রঙ তুলির প্রেয়সী ১৭+১৮

0
1498

রঙ তুলির প্রেয়সী
১৭+১৮

‘সাহিল, বল দে। তাড়াতাড়ি দে বল, ও তো অলরেডি দুই রান নিয়ে নিছে। আরে ওই চুলকাইস পরে আগে বল দে বে।’

জোরে জোরে চিল্লাচ্ছে রিয়াদ। জাওয়াদ দের ছোট মামার ছেলে, সাত বছর বয়সি সাহিলের কানে এই চিৎকার পৌঁছাচ্ছেই না। সে মাঠে বসে বল হাতে নিয়ে উবু হয়ে পা চুলকাচ্ছে। একটা ছেলে গিয়ে বল চেয়েছিলো কিন্তু সে দেয়নি। ওর চুলকানো শেষ হলে পরে সে বলটা ইটা মেরে রিয়াদের কাছে দিবে। কিন্তু ওর তো চুলকানো ও শেষ হচ্ছেনা। কেউ জোর করে আনতেও পারছেনা। জোর করে আনতে গেলেই মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেয়ে কাঁদবে। যতোক্ষণে ওর চুলকানো শেষ হলো ততোক্ষণে জাওয়াদ জিতে গিয়েছে দৌড়ে দৌড়ে ছয় রান নিয়ে। রিয়াদ কোমরে হাত দিয়ে রাগী চোখ নিয়ে তাকালো সাহিলের দিকে। সাহিল দুহাতে বল ধরে ঠোঁট উল্টে দাঁড়িয়ে থাকলো। জাওয়াদ হাসতে হাসতে সাহিলের কাছে গিয়ে ওর গালে একটা চুমু খেলো। সাহিল বললো, ‘আমি এক্ষুণি ইটা মেরে স্টাম্প ফেলে দিতাম। শুধু মশাটা কামড় দিয়ে বাগড়া দিলো।’

‘এখন রিয়াদ ব্যাটিংয়ে যাবে। ফেলে দিস ওর বেলা।’ বলে হাসলো জাওয়াদ।

রিয়াদ এগিয়ে এসে বললো, ‘এইজন্যেই আমি তোকে নেইনা খেলায়। দুধভাত বানাই। এমনভাবে চুলকানো শুরু করলি যেন তোর খুজলি হইছে।’

‘এমন করলে কিন্তু বল দেবোনা। এটা আমার বল। তখন কীভাবে খেলো দেখে নেবো।’ বলে একবার মুখ ভেংচি দিলো সাহিল।

রিয়াদ বড় বড় চোখ করে বললো, ‘কতো বড় ব্ল্যাকমেইলার বে তুই! একেতো স্কুল থেকে এসে ফ্রেশ না হয়েই খেলতে এসছিস তার ওপর হুমকি দিচ্ছিস? ছোট মামাকে বলে দেবো কি আমি যে গোসল করিসনি এসে?’

সাহিল কাঁদো কাঁদো হয়ে জাওয়াদের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ভাইয়া দেখো রিয়াদ ভাইয়া কেমন করছে।’

জাওয়াদ রিয়াদকে একটা ধমক দিলো। সাহিল তা দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসলো। জাওয়াদ রিয়াদের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘শোন, এই কাদার মধ্যে আমি আর থাকতে পারবোনা। খেল তোরা। আমি গেলাম।’

‘বুঝি বুঝি, কেন যেতে চাচ্ছিস।’ চোখ টিপ দিলো রিয়াদ।

জাওয়াদ হাঁটতে হাঁটতে পিছু ফিরে তাকিয়ে বললো, ‘এক চামচ বেশি বোঝার অভ্যাস টা ছাড় রিয়াদ। এটা অপকারী।’

রিয়াদ হাসলো। তারপর সাহিলের মাথায় আস্তে করে একটা গাড্ডা দিয়ে বললো, ‘চল বলটা অভিক কে দে। আর চুপচাপ এইখানে দাঁড়িয়ে থাক। বল আসলে ধরিস।’

‘আচ্ছা।’ বলে দাঁড়িয়ে থাকলো সাহিল।
____________

সিঁড়িতে বসে হাঁপাচ্ছে আর কাঁদছে তিথি। হা করে নিশ্বাস নিচ্ছে। নাকে অনেক পানি ঢুকেছে মনে হচ্ছে, জ্বলছে নাকে। অনেক পানি গিলেছেও। একটু পর পর কাশছে সে। কাঁদতে কাঁদতে উঠে দাঁড়ালো তিথি। তারপর কাপড় পাল্টাতে লাগলো। তার মনে হচ্ছে সে যেন এক্ষুণি মরার মুখ থেকে ফিরে এলো। পানিতে যখন মনে হচ্ছিলো যে এক্ষুণি সে ডুবে যাবে, কিন্তু এখনও কেউ আসছেনা, তখনই আল্লাহর নাম নিয়ে এলোমেলো ভাবে হাত নেড়ে নেড়ে কোনোমতে সামনে এগিয়ে এসেছে। এইভাবে এগিয়ে আসতে গিয়ে অনেক পানি নাকেমুখে ঢুকেছে তার। সিঁড়িতে এসে কোনোমতে পা ফেলে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে নিশ্বাস নিলো সে। একটু আগের কথা যতোবারই মনে হচ্ছে তিথির, ততোবারই তার কান্না বাড়ছে। ভেজা কাপড় পাল্টে আবার গিয়ে এজটা শুকনো সিঁড়িতে বসলো তিথি। কান্না থামছে না তার। নুহা এমন করলো কেন ভেবে পাচ্ছেনা তিথি। কাউকে নিয়ে এলো না কেন? তিথি যদি মরে যেতো? এসব ভাবতেই আরো বেশি কান্না পেলো তিথির। দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলো সে এবার শব্দ করে।

