দৃষ্টিনন্দনে তুমি বোনাস পর্ব

0
525

#দৃষ্টিনন্দনে_তুমি
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
বোনাস পর্ব

থমথমে মুখ নিয়ে বসে আছে হৈমন্তী। এখানে আসার পরে ফুপি আর ফুপা ছাড়া কেউ ওর সঙ্গে তেমন কথাবার্তা বলেনা। ফুপির দুজন মেয়ে ওকে এলিয়েন ভাবছে হয়তো। আড় চোখে দেখছে। এরা এমন কেনো করছে বুঝতে পারছে না। আসার পর থেকে নিয়মিত মাসুদ ফোন দিচ্ছে। ওখানের আপডেট বলছে। হৈমন্তীর মন কিছুটা শান্ত আছে। ভাইদের উপরে ওর পুরোপুরি ভরসা আছে। হৈমন্তীর জন্য সব করতে পারে। এরকম ভাই থাকা সত্যি সৌভাগ্যের বিষয়। বিষণ্নতা কাটাতে ফুপি ওকে পাশের একটা পার্কে ঘুরতে নিয়ে যেতে চেয়েছে। হৈমন্তী না করতে পারেনি। বড়দের মুখের উপরে মানা করা কেমন বেমানান লাগে। হৈমন্তী লাল রঙের একটা গাউন পরে তাঁর উপরে সোয়েটার জড়িয়ে নিলো। চুলগুলো সুন্দর করে মাফলারে জড়িয়ে নিয়ে বের হলো। হৈমন্তীকে দেখে আবেদা মির্জার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। ওকে দুহাতে জড়িয়ে নিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বললে,

> মাশাল্লাহ্ আমার মাকে দেখতে পরির মতো লাগছে। মায়ের মুখটা তোকে দেখলেই মনে পড়ে যায়। ঠিক তোর মতো ছিল জানিস? বাবা আমার মাকে প্রথম দেখাতে পছন্দ করে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। আমার দাদাজান তো প্রথমে মানতেই চাইনি পরে নাকি অনেক ঝামেলা করে বিয়ে হয়। মা বলতেন আমার শুনতে বেশ লাগলো। মায়ের কথা প্রচণ্ড মনে পড়ে। তোর জন্মের আগেই মারা গেছেন তোর দেখা হয়নি। আমি সবাইকে বলি হৈমীর মধ্যে আমার মা ফিরে এসেছে।

আবেদা কাজী একদমে কথাগুলো বলে থামলেন। হৈমী ওষ্ঠে হাসি ফুটিয়ে বলল,

> ফুপি আম্মু রোহান ভাইয়া জুলি আপু নায়রা আপু ওরা আমাকে পছন্দ করছে না তাইনা?কথা বলেন না কেনো?
> সবগুলো হয়েছে এক নাম্বারের ফাজিল। একগাদা বন্ধু বান্ধবী জুটিয়ে রাতদিন পার্টি ফার্টি করছে। কথায় বলে না দুই দিনের বৈরাগী ভাতের বলে অন্ন।এদের হয়েছে তাই। চলতো ওদের লাগবে না। তোর ফুপি একাই একশো। তোকে ঘুরতে আমি আর তোর ফুপা সাহায্য করবো। কলেজে নিয়ে যাবো। একা ছাড়বো না।
হৈমন্তী প্রশন্ন হলো ফুপির কথা শুনে। একা একা চলাফেরার অভ‍্যাস নেই। ভয় ভয় করে। চলাফেরাটা শিখে নেওয়া উচিত ছিল। কিছু সময় আসে যখন পাশে কাউকে পাওয়া যায় না। নিজের কাজ নিজেকেই করতে হয়। সব সময়ের জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকা উচিত। হৈমন্তী আফসোস করতে করতে ফুপিকে নিয়ে বের হলো। বাসার সামনে গাড়ি আছে কিন্তু পার্ক বেশিদুরে না। হেটে যাওয়া আসা করা যাবে। বিকেল টাইমে লোকজন হাটতে বের হয়েছে। শীতের শেষ হয়তো। হৈমন্তী আছে অষ্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরা শহরে দক্ষিণে। চমৎকার একটা শহর। হৈমন্তীর বেশ পছন্দ হয়েছে। আরব মহাসাগরের পাশ ঘেঁষে অবস্থিত অষ্ট্রেলিয়াকে নিয়ে হৈমন্তীর বেশ কৌতূহল ছিল। খুব ইচ্ছা পুরো অষ্ট্রেলিয়া ভ্রমণ করার কিন্তু সেটা সম্ভব না। এর আয়তন অনেক দীর্ঘ।তবে যতটা পারে আশপাশটা ঘুরবে। হৈমন্তী ফুপির হাত ধরে সামনে এগিয়ে গেলো। প্রতিবেশিরদের সঙ্গে আবেদা মির্জার ভালো সম্পর্ক আছে ওটা হৈমন্তীর বেশ ভালো লাগলো। পথে দেখা হলো পাশের বিল্ডিংয়ের এক মহিলার সঙ্গে। ভদ্রমহিলা এটা ওটা জিঞ্জাসা করছে। হৈমন্তী চুপচাপ ফুপিদের কথা শুনতে শুনতে পার্কে পৌঁছে গেলো। দুরে অল্প বয়সি ছেলেমেয়েরা আড্ডা দিচ্ছে। কেউ দৌড়াদৌড়ি করছে। হৈমন্তী সেসব দেখছে। হঠাৎ দুর থেকে জুলি দৌড়ে এসে হৈমন্তীর হাত ধরে বলল,

