রক্তের বন্ধন
– রাজের কথাগুলে বারবার মনে পড়ছে। একটা দিন আসবে যখন আমি থাকবে না। আমার স্মৃতিগুলোই সেদিন কাঁদাবে। সন্ধ্যা তারা হয়ে রোজ দেখব তোমায় রাখিব আঁখি বন্ধনে।
আমি আর সহ করছে পারছে না রাজের লাশটা ধরে হাউমাও করে কেঁদে দিলাম। তারপর আর কিছু মনে নেই।
– যখন সেন্স ফিরে আসে, তখন দেখি সবাই রাজকে নিয়ে যাচ্ছে।
-মম বাবাইকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?বল না মা কেউ বলে না বাবাইকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। তুমি মিথ্যা বলবে না জানি। প্লিজ মম বল।
– রাইসাকে বলার মত পৃথিবীর কোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না । কিভাবে বুঝাবো তাকে।চোখের পানি বাঁধা মানছে না। আমি যে অপরাধী। রাজকে খুব খুব কষ্ট দিয়েছি। বুকের ভেতরটা পুড়ে ছার-খার হয়ে যাচ্ছে। মম তুমি কাঁদছ কেন? তুমি বল না সবাইকে বাবাইকে না নিয়ে যেতে। বাবাই কি আর কোনদিন আমাকে কুলে নিবে না?
– বাবা কেন কথা বলছে না মম!
– আল্লাহ আমি কি করব। কি বলব, কিভাবে বলব আমি যে তোমার বাবাইকে যেখানে নিয়ে যাচ্ছে সেখান থেকে কেউ আর ফিরবে না।
– রাইসা চিৎকার দিয়ে কাঁদছে। রাইসাকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়েছি। হঠাৎ ঠাস করে কিছু ভাঙার শব্দ হল! চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি ফ্ললে একটা বিড়াল মিউ মিউ করছে। আকাশটা মেঘলা। বুঝতে বাকি রইল না আমি দুঃস্বপ্ন দেখছি! টেবিলে রাখা জলের গ্লাসটা হাতে নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নিলাম। দুঃস্বপ্ন হলেও বুকের ভেতরটা কেমন যেন করছে। কারণ রাজকে ছাড়া যে সত্যি আমি মরে যাবে। রাজ যে আমার নিঃশ্বাস এখনো চোখ থেকে পানি পড়ছে। না আমার রাজের কিছু হবে না। বিছানা থেকে উঠে,ফ্রেশ না হয়েই গাড়ি নিয়ে হসপিটালে চলে গেলাম!
– হসপিটালে গিয়ে দেখি, হসপিটালের পরিবেশ কেমন যেন নিঃস্তব্ধ! রাইসার কেবিনে গিয়ে দেখি রাইসা সাথিকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে! জানি না রাইসাকে সাথীর বুকে দেখতে কেন এত কষ্ট হয়।
– কাউন্টারে গিয়ে রাজের কথা জিজ্ঞেস করতে রুম নাম্বার বলে দিল।
রুমের সামনে এসে নার্সকে জিজ্ঞেস করলাম, রাজকে কোন কেবিনে রেখেছে!
-কোন রাজ?
– কাল রাতে যার অপারেসন হয়েছে।
– ও কাল রাতে যার অপারেশন হল?
– জ্বি!
– ওহ্! উনাকে বিশেষ অবজারবেশনে রাখা হয়েছে। উনার অবস্থা আশঙ্কাজনক।
– আমি একটু দেখা করতে চাই!
– নাহ্, আপাদত কেউ দেখা করতে পারবে না।
-আপু প্লিজ আমাকে একটু দেখতে যেতে দেন। আমার স্বামীকে একটু দেখেই চলে আসব। প্লিজ আপু আমাকে যেতে দেন।
– আপনি কি হন পেশেন্ট এর?
– আমি তার হতভাগা স্ত্রী!
