রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ৬ +৭

0
388

#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#পর্ব_৬
#নবনী_নীলা

হুট করেই স্নিগ্ধার ঘুম ভেঙে গেলো। ঘুম ভাঙতেই সে পাশে তাকালো। অভ্র গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। স্নিগ্ধা ঘাড় ঘুরিয়ে ঘড়ির দিকে তাকালো,রাত একটা পনেরো, অথচ আদিল এখনো বাড়ি ফেরেনি। এতো কিসের ব্যস্ততা তার? স্নিগ্ধা বেশ সাবধানে অভ্রের পাশ থেকে উঠে পড়ল। গল্প শুনতে শুনতে অভ্র এই ঘরেই ঘুমিয়ে পড়েছে। স্নিগ্ধা কোনো শব্দ না করে রুম থেকে বেরিয়ে এলো।

এই বাড়িটা তার কাছে ধীরে ধীরে রহস্যময় হয়ে উঠেছে। এই বাড়িতে কোনো ফ্যামিলি ফটো নেই। কিন্তু কেনো? এমন কি অভ্রর ঘরে অভ্রর মায়ের ছবি পর্যন্ত নেই। এইটা কি অন্যায় না? এই বাচ্চাটির কি অধিকার নেই তার মাকে দেখার?

স্নিগ্ধার সন্দেহ আরো গাঢ় হয়েছে যখন সে দোতলার শেষ রুমটি তালাবদ্ধ দেখেছে। রোজ একবার একজন স্টাফ রুমটা পরিষ্কার করে আবার তালা দিয়ে রাখে। বিষয়টা স্নিগ্ধার কাছে খুবই অদ্ভূত লেগেছে। এমন কি আছে ঐ রুমে যে এত যত্ন করে রাখা হয় আর সবার থেকে আড়াল?

স্নিগ্ধা সকাল থেকেই আদিলের জন্যে অপেক্ষা করছিলো। একটা কারণে সে ভীষন রেগে আছে। আজ সে নিজের মা বাবার সাথে দেখা করবে ভেবে বের হতে যাচ্ছিল। সেই সময় গার্ডরা তাকে বের হতে দেয় নি।

আদিল নাকি তাদের বলে রেখেছে তার অনুমতি ছাড়া যেনো স্নিগ্ধাকে বাড়ির বাইরে যেতে দেওয়া না হয়। কিন্তু কেনো? সবকিছুতে ওই লোকটার পারমিশন নিতে হবে কেনো? এমন একটা বাড়িতে তাকে থাকতে হচ্ছে, যেখানে কথা বলার কেউ নেই।কেমন নিস্তব্দ একটি বাড়ি। মনে হয় কতগুলো রবোমানবের মাঝে সে একটি মাত্র মানুষ।

অভ্রর মতন একটা ছোট্ট শিশুকে নাকি জন্মের পর থেকে এই চার দেওয়ালের ভিতরেই থাকতে হচ্ছে। তাহলে কি তার সাথেও তাই হবে। কখনই না, সে এইসব মেনে নিবে না।

অভ্রর ব্যাপারটা জানার পর থেকে স্নিগ্ধার মাথায় রীতিমত রক্ত উঠে গেছে। একটা বাচ্চাকে এইভাবে কষ্ট দেওয়ার কি কোনো মানে হয়?

স্নিগ্ধা সিড়ি বেয়ে নিচে নামতেই দেখলো জিম একপাশে দাড়িয়ে দাড়িয়ে হাই তুলছে। স্নিগ্ধা এগিয়ে গেলো তারপর ভ্রু কুঁচকে বললো,” কোথায় আপনার স্যার?”

স্নিগ্ধাকে দেখে জিম বেশ অপ্রস্তুত হয়ে তাকালো তারপর বললো,” উনি তো আনোয়ার সাহেবের ঘরে ছিলেন।”

জিম ভেবেছিলো এ কথা শুনার সঙ্গে সঙ্গে স্নিগ্ধা উপরের রূমে চলে যাবে কিন্তু না স্নিগ্ধা আরো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পাক্কা গিন্নির মতোন বলল,” এতো রাত হলো কেনো?”

