রঙিন খামে বিষাদের চিঠি পর্ব ৩

0
307

#রঙিন_খামে_বিষাদের_চিঠি
#পর্বঃ০৩
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

৫,
“ওয়া আলাইকুম আসসালাম, জি বাবা ভালো আছি। এতদিন পর আংকেল আন্টিকে মনে পরলো জুবায়ের?”

ইয়াসিন সাহেব উপরোক্ত কথাটি বললেন যুবক-টির কথার জবাবে। রায়াদের পাশে দাড়ানো যুবক-টির নাম জুবায়ের। সে ইয়াসিন সাহেবকে জড়িয়ে ধরলো ফট করে। আহ্লাদের স্বরে বললো,

“আপনি জানেন ঢাকায় ছিলাম না। আসার পরপরই তো দেখা করতে চলে এলাম।”

“হয়েছে আর কৈফিয়ত দিতে হবেনা। দরজায় দাড়িয়েই বকবক শুরু করে দিয়েছো। বাসায় ঢোকো আগে।”

ফাতেহা খানম কথাটা বলেই জুবায়েরের হাত আকড়ে বাসায় ঢুকালেন। আয়াত এবং রিয়ানা দাড়িয়ে দাড়িয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে তাকিয়ে তাদের দেখছে সবকিছু। রায়াদ সবাইকে পাশ কাটিয়ে হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে জুবায়ের এবং ফাতেহা খানমকে এক ঝলক দেখে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো। ইয়াসিন সাহেব ফাতেহা খানমকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

“ছেলেকে আচ্ছা মতো খাতির-যত্ন করো। আমি মেয়েদের নিয়ে ঘুরে আসি।”

ফাতেহা খানম হেসে মাথা নাড়ালেন। ইয়াসিন সাহেব হাতের ইশারা আয়াত এবং রিয়ানাকে পা বাড়াতে বললেন। আয়াত এবং রিয়ানা ইশারা বুঝে হাঁটতে শুরু করে। সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে আয়াত ইয়াসিন সাহেবকে জিগাসা করে,

“একজন তো বুঝলাম আপনার ছেলে আংকেল। অপরজন কে?”

“জুবায়ের, রায়াদের বেস্টফ্রেন্ড। ধরতে গেলে আমার আরেক ছেলে-ই। কাজের জন্য জেলার বাইরে ছিলো। এমনিতে প্রতিদিনই বাসায় এসে দুজনে আড্ডা দেয় অনেক। আসেনি কয়েকদিন। তাই বাসা’টা খালি খালি লাগতো।”

“আপনি তো বাসাতেই থাকেন না আংকেল! তাহলে খালি খালি লাগার প্রশ্ন আসলো কোথা থেকে?”

রিয়ানা পাশ থেকে প্রশ্নটা করলো। ইয়াসিন সাহেব হেসে জবাব দিলেন, বললেন,

“আজ রাতেই টের পাবে কেনো বললাম। চলো আগে আমাদের কাজ সেরে আসা যাক।”

“হুম চলুন।”

রিয়ানা মাথা হেলিয়ে সম্মতি দিলো। অতঃপর তিনজনে সিড়ি বেয়ে নেমে বাসা থেকে বের হয়ে গাড়িয়ে উঠে রওনা দেয় নিজ গন্তব্যে।

“নতুন একজনকে দেখলাম আম্মু। সে আবার কে?”

কফির মগ হাতে কিচেন থেকে বেরিয়ে সোফায় মায়ের পাশে এসে বসতে বসতে প্রশ্ন-টা করে রায়াদ। ফাতেহা খানম জুবায়ের এ ক’দিন কোথায় কি করলো, কি রকম ঘুরলো কাজের ফাঁকে! সেসবই জানতে গল্প জুড়ে দিয়ে বসেছেন। রায়াদ ফ্রেশ হয়ে এসে আগে নিজের জন্য কফি বানিয়ে এসে বসলো। ফাতেহা খানম ছেলের প্রশ্নের জবাবে বললেন,

“আয়াত, রিয়ানার বড়ো বোন।”

“তাড়ছিড়ার বোন, তাড়ছিড়ার মতোই নাকি!”

“ধ্যাৎ, তোর কাছে সবাইকে-ই তাড়ছিড়া মনে হয়? রোজাও তাড়ছিড়া, রিয়ানাও! আবার নতুন মানুষকেও বলছিস! চিনিস না জানিস না। অদ্ভুত।”

“না বলার কারণ তো নেই আম্মু। ৭দিন হলো বাসায় এসেছে, সবকিছু লন্ডভন্ড করা ছাড়া তো কাজ দেখলাম না। মেয়ে কম গোছালো স্বভাবের ছেলেদের হ্যাবিটও উনার নেই।”

“এই তোমরা কার বিষয়ে কথা বলছো?”

