রং তুলির ক্যানভাস ২য় খন্ড পর্ব ৩

0
91

#রং_তুলির_ক্যানভাস
#দ্বিতীয়_খন্ড
#পর্ব_৩
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা

“আমাকে ভালোবেসে অন্য একজনকে বিয়ে করতে কষ্ট হলো না তোমার?”

রাফানের প্রশ্নে জোহার সোজা উত্তর,

“না, একটুও কষ্ট হয়নি।”

“এতোটা বদলে গেলে কীভাবে তুমি?”

“যেভাবে আপনি পাল্টেছেন।”

“আমি কিন্তু বিয়ে করিনি জোহা।”

চমকালো না মেয়েটা। বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠেই বলল,

“জানি আমি।”

“তবুও বিয়ে করলে কেন তুমি?”

“ইচ্ছে হয়েছে তাই।”

রাফানের ধৈর্যের বাঁধ যেন ভেঙে গেল নিমিষেই। অধৈর্য হয়ে বলল,

“এই মেয়ে এই কী সমস্যা তোমার? কয়জনকে লাগে তোমার?”

“আমার তো একজন হলেই চলে। কিন্তু আপনার যে অনেক জন লাগে রাফান।”

রাফান অবাক হয়। নিজের কণ্ঠে প্রশ্নের সুর রেখে প্রশ্ন করে,

“মানে?”

সামনে থাকা মানুষটার এমন রূপ দেখে হাসে জোহা। তার আজ বড্ড হাসি পাচ্ছে।

“অবাক হচ্ছেন? অবাক হওয়ার কিছু নেই। আপনার আগের কাহিনিগুলো তো আমার জানা। তবে বিদেশে থাকাকালীন আপনি যা যা করেছেন তা জানতে দেরি হয়ে গেল।”

“কী বলতে চাও তুমি?”

“আপনার বিদেশী একজন প্রেমিকা ছিল সেটা তো বলেননি আমায়। তার সাথে একই বাসায় স্বামী-স্ত্রীর মতো থেকেছেন সেটাও অজানা ছিল আমার।”

চমকে ওঠে ছেলেটা। তার এমন চেহারা দেখে ভালো লাগে জোহার। নিজের হাতে থাকা একটা গোলাপকে খুব শক্ত করে চেপে ধরে সে। হাতে কাঁটা ঢুকে যে র ক্ত পাত শুরু হয়েছে সেদিকে কোনো ধ্যান নেই তার। সে মুখের হাসি প্রশস্ত করে বলে,

“আমাদের সম্পর্কটাকে জোর করে টেনে নিয়ে গিয়েছি আমি। এই সম্পর্ক নিয়ে আপনার কোনো আগ্রহ ছিল না। আমি বোকার মতো কেবল ভালোবেসেছি আপনাকে। ফলস্বরূপ আপনি আমাকে দিয়েছেন অবহেলা, অপমান। আমার গল্পের পাতায় জুড়ে দিয়েছেন বিশ্বাস ঘা ত ক তা এবং প্র তা র ণা র মতো কিছু ভারি শব্দ। কী অপরাধ ছিল আমার? মন থেকে ভালোবেসেছিলাম আপনাকে। কিন্তু আপনি হয়তো আমাকে কখনোই প্রেমিকার জায়গাটা দিতে পারেননি।”

“জোহা ভুল করছ তুমি। এসব তোমাকে আফসান বলেছে তাই না? ওই ছেলে আমার সুখ কখনোই সহ্য করতে পারে না। আমার সম্পর্কে সব মিথ্যা বলেছে সে তোমাকে।”

“কোনটা মিথ্যা রাফান?”

“সব মিথ্যা সব!”

“তাই? বিদেশের মাটিতে তাহলে আপনার কোনো প্রেমিকা ছিল না? জেসিয়া নামের কোনো মেয়েকে আপনি চেনেন না? দিনের পর দিন বিয়ে না করে একজন মেয়ের সাথে শারীরিক সম্পর্কে আবদ্ধ হননি আপনি? আপনাদের ভালোবাসার ফসল হিসেবে ওই মেয়ের গর্ভে আপনার সন্তান আসেনি বলছেন? সেই ছোট্ট প্রাণকে দুনিয়ার আলো দেখানোর আগেই তাকে শেষ করেননি আপনি? এসবই মিথ্যা রাফান? মজার বিষয় কী জানেন? এসব কিন্তু প্রথমে আফসান আমাকে বলতেই চায়নি।”

“তাহলে তুমি এসব কীভাবে জানলে?”

রাফানের প্রশ্নে পুনরায় হাসে জোহা। ছেলেটা কি তবে মেনে নিলো সব!

