রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ১৪+১৫

0
299

#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#পর্ব_১৪
#নবনী_নীলা

স্পৃহা ফুলগুলো থেকে একটা ফুল জিমের দিকে এগিয়ে দিতেই জিম তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললো,” আমার লাগবে না।”
স্পৃহা ভ্রু কুঁচকে তাকালো তারপর বিরক্তি নিয়ে বললো,” কি আশ্চর্য! আপনাকে ফুল দিয়েছে কে? আপনার মাথায় কি সমস্যা আছে। ভাবলেন কি করে যে, আমি স্পৃহা তাসনিম আপনাকে ফুল দিবো।” বলেই ফুলটা জিমের হাতে ধরিয়ে দিলো। জিম হতবাক হয়ে তাকালো। এই মেয়ের মুখের কথা আর কাজের সাথে কোনো মিল নেই।

স্পৃহা আড় চোখে তাকিয়ে বললো,” ওটা আপনাকে দেই নি। ওটা আপুর জন্যে, আপুকে দিবেন। বুঝেছেন?”

জিম চোয়াল শক্ত করে তাকালো। এই মেয়ের সাথে কথা বাড়ানোর কোনো মানে হয় না। জিম তপ্ত নিশ্বাস ফেলে স্পৃহাকে রেলে ওদের বাড়ির দিকে হাটা দিলো। স্পৃহা দৌড়ে দৌড়ে জিমের পিছে পিছে ছুটতে লাগলো। স্পৃহার ইচ্ছে করছে জিমের পিছনে জঙ্গলী কুকুর ছেড়ে দেয়। কুকুর গুলো জিমকে তাড়া দিবে আর স্পৃহা বসে বসে বসে সেই দৃশ্য দেখবে। তাহলে মনে শান্তি পাওয়া যাবে।

জিম স্পৃহাদের বাড়ির গেটে এসে থামলো। স্পৃহা হাপাতে হাপাতে পিছু পিছু এলো। জিম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো স্পৃহার দিকে তারপর বললো,” কোথায় কাউকে তো দেখলাম না। কোন ছেলে নাকি তোমায় ডিস্টার্ব করে?”

স্পৃহা ভ্রূ কুচকে বললো,” সারাদিন চোখে এমন সানগ্লাস পরে থাকলে দেখবেন কি করে? ঐ ছেলেগুলো সূযোগ বুঝে আসে, এমন রোবোটিক মানব সঙ্গে থাকলে ছেলে তো দূরে থাক কোনো মেয়েও আসবে না আমার আশেপাশে।”

জিম বিরক্ত হয়ে বলল,” স্পৃহা! তুমি শুধু শুধু আমার কতটা সময় নষ্ট করলে তোমার কোনো ধারণা আছে?”

স্পৃহা কাঠ কাঠ গলায় বললো,” নাহ্, নেই। সময় নষ্ট হয়েছে, ভালো হয়েছে। আপনি কালকে আবার আসবেন। ছেলেগুলোকে না দেখিয়ে আমি আপনাকে ছাড়বো না।”

জিম দাতে দাঁত চিপে বললো,” তুমি..”বলেই থেমে গেলো। এর মাঝেই ফরিদা আপা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন এক গাল হাসি নিয়ে তারপর স্পৃহার দিকে তাকিয়ে বললেন,” ছোটো আফা চলে আইসেন?” তারপর জিমকে দেখে হতবাক হয়ে এক গালে হাত রেখে বললেন,” ওমা আফনে আসলেন কুন বেলা?”