জিম কয়েকবার চোখের পলক ফেলে বললো,” একটা কাজে স্যার আটকে গেছিলো। ”

স্নিগ্ধা বিশ্বাস করেছে বলে মনে হলো না জিমের। মিথ্যে কথাটা ধরতে পেরে সে বিরক্তির নিশ্বাস ফেলে রুমে চলে গেলো। স্নিগ্ধা রুমে ঢুকেই দেখলো আদিল ঘুমন্ত অভ্রর কপালে চুমু একে দিচ্ছে।

আদিলকে দেখে খুব টায়ার্ড মনে হচ্ছে ঠিকই কিন্তু স্নিগ্ধার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো তার হাতে বাঁধা সাদা রুমালটি। যার উল্টা পিঠে বিন্দু বিন্দু রক্তের দাগ ভাসছে। লোকটা কি কাউকে মেরেছে? নাকি নিজেকে নিজে আঘাত করেছে।

স্নিগ্ধাকে এইভাবে দরজার পাশে স্তম্ভিত অবস্থায় দাড়িয়ে থাকতে থেকে আদিল এগিয়ে এলো নিজের ঘড়ি খুলতে খুলতে বললো,” হটাৎ এতো রাত জাগার কি প্রয়োজন পড়লো তোমার? তুমি নিশ্চয়ই আমার জন্যে জেগে নেই?”

স্নিগ্ধা উত্তরে কিছু বললো না। বললে কি বলবে? হ্যা আপনার জন্য জেগে আছি। হ্যা তারপর মহাজন উল্টা পাল্টা কথা শুরু করবে। তাই নিরবতাকেই নিজের হাতিয়ার বানালো সে। আদিল ঘড়িটা একপাশে রেখে মৃদু হেসে মাথা কাত করে জিজ্ঞেস করলো,” তুমি আমার জন্যে অপেক্ষা করছিলে?”

স্নিগ্ধা আদিলের কথায় বেশ অপ্রস্তুত হয়ে তাকালো। তারপর নিজেকে এই অবস্থা থেকে বের করে আনতে সোজা প্রস্ন করে বসলো,” আপনার হাতে কি হয়েছে?”

আদিল ভ্রু কুঁচকে নিজের হাতের দিকে তাকালো। স্নিগ্ধার এক মুহূর্তের জন্যে মনে হলো আদিল হাতের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে রেগে গিয়েছিলো। কিন্তু পরক্ষনেই নিজের রাগ চাপা দিয়ে একটা ভ্রু তুলে বললো,” কেনো তোমার কি আমার জন্যে চিন্তা হচ্ছে?”

স্নিগ্ধার ভীষন রাগ হচ্ছে, আদিল এতো কৌশলে কথাগুলো এড়িয়ে যাচ্ছে যে এই কয়দিনের পরিচয়ে তার পক্ষে অধিকার খাটিয়ে প্রশ্নের জবাব চাওয়া সম্ভব না।

স্নিগ্ধাকে এমন অপ্রস্তুত হতে দেখে আদিল বেশ মজা পাচ্ছে। নিজেকে সংযত রাখতে গিয়ে স্নিগ্ধা রাগটাও দেখাতে পারছে না। আদিল নিশ্চুপে স্নিগ্ধার কাছাকাছি এগিয়ে আসতে লাগলো। স্নিগ্ধা আগে থেকেই দেওয়ালের সাথে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়লো।

আদিল কাছে এসে দুপাশে হাত রেখে দাড়াতেই স্নিগ্ধা অস্থির হয়ে উঠলো। বিচলিত চোখে তাকালো। তার বুকের ভেতরে ধুক ধুক বাড়তে লাগলো। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হচ্ছে না।

স্নিগ্ধা এলোমেলো দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,” কি করছেন কি আপনি?”