পায়ে একটু একটু কাদা লেগে আছে জাওয়াদের, তাই সে বাড়িতে ঢোকার আগে পুকুরে আসলো পা ধুতে। কিন্তু এসে দেখলো কেউ একজন বসে বসে কাঁদছে শব্দ করে। মাথায় তোয়ালে পেছানো, পেছন থেকে বোঝা যাচ্ছেনা কে। জাওয়াদ জিজ্ঞেস করলো, ‘কে? কী হয়েছে?’

তিথি মাথা তুললো। কণ্ঠটা শোনার সাথেসাথেই চিনেছে সে। পেছন ফিরে তাকালো সে। তিথিকে দেখে অবাক হলো জাওয়াদ। সে তাড়াতাড়ি তিথির পাশে গিয়ে অবাক কণ্ঠে বললো, ‘তিথি! কী হয়েছে? কাঁদছো কেন তুমি?’

তিথি উঠে দাঁড়ালো। এক মুহূর্তও দেরি না করে দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো জাওয়াদকে। তারপর হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। ঐ মুহূর্তে জাওয়াদের মনে হলো তার শরীরে কেউ বিদ্যুতের তার ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে। বারংবার বিদ্যুৎ খেলছিলো তার সর্বাঙ্গে। কোনোরকমে কাঁপা কাঁপা হাত দুটো সে তিথির পিঠে রাখলো। জাওয়াদের শরীর অসাড় হয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু সে নিজেকে কোনোমতে সামলালো। ঢোঁক গিললো। আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হয়েছে, তিথি? কাঁদছো কেন? আমাকে বলো।’

তিথি কিছু বলছে না। কেঁদেই যাচ্ছে। জাওয়াদ একটু ধাতস্থ হলো। তার মাথায় এলো, তিথি এখানে একা। তারপর খেয়াল হলো তিথির মাথায় তোয়ালে পেছানো, মানে সে গোসল করেছে। এক মিনিট, তিথি তো সাঁতার জানেনা! জাওয়াদ তিথিকে ছাড়িয়ে তার দু’কাঁধে হাত রেখে চোখের দিকে তাকালো। তিথি তখন কান্না বন্ধ করেছে। জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। তার চোখ মুখ অস্বাভাবিক রকমের লাল। জাওয়াদ জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হয়েছে? এই অবস্থা কেন তোমার? নাক মুখ এমন কেন?’

তিথি কিছু বলতে নিলো আর তখনই পেছনে আদিয়ার গলা শোনা গেল, ‘তিথি! কী হয়েছে? বড় ভাইয়া, কী হয়েছে?’

উদ্ধিগ্ন হয়ে ছুটে এলো আদিয়া। তার পেছন পেছন ফাহি। তিথি তখন মোটামুটি স্বাভাবিক। সে নিচের দিকে তাকিয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলো। জাওয়াদ বললো, ‘ওকে একা এখানে আসতে দিলি কেন? তোরা কেউ এলিনা কেন?’

‘আরে নুহাপু নিয়ে এসেছিলো তো। পরে নুহাপু চলে গেল ঘরে। জিজ্ঞেস করতেই বললো তিথি ওর সামনে গোসল করতে সংকোচ বোধ করছিলো আর বলেছিলো নাকি সে একা পারবে। তাই চলে গেছে।’ তিথির পাশে এসে দাঁড়িয়ে দু’হাতে তিথিকে ধরে বললো আদিয়া। ফাহিও একই কথা বললো। তিথি এই কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লো। সে এমন মোটেও বলেনি। আর নুহা এমন কথা বললো কেন? এভাবে ওকে এখানে ফেলে গিয়ে… নাহ, গড়মিল আছে কিছু একটা। কিন্তু সেটা কী?

‘হোয়াট! তোরা নুহার সাথে ওকে এখানে পাঠিয়েছিস?’ চেচিয়ে ওঠে জাওয়াদ। তিথি কেঁপে ওঠে জাওয়াদের চিৎকারে।

‘কেন কী হয়েছে? আমরা খেলছিলাম তাই…’ ভয়ে ভয়ে বললো আদিয়া। ফাহি একেবারেই নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে মাথা নিচু করে। জাওয়াদ রাগে দাঁতে দাঁত ঘষে। মাটিতে পা দাপায় দু’বার। তারপর তিথির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কী হয়েছিলো তিথি? সত্যি করে বলো।’

‘কি-কিছুনা!’ ঢোঁক গিলে তিথি। জাওয়াদকে দেখে ভয় পাচ্ছে সে। সত্যিটা বলে দিলে যে এখন কিয়ামত হয়ে যাবে সেটা ভালোই টের পাচ্ছে সে। রাগে জাওয়াদের চোখ মুখ লাল হয়ে আছে।

