রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ১২+১৩

0
362

#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#পর্ব_১২
#নবনী_নীলা

অভ্র সকাল থেকে বায়না করছে সে ঘুরতে যাবে। এখনই তাকে নিয়ে যেতে হবে এই বায়না নিয়ে সে আদিলের এক পা জড়িয়ে ধরে আছে। আদিল ফোনে ব্যাস্ত হয়ে কথা বলছিলো, সে যেদিকে যাচ্ছে অভ্র তার এক পা ধরে ঝুলে ঝুলে সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছে। কেউ এই দৃশ্য দেখলে না হেসে থাকতে পারবে না। অভ্র যে শুধু সেটাই করছে তা না কিছুক্ষণ পর পর ডোরেমন ডোরেমন বলে চেচিয়ে উঠছে। আদিল ফোন শান্তিতে কথা বলবে যে তারও উপায় নেই। আবার রাগও করতে পারছে না অভ্রর উপর। অভ্রর মুখের হাসি বলে দিচ্ছে সে নিজের এই অদ্ভূত কাজে বেশ আনন্দ পাচ্ছে।

আদিল চোয়াল শক্ত করে দাড়িয়ে পড়লো। তারপর লাইনে থাকা কলটা কেটে দিয়ে বুকের কাছে হাত ভাজ করে তার একপায়ে ঝুলন্ত অভ্রর দিকে তাকালো। আদিল ফোন কেটে দিতেই অভ্র এক গাল হেসে বলল,” ডোরেমন!” ডাকটা বেশ সুর করেই ডাকলো সে।

আদিল ভ্রু কুঁচকে বললো,” ডু আই লুক লাইক এ ডোরেমন? আর ইউ কিডিং উইথ মি?”

অভ্র চোখ পিট পিট করে তাকালো তার মতন চার বছর বয়সী শিশুর কাছে বেশ জটিল লাগলো, আদিলের বলা কথাগুলো। আদিল একট নিশ্বাস ফেলে বললো,” বলো কি চাই তোমার?”

অভ্র ঠোঁট উল্টে বললো,” ঘুরতে যাবো।”

আদিল তীক্ষ্ণ চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,” আচ্ছা,ঠিক আছে কালকে নিয়ে যাবো তোমায়। এইবার পা ছাড়ো।”

অভ্র না সূচক মাথা নাড়লো। আদিল অবাক হয়ে বললো,” কেনো?”

অভ্র চোখ পিট পিট করে বললো,” মজা লাগছে।” আদিল নিরুপায় ভঙ্গিতে সামনে তাকালো। এই ভাবে তার পা ধরে ঝুলতে নাকি এই ছেলের ভালো লাগছে। ভেবে হালকা হাসিও পেলো তার।

স্পৃহা কলেজ থেকে ফিরে অভ্রকে এই অবস্থায় দেখে হাসতে হাসতে শেষ। আদিল কি করবে নিজেও বুঝতে পারছে না। অভ্র কোথা থেকে যে এইসব অদ্ভুত খেলা গুলো শিখে?

স্পৃহা হাসতে হাসতে বললো,” কি করছে ও?”

আদিল নিরস চেহারায় বললো,” দোল খাচ্ছে।”

স্পৃহা হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলো তারপর অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বললো,” বাহ্, দোল খাওয়ার অভিনব পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে তাহলে?”

আদিল হেসে বললো,” পরীক্ষা কবে তোমার?”

স্পৃহা ভ্রু নাচিয়ে বললো,” পরীক্ষা দিয়ে কি হবে ভাবছি আর কলেজেই যাবো না।”

আদিল চিন্তিত গলায় বললো,” কেনো?”

স্পৃহা বেশ বিরক্তি নিয়ে বললো,” কিছু ছেলে পিছু নিয়েছে? একেবারে অতিষ্ট করে দিয়েছে।”

পাশ দিয়ে জিম যাচ্ছিলো।স্পৃহাকে ছেলেরা বিরক্ত করছে শুনে সে বেশ অবাক হয়ে তাকালো। স্পৃহা জিমের এমন দৃষ্টি দেখে ভ্রু কুঁচকে বললো,” কি আশ্চর্য! এমন অবাক হয়ে তাকানোর কি আছে?” স্পৃহার কথায় আদিল ঘাড় ঘুরিয়ে জিমের দিকে তাকালো।

জিম তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো,” তোমাকে ডিস্টার্ব করে? কার ঠেকা পড়েছে?”