আদিল ঘোর লাগা কণ্ঠে বললো,” যা করতে চাইছি সেটা কি করে দেখবো?,” তারপর একটু থেমে স্নিগ্ধার অগোছালো দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে গভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,” হুম্?”

স্নিগ্ধা রাগী চোখে তাকানোর চেষ্টা করলো কিন্তু সে চোখের হালকা লাজুক দৃষ্টিতে আদিল মৃদু হেসে বললো,” তুমি এত ঝাঁঝালো কেনো?”

স্নিগ্ধা এবার ভুত দেখার মতোন করে তাকালো।তারপর রাগান্বিত কণ্ঠে বললো,” ঝাঁঝালো মানে? দেখুন অনেক আজে বাজে বকেছেন। আমার একটাও প্রশ্নের উত্তর তো দিলেন না কায়দা করে এড়িয়ে গেলেন। এখন আমাকে আবার আমাকে ঝাঁঝালো বলছেন। আমি ঝাঁঝালো তো বিয়ে করেছেন কেনো? আমি কি আপনাকে নেমন্তন দিয়ে বলেছিলাম যে আসুন, এসে আমাকে বিয়ে করুন।”

আদিল ঝুকে এসে স্নিগ্ধার কানের কাছে মুখ আনতেই স্নিগ্ধা শিউরে উঠলো। শক্ত করে শাড়ির আঁচল খামচে ধরে চোখ বুঝতেই আদিল ফিচেল গলায় বললো,” কারণ, তোমাকে দেখার পর থেকে ঝাল জিনিস আমার একটু বেশিই ভালো লাগে।”

স্নিগ্ধা আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালো। পাশ ফিরতে আদিলের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে ফেললো সে। তারপর নিজেকে শান্ত করে প্রসঙ্গ ঘুরাতে গম্ভীর গলায় বললো,” দেখুন, আজে বাজে কথা বন্ধ করুন। আপনার সাথে আমার কিছু কথা বলার প্রয়োজন ছিলো। তাই আমি এতক্ষন জেগে ছিলাম।”

আদিল স্নিগ্ধার কানের কাছে মুখ রেখেই বললো,” হুম্, বলো। আমি তো তোমার কাছেই আছি। নাকি আরেকটু কাছে আসতে হবে।” কথাটা বলে স্নিগ্ধার দিকে তাকাতেই দেখলো স্নিগ্ধা চোখ ছানবড়া করে তাকিয়ে আছে।

আদিল মনে মনে হাসলো তারপর স্নিগ্ধাকে আরো ভয় দেখতে একটু সিরিয়াস ভঙ্গিতে এগিয়ে আসতেই। স্নিগ্ধা আদিলের হাতের নিচ বেড়িয়ে এলো। তারপর জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগলো। হার্ট বিট যেনো কয়েকগুণ বেড়ে গেছে তার।

আদিল মাথা নিচু করে হেসে ফেললো। তারপর দেওয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে ঘুরে দাড়ালো।বুকের কাছে হাত ভাজ করে স্নিগ্ধার দিকে অপলকে তাকিয়ে রইলো। স্নিগ্ধা আড় চোখে একবার আদিলের দিকে তাকিয়ে বিছানায় গিয়ে অভ্রর পাশে চুপচাপ শুয়ে পড়লো। জেগে থেকে যে এমন বিপদে পড়তে হবে কে জানতো। কি সাংঘাতিক লোক রে বাবা! স্নিগ্ধা চাদর টেনে গলা পর্যন্ত দেখে চোখ বন্ধ করে রইলো। যা প্রশ্ন সেগুলো সকাল বেলা করতে হবে।

আদিল ফোঁস করে হেসে ফ্রেশ হতে চলে গেলো। কিন্তু সে জানে স্নিগ্ধার এই প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি তাকে আবার হতে হবে। কিন্তু স্নিগ্ধাকে সবটা বললে সে কি তাকে বুঝবে? যদি ভুল বুঝে ছেড়ে চলে যায়! তখন কি সে আটকাতে পারবে?