‘কিছুনা তো এখানে বসে কাঁদছিলে কেন? আর নাক মুখ লাল কেন?’ চেচিয়ে উঠলো আবার জাওয়াদ।

তিথি আবার কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘মায়ের কথা মনে পড়ছিলো। মাও পুকুরে গোসল করতো।’

জাওয়াদ যেন একটু নরম হলো। সে বললো, ‘ঠিক আছে কেঁদোনা। যাও ভেতরে যাও।’

তিথি উবু হয়ে বসে নিজের কাপড় কাচতে লাগলো। জাওয়াদ বিরক্তি নিয়ে ফাহি আর আদিয়ার দিকে তাকালো। ফাহি তাড়াতাড়ি বললো, ‘এই তিথি, কাপড় কাচার মানুষ আছে। তুমি উঠে আসো তো।’

তিথি নিঃশব্দে উঠে গেলো। আদিয়া তিথির হাত ধরে বাড়ি নিয়ে যেতে লাগলো। যাওয়ার সময় পেছন ফিরে দেখলো তিথি। জাওয়াদ তাকিয়ে আছে। তিথির মনে পড়লো, একটু আগে সে জাওয়াদের আষ্টেপৃষ্টে ছিলো। তখন একদম লজ্জা লাগেনি। কিন্তু এখন যেনো সমস্ত লজ্জা এসে জড়ো হলো তিথির দু’গালে। তিথি মুখ ফিরিয়ে হেসে দিলো।

যাকে ভালোবাসা যায়, তার চোখের ভাষা নাকি পড়া যায়? সে মিথ্যা বললে নাকি চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝে ফেলা যায়? তিথির চোখের দিকে তাকিয়ে জাওয়াদের মনে হয়েছিলো, তিথি মিথ্যা বলছে। কিছু একটা হয়েছিলো যা তিথি আড়াল করেছে। একইভাবে তিথিরও মনে হয়েছে, তার মা-কে মনে পড়ার যে মিথ্যা কথাটা সে বলেছে সেটা জাওয়াদ বিশ্বাস করে নি। একদম করে নি।
__________

চলবে……..
@ফারজানা আহমেদ

রঙ তুলির প্রেয়সী
১৮.

ঘরে আসতেই মুনতাহার মুখোমুখি হয়ে গেল ওরা তিনজন। মুনতাহা আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘আরে তিথি, এ কী অবস্থা! এই মুখ এমন লাল কেন? চোখও লাল। ও আল্লাহ! কী হইছে রে মা?’

তিথি একটু হাসার চেষ্টা করে বললো, ‘আসলে পুকুরে গোসল করিনা তো কোনোদিন, ডুব দিতে গিয়ে একটু নাকেমুখে পানি ঢুকেছে। আমি ঠিক আছি মামণি।’

‘সাবধানের মার নেই। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে জ্বর আসতে পারে। একটা নাপা খেয়ে নিও। এই ফাহি, আমার ঘরের লাকড়ির আলমারির ড্রয়ারে পাবি ঔষধের বক্সটা।’ চিন্তিত মুখে বললেন মেহেরুন।

‘আচ্ছা। মা, দাদু কোথায়?’ বললো ফাহি।

‘পাশের বাড়ি।’

‘ফুলতরি খালাদের?’

‘হ্যাঁ।’

‘আবার ঝগড়া লাগালো নাকি ঘরের বউ!’ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো ফাহি। চাঁনতারা বেগমকে মুরব্বি হিসেবে গ্রামের মহিলারা অনেক সম্মান করে। তাই মহিলারা নিজেদের ঘরে কোনো ঝামেলা হলেই উনাকে এসে হাতে পায়ে ধরে নিয়ে যায় সমাধানের জন্য।

আদিয়া টুনিকে ডেকে বলে দিলো তিথির কাপড়গুলো ধুয়ে আনতে। তিথি আর আদিয়া সেখান থেকে প্রস্থান করলো। ফাহি এখনও দাঁড়িয়ে রইলো। একটু ইতস্তত করে সে মুনতাহার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘উম, ফুপি… সাহিল আসেনি এখনও?’

মুনতাহা মুচকি হাসলেন। বললেন, ‘আমার ছেলেটা অনেকদিন পরে ক্রিকেট খেলছে তো। মনে হয়না সন্ধ্যার আগে ওকে পাওয়া যাবে।’

ফাহি কথাটার কোনো ফিরতি জবাব না দিয়ে এক প্রকার দৌড়ে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে। আল্লাহ! মুনতাহা বুঝে গেছেন সে রিয়াদকে খুঁজেছে। ইশ, কী লজ্জা! ফাহি বেরিয়ে যেতেই মুনতাহা ও মেহেরুন মুখ টিপে হাসলেন।
______________

তিথিকে দেখে চমকে উঠলো নুহা। ঢোঁক গিললো। ভয়ে কথা বলতে পারছেনা সে। বিছানায় বসে হা হয়ে তাকিয়ে আছে তিথির দিকে। তিথি… কীভাবে উঠে এলো? বলে দিলো নাকি সব! ঢোঁক গিলে আদিয়ার দিকে তাকালো নুহা। আদিয়া স্বাভাবিক ভাবেই বিছানায় বসে মোবাইল দেখতে লাগলো। নুহা খানিক অবাক হলো। কিছু বলছেনা কেন তাকে? এমন সময় তিথি এসে নুহার সামনে দাঁড়ালো। বললো, ‘নুহাপু, একটু জায়গা দিবে? কিছুক্ষণ ঘুমাতাম। আসলে অনেক পানি নাকেমুখে গেছে তো, জ্বর আসতে পারে বলে এক্ষুনি নাপা খেলাম।’

‘হ-হ্যাঁ।’ বলে উঠে দাঁড়ালো নুহা। তিথি চুপচাপ শুয়ে পড়লো। নুহা যারপরনাই অবাক। কপাল কুঁচকে তাকালো তিথির দিকে। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে তিথি। নুহা আদিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আদিয়া, আমার না মাথাটা একটু ধরেছে। ছোট মামার ঘর থেকে একটু ভিকস টা এনে দিবি?’