স্পৃহার মুখের উপর জিমের এমন উক্তি শুনে সে বিস্ফোরিত কণ্ঠে বললো,” মানে? আমি এতোই খারাপ দেখতে? আপনি কি বলতে চাচ্ছেন? জিজু তুমি এর একটা বিহিত করো!”

জিম তীক্ষ্ণ গলায় বললো,” বিহিত করার কিছু নেই। যে মেয়ে স্টুপিড কথাটার উত্তরে পাঁচটা কথা শুনিয়ে আসতে পারে। সেই মেয়ে কেউ ডিস্টার্ব করবে আর সেটার ভয়ে কলেজে যাবে না, সেটা অবিশ্বাস্য নয় কি?”

স্পৃহা দাতে দাঁত চিপে জিমের দিকে তাকালো তারপর আদিলকে বললো,” তুমি এই লোকটাকে কিছু বলবে না?”

আদিল বুঝেই পায় না এরা দুজন এইভাবে যুদ্ধ করে বেড়ায় কেনো? আদিল এইবার কি বলবে? সে বেশ কায়দা করে জিমকে বললো,” তোর এইভাবে স্পৃহাকে বলা ঠিক হয় নি। ছিঃ,মেয়েদের সাথে কেউ এইভাবে কথা বলে?”

জিম প্রতি উত্তরে কিছু বললো না তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে স্পৃহার দিকে তাকিয়ে রইলো। স্পৃহা রাগী গলায় বললো,” কাল থেকে এই লোকটা আমাকে কলেজে দিয়ে আসবে নিয়ে আসবে। আমি কিছু জানি না, জিজু তুমি এইটা ফাইনাল করো। আমার জীবনেরও দাম আছে, আমারো প্রটেকশন লাগবে।”

এদের দুজনের কান্ড দেখে আদিল হাসি আটকে রাখার চেষ্টা করছে। এমন সিরিয়াস মুহুর্তে হাসা ঠিক হবে না। আদিল সিরিয়াস হয়ে বললো,” হুম, অবশ্যই এটাই ফাইনাল। জিম এখন থেকে তোমাকে আনা নেওয়া করবে।”

জিম হতবাক হয়ে আদিলের দিকে তাকালো। আদিল ঠোঁট চেপে হাসলো। পরক্ষনেই স্পৃহা মুখ ঘুরিয়ে সিড়ি বেয়ে নিজের রূমে চলে গেলো। জিম হতবাক হয়ে বললো,” এটা কি হলো?”

আদিল হেসে বললো,” আমিও সেটাই ভাবছি।” বলতে বলতে আদিলের হটাৎ অভ্রর কথা মনে পড়লো। পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে অভ্র পায়ে ঝুলে নেই। আদিল এদিক সেদিক তাকাতেই তার চোখ আটকে গেলো বারান্দার এক পাশে। অভ্র স্নিগ্ধার কোলে বসে আছে আর ফিসফিস করে দুজনে গল্প করছে। অভ্র যে কখন স্নিগ্ধার কাছে চলে গেছে আদিল খেয়াল করেনি। স্নিগ্ধা কি অনায়াসে অভ্রকে এতটা আদর করে আগলে রাখছে। অন্য কেউ কি পারতো ঠিক এতটা যত্নে অভ্রকে আগলে রাখতে?

বিকেলে স্নিগ্ধা আর অভ্র জিমের সাথে কারাগারের ফিরলো। স্নিগ্ধার জন্যে এই বাড়িটি কারাগার থেকে কম না। আদিল তাদের ফিরবার আগেই কোথায় যেনো বেরিয়েছে। জিমের উপর দায়িত্ব দিয়েছে ওদের সাবধানে বাড়ি নিয়ে আসার।

আদিলের এই বাড়িটিতে প্রাণ নেই, আনন্দ নেই, হইচই নেই।
স্নিগ্ধা চুপচাপ সভাবের মেয়ে তার শান্ত জিনিস পছন্দ কিন্তু এই বাড়িটি মাত্রাতিরিক্ত নির্জন।
আদিল নামক প্রাণীটি এই বাড়িতে থাকলেও একটা রমরমা পরিবেশ থাকে আর সে না থাকলে কেমন নিশ্চুপ হয়ে থাকে।
স্নিগ্ধা নিজের মধ্যে এই ক্ষুদ্র এক পরিবর্তন লক্ষ্য করছে।
আদিলকে কি তার ভালো লাগছে?
মনে মনে এগুলো সে কি চিন্তা করছে ভেবেই তার অবাক লাগছে। ইদানিং আদিলকে নিয়ে সে বেশি ভাবছে।
হুট করে এমন পরিবর্তনের কারণ কি? নিজের কাছেই নিজে প্রশ্ন করলো স্নিগ্ধা। কিন্তু কোনো উত্তর পেলো না।