⭐ ভোরের আলো চোখে পড়তেই স্নিগ্ধার ঘুমটা ভেঙে গেলো। কিন্তু সে গাঢ় ঘুমের কারণে চোখ খুলতে পারলো না। তারপর হাত বাড়িয়ে অভ্রকে জড়িয়ে ধরতেই তার মনে হলো সে শক্তপেশির কাউকে জরিয়ে ধরেছে। স্নিগ্ধা গাঢ় ঘুমের রেশ কাটিয়ে আস্তে আস্তে চোখ মেললো। তারপর সামনে তাকাতেই চোখ কপালে উঠে গেলো স্নিগ্ধার, ঘুমের ঘোরে এতক্ষণ তাহলে সে আদিলকে জড়িয়ে রেখেছে? স্নিগ্ধা দুঃস্বপ্ন দেখার মতোন লাফ দিয়ে উঠে বসে পড়লো।

সকাল সকাল মারাত্মক একটা শক খেয়ে ঘুম ভেঙেছে তার। হৃদ কম্পন বেড়ে গেছে অস্বাভাবিক ভাবে। স্নিগ্ধা ভ্যাবাচেকা খেয়ে আড় চোখে ঘুমন্ত আদিলের দিকে তাকালো। আসলেই কি ঘুমিয়ে আছে? জেগে থাকলে তো ভীষন বিপদ। কিন্তু সে আদিলের এতটা কাছাকাছি কি করে গেলো? মাঝে তো অভ্র ছিলো। স্নিগ্ধা মাঝে তাকিয়ে দেখে অভ্র নেই। কোথায় গেলো? ভেবেই চমকে আশে পাশে তাকিয়ে সে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো।

তারপর অনায়াসে তার মুখে হাসি ফুটে গেলো। এ কেমন সুন্দর মুহূর্তের সাক্ষী সে? আদিলের বুকের সাথে একদম মিশে আদিলকে জড়িয়ে ধরে ঘুমে অচেতন হয়ে আছে অভ্র। আদিল তার এক বলিষ্ঠ হাতে আগলে রেখেছে তাকে। দেখেই কেমন মায়ায় পড়ে গেলো সে।

পরক্ষনেই এই মহূর্তটাকে ক্যামেরা বন্দি করতে পা টিপে টিপে উঠে পড়লো সে। নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে ছবি তুলতেই ক্যামেরার ফ্ল্যাশ লাইট গিয়ে পড়লো আদিলের চোখে। স্নিগ্ধা একদম খেয়ালই করে নি যে লাইটটা অন করা ছিলো। ছবি তোলার পর দেখলো, আদিল ঘুম ঘুম চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। স্নিগ্ধা ফট করে ফোনটা লুকিয়ে ফেলে কিছু না হওয়ার ভান করতে লাগলো। কোনো লাভ হচ্ছে কিনা সে জানে না। আদিল তো তাকে ফোন হাতে দেখে নিয়েছে। এইবার আবার কি উল্টা পাল্টা কথা শুনতে হয় তাকে?

[ #চলবে ]

#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#পর্ব_৭
#নবনী_নীলা

” তুমি কি সবসময় লুকিয়ে লুকিয়ে আমার ছবি তুলো?”, রুমে পা রাখার সাথে সাথে প্রশ্নটা কানে এলো স্নিগ্ধার। ভীষন অসস্তিতে পড়ে গেলো সে। আদিল সকালে তখন প্রশ্ন না করায় সে ভেবেছিলো হয়তো লোকটা কিছুই দেখেনি কিন্তু নাহ্ সে ভুল ছিল। এইযে রুমে পা ফেলতে না ফেলতেই প্রশ্ন ছুড়ে মারলো।