জিম বিরক্তির চরম পর্যায়ে গেলো তারপর এক মুহুর্ত সেখানে না দাড়িয়ে গাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটা দিলো। ফরিদা আপা অবাক হয়ে স্পৃহার দিকে তাকিয়ে বললো,” চইল্যা গেলো কেনো?”
স্পৃহা তীক্ষ্ণ গলায় বললো,” তুমি যাও পিছু পিছু গিয়ে জিজ্ঞেস করে এসো, চইল্যা গেছে কেনো?” বলেই বাড়িতে ঢুকলো।

আয়েশা খাতুন আজ দেরী করে স্কুলে যাচ্ছেন। স্পৃহা এগিয়ে গিয়ে নিজের মাকে একটা গোলাপ দিয়ে বললো,” ভালোবাসা দিবসের শুভেচ্ছা আম্মু।” আয়েশা খাতুন হেসে উঠে বললেন,”এই ফুল হাতে বুঝি আমি এখন স্কুলে যাবো?”

স্পৃহা বাকা হাসি দিয়ে বলল,” হুম, যাও। কেউ জিজ্ঞেস করলে বইলো বাবা দিয়েছে।”

আয়েশা খাতুন আড় চোখে তাকিয়ে বললেন,” তোমার বাবা দিবে ফুল। তাহলেই হয়েছে। ওনার দ্বারা এইগুলো হবে না। আচ্ছা আমি যাই আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে। তুমি খেয়ে নিও।”বলেই তিনি বেড়িয়ে পড়লেন। স্নিগ্ধা নিজের রুমে চলে এলো। জিম তাকে রাগ দেখালো কেনো এই নিয়ে তার মেজাজ ভীষন খারাপ। এই জিম নামের ডিম এতো বেদ্যোপ তার জানা ছিল না।

__________

স্নিগ্ধা ভেবে পাচ্ছে না এই ফাহাদ রেজওয়ান লোকটা ঠিক কি চাইছে। তাকে ফোন করে হটাৎ এতোগুলো কথা বলার মানে কি? তার নিজেকেই এইসব প্রশ্নের উত্তর বের করতে হবে। কারণ আদিল বা জিম এরা এতো ধুর্ত যে এদের থেকে কথা আদায় করা সম্ভব না। তাকেই কিছু একটা করতে হবে। অভ্রকে সে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে কিন্তু অভ্রর তো বাচ্চা সে কি করে জানবে।

স্নিগ্ধা আবারো সেই লক করা রুমটার সামনে গেলো। এই রুমটায় হয়তো তার অনেক প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে। কিন্তু ভীতরে গিয়ে যে দেখবে তার উপায় নেই। স্নিগ্ধা যার অস্পষ্ট ছবি দেখেছিলো সে যে অভ্রর মা এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু অভ্রর মায়ের পরিচয় আড়াল করবার কারণ কি? স্নিগ্ধা অনেক্ষন ধরে রুমটার সামনে দাড়িয়ে আছে।

পাসওয়ার্ড কি হতে পারে সেই নিয়ে তার কোনো আইডিয়া নেই। নিশ্চয়ই মারাত্মক কঠিন কিছু হবে। স্নিগ্ধা একবার ট্রাই করবে ভেবে হাত বাড়াতে না বাড়াতেই জিম এসে হাজির। জিমকে দেখে স্নিগ্ধা সঙ্গে সঙ্গে নিজের হাত গুটিয়ে পিছনে নিয়ে গেলো।

জিম স্নিগ্ধাকে হটাৎ এই রূমের সামনে দেখে বললো,” এইখানে কি করছেন?”

স্নিগ্ধা অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,” কিছু না।”

স্নিগ্ধা ধরা পড়ে যাওয়ায় জিম একটু হেসে বললো,” নিচে চলুন। আমাদের বের হতে হবে।”

স্নিগ্ধা ভ্রু কুঁচকে বললো,” কোথায় যাবো?”

” অভ্রকে আজ বাইরে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। ভুলে গেলেন?”, জিমের কথা শুনে স্নিগ্ধার মনে পড়লো। তারপর ঠোঁট কামড়ে নিচে নেমে এলো। নিচে অভ্র লাফালাফি করছে। বাইরে যাবে শুনে সে বেশ খুশি। আদিলকে দেখে স্নিগ্ধা ভ্রু কুঁচকে দাড়িয়ে পড়লো। পিছনে জিমকেও দাড়াতে হলো। জিম ব্যাস্ত হয়ে বললো,” কি ব্যাপার দাড়িয়ে পড়লেন কেনো?”

