রজনীগন্ধা, পর্ব:১০

0
792

রজনীগন্ধা – ১০
অলিন্দ্রিয়া রুহি

দোলা খুশিমনে ব্যাগ গোছাচ্ছে। কণ্ঠ খাঁদে নামিয়ে গুনগুনিয়ে গানও গাচ্ছে। ব্যাগ গোছানোর কারণ সে বাপের বাড়ি চলে যাচ্ছে। একেবারের জন্যে নয়, অভি বলেছে আপাতত কয়েকদিন বাবার বাড়ি গিয়ে থাকতে। শহরের দিকে ভালো একটা ঘর ভাড়া করে তারপর দোলাকে নিয়ে আসবে সে। এদিকেই একটা দোকান নেওয়ার জন্য কথাবার্তা পাকা করেছিল অভি, তবে সেটি আর হচ্ছে না। অবশ্য দোলা বলেছে, দোকানের জন্য চিন্তা না করতে। শহরে অসংখ্য দোকান খালি পাওয়া যায়। দরকার পড়লে দোলা তার বাবার থেকে আরও লাখ দুই টাকা এনে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। তবুও অভির দোকান দেওয়ার স্বপ্ন জলে ভেসে যেতে দেবে না। তাই শুনে অভি কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত হয়েছে।

জহুরা বেগম রান্নাঘরের দাওয়ার উপর চুপচাপ বসে রয়েছেন। তার পাশে পানের থালা পড়ে রয়েছে, সে মুখ ঘুরেও তাকাচ্ছেন না। তার চোখেমুখে উদাসীনতা। অভি যে এতটা পর হয়ে যাবে- তা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি তিনি। কত বড় সাহস তার! বলে কীনা দোলাকে নিয়ে আলাদা হয়ে যাবে? হোক… শান্তিতে থাকুক সে। মায়ের দোয়া ছাড়া কতটা শান্তিতে থাকা যায় সেও সেটা দেখে নিবে।

শুভ’র বউ আনিকা এসে জিজ্ঞেস করল,
-আম্মা, দুপুরে কী রানবো?

-যা মন চায় তাই রানধো বউ। আমারে জিগাইয়ো না।

-আপনি সকালেও কিছু খান নাই। দুইটা পাতলা রুটি আলুভাজি দিয়ে এনে দেই?

-দরকার নাই।

আনিকা বড় একটি শ্বাস ফেলে জহুরা বেগমের পাশে বসল। কপালে এক হাত ঠেকিয়ে বলল,
-আপনার ভেতর কী চলতেছে, আমি একটু হইলেও বুঝতে পারতেছি আম্মা। থাক, কষ্ট নিয়েন না। তাগো সুখ তারা বাইছা নিতাছে। নিতে দেন। একদিন ঠিকই আপনের পায়ের কাছে আইয়া পড়ব।

-বদদোয়া দিও না তো বউ।

-না আম্মা। বদদোয়া না। তার বউয়ের এতটুকু কষ্টও তার সহ্য হয় না! হায়রে মাইয়াগো সংসারই তো সব। আমি আসলাম আর কয় বছর হইলো। কোনোদিন সংসারে আরাম করার চিন্তা করছি? করি নাই। আলাদা হওয়ারও চিন্তা করি নাই। চিন্তা কইরা লাভই বা কী? আমি চাইলেও কোনোদিন আলাদা হইতে পারুম না। শুভ তো আর অভি না।

আনিকা দাঁত দিয়ে জিভ কাটলো কথাটি বলেই। ভুলবশত মুখ দিয়ে কিছু সত্য কথা বেরিয়ে গেছে। জহুরা বেগমের দিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়েই আঁতকে উঠল ভেতরে ভেতরে। জহুরা বেগম ক্রুর চোখে তাকিয়ে রয়েছেন তারই দিকে। আনিকা হাসার চেষ্টা করল কিন্তু তার মুখ দিয়ে হাসি বের হলো না। অস্ফুটস্বরে সে কিছু একটা বলতে নেওয়ার আগেই জহুরা বেগম কঠিন স্বরে বলে উঠলেন,
-কী বলতে চাও তুমি বউমা? তুমিও আলাদা হইতে চাও? আমার সংসারে কীয়ের কাম এতো? আরাম পাও না?