“আফসানের ফোনে আপনার সাথে কিছু ছবি দেখেছিলাম। আপনার পাশে একজন মেয়েকে খুব ঘনিষ্ঠ অবস্থায় আবিষ্কার করলাম সেদিন। প্রশ্ন করলাম, কে এই ছেলে? আর মেয়েটা কে? আফসান বলল, এটা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আর পাশে ওর প্রাক্তন প্রেমিকা। বিয়ের ছয়দিন আগে এসব দেখে কিছুটা অবাক তো হয়েছিলাম। কিন্তু তা প্রকাশ করিনি ওর সামনে।”

থেমে যায় জোহা। তার হাতে ব্যাথা অনুভব করছে সে। লম্বা শ্বাস নিয়ে বলে ওঠে,

“কৌতুহলী মন আমার জানতে চাইল, বিচ্ছেদ কেন হলো? আফসান হয়তো অস্বস্তিবোধ করছিল। বলতে চাইছিল না সেসব। তবুও আমার জোড়াজুড়িতে বলল, মেয়েটা ওকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছিল। কারণ ততদিনে সে অন্তঃসত্বা। কিন্তু আমার বন্ধুর এক মেয়েকে বেশিদিন ভালো লাগে না। আর এর মধ্যে ওর অন্য একজনকে পছন্দ হয়ে যায়। তাই কিছুদিনের মধ্যে বাংলাদেশে ফিরে আসে।”

এতক্ষণে রাফানের দৃষ্টি নত হয়েছে। যাকে ‘প্রেয়সী’ বলে সম্বোধন করে আজ তার চোখের দিকে তাকাতে পারছে না সে।

“এখন লজ্জাবোধ কার হওয়া উচিত বলুন তো? আমার নাকি আপনার? এতকিছু জানার পরেও আমার আপনার কাছে ফিরে যাওয়া উচিত ছিল?”

“ভুল করে ফেলেছি আমি। তবে বিশ্বাস করো, আমি তোমার জন্যই ওকে ছেড়েছিলাম। আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি জোহা।”

“ইশ্! এই মুখে আমাকে ভালোবাসার কথা বলবেন না। আর বিশ্বাসের কথা তো ভুলেও বলবেন না। অস্বস্তিবোধ হয় আমার। আপনাকে যে কখনো আমি ভালোবেসেছিলাম এটা ভাবলে এখন নিজের উপর ভীষণ রাগ হয় আমার। আমি সেদিন সব জানার পর আপনার মুখ দেখতে চাইনি কোনোদিন। কিন্তু আজ আপনার সামনে দাঁড়িয়েই আমাকে কথা বলতে হচ্ছে। কতোটা দুর্ভাগ্য আমার!”

তন্মধ্যে জোহার হাত র ক্তে মাখামাখি। এতক্ষণ পর তার হাতের দিকে নজর যায় রাফানের। সে অস্থির চিত্তে এগিয়ে আসে জোহার দিকে। হাত ছুঁতে গেলে কয়েক পা দূরে সরে যায় জোহা।

“আমার হাত ছোঁয়ার অধিকার আপনি অর্জন করতে পারেননি। দয়া করে এই স্পর্ধা দেখাবেন না।”

“তোমার হাত থেকে যে র ক্ত ঝরছে।”

“বাহ্যিক কষ্ট দেখলেন। অথচ আমার মনে কি পরিমাণ অসহনীয় যন্ত্রণা হয়েছে তা বুঝতে পারবেন না আপনি কখনোই। শেষ একটাই চাওয়া আমার। আপনার মতো প্রেমিক যেন কারোর নয় হয়।”

র ক্তে মাখামাখি হওয়া গোলাপ ফুল দূরে ছুঁড়ে দিয়ে নিজের মতো করে চলে যায় জোহা। রাফান একই জায়গায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয়।

ঘরে ফিরে হাতের দিকে তাকিয়ে জোহা বিছানায় বসে পড়ে। আফসান জোহার এমন অবস্থা দেখে ছুটে আসে। জোহার ডান হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,

“এসব কীভাবে হলো?”

“গোলাপের থেকে তার শরীরে থাকা কাঁটা আমাকে বেশি আকর্ষিত করে।”

“ইচ্ছা করে এসব করেছ?”

“নিজের উপর রাগ হচ্ছিল ভীষণ।”

“আমি তোমাকে রাগ কমাতে বলব না। কিন্তু রাগ করে নিজের ক্ষতি করা কি বুদ্ধিমতীর কাজ?”