– সরি ম্যাডাম আপনাকে যেতে দেওয়া যাবে না এতে আমার চাকরি চলে যাবে।
– আপু আজ যদি তোমার বোন হতাম, পারতে বাধা দিতে আমাকে। আপু আমি যে আমার স্বামীকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমি ওকে চিনতে পারিনি। প্লিজ আপু আমি তোমার পায়ে পড়ি। আমার স্বামীর কাছে যেতে দাও! প্লিজ আপু প্লিজ!
-আচ্ছা ম্যাডাম পেশেন্টের দেখা শুনার দায়িত্ব পড়েছে আমার উপর। আপনি ১০-১৫ মিনিট থাকতে পারবেন। এর বেশি না যদি ডাক্তার আপনাকে রুমে দেখে ফেলে তাহলে আমার চাকরি চলে ডাবে।
– আচ্ছা তাতেই চলবে। নার্সকে বাহিরে রেখে রুমে প্রবেশ করতেই দেখে রাজ বিছানায় শুয়ে আছে। মনে হচ্ছে, একটা পূর্ণিমার চাঁদ মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ছে। মায়াবী মুখটা কেমন যেন মলিন হয়ে আছে। মন চাচ্ছে রাজকে বুকে নিয়ে বুকের আগুনটা ঠাণ্ডা করি। রাজকে আজ কেন এত সুন্দর লাগছে। আমি আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না। রাজের কপালে আলত করে ভালবাসার স্পর্শ এঁকে দিলাম। আচ্ছা তুমি আমায় ছেড়ে চলে যেতে চাও কেন? জান না তোমাকে এই কথা কতটা ভালবাসে। তুমি যে কথার শিরায় -উপশিরায় মিশে গেছ। তুমি একটাবার চোখ খুলে তাকাবে? রাজ কোন কথা বলছে না। আমি রাজের কপালে আবারো চুমু দিয়ে পা দু’টো বুকে নিয়ে কাঁদছি। মনে হচ্ছে এই পায়ের নিচেই আমার নীড়। হঠাৎ রাজ কেমন যেন করে ওঠল!
চেয়েই দেখি রাজ ছটফট করছে! মনে হচ্ছে অক্সিজেন বন্ধ হয়ে গেছে। আমি যখনই অক্সিজেন মাস্কটায় হাত রাখছি।এমন সময় পিছন থেকে ডাক্তার এসে বলল’ আপনি এখানে কি করছেন ? আর আপনি কিভাবে রুমে আসলেন? নার্স নার্স! কোথায় সব। হঠাৎ ডাক্তারের চোখ রাজের দিকে যেতেই দৌঁড়ে এল! একি! পেশেন্টের অক্সিজেন অফ করা কেন । তাড়াতাড়ি অক্সিজেন এর লাইন সেটাপ দিল!
– আর আপনি রুমে কেন এসেছেন?
– আমার স্বামীকে দেখতে।
-স্বামীকে দেখতে আসছেন না খুন করতে আসছেন?
– আমি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমি তো রাজের অক্সিজেন লাইন খুলিনি।
– কি হলো বলেন আপনি কেন পেশেন্ট কে মারতে আসছেন?
– এমন সময় নার্স রুমে আসতেই! মিস নুসরাত আপনি কোথায় গিয়েছিলেন? আপনাকে না পেশেন্টের ২৪ ঘন্টা দেখাশুনার জন্য রাখা হয়েছে। তাহলে এই মেয়ে কীভাবে আসলো?