স্নিগ্ধা ক্ষোভ ভরা কণ্ঠে বললো,” এই লোকটা এইখানে কি করছে? অভ্রকে নিয়ে যেতে এতো মানুষ লাগবে? আমি এই লোকটার সাথে যাবো না।”

জিম অপ্রস্তুত হয়ে বললো,” সেটা আপনাদের মধ্যকার ব্যাপার। আমাকে বলছেন কেনো?”

স্নিগ্ধা ভ্রু কুঁচকে তাকালো জিমের দিকে তারপর হনহনিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো। আদিল গাড়ির সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাড়িয়ে ছিল। স্নিগ্ধা সামনে এসে দাড়াতেই আদিল ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে স্নিগ্ধার দিকে তাকালো। স্নিগ্ধা এক মুহুর্ত বিলম্ব না করে বললো,” আমি আপনার সাথে যাবো না। হয়, আপনি যাবেন নয়তো আমি।”

আদিল ভ্রু কুঁচকে তাকালো। হটাৎ কি হলো এই মেয়ের? আদিল ফোনটা ডান পকেটে ভরতে ভরতে বললো,” সেটা হচ্ছে না। কারণ তুমি আমি দুজনেই যাচ্ছি।”

স্নিগ্ধা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললো,” তাহলে আপনি যান আমি যাবো না।” বলেই চলে যেতে নিলো। আদিল ফট করে স্নিগ্ধার হাত ধরে টেনে একদম নিজের কাছে নিয়ে এলো। সবার সামনে আদিল এভাবে তাকে নিজের কাছে নিয়ে আসবে ভাবতে পারেনি স্নিগ্ধা। স্নিগ্ধা কটমট করে তাকালো।

আদিল জিমকে কি ঈশারা করতেই, জিম অভ্র কিছু দেখার আগেই তাকে কোলে করে অন্য একটা গাড়িতে উঠে বসলো।

জিম চলে যেতেই স্নিগ্ধা নিজের হাত ছাড়িয়ে নিতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। কিন্তু ছাড়াতে না পেরে রেগে গিয়ে বললো,” কি করছেন কি? লজ্জা করছে না আপনার?”

আদিলের ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে আছে স্নিগ্ধার দিকে। আদিল স্নিগ্ধার দুইহাত পিছনে নিয়ে গিয়ে লক করে দিতেই স্নিগ্ধা ভরকে গিয়ে তাকালো। আদিল দূরত্ব কমিয়ে এনে স্নিগ্ধার চোখের দিকে তাকালো। স্নিগ্ধা একটা ঢোক গিলে একটু পিছিয়ে এলো। আদিলের এমন স্থির দৃষ্টি তাকে অস্থির করে তুলতে যথেষ্ঠ।

আদিল স্নিগ্ধার অস্থিরতা টের পেয়ে মনে মনে হাসলো। তারপর ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,” ভাবছি দুজনেই থেকে যাই। আফটার অল আজকে ভ্যালেন্টাইন ডে।” বলেই এক হাত স্নিগ্ধার কোমড়ে ডুবিয়ে দিতেই শিউরে উঠলো স্নিগ্ধা। ঠোঁট কামড়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো সে। বুকের ভিতরে ধুক ধুক শুরু হয়েছে তার।

আদিল মুখটা স্নিগ্ধার কানের কাছে আনতেই তার নিশ্বাস আছড়ে পড়লো স্নিগ্ধার গলায়। আদিল ফিসফিসিয়ে বললো,” আমার একটু উষ্ণতা লাগবে তোমার থেকে।”

