#ধারাবাহিক
#রাখি_আগলে_তোমায়_অনুরাগে ( চতুর্থ তথা শেষ পর্ব )
#কলমে — অর্পিতা চক্রবর্তী
রাইয়ের লড়াই অব্যাহত রয়েছে । নিয়মিত সুমনকে নিয়ে মনোবিদের কাছে হাজিরা দিতে হয় । যে মানুষটি প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে, সসম্মানে এতোবছর ধরে চাকরি করেছে , সে আজকাল নিজের জামাকাপড়টাও একাকী পরতে পারে না । এসব দেখে রাইয়ের দুচোখ অবাধ্য হয়ে ওঠে কিন্তু কাঁদার বা দুঃখ করার সময় অথবা পরিস্থিতি কোনোটাই তার নেই । মনোবিদ বললেন যে বিভিন্ন কারণ যেমন– চাকরি সংক্রান্ত ঝামেলা , সংসারে রাইয়ের সাথে সুমনের বাড়ির লোকজনের সম্পর্কের অবনতি, সর্বোপরি সন্তান হারানোর যন্ত্রণা সুমনকে অসুস্থ করে তুলেছে । যদি সে সকলের সাথে নিজের মনের কথা শেয়ার করতে পারতো তাহলে এই অবস্থা হয়তো হতো না । কিন্তু অন্তর্মুখী মানুষের খুব সমস্যা, তারা মন খুলে কথা বলতে পারে না ফলে ভিতরে ভিতরে কষ্ট পায় । বাড়ির লোককেই এখন তার প্রতি সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে ।
সুমনের অসুস্থতা রাইকে আরও নাকাল করে তুলেছে । জীবন এরই মধ্যে তাকে অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়েছে । সুমনের অফিস থেকে সহকর্মীরা, কর্তাব্যক্তিরা নিয়মিত খবরাখবর নেন । সুমনের অসুস্থতা একদিকে শাপে বর হলো কারণ হেড অফিস থেকে তাকে কোলকাতায় বদলি করে দিলো । ডক্টরের পরামর্শ মেনে এখন অনেকদিন তাকে ছুটিতে থাকতে হচ্ছে । এরই মধ্যে একদিন শ্বশুর মশাই এবং শাশুড়ি মা রাইকে জানালেন যে তাঁরা শীতকালীন ভ্রমণে যেতে চান । সেইমতো ব্যাবস্থা করে তাঁরা চলে গেলেন । রাই অবাক হতেও ভুলে গেছে । তাঁরা নিজেদের অসুস্থ ছেলেকে, ছোট নাতিটিকে রাইয়ের উপর চাপিয়ে বেড়াতে চলে গেলেন, অন্যদিকে রাই বাবিকে ভালো করে বুঝিয়ে বাড়িতে তালাবন্ধ করে রেখে সুমনকে ডক্টরের কাছে নিয়ে গেলো । সেদিন থেকেই রাই বুঝলো সে সম্পূর্ণ একা । নিজের শারীরিক সমস্যার কথা চিন্তা করে বাবিকে আগেই কিছু কিছু কাজকর্ম শিখিয়েছিলো, এবার তাকে নিজের খাবার তৈরি করা শিখিয়ে দিলো । তাতে করে অন্তত বাচ্চাটিকে অনাহারে থাকতে হবে না ।
সুমন ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে । তবে তার সমস্যা একদম কমে যায় নি । কোনো বিষয়ে , যেটা সাধারণত মানুষ পাত্তাও দেবে না, সেই বিষয়েও সে টেনশন করতে থাকে । তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনাতেও সে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে , তার হাত পা জ্বালা করে , মাথা ব্যথা করে । তবু সে সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে । রাই প্রতিনিয়ত সুমনের কাছ থেকে খুঁটিনাটি বিষয় জিজ্ঞাসা করে । তার হাতে হাত রেখে বলে, ” আমি তো আছি “। রাই আরও ভেবেছে যে সুমনের স্বার্থেই সুমনের বাড়ির লোকজনের সাথে বিশেষ করে শাশুড়ি মায়ের সাথে কোনো সংঘাত এড়িয়ে চলবে । ওঁর স্বভাব সে পাল্টাতে পারবে না, তুলনায় নিজে চুপচাপ থাকাটাই ভালো । উনি চেঁচামেচি করেন , রাই সব শোনে কিন্তু চোখ বন্ধ করে এক থেকে তিরিশ গোনে, এতে তার মন বেশ শান্ত হয় । তবে কখনো কখনো সেও চেঁচামেচি করে আবার একই রুটিনে ফিরে আসে, যতোই হোক মানুষ তো ।
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
‘ তুমি হাসলে আমার ঠোঁটে হাসি
তুমি আসলে জোনাকি রাশি রাশি
রাখি আগলে তোমায় অনুরাগে
আর কিকরে বোঝাই ভালোবাসি ।।’
রাই আর সুমনের জীবন আবার সমে ফিরে এসেছে । সমস্ত ঝড়, ঝাপটা থেকে তারা দুজন দুজনকে আগলে রাখার চেষ্টা করে । গাটছড়া বেঁধে, অগ্নিকে সাক্ষী রেখে সাতপাকে ঘোরার সময় তারা পরস্পরের বিপদে আপদে পাশে থাকার , পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস রাখার যে শপথ গ্রহণ করেছিলো, দুজনেই তা রক্ষা করে চলে । রাই জানে নিজের স্বামী ও পুত্রের জন্য ভালো থাকা ছাড়া তার আর কোনোও অপশন নেই । খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে থাকা সংসারকে সে টেনে এনেছে । তারা তিনজন একে অপরকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকে , ভালো থাকে ।