স্নিগ্ধা নিজের ভাবনার জগতে থাকতেই হটাৎ অভ্রর কান্না শুনতে পেলো সে। স্নিগ্ধা ব্যাস্ত হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। ব্যাথা পেয়েছে ভেবে অস্থির হয়ে বেরিয়ে দেখে সেই লক করা রুমটির সামনে দাড়িয়ে অভ্র কাদঁছে। জিম তাকে কি যেনো বোঝানোর চেষ্টা করছে কিন্তু অভ্র বুঝতে চাইছে না। স্নিগ্ধা এগিয়ে এসে অভ্রকে কোলে জড়িয়ে ধরলো, তারপর জিমের দিকে তাকিয়ে বললো,” ও এইভাবে কাদছে কেনো?”

জিম নিচু গলায় বললো,” অভ্র এই রূমে যেতে চায় কিন্তু এই লকের পাসওয়ার্ড আমার জানা নেই। স্যার না আসলে কিছু করা যাবে না। উনি রওনা দিয়েছেন এক্ষুনি এসে পড়বেন।”

স্নিগ্ধা হাঁটু ভাঁজ করে বসে অভ্রর চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,” একটু অপেক্ষা করো। এভাবে কাদতেঁ হয় না। কি আছে ঐ রুমে?”

অভ্র চোখের পানি আবারো ছল ছল করতে লাগলো। সে কাদো গলায় বললো,” আম্মুকে দেখবো। ওকে বলো খুলে দিতে।”

স্নিগ্ধা হতবাক হয়ে তাকালো। আম্মুকে দেখবে মানে? স্নিগ্ধা অভ্রকে বুকে টেনে নিয়ে অবাক হয়ে জিমের দিকে তাকালো তারপর জিমকে জিজ্ঞেস করলো,” মাকে দেখবে মানে? কি আছে ঐ রুমে?”

এই প্রশ্নের উত্তরে জিম চুপ করে রইলো। স্নিগ্ধা দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করার আগে কারোর ব্যাস্ত পায়ের আওয়াজ শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলো আদিল চলে এসেছে। আদিল এসেই ব্যাস্ত হয়ে অভ্রকে স্নিগ্ধার থেকে নিয়ে নিজের কোলে আনলো তারপর চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,” কি হয়েছে কাদঁছ কেনো?”

অভ্র অস্পষ্ট গলায় বললো,” আম্মুকে দেখবো। ” আদিল এক মুহুর্ত অপেক্ষা করলো না। অভ্রকে কোলে নিয়ে সেই দরজার সামনে চলে গেলো। তারপর দরজায় পাসওয়ার্ড আর নিজের ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে দরজা খুললো। স্নিগ্ধা হতবাক হয়ে দাড়ালো। দরজাটা খুলতেই প্রথমেই বিশাল এক ছবি চোখে ভাসলো স্নিগ্ধার। রুমটা খুব যত্নে সাজানো। চোখের পলক না পড়তেই রুমটার দরজা বন্ধ হয়ে গেলো। স্নিগ্ধা বেশ বড় একটা ধাক্কা খেলো। যাদের যে নিজের জীবনের সাথে এতো যত্নে জড়িয়ে নিয়েছে তাদের মনে যে তার থেকেও গুরুত্বপূর্ন কেউ বাসা বেধে বসে আছে সেটা তো তার জানাই ছিলো না। কেমন অস্থির লাগছে স্নিগ্ধার! এ কোন নতুন ধাঁধা?