তিথি চোখ বন্ধ করেই হাসলো। আদিয়াকে সরিয়ে দিচ্ছে নুহা। অবশ্যই এখন তিথির সাথে কথা বলবে। ঠিক তাই হলো আদিয়া যাওয়ার পর। নুহা বিছানায় বসেই তিথির দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো, ‘এবার বলো তো। মতলব কী তোমার?’

‘কিসের মতলব?’ চোখ বন্ধ অবস্থায়ই বললো তিথি।

‘একদম ভং করো না তিথি। আমার সাথে ভং করে কেউ টেকে না।’

তিথির মেজাজ ক্ষণে ক্ষণে বিগড়ে যাচ্ছে। কিন্তু কষ্ট করে সামলিয়ে নিচ্ছে। চায়না এখন এখানে কোনো ঝামেলা হোক ওর জন্য। তিথি চোখ খুললো। শুয়া থেকে উঠে বসতে বসতে শীতল গলায় বললো, ‘প্রশ্নটা তো আমার ভাগের। তুমি করলে যে?’

‘মানে?’ কপাল কুঁচকালো নুহা।

‘মানে টানে বুঝতে হবেনা। শুনে রাখো, আমাকে যেমন শান্ত দেখছো আমি মোটেও এতো ভালো মেয়ে নই। ভবিষ্যতে আমার সাথে লাগার পরিণতি একটু বেশিই খারাপ হবে।’ একদম স্বাভাবিক কিন্তু তেজী গলায় বললো তিথি।

রাগ এবার চেহারায় ফুটে উঠলো নুহার। নিঃশ্বাস দ্রুত চলতে লাগলো তার। সে ফোঁস ফোঁস করে কিছু একটা বলতে গিয়েই দেখলো আদিয়া চলে এসেছে। তাই চুপ হয়ে গেল কিন্তু নিজেকে সামলাতে পারছেনা। আদিয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হয়েছে নুহাপু?’ বলে তিথির দিকে তাকিয়ে আবার বললো, ‘তুই উঠে বসলি কেন?’

‘এতোক্ষণ লাগে আনতে? আমি মরে যাবো ব্যথায়? যত্তসব!’ গজগজ করতে করতে বললো নুহা।

‘যাহ বাবা! খুঁজে আনবো তো নাকি?’ বললো আদিয়া।

নুহা আর কিছু না বলে ভিকস টা নিয়ে বেরিয়ে গেল। আদিয়া আনমনেই বলে উঠলো, ‘এর আবার কী হলো?’

তিথি আবার শুয়ে পড়লো। তারপর নিজের হাসিকে আটকে রাখার কঠিন চেষ্টা চালাতে চালাতে বললো, ‘বিচুটি পাতার ঘষা লেগেছে।’

‘কী? কী বললি? বিচুটি পাতা আসলো কোত্থেকে?’ কপাল কুঁচকালো আদিয়া।

‘উফ, চুপ করে বসতো। আমি ঘুমাবো।’ বলে পাশ ফিরে চোখ বন্ধ করলো তিথি। প্রচণ্ড হাসি পাচ্ছে তার।
_____________

জাওয়াদ দের নানাবাড়ির ঠিক ডানদিকে কিছু ঝোপঝাড় পেরিয়েই একটা টিনের ঘর আছে। যেখানে মাত্র একটাই রুম, অনেক বড়। সব কাজিনরা আসলে সেখানে গিয়ে সবাই মিলে আড্ডা বসায়। আজও তাই হয়েছে। জাওয়াদ, রিয়াদ, ফাহি, আদিয়া, নুহা, তিথি। সবাই মিলে ফ্লোরে শীতল পাটি বিছিয়ে আড্ডা জমিয়েছে কেবল। সাথে আছে গরম গরম আলুর চপ আর পিঁয়াজু। টুনি আর ড্রাইভার আবদুল কেও রাখা হয়েছে। একটু পরে লাফিয়ে লাফিয়ে সাহিলও এসেছে। সাহিলকে দেখেই রিয়াদ বললো, ‘এই, পড়া রেখে এখানে কী?’