সকলের ভালোবাসা উচ্চকিত হয় না । প্রতিদিন সন্ধ্যায় চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সংসারের কথা, বাবির পড়াশোনা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করে তারা । ছুটির দিনে দুজনে মিলে ঘর পরিষ্কার করে, কাজকর্ম ভাগ করে নেয় । রাই সুমনের পছন্দসই খাবার বানায়, সুমন অফিস থেকে ফেরার সময় রাইয়ের পছন্দের কোনো জিনিস নিয়ে আসে । আবার একে অপরের কাছে কিছু দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে যায় । হয়তো এগুলোই তাদের কাছে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ । তাদের জীবন দূর্বা ঘাসের মতো । হয়তো চাপা পড়ে যাবে, বিবর্ণ হয়ে যাবে, তবু একদিন সব প্রতিবন্ধকতাকে দূরে সরিয়ে মাথা উঁচু করে উঠবে ।
তাহলে সেই দ্বিতীয় পর্বের ঘটনাটির কি হলো ? সেটি কি বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে ? একেবারেই নয় । আজও প্রতি বছর সেই নির্দিষ্ট দিনটিতে রাই ঠাকুরের সিংহাসনের নীচে একটি মোমবাতি জ্বালায় । সেইদিন বাবি জানতে চায় ” আজ কি পূজা ?” রাই নিরুত্তর থাকে । আর প্রতি বছর সেই নির্দিষ্ট দিনটিতে রাই আর সুমন সেই বিষয়টি নিয়ে একে অপরের মুখোমুখি হয় । অকপটে স্বীকার করে যে আজও তারা ভোলেনি । রাই কাজকর্মের ফাঁকে, সুমন অফিসে বসে আনমনা হয়ে যায়, ভাবে আজ তার কতো বয়স হতো । তাদের অন্তরে বাবির পাশেই আছে একটি ছোট মেয়ে, যার পরনে গোলাপী অথবা সাদা ফ্রক, মুখখানি আবছা । ?
********************************
একজন মা তাঁর সন্তানকে গর্ভে ধারন করেন, পিতা ধারন করেন নিজ হৃদয়ে । মা যখন চান তাঁর সুন্দর সন্তান হোক, তখন তিনি সম্ভবত সন্তানের সার্বিক মঙ্গল ও সুস্থতা কামনা করেন কারণ তিনি জানেন যে মায়ের অবর্তমানে কেউ বাচ্চাকে দেখবে না । কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই থাকতে পারে । সুন্দর অসুন্দর তো যার যার নিজের ধারণা, একটা সামাজিক কনসেপ্ট । তবে অনেক সময় আমরা দেখি হাত, পা না থাকলেও মানুষ বাঁচে, কষ্টকর হলেও বাঁচে । কিন্তু এর বাইরেও অনেক কিছু হয় সাধারণ বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা মেলেনা । তখন মনে হয়, এমনটাও হতে পারে ?
ডিপ্রেশন নিয়ে একটা চলতি ধারনা রয়েছে যে সেটা একটা কাল্পনিক অসুখ, দুঃখ বিলাস । কাওকে কাওকে বলতে শুনেছি, ” কুড়িটা ড্রেস পেলেই ওসব ডিপ্রেশন পালিয়ে যাবে । ” মনখারাপ এক জিনিস, গভীর অবসাদ বা clinical depression অন্য বস্তু । কখন, কোথায়, কেন, কে এতে আক্রান্ত হবেন তা জানা যায় না । কখনো কখনো অপ্রাপ্তি, দুর্ঘটনা, নির্যাতনের অথবা লাঞ্ছনার শিকার হওয়া মানুষকে অবসাদগ্রস্ত করে তুলতে পারে । আমি চিকিৎসক নই, তবে এটুকু বলতে পারি যে আপনার কাছের মানুষটির মধ্যে সামান্য অস্বাভাবিকতা অথবা পরিবর্তন দেখলেই সাবধান হয়ে যান । তাঁর চিকিৎসা করাতে হবে , তাঁর দিকে সহযোগিতা ও সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে । আর সবসময় পজিটিভ ভাবনা চিন্তা করুন, মনের জোর বজায় রাখুন । হসপিটালে গেলে দেখবেন আপনার থেকেও কষ্টকর অবস্থায় কতো মানুষ রয়েছেন । সুশান্ত সিং রাজপুতের মতো পাবলিক ফিগারের অকাল প্রয়ানে আপনি কষ্ট পেয়েছেন, আপনার পাশের ঘরের মানুষটির যদি একই সমস্যা হয়ে থাকে তাহলে তাকে বিদ্রুপ না করে বরং সাহস যোগান । আপনার সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গি একজন মানুষকে নতুন জীবন দিতে পারে । মনে রাখবেন ,
‘ যতই আঁধার হোক রাত্রি কালো
জানবে ততই কাছে ভোরের আলো ।।’
নিজের অন্তর্নিহিত শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সব বাধা বিপত্তিকে অতিক্রম করে জিতে যাক প্রতিটি নারী, প্রতিটি মানুষ ।
******************************************
পরিশেষে বলতে চাই , যাঁরা এই কদিন ধরে আমার লেখা পড়লেন, সহ্য করলেন তাঁদের অসংখ্য ধন্যবাদ । আপনাদের মূল্যবান মতামত আমাকে সমৃদ্ধ করে, আমার ভুলগুলো সংশোধন করতে সাহায্য করে । আপনাদের মতামত পেলে খুব খুশি হবো । আর আমি অ- সুর ( অর্থাৎ গলায় সুর নেই ) হলেও গান শুনতে খুব ভালোবাসি , তাই বিভিন্ন গানের কলি ব্যবহার করলাম ।
( সমাপ্ত )