গল্প : লারিসা | পর্ব : দশ
সকালবেলা কোনো কাজ না করিয়েই ছেলেটাকে হাসিমুখে বিদায় দেয় লারিসা। যদিও ছেলেটা কাজ করে দেবার শর্তে তার এখানে খাবার খেয়েছে। এবং সে কাজ করতে রাজিও ছিল। কিন্তু লারিসা চায় না কেউ তার কাজে সাহায্য করুক। সে নিজের কাজ নিজে করে নিতে পারে।
একটু একটু রোদ উঁকি দিয়েছে চারপাশে। কাচের দরজা ভেদ করে কিছুটা উজ্জ্বল রৌদ্র এসে পড়েছে শপের মেঝেতে-কার্পেটে। লারিসা এখনও ঘোরের মধ্যে আছে। মাথাটা ভনভন করছে তার। চেয়ারে বসে ঝিমাচ্ছিল সে। হঠাৎ টেবিলের উপর নজর পড়ে তার। প্রথমে খেয়াল না করলেও একটুক্ষণের মধ্যেই নড়েচড়ে বসে লারিসা। দ্রুত চোখ খুলে টেবিলের উপর দৃষ্টি ফেলে দেখে, টেবিলের একপাশে কয়েকটা লোম পড়ে আছে। কুচকুচে কালো, শক্ত লোমগুলো হাতে তুলে নেয় লারিসা। ভালো করে চেয়ে দেখে, এমনই লোম গতকাল রাতে ওই ছেলেটার গায়ে দেখেছিল সে। তার মানে ওটা তার ভ্রম ছিল না! আসলেই ছেলেটার গায়ে এত বড়ো বড়ো পশম গজিয়েছিল!
লারিসা এক মুহূর্তও দেরি করে না।
এক মুহূর্তও না।
ধড়ফড়িয়ে ছুটে যায়। শপ থেকে বেরিয়ে এদিক-ওদিক দেখে নেয়। যতদূর দেখা যায় পুরোটা পরখ করে নিয়ে হতাশ হয়ে পড়ে। নাঃ, ছেলেটাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
কোথায় চলে গেল সে? কেনই বা এসেছিল? কী তার আসল পরিচয়? সে কি আসলেই মানুষ? না কি অন্যকিছু?
অনেক্ষণ হেঁটেছে লি রি।
বাচ্চাকাল থেকে সাধুদের ঘরে বন্দি ছিল সে। বলতে গেলে তার পুরো জীবনটাই একটা ঘরের ভেতরে কেটেছে। আজ অবধি সে উপভোগ করা কাকে বলে জানে না। জীবনটাকে যে উপভোগ করা যায় তা সে এখন অবধি আন্দাজ করতে পারেনি। তবে যখন খাবার কিংবা গোসলের জন্য ফুটন্ত গরম পানি দেওয়ার জন্য জানালা খোলা হত, তখন জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে আকাশ দেখত লি রি। এত সুন্দর আকাশ! এই আকাশটা কত বড়ো? আচ্ছা, ঠিক কতদূর হেঁটে গেলে আকাশটাকে ছোঁয়া যাবে? আচ্ছা, আকাশ দেখে তো মনে হয় সেটা টুকরো টুকরো বরফ আর নীল পানি দিয়ে তৈরি। তাহলে সেগুলো পড়ে না গিয়ে শূন্যে ভেসে আছে কেমন করে?
এমন অদ্ভুত সব প্রশ্ন ঘুরত লি রি’র মাথায়। সব সময় সে মুক্ত হতে চাইত। স্বাধীন হতে চাইত।
আজ সে মুক্ত। কিন্তু তবুও জীবনটাকে উপভোগ করতে পারছে না সে। কারণ সে জানেই না, কীভাবে কী করতে হয়। সে শুধু দু’টো জিনিসই পারে। প্রথমত শামুকের মতো কী একটা জিনিস খাওয়া। আর দ্বিতীয়ত টগবগে জল দিয়ে গোসল করা। এর বাইরে কোনোকিছু তার শেখা হয়নি। তবে গতকাল রাতে সে একটা কফিশপে উঠেছিল। সেখানকার দায়িত্বে থাকা মেয়েটা কী একটা খেতে দিয়েছিল লি রি’কে। খাবারটা খুবই মজার এবং খেতে সহজ। মুখে দিলেই গলে যায়।
ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে এসেছে লি রি। সাধুদের কিছু লোক ছুটে এসেছে এদিকে। সাধারণ মানুষের পোশাক পরে সবার ভিড়ে মিশে গেলেও ওদের চেনা যায়। ওদের চেহারা ভিন্ন, চাহরি তীক্ষ্ণ এবং সজাগ। ওদের চঞ্চল চোখদু’টো স্থির থাকে না কখনো। খুঁজতে খুঁজতে তিনজন তিনদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ওদের একজন লি রি’কে দেখে ফেলেছিল। তবে সঙ্গে সঙ্গে ধেয়ে আসেনি। একটু সবুর করে ঠান্ডা মাথায় স্বাভাবিক ভঙ্গিতে এগিয়ে আসছিল। লি রি টের পেয়ে যায়। অতি সাবধানে লুকিয়ে পড়ে একটা ডাস্টবিনের আড়ালে। ডাস্টবিনের ভেতরে। সাধুদের ওই লোকটা হঠাৎ লি রি’কে হারিয়ে ফেলে অস্থির হয়ে পড়ল। দ্রুত পায়ে এদিক-এদিক এমনকি পাবলিক টয়লেটও বাদ দিলো না। কিন্তু লি রি কোথায় গেল? এদিক দিয়েই তো হাঁটছিল। সাধুটা শুধু একজন অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকের সাথে ধাক্কা লেগে রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল। দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে দেখে, লি রি নেই!