কিন্তু স্নিগ্ধা ও কম যায় না। সে প্রশ্ন না শোনার ভান করে আদিলকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতেই আদিল ফট করে স্নিগ্ধার হাত ধরে ফেললো। স্নিগ্ধা অগ্নিমূর্তি হয়ে তাকালো তারপর গম্ভির গলায় বললো,” আমার হাত ছাড়ুন।”

সেই গাম্ভীর্যতা উপেক্ষা করে আদিল স্নিগ্ধার কোমড় জড়িয়ে রেখে হাত ছেড়ে দিলো তারপর ঠোঁটের কোন মৃদু হাসি রেখে বললো,” লুকিয়ে লুকিয়ে ছবি তুলছো, তাহলে কি ভালোবাসতে শুরু করেছো আমায়?”

স্নিগ্ধা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থেকে বললো,” নাহ্। আপনাকে ভালোবাসা আমার পক্ষে সম্ভব না। আপনার কাছে তো আপনি যেটা চান তার মূল্যই বেশি, কখনো জানতে চেয়েছেন অন্য মানুষটি কি চায়? আমাকে বাড়িতে বলতে গেলে আটকে রাখা হয়েছে, বের হতে দিচ্ছে না। কেনো? কারণ আপনি না করেছেন। কিন্তু কেনো? এমন বন্দি জীবন কাটানো আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি চার বছরের অবুঝ অভ্র নই যে আমাকে এইভাবে বন্দি করে রাখবেন।”

আদিল একটা নিশ্বাস ফেলে তাকালো। স্নিগ্ধা রীতিমত রেগে আগুন। আদিলকে চুপ করে থাকতে দেখে স্নিগ্ধা আবার বললো,” কি হলো? বলছেন না।, কেনো আমি বাইরে যেতে পারবো না?”

আদিল একটু ঝুঁকে এসে থমথমে গলায় বললো,” কে বলেছে তুমি বাইরে যেতে পারবে না? অবশ্যই পারবে। কিন্তু আমি তোমার সঙ্গে যাবো।”

স্নিগ্ধা এবার ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তারপর কঠিন গলায় বললো,” কি আশ্চর্য! আপনি আমার সঙ্গে যাবেন মানে? আমি একা একা চলাফেরা করতে পারি না নাকি?”

” হয়তো পারো কিন্তু আমি তোমাকে একা একা চলা ফেরা করতে দিবো না। আমাকে তো খেয়াল রাখতেই হবে। তাই না? নয়তো আমার ডেঞ্জারাস শাশুড়ি আমার হাড় ভেঙে ফেলবে।”, আদিলের এমন খাপ ছাড়া কথায় স্নিগ্ধা বিরক্তির নিশ্বাস ফেলে তাকালো। তারপর ফট করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দ্বিতীয় কোনো বাক্য না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। প্রচন্ড রেগে আছে সে।

স্নিগ্ধা চলে যেতেই জিম রুমে আসলো। জিম ভয়ে ভয়ে ভিতরে এসে দাড়াতেই আদিল জিজ্ঞেস করলো,” সুনেয়রার সাথে কনট্যাক্ট করতে পেরেছো?”

জিম না সূচক মাথা নাড়তেই আদিল চোয়াল শক্ত করে ফেললো। তারপর চাপা কণ্ঠে চোখ রাগিয়ে বললো,” তোমাকে আমি কি বলেছিলাম? সুনেয়রার সাথে আমার কথা বলা প্রয়োজন। নাম্বার না পেলে আদার ওয়েতে কনট্যাক্ট করার উপায় বের করো।”

জিম নিচু স্বরে বললো,” তার ম্যানেজারের নাম্বার পেয়েছি কিন্তু তাতে লাভ হবে না। স্যার, বুঝতেই পারছেন যার বাবা রাজনৈতিক দলের একজন বিশিষ্ট পদে রয়েছেন। তার সাথে যোগাযোগ করাটা আমাদের জন্যে এতো সহজ হবে না। ।”

আদিল রাগ সামলে বললো,” সহজ না হলেও করতে হবে, জিম। আর কোনো ওয়ে নেই। হ্যা একটা তো আছেই, আমি নিজের হাতে ওই বাস্টার্ডটাকে শেষ করতে পারি।”