-আপনার সংসারে কীয়ের কাম? সেইটা আপনি যদি করতেন তাইলে বুঝতেন। বিনা টাকায় চাকর পাইছেন তো তাই টের পান না কীয়ের কাম!!
কথাগুলো মনে মনে বললেও মুখে বলে উঠার সাহস করতে পারল না আনিকা। জোরপূর্বক একটি হাসি ঠোঁটে এঁকে সে উঠে দাঁড়াল।
-যাই আম্মা। অনেক কাম বাকি…
বলে কোনোরকমে পড়িমরি করে ছুঁটলো সে। তার যাওয়ার পানে কঠিন দৃষ্টিতেই তাকিয়ে রইলেন জহুরা বেগম। একসময় সেই দৃষ্টি শীতল হয়ে এলো। আপাতত আনিকা ছাড়া তার ভরসার আর কেউ নেই। এক ছেলে তো বউয়ের প্রতি দেওয়ানা হয়ে গেছে। তার জন্য মা’কে পর্যন্ত ছাড়ার কথা চিন্তা করে ফেলেছে। অপর ছেলেও যদি এমন করে তবে শেষ বয়সে বউদের লাথি-গুতো খেয়েই দমটা ছাড়তে হবে জহুরা বেগমের। বুক চিঁড়ে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাসটি কোনোভাবেই আঁটকে রাখতে পারলেন না জহুরা বেগম।

কিছুক্ষণ আগেও বেশ ঝলমলে রোদ ছড়িয়ে ছিল চারিপাশে। তারপর হঠাৎ কখন, কীভাবে যেন কালো মেঘ এসে বিচরণ করতে লাগল আকাশের বুকে। ঠিক যেন রজনীর মনের মধ্যে বিচরণ করতে থাকা আদ্র বাবু! হ্যাঁ, এই ক’দিনে আদ্রকে নিয়ে প্রচুর ভেবেছে সে। অবশ্য সে যে ইচ্ছেকৃত ভাবে ভাবতে চেয়েছে তা কিন্তু নয়। আশেপাশের অবস্থা, পরিস্থিতি আর নাছির উদ্দীন নামক লোকটি তাকে ভাবতে বাধ্য করেছে। সেদিন অতিরিক্ত উত্তেজনার ফলে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল রজনী। তবুও আদ্র’র দেওয়া চিৎকারটি তার কর্ণকুহর অবধি পৌঁছেছিল। তারপর যখন চোখ খুললো, সে নিজেকে আবিষ্কার করেছে তার ঘরে। আশেপাশে সবাই উদ্বিগ্ন মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিল, অর্থিও ছিল, শুধু ছিল না আদ্র সাহেব। সেই দিনটির পর কেটে গেছে চারটি দিন.. আর রবিবার। অথচ এই চারটি দিনের একদিনেও আদ্র সাহেবের দেখা পায়নি রজনী। আদ্র ঢাকাতেই নেই। কোথায় গেছে তাও সে জানে না। অর্থিকে একবার জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছিল, আদ্র নাকি সেদিনই শ্যুটিং-এর উদ্দেশ্যে আউটডোরে গেছে। তবে নাছির উদ্দীন কে এই ব্যাপারে খোলাখুলি ভাবে জিজ্ঞাসা করেও তেমন কোনো উত্তর পায়নি রজনী। নাছির উদ্দীন বারবার তাচ্ছিল্য করে বলেছেন,
-যাকে লজ্জিত করতে পারো তার জন্য এত চিন্তা কীসের? সে যেখানে আছে, থাকুক না। তোমার কী তাতে?

