#রঙ_বেরঙের_জীবন
পর্ব (১৭)
#নুশরাত_জাহান_মিষ্টি
পলাশ নিজের ঘরে থ মেরে বসে আছে। এখন মনে হচ্ছে রহিমা বেগমের পিছু না নিলেই বোধহয় ভালো হতো।
রহিমা বেগমের পিছু না নিলে হয়তো জীবনটা রঙীন থাকতো। যে সত্যির মুখোমুখি সে হয়েছে, তারপর কি আদো তার জীবনটা রঙীন হবে।
পলাশের সমস্ত মস্তিষ্ক জুড়ে শুধু একটিই কথা, “তার আম্মা খুনি”।
পলাশ মনেমনে নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়ে বললো,” না এবার আম্মার থেকে সব সত্যি জানতেই হবে”।
সকালে রফিক সাহেব কাজে বেরিয়ে যেতেই পলাশ গিয়ে রহিমা বেগমের মুখোমুখি দাঁড়ালো। রহিমা বেগম পলাশকে দেখে বললেন,” আইজ কাইল বাড়ি থাইকাও তোর কোন দেহা পাওয়া যায় না”।
পলাশ কঠিনভাবে বলে উঠলো,” হয়তো আর কোনদিন চোখের দেখা দেখতে পাবে না”।
রহিমা বেগম কেঁপে উঠলেন। পলাশ এটা কি বললো!
” মানে”?
” আমার প্রশ্নের উত্তর দেও আম্মা “?
” প্রশ্ন? কিসের প্রশ্ন”?
রহিমা বেগম বেশ ভয় পাচ্ছেন। পলাশের আজকের ব্যবহার তার ঠিক লাগছে না। যদিও পলাশ পূর্বে একবার রুপরে নিয়ে প্রশ্ন করেছিলো কিন্তু তখন পলাশের চোখমুখে এতটা রাগ ছিলো না। যেটা আজকে দেখা যাচ্ছে।
” কিভাবে খুন করলে? কেন খুন করলে”?
রহিমা বেগমের আত্মা কেঁপে উঠলো। পলাশ এটা কি বললো! খুন!
” খুন? কা কার খুন”?
” কালরাতে যার খুনির কথা নিয়ে আলোচনা করছিলে তার খুনের কথা বলছি আমি”।
” পলাশ তুই কি কইতেছোস? আ আমি কিছু বুঝতাছি না”?
” আমাকে রাগাবে না আম্মা। জীবনে সবসময় আমি তোমার পাশে ছিলাম। তোমার খুশির জন্য রাতকে কখনো বোন ভাবিনি। রাতকে বোন ভেবে বুকে টেনে নিলে তুমি কষ্ট পাবে, এটা ভেবে কখনো রাতের দিকে ভাইয়ের নজরে তাকাই নাই আম্মা। যেখানে ভুলটা রাতের বা আমাদের কারোই ছিলো না। ভুল হোক বা অপরাধ সবটাই ছিলো রফিক সাহেবের”।
একটু থেমে পলাশ পুনরায় বললো,” ভুল কিন্তু রাইসা আন্টিরও ছিলো না আম্মা। সে তো না জেনে একটা ভুল মানুষের সাথে সংসার গড়ে ছিলো। কিন্তু তোমাদের দূর্ভাগ্য যে সেই ভুল মানুষটা তোমাদের দু’জনের জীবনেই প্রবেশ করেছিলো। এখানে তার দোষটা কোথায়! কিংবা রাতের দোষ কোথায়! তবুও তাদের শাস্তি দিলে কেন আম্মা? কেন রাতের জীবনটা নষ্ট করলে”?
রহিমা বেগম বসে পড়লেন। তার বলার মতো কিছুই নেই৷ পলাশ সব জেনে গেছে এখন তার কাছে লুকানোর মতো কিছু নেই। তিনি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললেন,” রাতের জীবনডা নষ্ট হয় নাই। শান্ত তো ভালো পোলা, ভালো চাকরি করে। ওর সাথে রাত ভালো থাকবো। সময়ের সাথে একদিন রুপকে ভুইলাও যাইবো”।
পলাশ পূর্বের থেকে দ্বিগুন রাগ নিয়ে বললো,” শান্ত ভালো ছেলে, তার সাথে রাত ভালো থাকবে। এসব ভেবে তুমি বিয়ে দিয়েছিলে বুঝি। শান্তর সাথে বিয়ে হওয়ার পূর্বে রাতের ভালো থাকা রুপের মধ্যে ছিলো। যদি রাতের ভালো থাকা তখন ভাবতে তবে রুপের সাথেই রাতের বিয়ে হইতো আম্মা। তোমার রাগ, যন্ত্রণা মেটানোর হলো সেই অমানুষটার সাথে মেটাও না যে তোমার সাথে অন্যায় করেছে। মেটানোর জন্য রাতের জীবন নিয়ে কেন খেললে আম্মা? আসল দোষীকে শাস্তি দিতে পারোনি অথচ অন্যকে দিয়ে বুকের জ্বালা মেটাচ্ছো। সত্যি করে বলো তো তোমার বুকের জ্বালা সত্যি মিটেছে”?