” স্যার, এতো উত্তেজিত হবেন না।”, শান্ত গলায় বললো জিম।

” আমি উত্তেজিত হবো না? ঐ বাস্টার্ডটা এখন অভ্র আর স্নিগ্ধার ক্ষতি করবে বলছে। আমার সামনে আরেকবার পরলে তো ওকে আমি মেরেই ফেলবো।”, রেগে গিয়ে বললো আদিল।

” স্যার, মিস সুনেয়রা যদি দেশে থাকতেন আমাদের জন্য ব্যাপারটা অনেক সহজ হতো কিন্তু আমি যতটুকু জেনেছি উনি দেশের বাইরে আছেন। আপাদত ওনার ঘনিষ্ট একজনের ইনফরমেশন পেয়েছি।”

আদিল চুপ করে থেকে বললো,” হুম সেটাই আমাদের কাজে লাগাতে হবে।” আদিলের কথা শুনে জিম হাতের ট্যাবটা এগিয়ে দিয়ে পুরো বিষয়টা বললো।

__________

স্নিগ্ধা অভ্রর ঘরে গাল ফুলিয়ে বসে আছে। সে নিজের বাড়িতে যেতে চায়।

অভ্র ভিডিও গেইম খেলতে ব্যাস্ত। স্নিগ্ধা ভ্রু কুঁচকে স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে। হুট করে আদিল রুমে ঢুকেই স্নিগ্ধার পাশে বসে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে স্নিগ্ধা কিছুদূর সরে বসলো। আদিলকে দেখলেই তার রাগ হচ্ছে। আদিল বেশ আন্দাজ করতে পারছে স্নিগ্ধার রাগ। তাই অভ্রকে ডাকলো,” অভ্র। অভ্র…… অভ্র”

অভ্র ভ্রু কুঁচকে আদিলের দিকে তাকালো তারপর গাল ফুলিয়ে আবার গেইম খেলতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। এই জনাবের তো আবার নাম বদলে যায়। কি নাম হয়েছে আজকে? আদিল কয়েকবার ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকলো। কোনো সাড়া নেই। বাহ্ এরা সবাই মিলে তাকে বয়কট করছে? ম্যাডাম তো তার দিকে তাকাচ্ছে পর্যন্ত না ।

আদিল ফোস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,” অভ্র তুমি কি ঘুরতে যেতে চাও? না যেতে চাইলে থাকো আমি চলে যাচ্ছি।” বলেই আদিল উঠে পড়লো।

কথাটা শুনে অভ্র আর স্নিগ্ধা দুজনেই ভ্রু কুঁচকে একবার আদিলের দিকে তাকালো কিন্তু উত্তরে কিছু বললো না। আদিল দরজা পর্যন্ত গিয়ে থামলো। কেউ কোনো রেসপন্স করছে না কেনো? অভ্র আগে তো ঘুরতে যাওয়ার কথা শুনে লাফিয়ে উঠতো। আদিল ঘাড় ঘুরিয়ে আড় চোখে পিছনে তাকালো। তারপর আবার জিজ্ঞেস করলো,” তার মানে সত্যিই যেতে চাও না?”

স্নিগ্ধা মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকালো। কিন্তু অভ্র আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,” কোথায় যাবো?”

আদিল মৃদু হেসে স্নিগ্ধার দিকে ইশারা করে বললো,” ওদের বাড়িতে।” স্নিগ্ধা অন্যদিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থায় ভ্রু কুঁচকে ফেললো। অভ্র মহা আনন্দে লাফিয়ে উঠে বললো,” ইয়ে! আমি যাবো।”

আদিল পরক্ষনেই বললো,”কিন্তু, ও মনে হয় আমাদের নিবে না।”

অভ্র নাচা বন্ধ করে হা করে তাকিয়ে রইল তারপর ছুটে স্নিগ্ধার কাছে গিয়ে বলল,” তুমি আমাদের নিবে না। চলো না যাই।”