জুবায়ের মা-ছেলের কথার মাঝে কিছু বুঝতে না পেরে প্রশ্ন-টা করলো। রায়াদ কফির মগে চুমুক দিয়ে গা ছাড়া ভাবে বললো,

“কার কথা আর বলবো! একটা মেয়ে মানুষের পাশে আরও একজন দেখলি না! জিন্স টপস গলায় স্কার্ফ পেঁচানো এক অদ্ভুদ প্রাণী-কে?”

“হুম তো! সে অদ্ভুত হলো কি করে?”

“বাসায় কয়েকটা দিন থেকে দেখিস। বুঝবি কেন বললাম অদ্ভুত!”

“তুই থামবি রায়াদ! সব-টা সময় শুধু আমার মেয়ে-টাকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা।”

“তোমার আবার সে মেয়ে হলো কবে থেকে?”

রায়াদ বিস্মিত কণ্ঠে নিজের মা’কে প্রশ্ন করে। ফাতপহা খানম একটু নরম স্বরে বললেন,

“যেদিন থেকে ও আমায় মায়ের মতো ভাবতে শুরু করেছে।”

“আর তোমার মেয়ে মানে আমার বোন। নামেও বেশ মিল আছে রায়াদ, রিয়ানা। সো ঐ তাড়ছিড়ার সাথে বিয়ের কথা ভুত ধরলেও ভাববে না। বড়ো ভাই হিসেবে ওরে ঠিক করার দায়িত্ব আমার।”

ফাতেহা খানম ছেলের যুক্তি শুনে আফসোসের স্বরে কপাল চাপড়ে বললেন,

“হায় খোদা! আমার ছেলের সুবুদ্ধি দাও একটু।”

“তোমরা মা-ছেলেতে আড্ডা জুড়ে দিয়ে আমায় দেখছি পাত্তাই দিচ্ছো না। নট ফেয়ার।”

জুবায়ের বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে বুকে হাত বেধে কথাগুলো বললো। ফাতেহা খানম সেদিকে তাকিয়ে হাসলেন। বসা থেকে উঠে জুবায়ের পাশে বসে বললেন,

“থাক, তোকে পাত্তা এমনিও দিলাম না, ওমনেও দিবোনা। তুই বসে থাক, আমি তোর জন্য রান্না করি গিয়ে।”

ফাতেহা খানম চলে যেতে উঠে দাড়ালে রায়াদ উনার হাতে কফি পান করা হয়ে যাওয়ার দরুণ কফির মগ-টা ধরিয়ে দেয়। ফাতেহা খানম ছেলের মাথার চুল এলেমেলো করে দিয়ে কিচেনের দিকে পা বাড়ালেন। রায়াদ আর জুবায়ের ব্যস্ত হয়ে পরে তাদের নিজেদের মাঝে আড্ডা দেওয়া নিয়ে।

৬,
শপিং শেষে দুবোনে একসাথে বাসার দিকে রওনা দিয়েছে। ইয়াসিন সাহেব নিজে আর বাসায় আসলেন না। কাজের মাঝে আটকে পরায় ড্রাইভার সহ ওদের পাঠিয়ে দিলেন। গাড়ির মাঝে জানালার ধারে বসপছে রিয়ানা। জানালার গ্লাস নামানো। সীটে গা এলিয়ে দিয়ে ব্যস্ত শহর ঢাকাকে দেখছে সে মনোযোগ দিয়ে। আয়াত ফোনে বাবার সাথে কথা বলছিলো। কথা বলার এক ফাঁকে আয়াত ফোন-টা রিয়ানার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

“ধর, বাবা কথা বলবে।”

“বাহ বা! মিঃ হানিফের মনে পরলো তার আরও একজন মেয়ে আছে! আর তার সাথে ফোনেও কথা বলতে হবে!”

রিয়ানা চাপাকণ্ঠে কান্নার দমক আঁটকে কোনোমতে কথা-টা বললো। বাবাকে এমনও মিস করে। সেখানে বাবার থেকে এতদূরে থাকা সত্বেও হানিফ সাহেব তার সাথে কথাও বলেনি। আজ কথা বলতে চাইলো, সেটাও আয়াতের মাধ্যমে। এজন্য একপ্রকার কান্না-ই পেয়ে বসলো রিয়ানাকে। আয়াত দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। বাবা আর বোনের মাঝে দূরত্ব কবে ঘুচবে কে জানে! তার আর ভালো লাগেনা দুজনের মন কষাকষি। সে ফোন-টা রিয়ানার হাতে গুঁজে দিয়ে বললো,

“কথা বল।”

রিয়ানা ফোন-টা কানে ধরে কাঁপা স্বরে বললো,

“আসসালামু আলাইকুম বাবা।”

হানিফ সাহেব ফোনের এপাশ হতে নিজের ছোটো মেয়ের মুখে হঠাৎ সালাম আর বাবা ডাক শুনে অবাক-ই হলেন। মনে মনে সালাম নিয়ে বিস্মিত কণ্ঠে বললেন,

“হঠাৎ হ্যালো ড্যাড হতে সালাম দিয়ে বাবা ডাক! যাক ভালো-ই উন্নতি হলো তবে!”