রহিমা বেগম কিছু বলতে পারলেন না। তিনি চুপ করে রইলেন। পলাশ কঠিনভাবে শেষ একটি কথা বলে চলে গেলো।
” আমি চলে যাচ্ছি আম্মা। যেদিন তোমার বুকের জ্বালা মিটবে সেদিন ডেকো ভুল আর ঠিকের হিসাব করতে। কিন্তু হ্যাঁ সন্তান হিসাবে কখনো ডেকো না। আমার জীবনে বাবা, মা কাউকে প্রয়োজন নেই। তোমরা তোমাদের বুকের জ্বালা ভালোভাবে মেটাও”।
পলাশ চলে গেলো। পিছনে ফিরে আর তাকায়নি।
__________
শান্ত আজও রাত্রীকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছে। আজ রাত্রীর মুখে বিষন্নতার হাঁসি নেই, তবে মুখ দেখে মনে হচ্ছে বেশ ভাবনায় আছে। একটা নিরিবিলি স্থানে রাত্রীকে দাঁড় করিয়ে শান্ত দু’জনের জন্য আইসক্রিম আনতে চলে গেলো।
বেশ কিছুক্ষন পর শান্ত দু’টো আইসক্রিম নিয়ে চলে এলো। একটা রাত্রীর হাতে তুলে দিলো অন্যটা নিজে নিলো।
রাত্রী খুশিমনে আইসক্রিম খাচ্ছিলো হঠাৎ করে শান্ত তার আইসক্রিম রাত্রীর গালে মাখিয়ে দিলো। রাত্রীর মনটা বিষন্নতায় ভরে গেলো। রাত্রীকে মনমরা দেখে শান্ত বললো,” দুঃখিত। তোমার এসব পছন্দ না তাই তো? আমার ভুল হয়ে……”।
শান্ত সম্পূর্ণ কথাটি শেষ করতে পারলো না তার পূর্বেই রাত্রী বললো,” রুপ এরকম মজা করতো। শুধু রুপ নয় আমিও। আমরা দু’জন সেটা খুব উপভোগ করতাম”।
নিমিষেই শান্তর মনটাও বিষন্নতায় ভরে গেলো। শান্তর স্বার্থপর মনটা বলে উঠলো,” খুব কি ক্ষতি হতো সময়টা আমাদের দু’জনের হলে? এখানে রুপের আসার কি খুব প্রয়োজন ছিলো”?
শান্ত ‘ওহ আচ্ছা’ বলে চুপ করে গেলো। রাত্রী শান্তর ব্যপারটা বুঝতে পেরে বললো,” ভালোবাসা এত সহজে ভোলা যায় না শান্ত। ছোট ছোট মূহুর্তগুলো তাকে মাঝেমাঝে মনে করিয়ে দেয়”।
” আমি বুঝতে পেরেছি”।
রাত্রী আকাশের পানে তাকিয়ে একমনে বললো,” মারা যাওয়ার মানুষগুলোকেও সহজে ভোলা যায় কিন্তু হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে ভোলা যায় না। সেখানে হারিয়ে যাওয়া মানুষটি যদি হয় ভালোবাসা”!
শান্ত মলিন হাঁসলো। তারপর বেশ কিছুক্ষন ঘুরেফিরে তারা চলে গেলো।
পলাশ এবং সাথী পাশাপাশি বসে আছে। সাথী বেশ স্বাভাবিকভাবে বললো,” রুপকে খুঁজে বের করাটা কি খুব জরুরি”?
” জরুরি নয় বলছো”।
” তা নয়। বেশ তো আছে শান্ত এবং রাত। তাদের জীবনে বর্তমানে রুপ তৃতীয় ব্যক্তি”।
” তৃতীয় ব্যক্তি”?
কথাটি বলে পলাশ কিছুটা হাঁসলো। তারপর বললো,” রুপ রাতের প্রথম ভালোবাসা। আমরা আদো জানি না দ্বিতীয় ভালোবাসা হিসাবে শান্ত রাতের মনে যায়গা করতে পেরেছে কি পারেনি”?