[ #চলবে ]

#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#পর্ব_১৩
#নবনী_নীলা

অভ্র ঘুমিয়ে পড়তেই আদিল অভ্রকে কোলে করে বেরিয়ে এলো। রুমটায় ঘণ্টা খানেক ছিলো তারা। আদিল অভ্রর রুমে এসে অভ্রকে বিছানায় শুইয়ে দিতেই খেয়াল করলো স্নিগ্ধা একপাশে চুপ করে দাড়িয়ে আছে। স্নিগ্ধার চোখে মুখে বিষণ্ণতা স্পষ্ট। তবুও স্নিগ্ধা বিছানায় অভ্রর একপাশে বসলো। তারপর স্বাভাবিক ভাবেই বললো,” ঘুমিয়ে পড়েছে?”

আদিল পকেটে এক হাত ভরে বললো,” হুম্।” আদিলের মনে হচ্ছে স্নিগ্ধা তাকে হয়তো আজ সত্যিটা বলার জন্যে জোর করবে। জোর করলে সে বলবে স্নিগ্ধাকে। সেই মানসিকতা নিজেই ওই রুম থেকে বেরিয়েছে আদিল। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে স্নিগ্ধা কোনো প্রশ্ন করলো না। অভ্রর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,” আপনি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন। আমি আছি অভ্রর কাছে।”

আদিল থমকালে স্নিগ্ধার এমন স্বাভাবিক আচরণে। আদিল নির্বিকার দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে রইলো। স্নিগ্ধা অদ্ভূত এক আচরণ করছে। তার দিকে তাকাচ্ছে না। আদিল তপ্ত এক নিশ্বাস ফেলে রূম থেকে বেরিয়ে এলো।

স্নিগ্ধা নিশ্চুপে কিছুক্ষণ আনমনে বসে রইলো। কত প্রশ্ন আছে তার মনে। কিন্তু প্রশ্নগুলো সে করতে পারলো না কেনো? আচ্ছা প্রশ্ন করতে হবে কেনো তাকে?

প্রশ্ন না করলে আদিল কি কখনই তাকে কিছু জানবে না? তাহলে কি তার জানবার কোনো অধিকার নেই। স্নিগ্ধা নিরবে নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর অভ্রর পাশে ঘুমিয়ে পড়লো।

আদিল ফ্রেশ হয়ে স্নিগ্ধাকে নিজের রুমে না দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো। তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে আদিল বের হয়ে এলো। অভ্রর রুমে এসে সে থমকে দাড়ালো। স্নিগ্ধা অভ্রকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। আদিল মৃদু হাসলো তারপর তোয়ালে কাধের দুপাশে রেখে এগিয়ে এলো। চাদরটা দুজনের গায়ে তুলে দিয়ে সে ড্রীম লাইট অন করে রুম থেকে বেরিয়ে এলো।

______

স্নিগ্ধার ঘুম ভাঙলো দেরিতে। সে ঘুম ঘুম চোখে উঠে বসলো। অভ্র এখনো ঘুমিয়ে আছে। অভ্র বেলা করেই ঘুম থেকে উঠে। কিন্তু স্নিগ্ধার সকাল বেলায় উঠার অভ্যাস। আজ এতো বেলা হলো কেনো সে জানে না। জানালা দিয়ে সকালের রোদের আলো অভ্রর মুখে এসে পড়ছে। স্নিগ্ধা উঠে গিয়ে জানালায় পর্দা টেনে দিলো। তারপর নিজের রুমে চলে গেলো।
আজ উঠতে দেরী হওয়ায় সে সকাল সকাল গোসল সেরে নিলো।

স্নিগ্ধা ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালো। চুলের পানি মুছে তোয়ালে একপাশে রাখতে গিয়ে স্নিগ্ধার চোখ পড়ল একটি সাদা খাম যার ঠিক উপরে একটি লাল গোলাপ। স্নিগ্ধা আশেপাশে তাকালো এই ঘরে আদিল আছে কিনা? আদিলের থাকবার কথা নয় কারণ বেশ বেলা গড়িয়েছে। স্নিগ্ধা নিশ্চিত হয়ে গোলাপসহ খামটি হাতে নিলো। আগে সাদা খামটি খুললো। খামের ভিতরে লাল কাগজে সাদা রঙের বলপেন দিয়ে লেখা,

তোমার বইয়ের পাতার ভাজে,
আমার দেওয়া গোলাপটির জন্যে
একটু জায়গা হবে কি?