স্নিগ্ধা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। লোকটা যে প্রচুর মাথা খাটিয়ে প্রতিটা কাজ করে সেটা প্রতি মুহুর্তে সে টের পাচ্ছে। সামনের মানুষটা বাধ্য তার কাছে হার মেনে নিতে। স্নিগ্ধার রাগ দেখিয়ে বসে থাকবার উপায় নেই। যেতে না চাইলে অভ্র কান্নাকাটি শুরু করবে সেটা সে চায় না। শেষে উপায় না পেয়ে স্নিগ্ধা রাজি হলো।

স্নিগ্ধা রুমে যাচ্ছিলো তৈরি হবে বলে। জিমকে দেখে স্নিগ্ধা থামলো। ঐ বুদ্ধিমান লোকটা থেকে কথা বের করা না গেলে একেই তার হাতিয়ার বানাতে হবে। স্নিগ্ধা জিমের সামনে ভ্রু কুঁচকে দাড়িয়ে পড়লো। জিম চোখের পাতা দুবার ফেলে বললো,” ম্যাডাম আপনার কিছু প্রয়োজন?”

স্নিগ্ধা দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে বললো,” আপনাকে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। উত্তর না দিলে সত্যি বলছি আপনার কপালে দুঃখ আছে।”

হটাৎ স্নিগ্ধার এমন আচরণে জিম চিন্তিত মুখে তাকালো। কিন্তু সে শান্ত গলায় বললো,” কি জানতে চাচ্ছেন বলুন।”

জিম এতো সহজে বলতে রাজি হয়ে যাওয়ায় স্নিগ্ধা একটু চিন্তা করে বললো,” আচ্ছা, তাহলে বলুন। আমাকে এই বাড়ি থেকে বের হতে দেয় না কেনো? আর কালকে ওনার এতো দেরী হয়েছে কেনো আসতে? আর হাতে কি হয়েছিলো? উনি কাউকে মেরেছিলেন?”

জিম চুপ করে রইলো। স্নিগ্ধা এমন প্রশ্ন করবে সেটা সে বুঝতে পারে নি। সে প্রতিউত্তরে বললো,” সরি, আপনার একটা প্রশ্নের উত্তরও আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব না। আবরার ফাইয়াজের প্রাইভেসি রক্ষা করা আমার দায়িত্ব।”

” বলবেন না মানে? বলতেই হবে। ওই আবরার ফাইয়াজকে কিছু করতে পারি না তাই বলে আপনাকে পারবো না? আপনার বারোটা বাজিয়ে ছাড়বো আমি। বলুন বলছি।”, ভয় দেখিয়ে বললো স্নিগ্ধা। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। জিম দুঃখিত মুখে বললো,” আমার পক্ষে আপনাকে কিছু বলা সম্ভব নয়। সময় হলে স্যার নিজেই বলবে। একটু অপেক্ষা করুন।”

স্নিগ্ধা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। বাহ্ অসভ্য লোকটা তার আশেপাশের সবাইকে নিজের মতন ট্রেনিং দিয়ে রেখেছে। পেট থেকে যদি একটাও কথা বের হয়। ইচ্ছে করছে!! উফ! শান্ত হ স্নিগ্ধা। বুদ্ধি খাটা। এরা চালাক হলে তুই কি কম নাকি?

স্নিগ্ধা আবারো পথ আটকে বললো,” আচ্ছা একটা কিছু বলে যান। এইভাবে আমার মাথায় প্রশ্ন জমা হতে থাকলে আমি তো পাগল হয়ে যাবে।”

জিম নিরবে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,” আপনার করা প্রথম প্রশ্নটির সাথে শেষ প্রশ্নটির যোগ আছে। এবার বুদ্ধি দিয়ে বের করুন। এর চেয়ে বেশি কিছু আমি বলতে পারবো না।” এতোটুকু বলে জিম স্নিগ্ধাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো।

স্নিগ্ধা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। রাগে বির বির করে বললো,” যেমন শেয়াল তেমনি তার ছানা। বলছিলাম কিছু বলে যেতে, আমাকে ধাঁধা ধরিয়ে দিয়ে যেতে বলেছি?”