-নার্স ডাক্তারের ধমক শুনে সত্যিটা বলে দিল।
– স্যার ওই ম্যাডাম অনেক কান্না কাটি করছে। উনার নাকি স্বামী! আমি যেতে দিতে চাইনি ।
– তাই বলে অভজারভেশনে রাখা কোন পেশেন্টে রেখে আপনি বাহিরে যাবেন। এখন যদি পেশেন্ট মারা যায়? জানেন কি করছেন ইনি, পেশেন্টের অক্সিজেন মাস্ক খুলে দিয়েছিল।যদি আমি না আসতাম, তাহলে রোগী হয়ত এতক্ষণে মারা যেত। আর আপনার বিরুদ্ধে পরে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
-আর আপনাকে বলছি , নিজের স্বামীর সাথে কী এমন শত্রুতা যার জন্য অক্সিজেন মাস্ক খুলে দিয়েছেন। আর একমিনিট অভার হলেই পেশেন্ট মারা যেত। আপনি তো মেয়ে নামে কলঙ্ক। স্বামী যত অপরাধ করুক না কেন, তবুও কোন স্ত্রী স্বামীকে হত্যা করার এমন ঘৃণ্য পরিকল্পনা করতে পারে না। আপনি জানেন আপনি কাকে মারতে চেয়েছিলেন? জানেন না। আমি অপারেশন করার আগে সব ডিটেলস শুনছি ডাঃআশিকের কাছে। কোন বাবাই হয়ত এতটা ত্যাগ স্বীকার করত না, নিজের মেয়েকে বাঁচাতে। কারণ মিঃ রাজের দু’টা কিডনীর মাঝে, একটা কিডনীর কাছে টিউমার ছিল! যে জন্য তার কিডনী ডুনেট এর সাথে সাথে একটা কিডনীর থেকে টিউমারটা সরানো রিক্স ছিল। তাই কিডনী ডুনেট করার আগে ডাঃ আশিক রাজকে, বলেছিল যেন তিনি অপারেশনটা না করায়। এতে তার মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু মিঃ রাজ নাকি মৃদু হেসে বলেছিল, নিজের বোনকে সে বিধবা কিভাবে দেখবে? সে তা দেখতে পারবে না। মিস জুথির স্বামীকে বাঁচাতে এককথার হাসিমুখে জীবন দিতে বসেছিল। আমি বিদেশ থেকে ডাঃ আশিকের কাছে এমন কাহিনী শুনে শুধু ফেরেশতা নামক মানুষটা অপারেশন করতে এসেছি। আলহামদুলিল্লাহ্ মিঃ রাজ অনেকটা বিপদ মুক্ত ছিল। কিন্তু, আপনার অক্সিজেন মাক্স খুলে ফেলায়, অনেকটা শর্ক খেয়েছে। জানি না কি হয়। পেশেন্টের অবস্থা আশংঙ্কাজনক। আজ আমি মেয়ে হয়ে মেয়েদের ঘৃনা করছি। আপনার মতো মেয়ে যেন কারো স্ত্রী না হয়। আপনাকে পুলিশে দিব আমরা।
– আমি কিছু করিনি ডাক্তার ম্যাডাম। আমি আমার স্বামীকে আমার নিজের জীবনের থেকেও বেশি ভালবাসি। প্লিজ বিশ্বাস করেন। আমি রুমে এসে দেখি রাজ কেমন যেন করছে। আমি কেন আমার স্বামীকে হত্যা করব। আমি যে রাজকে ছাড়া বাঁচব না।
এমন সময় সাথি এসে ঠাস ঠাস করে গালে চড় বসিয়ে দিল!
-কি হলো আপনার লজ্জা করে না ইমোশনাল ড্রামা করতে। আর কি চান? রাজের মৃত্যু? আমি বেঁচে থাকতে আমার ভালবাসার কোন ক্ষতি করতে দিব না। রাজ সুস্থ হলেই আমরা বিয়ে করব। রাজকে আমি ভালবাসি। আপনি একটা খুনি। আর একটা কথা পুলিশ ডাকার আগেই আমি চাই আপনি চলে যান! আপনার মতো কলংঙ্কিনী কোন মেয়ের মুখ দেখতে চাই না।
-ডাক্তার প্লিজ বিশ্বাস করেন আমি কিছু করিনি। আমি কেমনে করে আমার স্বামীকে মারতে চাইব।
প্লিজ আপনি চলে যান, আপনার মতো মেয়ের ছায়া যেন রাজের উপর না পড়ে। আপনাকে পুলিশে দিতাম। দিলাম না শুধু রাজ কষ্ট পাবে বলে! আপনি প্লিজ চলে যান।
– মম তুমি আমার রেখে চলে গিয়েছ কেন?তুমি জানো তোমায় কত খুঁজেছি, এই বলে রাইসা যখনি, আমার কাছে আসতেছে। সাথি রাইসাকে ছুঁ মেরে বুকের সাথে জড়িয়ে নিল।
– মামনি, ওটা তোমার মম না। ওটা তোমার বাবাকে মেরে ফেলতে চাই।
নাহ আমি বিশ্বাস করি না!