স্নিগ্ধা নিজেকে শান্ত করে খুব ধীরে চোখ খুলে তাকালো। কিন্তু তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এসেছে। উষ্ণতা লাগবে মানে? কি বলতে চাইছে আদিল! স্নিগ্ধা অস্পষ্ট স্বরে বলল,” মানে?”, বলেই দৃষ্টি সরিয়ে ফেললো সে।

আদিল মৃদু হেসে স্নিগ্ধাকে নিজের দুই বাহুতে আবদ্ধ করে নিজের সাথে মিলিয়ে নিয়ে স্নিগ্ধার চুলের ভাজে মুখ গুজে দিলো, শিউরে উঠে আবারো চোখ বুজে ফেললো স্নিগ্ধা। হুট করে আদিলের এতো কাছে চলে আসায় স্নিগ্ধার অস্থিরতা আরো বেড়ে যায়। কিন্তু হটাৎ কেনো জানি তার ভালোলাগছে এই বাঁধনটা, এভাবে জড়িয়ে থাকাটা।

কিন্ত কয়েক মুহুর্তেই ফাহাদের বলা সেই কথা মনে পড়ে গেলো তার। অজানা এক ভয় গ্রাস করলো তাকে। আদিল কি সত্যি তাকে ব্যাবহার করছে নিজের প্রয়োজনে? ভেবেই বুকের ভিতরটা কেপে উঠলো তার। পরক্ষনেই স্নিগ্ধা কঠিন ভঙ্গিতে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। তারপর সরে দাঁড়ালো, আদিল স্নিগ্ধার এমন আচরণে বেশ অবাক হলো। স্নিগ্ধার চেহারায় লাল আভার মাঝে কোথাও যেনো এক অভিমানী মেঘ বাসা করেছে।

[ #চলবে ]

#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#পর্ব_১৫
#নবনী_নীলা

এমন সুন্দর একটা জায়গা কিন্তু জনমানবহীন, দেখতে বড়ই অদ্ভূত লাগছে।সুন্দর জায়গায় মানুষের হইচই কলরবে ভরে থাকাটাই মানাসই। গাজীপুরের এই রিসোর্টটা এমন জনমানবহীন হওয়ায়
খুব বেশি অবাক হয় নি স্নিগ্ধা। আবরার ফাইয়াজ বলে কথা তার জন্যে এইসব তো খুবই সামান্য বিষয়। জনমানবহীন এমন পরিবেশে থাকতে থাকতে স্নিগ্ধা বিরক্ত।

বিশাল এক গাছের চারিপাশে উচুঁ করে চারিদিক রেলিং দিয়ে বানানো বৈঠক খানায় দাড়িয়ে আছে স্নিগ্ধা। সিড়ি বেয়ে উচু জায়গায় উঠে এইবার তার ভালো লাগছে একটু। এখান থেকে পুরো রিসোর্টটা দেখা যাচ্ছে। একপাশে বিশাল এক লেক সেখানে পা দিয়ে চালিত বোট রয়েছে। লেকের পাশে পুকুর পাড়ের মতন সিড়ি রয়েছে বসার জন্যে জায়গা রয়েছে। স্নিগ্ধা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার পাশে রয়েছে বিশাল মাঠ আর কিছুদুর পর একেকটা কুটির।

আদিল এতক্ষণ অভ্রর সাথে ছিলো। অভ্রর খিদে পেয়েছে তাই সে এখন জিমের সাথে ফুডকোডে।

স্নিগ্ধাকে অনেক্ষন হয়েছে আদিল দেখছে না। এখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আদিল খুজতে গিয়ে দেখলো স্নিগ্ধা রেলিং ধরে এক পাশে চুপটি করে দাড়িয়ে আছে। কি হয়েছে মেয়েটার? কেমন অন্যরকম আচরণ করছে! সাড়া রাস্তায় একটাও কথা বলেনি আর এইখানে এসেও চুপচাপ। যদিও এই মেয়ে সবসময় চুপচাপ থাকে তবে আজকে কেমন অন্যরকম লাগছে।