> হৈমী চলো আমার বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করবে। ওরা তোমার সঙ্গে আলাপ করতে ইচ্ছুক। আসো আসো। মাম্মা ওকে নিয়ে যায়?

হৈমন্তী চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। আবেদা মির্জা ওষ্ঠে হাসি এনে ওকে অনুমতি দিলো। হৈমন্তী ভয়ে ভয়ে বোনের হাত ধরে সামনে এগিয়ে গেলো। প্রচণ্ড ভয় করছে। তাছাড়া ওর তেমন কোনো বন্ধু নেই। যারা আছে একান্ত কলেজে গিয়ে ছাড়া কথা হয়না। হৈমন্তীর চুপচাপ জুলির বকবক শুনছে। হঠাৎ মেয়েটার কি হলো কে জানে। দূর থেকে ওকে দেখেই দৌড়ে এসেছে। জুলি ওকে নিয়ে ওর বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলো। নায়রা সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। হৈমন্তী এদের ছোট। ওদের সঙ্গে কয়েকজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। হৈমন্তীকে এখানে আনার কারণ ও এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে। হৈমী কোনোভাবে সামনের ছেলেমেয়েগুলোর নজরে পড়েছিল তাই এখানে আনা হয়েছে। হৈমন্তী অস্বস্তি নিয়ে সকলের সঙ্গে হাই হ‍্যালো করলো। কথা বলে বুঝলো এরা খারাপ না বেশ ভালো। ফুপি কেনো যে এদের নামে এতগুলো কথা বলেছিল বুঝতে পারলো না। এর মধ্যেই রোহান বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে হৈচৈ করে হাজির হলো। হৈমন্তী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রোহানের চালচলন আর চেহারা মোটামুটি বিদেশিদের মতোই তবে গায়ের রঙটা হালকা চাপা। বাংলাদেশের হলে বলা যায় ছেলে ভীষণ সুদর্শন। রোহানের দৃষ্টি হৈমন্তীর দিকে। লাল গাউনের উপরে কালো রঙের ছোয়েটার আর লাল রঙের মাফলার পরা মেয়েটাকে ওর ছোটখাটো একটা পুতুলের মতো লগছে। এতোটা খেয়াল করে আগে দেখা হয়নি। বিষয়টা ভেবে ও চনচল হয়ে উঠলো। মিষ্টি হেসে জুলিকে বলল,

> ওর চোখের পানি শুকিয়ে গেছে? চোখের পানিতে আমাদের হাউজ ডুবিয়ে দেওয়ার উপক্রম করেছিল। চারদিকে এই সাদার মধ্যে কটকটে লাল রঙে ওকে দখতে পেত্নীর মতো লাগছে।

হৈমন্তী ভ্রু কুচকে রোহানের দিকে তাঁকালো। ছেলেটা ওকে বিনা কারণে খোচা দিচ্ছে কিন্তু কেনো? জুলি ওর কথার উত্তর দিলো,