– মামনি তোমার ডাক্তার আন্টিকে জিজ্ঞেস কর।
– আচ্ছা!
– হুম কর।
– ডাক্তার আন্টি ডাক্তার আন্টি সত্যি বাবাইকে মম মারতে চেয়েছিল?
– ডাক্তার মম রাইসার কথায় কি উওর দিবে ভেবে পাচ্ছে না! একটা সন্তানকে কীভাবে বলবে যে তোমার মম তোমার বাবাইকে মারতে চাই!
– কি হলো বল আন্টি!
– ডাক্তার’ রাফিয়া ইসলাম মন’ যেন মুখে কিছু বলতে পারছে না। মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিল!
– ছিঃ মম তুমি আমার বাবাইকে আবারো মারতে চাও! তুমি এতো পঁচা কেন? আমার মম তুমি না, আমার মম উনি’ সাথিকে দেখিয়ে দিয়ে।
তুমি চলে যাও, তুমি আমার বাবাইকে মারতে চাও। রাইসা দৌঁড়ে রাজের মাথার কাছে গিয়ে বলে বাবাই আমি আর উনাকে মম বলে ডাকব না। আর বলব না তুমি উনাকে ক্ষমা করে দাও। তোমাকে মারতে চাই। তোমার কিছু হলে আমি কাকে বাবাই ডাকব? কার বুকে ঘুমাবো।
– কি হলো মিস কথা আপনি এখনি দাঁড়িয়ে আছেন? প্লিজ চলে যান।
– কথার আজ এখানে কিছু বলার নেই চোখের পানি টা মুছে, উপরের দিকে চেয়ে বলল’ হে আমার আল্লাহ আর কত অপবাদ দিবে আমায়? আমি যে আর পারছি না। হঠাৎ করে সাথি ধাক্কা দিয়ে রুমের বাহিরে বের করে দিল! সেন্ডেল স্লিপ কেটে পড়ে যায়। কপাল ফেঁটে রক্ত পড়ছে। এক হাতে চোখের পানি মুছতেছি। অন্য হাতে কপালের ফাটা জায়গায় ধরে আছি। মনে মনে আল্লাহ কে স্মরণ করছি। যার কেউ নেই তার তো আল্লাহ আছে। বাসায় এসে হসপিটালে কাজের মেয়েকে দিয়ে ফোন করে শুনলাম রাজের অবস্থা খারাপ। কথাটা শুনে বুকের ভেতর রক্ত ক্ষরণ হতে লাগল!
– এদিকে ডাক্তার মন তার রুমে বসে একা একাই ভাবছে। মনে হচ্ছে কোথাও কিছু ভুল হচ্ছে! কারণ মানুষের চোখের পানি কখনো মিথ্যা বলে না। হঠাৎ মনে হল হসপিটালে তো সিসি ক্যামেরা আছে।
– ডাক্তার আশিককে ফোন করে বলল’ আমার হসিটালের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ লাগবে।
– ডাক্তার আশিক ঘন্টাখানেক এর মাঝেই সিসিটিভির ফুটেজ এনে ল্যাপটপে ওপেন করতেই যা দেখল তাতে একদম পরিষ্কার হয়ে গেল রাজকে মারতে কথা নয় ”’
পর্রবর্তী পর্বের অপেক্ষায় থাকেন। ধন্যবাদ।
কষ্ট করে পোস্ট একটু like তো দিতে পারেন তাই নাকি???