আদিল সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসলো। তারপর এগিয়ে যেতেই খেয়াল করলো পড়ন্ত বিকেলে এই হিমশীতল হাওয়ায় স্নিগ্ধার কৃষ্ণ কালো চুলগুলো থেমে থেমে বাতাসের সঙ্গে দুলছে। আর আনমনে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে স্নিগ্ধা।

আদিল বড় গাছটির সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ নিশ্চুপে তাকিয়ে রইলো স্নিগ্ধার দিকে। স্নিগ্ধা আদিলের হটাৎ এই আগমন ঠিক টের পায় নি। শীতল বাতাসের কারণে কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভব হচ্ছে তার। স্নিগ্ধা দু হাতে দুই বাহু জড়িয়ে ধরলো, ঠান্ডায়। তার কয়েক মুহূর্তপর কেউ যেনো তাকে উষ্ণ ভালোবাসায় জড়িয়ে দিলো। স্নিগ্ধা হকচকিয়ে পাশে তাকালো, আদিল শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। স্নিগ্ধা নিজের গায়ে জড়ানো এই লেদারের জ্যাকেট দেখে বুঝতে পারলো আদিল হয়তো বেশ কিছুক্ষন ধরে এইখানেই ছিলো।

স্নিগ্ধা কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো। পুনরায় দৃষ্টি সামনে স্থির করতেই আদিল ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,” কি হয়েছে তোমার? কি এতো ভাবছো?” বলতে বলতে আদিল বুকের কাছে হাত ভাজ করলো।

স্নিগ্ধা মলিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,” ভাবছি তো অনেক কিছুই কিন্তু ভেবে কি লাভ হচ্ছে বলুন? সবকিছু যেনো আরো অস্পষ্ট লাগছে।” গলার স্বর ভারী হয়ে এলো স্নিগ্ধার।

আদিল কিছু একটা আগেই আন্দাজ করে রেখেছে তাই কথার মোড় ঘুরিয়ে বললো,” আমাকে নিয়ে এতো ভাবছো কেনো? ভালোবেসে ফেলেছো আমায়?” বলতে বলতে হাতের ভাজ ছেড়ে দাড়ালো সে।

স্নিগ্ধা ভাবলেশহীন ভাবে বললো,” আপনি অত্যন্ত চালাক প্রকৃতির একজন মানুষ। আপনাকে নিয়ে ভাবতে গেলো আমার মনে কখনো ভালোবাসা জন্মায় না। তখন শুধু রাগ আর ক্ষোভ জন্মায়। কি বলুন তো? আপনাকে আমার পক্ষে ভালোবাসা সম্ভব না।”

এইকথা গুলো যেনো আদিলের মাথায় চড়ে বসলো। চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে রইল স্নিগ্ধার দিকে। তারপর হুট করে স্নিগ্ধার এক হাত ধরে অন্য হাতে কোমড় জড়িয়ে একদম নিজের কাছে নিয়ে এলো। আদিলের হটাৎ এমন আচরণে ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকালো স্নিগ্ধা। এতো রেগে গেছে কেনো আদিল? সে তো মিথ্যে কিছু বলে নি। সত্যিই তো বলেছে, এমন চলতে থাকলে তার পক্ষে এই সম্পর্কটা স্বাভাবিক রাখা সম্বব হবে না। আদিল স্নিগ্ধার চোখে দিকে তাকিয়ে গভীর গলায় প্রশ্ন করলো,” কেনো? আমাকে ভালোবাসা যাবে না কেনো?”