> ভাইয়া তুই জানিস আমার বন্ধুরা ওকে ভীষণ পছন্দ করেছে। রেড ড্রেসে ওকে দারুন লাগছে।

> ওদের দৃষ্টি পচে গেছে। ওকে এভাবে বাইরে বাইরে ঘুরতে নিষেধ করে দিস।

রোহান যেভাবে হুট করে এসেছিল সেভাবেই চলে গেলো। হৈমন্তী হতবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে নিরাশ হয়ে জুলির দিকে তাকালো। মনের মধ্যে আবির ঘোরাঘুরি করছে। এমনিতেই অশান্তিতে আছে। এসব আজেবাজে বিষয় নিয়ে ও ভাবতে চাইছে না।
__________________
আবিরের ক্লিনিক বন্ধ। যত রোগী ছিল সব বের করে দেওেয়া হয়েছে। হাসপাতালের জব থেকে ওকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ছেলেটার খোঁজখবর নেই সে নিয়ে বাড়িতে কেউ চিন্তিত না। ওর বিষয়টা আরাফাত দেখছে। রাজীব বড় অঙ্কের টাকা দিয়ে কেসটা উল্টোদিকে ঘোরানোর চেষ্টা করছে। মার্ডার না হলে সমস্যা ছিল না। আবিরের ফুপাতো বোন আর ফুপা বেশ মুখোশধারি লোক। প্রথমেই মিডিয়াকে ক্ষেপিয়ে তুলেছে। কিছু একটা হলেই সাংবাদিকদের নিয়ে বসে যাচ্ছে মিটিংয়ে। মাসুদ ঢাকায় বদলি নিয়েছে। বাসাই থাকতে অসুবিধা হচ্ছে না। আমেনা বেগম আবিরের উপরে প্রচণ্ড ক্ষেপে আছে। বদ ছেলেটা নিজের ফুপিকে হত্যা করেছে। যদিও বা না করে তবুও দেশের লোকজন সব জেনে গেছে। মির্জা বাড়ির ছোট জামাই খুনী। উনার মান সম্মান চলে যাচ্ছে। চয়নিকা বুঝিয়েছে বলেছে যখন সত্যি সামনে আসবে তখন আর কেউ আবিরকে ভুল বুঝবে না। অরিন দুপুর বেলায় বাবার বাড়িতে গেছে। এটা আরাফাত জানে না। আসমা বেগম ওকে যেতে বলেছে। বাড়িতে কোনো ছেলেমেয়ে নেই। সবগুলো বাইরে শুধু অরুনি বাড়িতে আছে। মেয়েটাকে কাছে পেলে শান্তি পাবে এই আশায় ওকে ডেকেছে। আরাফাত রাতে বাড়িতে ফিরে ঘরে অরুনিকে না পেয়ে সারা বাড়িতে খোঁজ করলো। ভেবেছিল কাউকে জিঞ্জাসা না করেই খুঁজে নিবে কিন্তু শেষমেশ বাধ্য হয়ে বড় ভাবির রুমে উঁকি দিলো। চয়নিকা তখন ছেলেকে পড়াতে বাস্ত ছিল। আরাফাত গিয়ে সোজাসুজি জিঞ্জাসা করলো,
> ভাবি সেই গাধীটা কোথায়?দেখছি না।
চয়নিকা ঠোঁট উল্টে হেসে বলল,
> মিস করছো বুঝি?
> না সব সময় চোখের সামনে দুখি দুখি মুখ করে ঘুরে বেড়ায় আজ হঠাৎ নেই তাই বললাম। যাইহোক কোথায় তিনি?
> বাবার বাড়িতে। তোমাকে ফোন করা হয়েছিল পাওয়া যায়নি। তুমি সারাদিনব্যাপী কোথায় যাচ্ছো কি করছো কিছুই তো বলে যাও না।আধার রাতের চাঁদ হয়ে গেছো।
> ভাবি এসে বলবো এখন যাচ্ছি ।
> বাহ দুদিনেই বউয়ের প্রতি এতো মায়া?
> একটা মাত্র বউ আমার। হাতছাড়া হতে দেওয়া চলবে না। ঘুমের মেডিসিন বুঝলে?
আরাফাত উত্তরের আশা করলো না। চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে বেরিয়ে গেলো। চয়নিকা সামান্য হেসে ছেলের দিকে নজর দিলো। রাজীব বাড়িতে তেমন থাকতে পারে না। কখন আসে কখন যায় বলা কঠিন। সব সময় লোকজন নিয়ে চলাফেরা করে।