সাহিল দাঁত কেলিয়ে হেসে বললো, ‘টিচারকে আসতে মানা করে দিয়েছি ফোন করে। বলেছি বাসায় মেহমান, বসার জায়গা নাই। হিহি!’ আবারও দাঁত কেলায় সাহিল।

‘ব্রিলিয়ান্ট, খালি শয়তানি বুদ্ধিতে।’ হেসে বললো জাওয়াদ। তারপর তাকালো ঠিক সামনাসামনি বসা তিথির দিকে। হেসে হেসে কথা বলছে ফাহি আর আদিয়ার সাথে। এতো গল্প করতে পারে মেয়েটা! হাসলো জাওয়াদ। জাওয়াদের হাসি দেখে শরীরে আগুন ধরে যাচ্ছে নুহার। জাওয়াদ হাসছে! তাও ঐ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে। নুহা একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো তিথির দিকে। কোনোরকমে নিজের রাগ সামলিয়ে হাসার চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু চোখেমুখে রাগ তার স্পষ্ট।

‘আচ্ছা শোনো শোনো, এবার খেলা শুরু হবে।’ দু’হাত উঁচু করে সবাইকে থামিয়ে বললো আদিয়া।

‘কিসের খেলা?’ কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো জাওয়াদ।

ফাহি পাটির ওপর রাখা বাটি দেখিয়ে বললো, ‘এই বাটিতে অনেকগুলো কাগজ আছে। এখানে কিছু টাস্ক লেখা আছে, যার হাতে যেটা আসবে সেই টাস্ক তাকে পুরো করতে হবে।’

‘ড্যাম, তোদের এসব ফিল্মি খেলাধুলা। খেল তোরা আমি গেলাম।’ বলে উঠে যেতে নিলো জাওয়াদ। জাওয়াদ যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াতেই নুহা বললো, ‘খেল না, মজা পাবি।’

কথাটা যেন কানেই গেলোনা জাওয়াদের। নুহার মুখটা ছোট হয়ে গেল। জাওয়াদ দরজার কাছে যেতেই তিথির গলা শুনলো। তিথি বলছে, ‘ছাড়ো না, সবাই আবার সবকিছু পারে না।’

জাওয়াদ থমকে গেল। ফিরে এসে আবার জায়গায় বসলো। তারপর তিথির দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত ভাবে হেসে বললো, ‘আজ দেখাবো, কী কী পারি।’

এই হাসিটা দেখে একটা ধাক্কা খেলো তিথি। অস্পষ্ট ভাবে বিড়বিড় করলো, ‘এখনথেকে আর তোমাকে মোগ্যাম্বো বলবোনা। হ্যান্ডু বলবো। শোনো মিস্টার হ্যান্ডু, এতো হ্যান্ডসাম লাগা পাপ!’

নুহার মুখটা অপমানে থমথমে হয়ে গেল। জাওয়াদ তার কথাকে পাত্তা দিলো না। অথচ এই মেয়েটার একটা কথায় এসে বসে গেল! ভেতরের বন্য রূপটা যেন এক্ষুণি বেরিয়ে আসতে চাইলো। সে তাকিয়ে থাকলো জাওয়াদের দিকে।

‘অকে অকে এবার শুরু করো তো!’ বললো রিয়াদ।

‘আচ্ছা তাহলে সবার আগে কে কাগজ তুলবে?’ বলে এক এক করে সবার দিকে তাকালো আদিয়া।

‘আমি আমি, আমি তুলবো আমি।’ লাফিয়ে উঠে বললো সাহিল। তারপর একটা কাগজ তুলে আনলো। সেটাতে ছোট করে ‘নাচ’ লেখা। সাহিল ঠোঁট উল্টে বললো, ‘আমিতো এখনও ঐ নাচটা শিখিনি ভালোমতো।’

‘কোন নাচ?’ জিজ্ঞেস করলো ফাহি।

‘ঐযে, মেরে ব্রাদার কি দুলহান। তোমার আর রিয়াদ ভাইয়ার গায়ে হলুদে আমি এটাতে নাঁচবো আমার বন্ধুদের নিয়ে।’ হেসে হেসে বললো সাহিল।

লজ্জায় মাথা নিচু করে একেবারে গলার সাথে থুতনি লাগিয়ে ফেললো ফাহি। এমন কিছু সাহিল বলবে এটা সে আশাও করেনি। রিয়াদ হাসছে, হেসে দেখছে ফাহির লজ্জারাঙা মুখ। তার দারুণ লাগছে। নুহা বললো, ‘তুই এটাতে নাচবি কেন রে? তোর ভাইয়ের বিয়ে নাকি? বোনের বিয়ে।’

‘কেন ভাইয়ের বিয়ে হবেনা কেন? রিয়াদ ভাইয়া আমার ভাই না? তাছাড়া মিষ্টিপু আমাকে খালি বকাবকি করে। রিয়াদ ভাইয়াও লাগালাগি করে, তবে মিষ্টিপু থেকে কম। তাই আমি রিয়াদ ভাইয়ার পক্ষে।’ বিজ্ঞের মতো বললো সাহিল। এই কথা শুনে সবাই হেসে ফেললো। ফাহি লজ্জা পেয়ে লাল হয়ে গেল। এভাবে বিয়ের কথা উঠলে লজ্জায় তার মরে যেতে ইচ্ছে করে। জাওয়াদ বললো, ‘আমি আসছি। দেখিয়ে দিচ্ছি।’

বলে সাহিলের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। আদিয়া তার মোবাইলে গানটা ছেড়ে দিলো। জাওয়াদ খুব সুন্দর ভাবে অঙ্গভঙ্গি করে নাচলো। দু’একটা স্টেপ দেখালো সাহিলকে। জাওয়াদ যখন নাচছিলো তিথি তখন হা করে দেখছিলো। তার বুক কাঁপছিল অজানা কারণে। কাউকে এই একটু নাচতে দেখলেও এভাবে ভালো লাগে? তিথির এখন আফসোস হলো, ইশ! যদি একবার ডুয়েট ডান্স করার সুযোগ পেতো জাওয়াদের সাথে!