প্রতুত্তরে কিচ্ছুটি বলতে পারেনি রজনী। বলার মতো মুখ থাকলে তো বলবে! রজনীর একেমন অভ্যাস, সে নিজেও জানে না। তবে যতবারই অতিরিক্ত উত্তেজিত হয় সে, ততবার খানিকক্ষণের জন্য জ্ঞান হারায়। এটি কেমন রোগ- আল্লাহ মাবুদই ভালো জানেন। এই ক’দিনে আদ্র সাহেবকে প্রচুর অনুভব করেছে রজনী। অর্থিকে জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছিল,সেদিন রাতে আদ্র সাহেব আর অনুপমার মধ্যে কী কী কথা হয়েছে তার সবটাই… আদ্র আর মুক্তির ডিভোর্সের ব্যাপারটা রজনী আগেই জানতো। টেলিভিশনেই এই ব্যাপারটি নিয়ে একসময় তুমুল হৈচৈ হয়েছিল। তখন একদল মুক্তিকে নিয়ে নানান কটু কথা বললেও আরেক দল আদ্রকে নিয়ে বিভিন্ন রকমের বাজে কথা ছড়িয়েছিল। তাই আসল সত্যটা এত ভালো করে জানত না রজনী। অর্থির মুখ থেকে সবটা শোনার পর তার নিজের কাছেই প্রচুর খারাপ লাগে। আর সেখানে আদ্র তো নিজেই ভুক্তভোগী! রজনী নিজেই ভালোবাসা হারিয়েছে। তাই সে বোঝে ভালোবাসা হারানোর ব্যথা কতখানি! তার উপর যদি ভালোবাসার মানুষটাই ধোঁকা দেয়, তাহলে তো ক্ষতবিক্ষত মনের ভেতর সূচের আঘাত করা!

বুক চিঁড়ে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস সশব্দে বাতাসে মিশিয়ে দিয়ে ধীরস্থির পায়ে নিচে নেমে আসে রজনী। হালকা হালকা শীত করছে তার। সিজনটাই এমন- কখনো গরম তো কখনো ঠান্ডা! অর্থির রুমে উঁকি দিয়ে দেখল, অর্থি এখনো ঘুমোচ্ছে। এই মেয়েটা এত ঘুমোতে পারে! অবাক হলেও মৃদু হাসে রজনী। কোনো শব্দ না করে ধীরে ধীরে বিছানার দিকে এগিয়ে আসে রজনী। অর্থির ঘুমন্ত মুখপানে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবে, সে যদি আদ্রকে বিয়ে করে তবে তো অর্থি তার মেয়ে হয়ে যাবে। আচ্ছা জন্ম না দিলে কী আপন মেয়ে হওয়া যায় না? রক্তের সম্পর্কই কী সবচেয়ে বড় সম্পর্ক?
অর্থির কপালে আলতো করে একটি চুমু এঁকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে রজনী। আদ্র’র রুমের সামনে এসে থামলো। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়েই রইল। আদ্র তো ঘরে নেই, তবুও এক অদ্ভুত ধরনের জড়তা কাজ করছে রজনীর ভেতর। মনে হচ্ছে ঘরের ভেতর বের হলেই আদ্র’র মুখোমুখি হতে হবে তাকে। আদ্র নিশ্চয়ই কঠিন দৃষ্টিতে তাকাবে। ঘৃণা ভরা কণ্ঠে বলবে,
-আপনি এখানে কেন? বেরিয়ে যান আমার রুম থেকে। আর কক্ষনো আমার ঘরে ঢোকার সাহস করবেন না বলে দিলাম। আপনি খুবই বাজে.. আপনার কারণে সবসময়, সব জায়গায় অপমানিত হতে হয় আমাকে!!

মৃদু নিঃশ্বাস ফেলে রজনী। নিজের মাথায় নিজেই হালকা চাটি মেরে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল। পুরো রুমটার চারিদিকে ভালো করে চোখ বুলালো সে। তারপর এগিয়ে গেল ক্লজেটের দিকে। একটি টি-শার্ট বের করে আনলো রজনী। আদ্র সাহেব বাসায় থাকাকালীন প্রায় সময় এই টি-শার্টটি পরত। এটি তার খুব পছন্দের টি-শার্ট গুলোর একটি বোধহয়! টি-শার্টটি নাকের কাছে নিয়ে লম্বা করে নাক টেনে নিল রজনী। সঙ্গে সঙ্গে একধরনের বিদ্যুৎের মতোন কিছু তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছুটে চলে গেল। পাজরে পাজরে ধরল কাঁপন। হাড় পর্যন্ত কাঁপছে। এই অদ্ভুত অনুভূতির নাম কী?

নিচ থেকে একজন মহিলার গলার আওয়াজ ভেসে আসতেই রজনীর হুশ ফিরলো। ক্লজেটের ভেতর টি-শার্টটি রেখে সে দ্রুত নিচে নামতেই বিস্ফোরিত চোখ মেলে দেখল, মুক্তি তার দিকেই তাকিয়ে আছে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here