স্নিগ্ধা নিজেকে শান্ত করে বললো,” আমি একটি সাধারণ মেয়ে, মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম। অন্য মেয়েরা আপনার আভিজাত্য, আপনার স্টাইল, স্ট্যাটাস দেখে আপনার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়তে পারে। কিন্তু আমি এইভাবে ভালোবাসতে শিখি নি। আমার কাছে মনটাই প্রাধান্য পায়, বাইরের চাকচিক্য নয়। আপনাকে আমি কতটুকুই বা চিনি। যেটুকু চিনেছি সবটাই তো আপনার চতুরতা। আমার প্রতিটা প্রশ্ন আপনি এড়িয়ে গেছেন, কিংবা আমাকে থামিয়ে দিয়েছেন।”

আদিল তপ্ত এক নিশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করলো। স্নিগ্ধার প্রতিটা কথা তার মনকে অস্থিরতায় ভরিয়ে দিয়েছে। স্নিগ্ধা কি সত্যি তাকে এতো জঘন্য মনে করে? এমনটা সে কখনো ভাবেনি। আদিল ব্যাথাতুর
চোখে বললো,” কি জানতে চাও? বলো। তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দিবো আজ।”

স্নিগ্ধা অবাক হয়ে আদিলের দিকে তাকালো। তার বলা কথা গুলো আদিলের উপর এতটা প্রভাব ফেলবে সে বুঝতে পারেনি। সে কি খুব বেশি বলে ফেলেছে? কিন্তু মিথ্যে কিছু তো সে বলেনি।

স্নিগ্ধা অবাক চাওনিতে প্রশ্ন করলো,” সত্যি! বলবেন?”

আদিল আরেকটু কাছে এসে ভারী গলায় বললো,” হুম, বলবো। বলো,কি জানতে চাও?” বলতে বলতে স্নিগ্ধার চোখের দিকে তাকালো। আদিলের সে চাউনিতে স্নিগ্ধা ভরসা খুঁজে পেলো। আজ হয়তো সে তার প্রশ্নের জবাব পাবে। আদিলের এমন চাউনিতে স্নিগ্ধা অনেকটা শান্ত হয়ে গেলো ঠিকই কিন্তু হৃদ কম্পন বেড়ে গেলো।

স্নিগ্ধা একটা ঢোক গিলে বললো,” ফাহাদ রেজওয়ান কে?”

ফাহাদ রেজওয়ান নামটা আদিলের কানে আসতেই আদিল ভ্রু কুঁচকে ফেললো এক মুহূর্তের জন্যে মনে হলো সে হয়তো ভুল শুনেছে। আদিল চোয়াল শক্ত করে জিজ্ঞেস করলো,” কার নাম বললে?”

স্নিগ্ধা হটাৎ আদিলের এই আচরণে থমকে গেলো। তারপর থেমে থেমে বললো,” ফাহা..দ রেজ..ওয়ান।” বলে শেষ না করতেই কোমরের কাছে নখের চাপ অনুভব করে ব্যাথায় চোখ বন্ধ করে ফেললো স্নিগ্ধা তারপর চোখ খুলে আদিলের দিকে তাকাতেই দেখলো নামটা শুনে কেমন হিংস্র হয়ে উঠেছে সে। আদিল খুব জোড়ে তার কোমড় চেপে ধরেছে, ব্যাথায় স্নিগ্ধা নিজেকে ছাড়াতে ব্যাস্ত হয়ে বললো ” কি করছেন কি? আমার ব্যাথা..?” বাকিটা বলার আগেই আদিল স্নিগ্ধাকে একদম নিজের কাছে এনে বিস্ফোরিত কণ্ঠে বললো,” কি করে জানো তুমি এই নাম? তুমি চিনো ওকে? কীভাবে এই নাম জানলে তুমি?”