একে একে সবার টাস্ক সবাই পুরো করলো। টুনির টাস্ক ছিলো গান গাওয়ার। ভালো না গাইলেও খুব একটা খারাপ গায় নি সে। তবুও আব্দুল তাকে খ্যাপানোর জন্য বলেছিলো, ‘এতো বেসুরাই যহন গাস তাইলে গাইতে নিলি ক্যা? ইশরে বাবা, আমার কানে জ্বলতাছে।’

কথাটা শুনতেই টুনির রাগ হলো। সে আদিয়ার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে চলে গেল সেখান থেকে। আব্দুল একটু কাচুমাচু করলো। জাওয়াদকে সে ভয় পায়। তাই রিয়াদকেই আস্তে আস্তে বললো, ‘ভাইজান, ইকটু যাইগা আমি? আপনেরা খেলেন।’

রিয়াদ হেসে বললো, ‘খুব খেয়ালে কিন্তু, আব্দুল। কেউ যাতে না বোঝে।’

আব্দুল সব দাঁত বের করে হেসে বললো, ‘আরে না না, এইগুলানে বহুত ইক্সপার্ট আছি।’

হাসলো রিয়াদ। আব্দুল চলে গেল। নুহা বললো, ‘এবার তাহলে জাওয়াদের পালা।’

জাওয়াদ বিরক্তি চোখে তাকালো নুহার দিকে। নির্লজ্জ মেয়েটাকে সহ্যই হচ্ছেনা তার। সে ছোট করে বললো, ‘রিয়াদ, যা কাগজ তোল।’

নুহা ঢোঁক গিয়ে তাকিয়ে থাকলো। এতোবার, এতোবার ক্ষমা চাওয়া পরেও কেন এই অবহেলা? কেন এই ব্যবহার?

কাগজে লেখা আসলো, একটা সিনেমার নাম একজনকে অভিনয় করে বুঝাতে হবে। এবার জাওয়াদ হইহই করে উঠলো। বললো, ‘আমি আমি, আমি নাম দেবো।’

রিয়াদ বললো, ‘ না তুই না। এইখানে লেখা নাই কিন্তু কেউ দিবে। আমি নিজেই যেকোনো একটা দেখিয়ে দেবো।’

‘না না, এটাই নিয়ম। আমি নাম দেবো, আর বলে দেবো কাকে বুঝাতে হবে।’

অনেক তর্কাতর্কি করার পর হার মেনে নিলো রিয়াদ। বললো, ‘অকে ফাইন। বল।’

জাওয়াদ কানেকানে সিনেমার নাম বলতেই হেসে দিলো রিয়াদ। জাওয়াদও হাসলো। নিজের জায়গায় গিয়ে বসতে বসতে জাওয়াদ বললো, ‘ফাহি, তোমাকে বুঝাবে। তুমি বুঝে নামটা বলবে।’

‘আচ্ছা।’ বলে মন দিয়ে তাকালো রিয়াদের দিকে ফাহি। রিয়াদ আর জাওয়াদ দুজনের মুখেই দুষ্টু হাসি। তিথি জাওয়াদের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা খেয়াল করলো। কিন্তু কিছু বুঝলোনা। বুঝলো তখন, যখন দেখলো রিয়াদ অভিনয় করে ফাহিকে দেখাচ্ছে। দুই ভাইয়ের শয়তানি হাসির রহস্য এবার পরিষ্কার হলো। হেসে দিলো তিথিও। ফাহি ক্রমশই লজ্জায় লাল হচ্ছে। এই নামটা সে বলবে কী করে? ঢোঁক গিলছে বারবার। নিঃশ্বাস নিচ্ছে দ্রুত। এক পর্যায়ে হার মেনে নিলো। বললো, ‘আ-আমি… পারছিনা।’

এতোক্ষণ রিয়াদ খুব উপভোগ করেছে ফাহির লজ্জা পাওয়া। হার মেনে নেয়া পরেও সে ফাহির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘এতো সহজ এটা পারলেনা! মুভির নাম… উফ ফাহি, আই লাভ ইউ!’

চমকে উঠলো ফাহি। অস্থির চোখে তাকালো রিয়াদের দিকে। শেষে বলা ‘আই লাভ ইউ’ কথাটায় অদ্ভুত কিছু একটা ছিলো। রিয়াদের কণ্ঠ ভীষণ শীতল ছিলো ওটা বলার সময়। বুকে একটা নীরব তাণ্ডব বয়ে যাচ্ছে যেন ফাহির। সবাই মিটিমিটি হাসছে দেখে আরো লজ্জা পেলো ফাহি। রিয়াদও ফাহির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে জায়গায় এসে বসলো।

তিথির যেন কেমন কেমন লাগলো ঐ মুহূর্তে। সে এক ঝলক তাকালো জাওয়াদের দিকে। দেখলো জাওয়াদ তার দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখ ফিরিয়ে নিলো তিথি। ছেলেটা যখন তখন এভাবে তাকায় কেন?