স্নিগ্ধা রাগে গজগজ করতে রুমে গেলো। শেষে কোন প্রশ্নটা করেছিলো। সেটাই তার মাথায় আসছে না। সে কি এদের মতন কথা মেপে মেপে বলে যে পরের লাইনে ফাঁদ পেতে রাখবে। আজব মানুষজন।

স্নিগ্ধা আনমনে রুমে এলো তারপর নিজের ব্লাউজ নিয়ে ওয়াশরুমের চলে গেলো। প্রথম প্রশ্নটা করেছিলো তাকে বাড়ির বাইরে যেতে দেওয়া হয় না কেনো? তারপর কি বলেছিল? ভাবতে ভাবতেই ব্লাউজ পড়ে সে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো। তারপর আনমনে শাড়ী পড়তে লাগলো।

শাড়ির কুচি হাতে নিয়ে আবারো সে চিন্তায় পড়ে গেলো। শেষের প্রশ্নটা কি ছিলো যে রাতে বাড়ি দেরী করে ফিরেছে কেনো? নাহ্, এইটার সাথে কিসের যোগ থাকবে। অদ্ভূত। আর কয়েকদিন এদের সঙ্গে থাকলে নির্ঘাৎ পাগল হয়ে যাবে সে। ভাবতে ভাবতে কুচি ঠিক করে পড়লো। তারপর আঁচলটা ঠিক করে ব্লাউজের ফিতা বাঁধতে গিয়ে বিপাকে পড়লো।

স্নিগ্ধার এইবার অসহ্য লাগছে। একে তো এই আবরার ফাইয়াজ শেয়াল কোথাগার আবার সঙ্গে নিয়ে ঘুরে জিম নামের এই শেয়াল ছানা। দুজন মিলে তাকে পাগল করে দিবে।

স্নিগ্ধা চুলগুলো একপাশে এনে আবারো ব্লাউজের ফিতা আটকাতে চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। স্নিগ্ধা রাগে গরগর বললো,” কি আজব বাড়ি! এইখানে তো এই একজন মেয়েই আছে। আর সেটা আমি নিজেই। এইবার আমার ফিতা বেধে দিবে কে?”

হটাৎ স্নিগ্ধার মনে হলো কে যেনো তার হাত থেকে ফিতাটা নিয়ে বেধে দিয়েছে। মুহূর্তেই স্নিগ্ধা থমকে গেলো। কি হলো এইটা? চমকে উঠে পিছনে ফিরতেই তার মুখ হা হয়ে রইলো। তার সামনে আদিল দাড়িয়ে আছে। তাহলে কি সে তার ফিতে বেধে দিয়েছে?
স্নিগ্ধার বিস্ময় না কাটতেই আদিল বললো,” এরপর থেকে তোমার কোনো প্রয়োজনে আমাকে ডাকবে।”

স্নিগ্ধার সঙ্গে সঙ্গে চোখ গেলো দরজার দিকে। দরজা তো লাগানো তাহলে এই লোক ভিতরে এলো কি করে।নাকি প্রথম থেকেই ছিলো, সে খেয়াল করেনি। তার মানে এতোক্ষণ কি সে আদিলের সামনে শাড়ী বদলেছে। ভেবেই পীলে চমকে উঠলো তার। দু পা পিছিয়ে গিয়ে কাপা কাপা গলায় বললো,” আপনি ভিতরে এলেন কি করে?”

আদিল মৃদু হেসে বলল,” আমি তো এখানেই ছিলাম।” মৃদু হাসির মাঝে হালকা দুষ্টুমির ছাপ দেখে শিউরে উঠলো স্নিগ্ধা।

[ #চলবে ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here