আদিলের এমন আচরণে কেপে উঠলো স্নিগ্ধা। স্নিগ্ধা চোখ বন্ধ করে ব্যাথাতুর কণ্ঠে বললো,” ছাড়ুন আমায় আমার লাগছে।” কথাটা বলার পর মুহূর্তেই তার কোমরের বাঁধন একটু সহজ হলো। স্নিগ্ধা আস্তে করে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলো, আদিল কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। স্নিগ্ধাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আদিল তীক্ষ্ণ গলায় বললো,” চুপ করে আছো কেনো? কিভাবে চিনো ওকে? ফাহাদ রেজওয়ানকে কিভাবে চেনো তুমি? বলো।”

স্নিগ্ধার ভীষন রাগ হলো। এমন আচরণ করছে কেনো আদিল তার সঙ্গে। স্নিগ্ধা কোনো কথা বললো না মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে নিজেকে ছাড়াতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। কিন্তু কোনো লাভ হলো না আদিল বাঁধন আরো শক্ত করে কঠিন গলায় বললো,” বৃথা চেষ্টা করো না। আমার প্রশ্নের উত্তর না দেওয়া পর্যন্ত তোমাকে আমি কোথাও যেতে দিবো না।”

স্নিগ্ধা তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো তারপর বললো,” ওনাকে যদি আমি চিনতাম তাহলে নিশ্চয়ই আপনাকে প্রশ্ন করতাম না। বলুন, ফাহাদ রেজওয়ান কে? আপনাকে দেখে তো মনে হচ্ছে খুব ভালো করেই চিনেন।”

আদিল স্নিগ্ধার একদম কাছে গিয়ে কঠিন দৃষ্টিতে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে বললো,” এই নামটা যেনো আমি দ্বিতীয়বার তোমার মুখে না শুনি।” স্নিগ্ধা ভীষন রেগে গিয়ে বললো,” কেনো? আমায় কি আপনার কথামত…” বাকিটা বলার আগেই আদিল শীতল দৃষ্টিতে তাকালো তারপর স্নিগ্ধার খুব কাছে এসে ঠোঁটের ওপরে আঙ্গুল ছুঁইয়ে স্নিগ্ধাকে চুপ করিয়ে দিলো। তারপর ঠোঁটের চারপাশে আঙ্গুল ছুঁইয়ে দিতেই
স্নিগ্ধা থমকে তাকালো। আদিলের চোখে চোখ পড়তেই চোখ বন্ধ ফেললো সে।

আদিলের এমন আচরণে স্নিগ্ধা সঙ্গে সঙ্গে নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। ঘনো ঘনো নিশ্বাস ফেলতে লাগলো। হৃদকম্পন বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেলো। ঠোঁট কাপতে লাগলো তার। স্নিগ্ধা আদিলের শার্টের অংশ খামচে ধরলো। স্নিগ্ধা একেবারে শান্ত আর নিবিড় হয়ে যেতেই আদিল ঠোঁটের উপর থেকে আঙ্গুল সরিয়ে নিচের ঠোঁট ভিজিয়ে শীতল কণ্ঠে বললো,” সময় এলে আমি নিজেই তোমাকে সবটা বলবো। কিন্তু অন্যের কথায় আমাকে ভুল বুঝো না।” স্নিগ্ধা চোখ খুলে তাকালো তারপর আদিলের চোখের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিললো।

আদিল আর কোনো কথা না বলে স্নিগ্ধার এক হাত ধরলো তারপর সিড়ি বেয়ে নেমে এলো।

স্নিগ্ধার কথা বলার কোনো উপায় নেই। আদিল তাকে ভয়াবহ লজ্জায় ফেলেছে। যার কারণে কিছুক্ষণ পর পর সে শিউরে উঠছে।

_______

জিম স্নিগ্ধার কল লিস্ট চেক করতে ব্যাস্ত কিন্তু রিসোর্টের নেটওয়ার্ক দুর্বল হওয়ার কারণে ওয়েবসাইড অনেক সময় নিচ্ছে। জিম বেশ বিরক্ত হচ্ছে। আজ রাতেই তাকে সবটা জানতে হবে। তার ধারণা মতে স্নিগ্ধার ফোনেই ফাহাদ কল করেছে। কল করা ছাড়া যোগাযোগের কোনো উপায় নেই স্নিগ্ধার সাথে। ফাহাদ ঠিক কি ফাঁদ পাতার চেষ্টায় আছে সেটাই তাকে বের করতে হবে। কিন্তু এই নেটওয়ার্কের ঝামেলায় সেটা কি আজ সম্ভব হবে?