‘এইবার বড় ভাইয়া। জোশ কিছু একটা হবে এবার।’ উৎসাহ নিয়ে বললো আদিয়া।

জাওয়াদ কাগজ তুলতেই সেখানে লেখা পেলো, রোম্যান্টিক একটা গানে ডুয়েট ডান্স দিতে হবে। এটা শুনে নুহা যেন আশার আলো দেখলো। নড়েচড়ে বসলো সে। তার বুকে ক্ষীণ আশা, জাওয়াদ অবশ্যই তার সাথে ডুয়েট নাচবে? কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে জাওয়াদ তিথির দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে উঠলো, ‘বলছিলে কিছু পারিনা। এসো এবার, দেখি কে কী পারে।’

তিথি যেন অবাকের অষ্টম পর্যায়ে। এতো তাড়াতাড়ি তার উইশ পুরো হয়ে যাবে সে ভাবতেই পারেনি। নিচের দিকে তাকিয়ে হাসলো। তারপর হাত বাড়িয়ে জাওয়াদের বাড়িয়ে দেয়া হাতটা ধরলো। সাথেসাথে যেন একটা অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেলো তার সর্বাঙ্গে। ঘোর লাগা চোখে উঠে দাঁড়ালো তিথি। তার শরীর মৃদু কাঁপছে। দুরুদুরু করছে বুক। জাওয়াদ এক টানে তাকে নিজের সাথে এনে লাগালো। তিথি যেন অসাড় হয়ে পড়লো। ইয়া আল্লাহ! এই উইশ কেন করতে গেল? জাওয়াদ মাথা ঘুরিয়ে রিয়াদের দিকে তাকিয়ে একবার হাসলো। তারপর সবার উদ্দেশ্যে বললো, ‘জনগণস, ইটস অ্যা রোম্যান্টিক ডান্স। সবাই মনে করো যে এটা টিভিতে দেখছো।’

‘টিভির ডান্স লাইভ দেখবো!’ চোখ বড়বড় করে বললো সাহিল।

জাওয়াদ কপাল কুঁচকে বললো, ‘এই পাকনা, চুপ করে বসতো। ডিস্টার্ব করবিনা।’

হেসে দিলো সবাই, একজন বাদে। রিয়াদ এবার হাসতে হাসতে তার ফোনে একটা ইংরেজি রোম্যান্টিক গান ছেড়ে দিলো। জাওয়াদ নাচতে লাগলো, তিথিকে নিয়ে। তিথির যেন শরীরের সব শক্তি গায়েব হয়ে গিয়েছে। জাওয়াদ তিথির কোমর ধরছে। অজ্ঞান হই হই অবস্থা তিথির। তিথির চুলগুলো খোঁপা করা ছিলো। জাওয়াদ তিথিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সেই চুল খুলে দিলো। তারপর তিথিকে পেছন থেকে ধরে চুলে নাক গুঁজে ঘ্রাণ নিলো। তারপর তিথির দু’হাত ধরে তার হাত সহ তিথির পেটের উপর রাখলো। গান শেষ হলো। তিথি তার সমস্ত ভর ছেড়ে দিলো জাওয়াদের ওপর। সে আর নড়তে পারছেনা। তার শরীর অবশ হয়ে আসছে। এভাবে না চাইতে এতোকিছু পেয়ে যাবে, কে জানতো? আচ্ছা, এতো সুখ সুখ কেন অনুভূত হচ্ছে তিথির? এটা কি দুঃখ আসার সিগনাল? মাথাটা ঘুরছে তিথির, সে কি জ্ঞান হারাচ্ছে? না না, এখন জ্ঞান হারালে চলবেনা, একদম না! ঘরে যাওয়ার পরে যা হয় হোক!

‘উফ, এক্সট্রিম লেভের রোম্যান্টিক ডান্স ছিলো।’ বলে হাত তালি দিলো রিয়াদ। সবাই হাত তালি দিলো। আদিয়া বললো, ‘বড় ভাইয়া বরাবরই ভালো নাচে। কিন্তু তিথিও এতো ভালো নাচে জানতাম না।’

তিথি চুপচাপ এসে বসলো জায়গায়। তার লজ্জা করছে খুব। চোখ তুলে তাকাতে পারছেনা। চোখ তুলে তাকালেই ঐ মানুষটার চোখে চোখ পড়বে। মরেই যাবে সে। শরীরে এখনও শিহরণ জাগছে। স্পর্শগুলো যেনো এখনও লেগে আছে। বারংবার কাঁপিয়ে তুলছে তিথিকে। তিথি চোখ বন্ধ করে ফেললো।

দুই কান দিয়ে যেনো গরম বাতাস বেরোচ্ছে নুহার। শরীরে আগুন ধরে গেছে যেনো। সে এখানে এক মুহূর্তও থাকতে চাইছেনা। কাউকে কিছু না বলেই উঠে হনহন করে চলে গেল। সবাই অবাক হলেও রিয়াদ আর জাওয়াদ অবাক হলো না। তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসলো কেবল। হুট করে লাইট নিভে গেল রুমের। সাহিল চিৎকার দিয়ে উঠলো। রিয়াদ মোবাইলের ফ্লাশ লাইট জ্বালালো। তারপরে বললো, ‘কবুতরের জান তোর। ইলেক্ট্রিসিটি গেছে। এখানে রো আইপিএস নাইরে। সবাই উঠ, ঘরে যাই। আর ঘণ্টাখানেক পরেই ডিনারের জন্য ডাক আসবে।’