যার সঙ্গে ধাক্কা লেগেছে সে হয়তো ইংরেজি জানে না। তার হাতে থাকা কফি গায়ে পড়েছে বলে আনাড়ি ভাষায় গালি দেয়, “হেই! ইউ শিট! ইউ গাডা ইউজ ইয়োর ফাকিং আই’জ ব্লাডি!” লোকটা হয়তো অস্ট্রেলিয়ান না। কে জানে!
সাধুদের জঙ্গল পেরিয়ে বহুদূর একটি দ্বীপ, যেখানে লারিসার ছোট্ট কফিশপ।
দ্বীপ পেরোলে আবার ছোট্ট বন। তারপর একটা শহর। ছোট্ট স্বপ্নের মতো শহর। শহর থেকে একটু দূরে একলা একটা বাড়ি। দরজায় তালা ঝুলছে সঙ্গে ছোট্ট অ্যাক্রেলিকের সাইন। সেখানে স্থানীয় ভাষায় লেখা, “সেই মেয়েটি, যে তার বাবা-মা’কে হারিয়েছে।”
লি রি পড়াশোনা জানে না। তাই সাইনে কী লেখা আছে তা সে বুঝল না।
সন্ধ্যে নেমে এসেছে।
পালাতে পালাতে ক্লান্ত লাগছে তার। এদিকে সাধুরা তাকে খুঁজতে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। এই মুহূর্তে লি রি’র নিরাপদ আশ্রয় দরকার। সাথে কিছু খাবারও। শহরের একপাশে নির্জন এলাকায় ছিমছাম বাড়িটার সামনে এসে থমকে দাঁড়ায় লি রি। বাড়ির চারপাশে বড়ো বড়ো গাছ, লতাপাতা আর…
দরজায় তালা ঝুলছে। সুতরাং নক করে লাভ নেই। কিন্তু লি রি’র আশ্রয় লাগবে।
এ-বাড়িতে কেউ নেই বলেই হয়তো এত আগ্রহ হলো লি রি’র। প্রথমেই দরজা ভাঙার চেষ্টা করল না সে। কারণ ঘরের বাঁ দিকেই আছে কাচের স্লাইড উইন্ডো। সেটা ভেঙে ফেললার পর গ্রিল ভাঙা সহজ ছিল না। প্রায় দুই ঘন্টা চেষ্টা করে অবশেষে জানালার গ্রিল আলাদা করতে পারল লি রি।
ভেতরে ঢুকেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল সে। যাক! অবশেষে থাকার মতো একটা ঘর পাওয়া গেল! কিন্তু এই ঘরটা কার?
একদিন পর বাসায় ফিরেছে লারিসা।
তার বাড়িটা শহর থেকে একটু আলাদা। মানুষের ভীড় থেকে একটু দূরে। এই একলা একা জীবনই তার ভালো লাগে।
তালা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল লারিসা।
সুইচ টিপলেও বাতি জ্বলছে না। অর্থাৎ বিদ্যুৎ নেই। হলঘর থেকে ক্যান্ডেলটা তুলে আনে লারিসা। ক্যান্ডেলের আলোয় ফ্রিজ খুলে দেখে খাবার মতো কিছু নেই। একটা কোল্ডড্রিঙ্কের ক্যান তুলে নিয়ে শোবার ঘরের দিকে পা বাড়ায়।
শপ থেকে ফেরার পথে সে খেয়ে এসেছে। তবুও খিদে পেয়েছে খুব। এই মুহূর্তে কিছু তৈরি করে খাওয়ার ইচ্ছে নেই। ঢকঢক করে কোল্ডড্রিঙ্কের ক্যানে চুমুক দিয়ে ডাস্টবিন বরাবর ছুড়ে ফেলে সেটা। তারপর যখনই ধপাস করে জুতো সুদ্ধ বিছানায় ঢলে পড়ে, তখনই তার মনে হয়, আগে থেকেই কেউ একজন ঘুমুচ্ছে!
এক লাফে দূরে সরে যায় লারিসা।
ভয়ে হাত-পা কাঠ হয়ে আসে তার। ঘনঘন নিঃশ্বাস নিতে নিতে সে বিছানার দিকে তাকায়। বাইরের ঘরে ক্যান্ডেল জ্বলছে। দরজা সামান্য খোলা থাকায় এ-ঘরে মৃদু আলো এসেছে। সেই আলোয় আবছা দেখা যাচ্ছে, কেউ একজন পা থেকে মাথা অবধি চাদর দিয়ে ঢেকে ঘুমিয়ে আছে।
লারিস ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়ায়।
আস্তে আস্তে বিছানার দিকে এগিয়ে যায়।
তারপর সতর্ক হাতে চাদর ধরে জোরে হেঁচকা টান দিতেই এমন কিছু দেখতে পায় যা দেখে তার মাথা ঘুরে যায়। বিস্ময়ে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, “ও মাই গড!”
চলবে
মো. ইয়াছিন