” আজ না পারলেও একদিন ঠিকি পারবে। শান্তও সেই আসায় আছে”।
” আসাটা পূরণ হলে আমার কোন সমস্যা নেই। শান্তর আসার জন্য রুপ বিপদে আছে জেনেও তারে বাঁচানোর চেষ্টা করবো না এটা ঠিক নয়”!
সাথী ভাবুক হয়ে পড়লো। পলাশ পুনরায় বললো,” শান্ত এবং রাতের জীবনে রুপ ফিরে আসলে তাদের আলাদা হওয়ার সম্ভবনা আছে, এটা ভেবে আমরা রুপের মৃত্যুটা আসা করতে পারিনা নিশ্চয়”?
সাথী এবার সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো। পলাশ সাহস করে সাথীর হাতে হাত রাখলো তারপর বললো,” চিন্তা করো না। যা ঘটার তাই ঘটবে”।
সাথী মনেমনে বেশ খুশি হলো। প্রথমবার পলাশ নিজ থেকে তার হাত ধরলো। কথাটা ভেবেই তার নাঁচতে ইচ্ছে করছে।
_________
রুপ খাবার খাওয়ার জন্য খাবারের থালায় হাত রাখতেই মেয়েটি রুপের হাত থেকে থালাটি নিয়ে ফেলে দিলো। রুপ হাঁসি দিয়ে বললো,” খাবার না খাইয়ে মারবা বুঝি”?
মেয়েটি মলিন হেঁসে বললো,” এই খাবারে বিষ মেশানো ছিলো রুপ”।
রুপের মুখশ্রী থেকে হাঁসি বিলীন হলো না। মুখে হাঁসি ধরে রেখেই বললো, ” তো আটকাইলেন ক্যান”?
” আমি চাই না তুমি মারা যাও”।
” আমার বাঁইচা থাকায় আপনের কি লাভ”?
” আমার কোন লাভ নেই। তবে আমি চাই না তুমি মারা যাও”।
মেয়েটি একটু থেমে পুনরায় বললো,” বাহিরে দুটো লোক পাহারায় আছে তাদের চোখ এড়িয়ে আমি তোমারে পালিয়ে যেতে সাহায্য করবো, পালিয়ে যাও রুপ”।
” পালিয়ে কার কাছে যাইবো”?
” কেন রাতের কাছে? তোমার রাতের কাছে”?
রুপ অট্টহাসি দিয়ে বললো,” পূর্বেই বলছি অধিকার নাই”?
” কেন অধিকার নেই? তুমি তো ইচ্ছে করে বিয়ে না করে আসোনি! তোমারে আটকে রেখে ওর বিয়ে শান্তর সাথে দেওয়া হয়েছে। এখানে তোমার কি দোষ”?
” আমার ভুল নাই তা যেমন ঠিক। তেমন রাতের জীবন অন্যকারো সাথে জুড়ে গেছে। যার সাথেই রাতের জীবন রঙীন হইয়া উঠবো। আমি এহন রাতের জীবনে যাওয়া মানে তার জীবনডা বেরঙের ছায়ায় ভরিয়ে দেওয়া”।
” ভালোবাসো না রাতকে”?
” বাসি তো”।
” তাহলে তাকে পেতে চাওনা কেন”?
” কতবার বলবো অধিকার নাই। ভালোবাসলেই যে তারে পাইতে হইবো তেমনও কথা নাই”।
মেয়েটি মুখে হাঁসি ফুটিয়ে বললো,” তোমারে আমি কেমন প্রেমিক বলবো জানি না তবে ভালোবাসার অনেক রুপ। যার একটা রুপ তুমি রুপ আমারে শিখিয়েছো”।
একটু থেমে পুনরায় বললো,” রাতের জন্য না হোক পরিবার জন্য চলো পালিয়ে যাও। এখান থাকলে তোমারে মরতে হবে”।
” আমারে পালাইতে সাহায্য কইরা নিজের বিপদ বাড়াচ্ছো না”?
মেয়েটি কিছু না বলে রুপের হাত ধরে বাহিরে নিয়ে যাওয়ার জন্য এগোতেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকে দেখে কেঁপে উঠলো। লোকটির চোখেমুখে রাগের জ্বলন্ত আভা দেখা যাচ্ছে। লোকটি নিজেকে সামলাতে না পেরে ‘রুহি’ বলে চিৎকার দিয়ে মেয়েটির গালে একটি থাপ্পড় বসিয়ে দিলো।
পুরো রুমজুড়ে থাপ্পড়ের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে।
চলবে,
[ভুলক্রটি ক্ষমা করবেন। পরবর্তী পর্ব সন্ধ্যার পর]