জিম বিরক্ত হয়ে উঠে দাড়ালো। সঙ্গে সঙ্গে তার ফোন বেজে উঠলো। জিম নিজের ট্রাউজারের পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখলো অচেনা নাম্বার। নিজের কাজেই জিম ফোনে এমন একটা অ্যাপ নামিয়ে রেখেছে যা দিয়ে অচেনা নাম্বার হলেও আসল নাম কয়েক সেকেন্ডেই বের করা যাবে। জিম অ্যাপটা চেক করে ফোনটা রিসিভ করলো সঙ্গে সঙ্গে তার কানে মেয়েলি একটা কণ্ঠ ভেসে এলো। ওপাশ থেকে বললো,” আফনে কি জিম জুবায়ের?”

জিম ভ্রু কুঁচকে বললো,” হুম, কিন্তু আপনার কি দরকার?”

ওপাশ থেকে ফিক করে হাসির আওয়াজ এলো তারপর মেয়েটি বললো,” আমি ফুলবানু , তুমি আমারে চিনসো?”

জিম ঠোঁট চেপে নিজের হাসি থামিয়ে বেশ তাল মিলিয়ে বললো,” বাহ্, আকিকা করে এক দিনে নাম বদলে ফেলেছো? ভেরি গুড। ফুলবানু নামটা তোমাকেই মানায়।”

স্পৃহা দাতে দাত চিপে ভ্রু কুঁচকে ফোনের দিকে তাকালো। আওয়াজ শুনেই চিনে ফেলেছে। রোবটমানব কি সাধে বলি। স্পৃহা গলার স্বর স্বাভাবিক করে বললো,” একদম আজে বাজে কথা বলবেন না।”

জিম পাল্টা জবাবে বললো,” অবশ্যই বলবো। এতো রাতে ফোন দিয়ে ডিস্টার্ব করলে তো আজে বাজে কথা শুনতেই হবে।”

” এই আপনি কোন সেলিব্রিটি যে আপনাকে আমি ডিস্টার্ব করতে যাবো? কি ভাবেন নিজেকে? আমি দরকারে ফোন দিয়েছি।”, গর গর করে বললো স্পৃহা।

জিম ভ্রু কুঁচকে হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,” রাত একটায় তোমার আমাকে দরকার পড়লো কেনো?”

স্পৃহা একটু চুপ করে গেলো তারপর হাতের নখ কামড়াতে শুরু করলো। কি বলবে এইবার? সে তো এমনেই বিরক্ত করতে কল করেছে। স্নিগ্ধা মুখ থেকে হাত নামিয়ে বললো,” আপুকে আপনি ফুল দিয়েছেন কিনা সেটা জানতেই কল করেছি।”

জিম অবাক হয়ে বললো,” এতো রাতে?”

স্পৃহা বললো,” কারণ এর আগে কথাটা আমার মাথাতে আসে নি তাই।”

জিম বিরক্তি নিয়ে বললো,” তো নিজের বোনকে ফোন করলেই পারতে।”

স্পৃহা রেগে গিয়ে বললো,” আমি কি বেয়াক্কেল নাকি? এতো রাতে ফোন দিয়ে ওদের রোমান্সে ডিস্টার্ব করতে যাবো?”

জিম তীক্ষ্ণ গলায় বলল,” এই তোমার লজ্জা করছে না এইগুলো বলতে?”

স্পৃহা অবাক হয়ে বললো,” লজ্জার কি আছে? নতুন বিয়ে হয়েছে বর বউ এতো রাতে রোমান্স করবে, এইটাই তো স্বাভাবিক। আশ্চর্য! এতে লজ্জার কি আছে?” স্পৃহার কথা শুনে জিম হতভম্ব হয়ে ফোনের দিকে তাকালো।

[ #চলবে ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here