“আমি তো বুদ্ধিমতী নই আফসান।”

“তুমি একজন বিচক্ষণ মেয়ে। আর কখনো এভাবে নিজেকে কষ্ট দিয়ো না কেমন? তোমার কষ্টে আমারো কষ্ট হয়।”

জোহা কিছু বলে না। নিরবে তাকিয়ে থাকে মানুষটার দিকে। আফসান খুব যত্ন করে জোহার হাতে ওষুধ লাগিয়ে দেয়। অতঃপর ব্যান্ডেজ করে দিয়ে হাতের উল্টো পিঠে একটা চুমু এঁকে দেয়।

“সকাল থেকে সাজুগুজু করে স্টেজে বসে ছিলে। ক্লান্ত লাগছে না?”

“কিছুটা ক্লান্ত লাগছে।”

“তাহলে ফ্রেশ হয়ে এসো যাও।”

“আচ্ছা।”

একটা হালকা গোলাপি রঙের থ্রিপিস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় জোহা। হাতমুখ ধুয়ে শাড়ি পাল্টে জামা পড়ে নেয় সে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে আফসানের দিকে তাকিয়ে বলে,

“একটা কথা বলি?”

“হ্যা বলো।”

“আমার না ঘরের মধ্যে দমবন্ধ লাগছে। আমাকে নিয়ে একটু বের হতে পারবেন?”

“কোথায় যেতে চাও?”

“নির্জন কোথাও যেতে চাই। যেখানে আমাদের বিরক্ত করার মতো কেউ থাকবে না।”

“আচ্ছা চলো।”

আফসান যে এক বাক্যে রাজি হয়ে যাবে তা হয়তো আগেই বুঝেছিল জোহা। তাই ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা ফুটে ওঠে তার।

বাড়ি থেকে বের হয়ে জোহা প্রশ্ন করে,

“কোথায় যাচ্ছি আমরা?”

“উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটি চলো। এত ভেবেচিন্তে কোনো কাজ করতে পারি না আমি। তোমাকে নিয়ে বের হয়েছি। কিন্তু কোথায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়েছি সেটা আমার জানা নেই।”

“অচেনা রাস্তায় যদি কোনো বিপদ হয়?”

“আমি আছি তো তোমার পাশে। ভয় পেয়ো না।”

“ভয় পাচ্ছি না। ভালোই লাগছে।”

“একটা প্রশ্ন করি তোমাকে?”

“হুম করুন।”

“গতকাল আমাদের বিয়ে হলো। কিন্তু গতকাল থেকেই তোমাকে অন্যমনস্ক লাগছে। কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গিয়েছ। এর কারণ কী? কাল আমাকে কিছু একটা বলতে চেয়েও বললে না।”

“সত্যি বলতে হয়েছে তো অনেককিছুই। কিন্তু এখন সবকিছু জানার সঠিক সময় নয়। সময় আসুক, আমি নিজে আপনাকে সবকিছু জানিয়ে দিব।”

“এখন বলতে না চাইলে জোর করব না।”

“আচ্ছা আপনি যদি কখনো আমার প্রাক্তনকে দেখেন তখন কী করবেন?”

“বুকে জড়িয়ে নিয়ে ধন্যবাদ জানাব।”

“কেন?”

“তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার জন্য।”

“একটা কথা আগেই বলে দিচ্ছি। আমার প্রাক্তনের সাথে কিন্তু আমার তেমন ঘনিষ্ঠতা ছিল। হাত ধরাধরির বিষয়গুলোও আমাদের মধ্যে ছিল না। আর না তো ছিল ঘনিষ্ঠ কথাবার্তা। আমাকে এখনো কোনো ছেলে স্পর্শ করেনি আফসান। আপনি যদি ভেবে থাকেন আমার প্রাক্তনের সাথে খুব গভীর সম্পর্ক ছিল তাহলে ভুল ভাবছেন। আপনার স্ত্রী আপনার হক অন্য কাউকে দেয়নি।”

“বোকা মেয়ে, আমি কি কখনো তোমাকে এসব জিজ্ঞেস করেছি?”

“আগে থেকেই বলে দিলাম। পরে যেন দোটানায় না পড়েন আপনি।”

“শোনো চাঁদ, তোমার অতীত নিয়ে আমার কোনো ভাবনা নেই। আমার ভাবনা শুধুমাত্র আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে। আমি তোমাকে আমার মাধ্যমে আলোকিত করতে চাই। নিজেকে বিলীন করে হলেও তোমাকে ভালো রাখতে চাই। এর থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কিছু আপাতত আমার জীবনে নেই বুঝলে?”

জোহা চোখের ইশারায় বোঝায়, বুঝেছি!

চলবে??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here