“জি, হয়েছে হয়তো। ভালো আছেন?”

“হুম, তুমি কেমন আছো? ওখান কার সবাইকে আবার নাকানিচুবানি খেতে হচ্ছে না তো তোমার জন্য? ”

“আপনি সবসময় আমার খারাপ দিকগুলোয় দেখে আসলেন বাবা। কখনও এই খারাপ দিকগুলো তৈরি হলো কেনো? হাতড়ে দেখলেন না।”

“তোমার যে ভুল! সেটা কি ছোটো?”

“সেই আমি মানি আমার ভুল, স্যরি ওটা ভুল নয় অন্যায়। কিন্তু আপনি এটা ভেবে দেখেননি জেনে-বুঝে করিনি বা তখন আমি নেহাৎ-ই বাচ্চা ছিলাম, ছোটো ছিলাম। আমি ছোটো ছিলাম, আমার সাথে সাথে আপনার জিদও সেই ছোটো বাচ্চাদের মতো-ই হলো। যার খেসারত আমি দিই।”

“তর্ক করতে ফোন দিইনি রিয়ানা৷ তোমার আংকেল আন্টি, তাদের ছেলেমেয়ে, কারোর সাথে যেনো বেয়াদবির কথা না শুনি।”

“শুনবেন না। সেটা আপনার বড়ো মেয়ে-ই নিশ্চিত বুঝে গেছে। অনেক তো আপনার সম্মান ডুবালাম! এবার একটু এইদেশে উঠানোর চেষ্টা করি!”

“সেই চেষ্টার জন্য-ই রেখে এসেছি। সফল হও, দুয়া করি। ”

রিয়ানা কথা বাড়ালো না। ফোন-টা আয়াতের দিকে বাড়িয়ে দিলো। আয়াত নিজে কথাবার্তা বলে কেটে দিলো কল। ফোন-টা পার্সে ঢুকিয়ে সীটে গা এলিয়ে বসলো। রিয়ানা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কান্নার দমক থামানের চেষ্টায় ফাঁকা ঢোক গিললো বেশ কয়েকবার। বোনের দিকে নজর ঘুরিয়ে জিগাসা করলো,

“তোর বিয়ের তোড়জোড় কতদূর? দিনতারিখ ঠিক হলো?”

“আর বিয়ে! বিয়ে করে মানুষ? বিরক্তিকর।”

“কেনো কি হয়েছে?”

“বড়বাবা যে পাত্র-র কথা বলে দেশে আনলো! বাবার পছন্দ হয়নি। বাড়িতে কয়েকদফা ঝামেলা হওয়া শেষ। আবার এখন বাবা নেমেছেন। হারিকেন লাগিয়ে পাত্র খুজছেন।”

রিয়ানা আয়াতের জবাব শুনে ভীমড়ি খেলো। বিয়ে হবে না মানে! সে আয়াতের দিকে ফিরে বসে ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে অবাক হয়ে জিগাসা করলো,

“বাবার পছন্দ হয়নি মানে? কি সমস্যার জন্য পছন্দ হলো না? বাবা আর বড়ো বাবার তো গলায় গলায় মিল। ভাইয়ে ভাইয়ে মিল থাকা ভালো। কিন্তু ঝগড়া কেনো হলো! এতটাই বাজে পাত্র?”

“পাত্রের সাথে আমার কিছুই মিলে না।”

“যেমন?”

“পড়াশোনা আমার থেকে কম জানাশোনা, বনেদী পরিবার। ছেলের প্রফেশন নেই, বাপ দাদার সম্পত্তির উেপর ডিপেন্ড করে চলে। বাবা চান না আমি বনেদী পরিবারে গিয়ে বন্দী জীবন কাটাই।”

“বনেদী পরিবার মানেই কি বন্দী নাকি?”

“ঠিক তা নয়, কিন্তু উনারা আগের সময়ের চাল চলন মেনে চলে আজও। কিন্তু আমি মানিয়ে নিতে আদৌও পারবো কিনা! বাবা এটা ভেবেছেন।”

“থাক বাদ দাও, আমার বড়ো বোন হয়ে আজও একটা প্রেম করতে পারোনি। এর থেকে লজ্জার কিছু আছে? অথচ আমায় দেখো! এ অব্দি কত ছেলের সাথে ফ্লার্ট করেছি মেয়ে হয়ে! তার ঠিক নেই।”

“তুই এমন কেন হলি রিয়ু! এমন না হলে তো বাবা আর তোর মাঝে দূরত্ব আসতোনা?”

“তুই হয়তো সব ভুলে যাচ্ছিস আপু।”

রিয়ানার এই কথায় দমে যায় আয়াত। আর কথা বাড়ায় না। রিয়ানার মতো সে নিজেও গাড়ির জানালা দিয়ে চারপাশ টা দেখতে শুরু করে।

চলবে?

ভুলত্রুটি মার্জনীয়, আসসালামু আলাইকুম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here