☆☆
ছোট মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে অরিন। আসমা বেগম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর চোখের পানি ফেলছেন। ছেলেটার সঙ্গে কথা বলা হয়নি। কোথায় আছে কি করছে কিছুই জানে না। বড় ছেলেটা বিদেশ গিয়ে বাড়িতে ফেরার নাম করে না। সেখানেই বিয়ে করে সংসার পেতেছে। ছোট ছেলেটার এই কঠিন সময়ে বড় ছেলে একবার ফোন দিয়েছিল মাত্র। সেসব কথা অরিনকে উনি বলছেন। এমন সময় আরাফাত এসে হাজির হলো। কাজীদের বাড়িতে ওর বেশ কদর বেড়েছে। শশুর শাশুড়ি চাচি শাশুড়ি সকলের চোখে এখন ও সুপার হিরো। বিপদে যারা পাশে থাকে তারাই প্রকৃত বন্ধু। ভালো সময়ে বন্ধুর অভাব হয়না কিন্তু খারাপ সময়ে তাদের পাওয়া যায় না। ওরা সুসময়ের বন্ধু। আরাফাতকে দেখে অরিন দ্রুত উঠে বসলো। আসমা বেগম মিষ্টি হেসে আলাপ করলো। আরাফাত উনার পাশে বসে অরিনকে হুকুম দিলো পানি আসতে। অরিন ছুটলো ঠাণ্ডা পানির খোঁজে। আসমা বেগমের দিকে তাকিয়ে আরাফাত বলল,
> চিন্তা করবেন না। আবির ভালো আছে।
> একবার কথা বলা যাবে?
> এখন তো বলা যাবে না। আশাকরি সকালে যাবে। নেটওয়ার্কের বাইরে আছে। আপনি ওকে নিয়ে একটুও ভাববেন না। তাছাড়া এদিকটা আমি সামলে নিবো। ক্লিনিকের তালা ভাঙার ব‍্যবস্থা করছি।
এর মধ্যেই অরিন পানি নিয়ে হাজির হলো। আসমা বেগম জামাইয়ের খাবারের ব‍্যবস্থা করতে উঠে যেতেই আরাফাত অরিনের হাত ধরে বসিয়ে দিয়ে ভ্রু কুচকে বলল,
> না বলে আসার জন্য আজ সারারাত তুমি আমার পা টিপে দিবে।
অরিন চোখ বড়বড় করে বলল,
> দজ্জাল শাশুড়িরা যেমন করে আপনিও আমার সঙ্গে তেমন করবেন?
> দূর ওসব না। সাইকো বরের মতো করবো। কথা না শুনলেই মার চলবে।
অরিন ভেঙচি দিয়ে চলে গেলো। লোকটা যে ওকে পচানোর চেষ্টা করছে বুঝতে বাকি নেই। কঠিন মূহুর্ত্তেও লোকটার মজা করা যায় না। আরাফাত ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। আবিরকে ছাড়িয়ে আনতে গিয়ে বহু ঝামেলা হয়েছে। লোকজনের চোখের আড়ালে টাকা দিয়ে ওকে বের করেছে। তাছাড়া আবিরের নামে এখনো মুল চার্চশিট দেওয়া হয়নি। আগে সুষ্ঠুভাবে তদন্ত হবে তারপর দেখা যাবে। তিনমাস না পার হলে ওসব কোর্টে জমা হবে না। একবার য‍দি ওকে জেলে দেওয়া হয় তিনমাসের আগে বেল পাওয়া যেতো না। আপাতত ওকে সকলের দৃষ্টির আগচরে থাকা জরুরি। আরাফাত ওর হয়ে এদিক সামলে নিবে। মির্জাদের ক্ষমতা আছে সেই সঙ্গে আছে টাকা। দেশে যে হারে দুর্নীতি হচ্ছে সেখানে বাঁচতে হলে এই দুটো থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

চলবে

ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here