেন একটু বেশিই সমীহ করে এই ছেলেটাকে।ফোন না দিয়ে নিজেই থানায় গেল মুকুল।চেয়ারে বসে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো,
” আমার ছোটভাইকে কোন অপরাধে ধরেছেন? মেরেছে যে প্রমাণ দেখান।কত নিয়েছেন মেয়ে পক্ষ থেকে?”
বিগলিত হেসে নুইয়ে পড়লেন অফিসার শাহাবুদ্দিন। মাথা চুলকে বললেন, ” ভাই একটা ফোন দিলেই চলতো,আসা লাগতো না।এসে অবশ্য ভালোই করেছেন।চা-পানি খান।অনেকদিন গল্প-গুজব করা হয় না।”
” গল্প করার টাইম নাই।এমপি স্যারের বাসায় যেতে হবে।ওরে ছাড়বেন নাকি রাখবেন?”
দাঁতে জ্বিভ কাটে অফিসার।
” ছিঃ! ছিঃ! কি যে বলেন।”
ফয়সালকে বগলদাবা করে বেরিয়ে আসার আগে হুশিয়ারি দেয় মুকুল, ” পরেরবার ধরার আগে একটু দেখে-শুনে আনবেন। ভাই-ব্রাদার ধরে আনলে আমাদের সহ্য হয় না।”
সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরলো ফয়সাল।ভীত,অবসন্ন শরীরের ভর টানতে টানতে ক্লান্ত সে।পুলিশে ধরার পরে যে ভয় পেয়েছে তা অস্বীকার করা যাবে না।কে চায় শাস্তি?
বসার ঘরে পা দিতেই রোমেলা বানু ছুটে এলেন।ছেলের আহত মুখ ভরিয়ে দিলেন চুমুতে চুমুতে।
দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে এলেন রমিজ শিকদার।মুখ থমথমে।ফয়সালের কাছ থেকে বোনকে সরিয়ে সজোরে চড় কষালেন ভাগ্নের গালে।ফেটে পড়লেন চরম আক্রোশে।
” তুই অমানুষ,জানোয়ার।কী করে পারলি মেরে ফেলতে মেয়েটাকে? মুকুলকে পাঠানোর আগে পুরো ঘটনা জানলে কিছুতেই তোকে ছাড়িয়ে আনতাম না।আমারও মেয়ে আছে।আরেকজনের মেয়ের সাথে অন্যায় করলি আর আমি তোকে সাহায্য করলাম! ছিঃ! এই আফসোস আমার জীবনে মিটবে না।তবুও না জেনে করেছি,আল্লাহ যদি আমাকে ক্ষমা করে।”
” কী হইছে রমিজ? এমন করোছ ক্যান?”
” তোমার ছেলেকে চুমু দেওয়ার মতো কিছু হয়নি বুবু।ঘরের বউকে মেরে পালিয়েছে ও।জানোয়ার,তোর জেলে পচে মরা উচিত ছিল।ভাগ্যিস হুমায়রাকে ফোন দিয়েছিলাম।নয়তো সত্যিটা জানতেই পারতাম না।এই মুহূর্তে তোমরা বেরিয়ে যাবে বুবু।তোমাদের সাথে আমার আর কোনো সম্পর্ক নেই।তোমাকেও আমি চিনি।বাড়াবাড়ি যে কতটুকু করতে পারো তা জানি।ঘরের বউকে তো কোরবানির গরু ভাবো তোমরা।থাপড়ানোর পর জবাই দেবে।ল্যাঠা চুকে গেল।তাই না?”
সন্ধ্যাবতীর কোলে জেগেছে চিরপরিচিত শুকতারা।কুমড়োফালি চাঁদের আশেপাশে জ্বলজ্বলে তারাগুলো অচেনা।অন্ধকারে মোড়া আকাশটাও অচেনা,চেনা পৃথিবীটাও আজ অচেনা-অজানা।মায়ের হাত ধরে হুট করেই অচেনা হয়ে ওঠা পৃথিবীর বুকে পা বাড়ায় ফয়সাল।মামাবাড়ির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে এগিয়ে চলে সামনে। পরাজিত সৈনিকের মতো এগিয়ে চলে একটি নতুন অধ্যায়ের অশুভ সূচনার পথে।
চলবে…
( পরের পর্ব ইনশাআল্লাহ মঙ্গলবারে।)