সবাই বেরিয়ে যেতে লাগলো। সবার শেষে তিথি দরজার কাছে যেতেই জাওয়াদ তিথির পেছন থেকে কোমর জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, ‘একটু দাঁড়াও পাতলি কোমর ওয়ালি।’

কানের কাছে জাওয়াদের উত্তপ্ত গরম নিশ্বাস তিথিকে যেন এক্ষুণি ৪৪০ ভোল্টেজ এর শক দিলো। তিথি নিঃশব্দে জাওয়াদের হাত নিজের কোমর থেকে ছাড়াতে চাইলো। সবাই বেরিয়ে গেছে ততোক্ষণে। জাওয়াদ আরো শক্ত করে ধরলো, তারপর নিজের দিকে ফিরালো। তিথি বললো, ‘প্লিজ ছাড়ুন। কেউ দেখলে খারাপ বলবে।’

জাওয়াদ কোনো উত্তর না দিয়ে একহাতে তিথিকে নিজের সাথে লাগালো। তিথি কাঁপতে লাগলো, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসলো তার। এভাবে জাওয়াদের সাথে লাগার কারণে তার শরীর যেন বরফ হয়ে গেল। সে আর শক্তি পাচ্ছেনা জাওয়াদকে ছাড়ানোর। নিচের দিকে তাকিয়ে থাকলো। জাওয়াদ মোবাইলের ফ্লাশ লাইট বন্ধ করে দিলো। চাঁদের আলো এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে তিথির মায়াবী মুখ পরম যত্নে। সেই মুখের দিকে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে রইলো জাওয়াদ। তিথি আবারও খানিক মোচড়ামুচড়ি করে বললো, ‘ছাড়ুন, এমন করছেন কেন? সবাই চলে গেছে।’

জাওয়াদ তিথিকে না ছেড়ে রিয়াদের নাম্বারে কল দিলো। তারপর রিয়াদকে বললো, ‘আই ডোন্ট নো হাও, বাট ওদিকটা তুই ম্যানেজ করবি। তিথি আমার সাথে। কেউ জিজ্ঞেস করলে কী বলতে হবে সেটা তুই ডিসাইড কর। রাখছি।’

তিথির মুখ একদম হা হয়ে গেল। সে এবার আরো জোরে নড়াচড়া করতে লাগলো। জাওয়াদ বিরক্ত নিয়ে বললো, ‘উফ! নড়োনা।’

‘আ-আপনি…’

‘শসসসস!’ তিথির ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করালো জাওয়াদ। ঠোঁটে জাওয়াদের আঙুলের স্পর্শ পেতেই কেঁপে ওঠে তিথি। তিথির এই কেঁপে ওঠা যেন জাওয়াদের বুকেও কাঁপন ধরায়। সে আস্তে করে বলে, ‘আমার সাথে আজ মিথ্যে বললে কেন? আমি জানি নুহা তোমার সাথে কিছু একটা করেছে। তুমি মা কে বলেছো ডুব দিতে গিয়ে পানি খেয়েছো। আসলে এটা মিথ্যে। নুহা কী করেছে বলো। ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলেছে?’

তিথি ডানে বামে মাথা নাড়ে। জাওয়াদ হাসে। আবার বলে, ‘সেদিন ডায়েরিটা তুমি পড়েছো আমি জানি।’

চমকে উঠলো তিথি। হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে এলো তার। এজন্যেই কি জাওয়াদ ওকে এভাবে আটকে রেখেছে? এখন কি ওকে শাস্তি দিবে? কী শাস্তি দিবে? তিথি ঢোঁক গিললো। তিথির মুখে স্পষ্ট ভয় খেলা করছে। তা দেখে জাওয়াদ হেসে দিলো। বললো, ‘তিথি, বেহুদা ভয় পাচ্ছো কেন? তুমি না খুব সাহসী? আমি এবার তোমাকে ডায়েরির পেছনের গল্পটা বলবো। শুনতে চাও?’

ফের চমকায় তিথি। চোখে তার কৌতূহল। জাওয়াদ কি এখন তাকে সেই গল্পটা বলবে? যার জন্য তার ভালোবাসা পূর্ণতা পায়নি?

জাওয়াদ তিথিকে টেনে তার মাথাটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরলো। পরম যত্নে, পরম মায়ায়। তিথির মনে হলো, পৃথিবীর সবথেকে শান্তির জায়গায় মাথা ঠেকিয়েছে সে। শান্তির নিশ্বাস নিলো তিথি। সে কিছু বলছেনা। তার কাছে এখন যেন সব স্বপ্ন। কিছু বলতে গেলে বা নড়তে গেলেই যেন স্বপ্নটা ভেঙ্গে যাবে সেই ভয় পাচ্ছে সে। তিথির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জাওয়াদ বললো, ‘শোনো, এবার তোমাকে আমি সেই ঘটনাটা বলবো। যা ডায়েরিতে লেখা নেই।’

চুপটি করে জাওয়াদের বুকে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে আছে তিথি। সে শুনবে, খুব মনোযোগী শ্রোতা সে।
_____________

চলবে………
#ফারজানা_আহমেদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here