স্নিগ্ধা চোখ পিট পিট করে তাকালো। এইটা কে রেখেছে? তার জন্যেই কি রেখেছে? এই বাড়িতে তো সে বাদে কোনো মেয়ে নেই। তাহলে এইটা আদিল লিখেছে তার জন্যে? আদিল তাকে এতো ভালো করে জানে কিভাবে? সে যে বইয়ের পাতায় ফুল রাখতে পছন্দ করে সেটা তো আদিলের জানার কথা না।

হটাৎ লোকটা তাকে ফুল দিতে গেলো কেনো? এমন লাল গোলাপ তাও আবার। ভালোই নাটকীয়তা করতে পারে এই ছেলে। কাল রাতে একবারো ভালো করে কথা বলেনি। আর এখন সকাল সকাল ফুল দিয়ে মন গলানোর চেষ্টা। চেষ্টায় যে ব্যার্থ হয়েছে এমনটাও নয়।

স্নিগ্ধা লাল গোলাপটা হুমায়ূন আহমেদের লেখা তার প্রিয় বই ” অপেক্ষা “। সেই বইয়ের পাতার ভাজে গোলাপটি রেখে দিলো। সাদা খামটি তার ফেলতে ইচ্ছে করলো না। সেটাও সে সযত্নে বইয়ের একটা পাতার ভাঁজে রেখে দিলো।

কিন্তু স্নিগ্ধা এতো বোকা নয়। সে ঠিক সেই রকম আরেকটা খাম বানালো। বানিয়ে সেটা হাতে মুড়িয়ে পাশের ঝুড়িতে ফেলে দিলো। আর বাগান থেকে একটা গোলাপ এনে তার পাঁপড়ি ছিঁড়ে সেই ঝুড়িতে ফেলে দিলো। স্নিগ্ধাকে হাতে পাওয়া এতো সহজ না আবরার ফাইয়াজ।

স্নিগ্ধার মনটা এখন বেশ ফুরফুরে লাগছে। এই ফুলগুলো দেখে আদিলের কি চেহারা হয় সেটাই দেখবার পালা।

বেলা বারোটার দিকে স্নিগ্ধার ফোন বেজে উঠলো। স্নিগ্ধা ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো অচেনা নাম্বার। স্নিগ্ধা কল রিসিভ করে ফোনটা কানে ধরতেই এক পুরুষালী কণ্ঠ ভেসে এলো। ওপাশ থেকে বললো,” কেমন আছো, স্নিগ্ধতা?”

স্নিগ্ধা একটু অবাক হলো। নাম্বারটা তার চেনা নয় আর এই কণ্ঠ সে এর আগে কখনো শুনেনি। পরিচিত কারোর সাথে এই কণ্ঠের মিলও নেই। অথচ লোকটা তার নাম জানে আর এমনভাবে কথা বলছে যেনো তাকে চিনে। স্নিগ্ধা ভ্রূ কুচকে বললো,” কে আপনি?”

ওপাশ থেকে ভারী গলায় বললো,” তুমি আমাকে চিনবে না।”

স্নিগ্ধা বেশ বিরক্ত হলো তারপর বললো,” কি জন্যে ফোন করেছেন আপনি ?”

ওপাশ থেকে হালকা হাসির শব্দ পেলো স্নিগ্ধা। হাসি থামিয়ে ওপাশ থেকে বললো,” নতুন জীবন শুরু করেছে তাই শুভেচ্ছা জানতে ফোন করেছি। যদিও বেশি দেরি করে ফেলেছি। আফটার অল তুমি আবরার ফাইয়াজের ওয়াইফ শুভেচ্ছা তো তোমাকে দিতেই হতো।”

স্নিগ্ধা লোকটার কথা বুঝতে না পেরে বললো,” মানে?”

ওপাশ থেকে বললো,” মানে বুঝতে পারা কি আর এতো সহজ? তোমাদের ছেলেটা কেমন আছে? আমার জানা মতে বাচ্চাটা তো তোমার না। ঠিক বলেছি না?”

স্নিগ্ধা বেশ রেগে গিয়ে বললো,” আপনার মনে হচ্ছে না, আপনি বেশি বলছেন?”

” নাহ্, একদমই না। আমি মোটেও বেশি বলছি না।ঠিক কোন সত্য চাপা দেওয়ার জন্যে আবরার ফাইয়াজ তোমাকে ব্যাবহার করছে সেটা জানার আগ্রহে ফোন দিয়েছিলাম। কিন্তু তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি নিজেই দিশেহারা।”

স্নিগ্ধার বেশ রাগ হলো ফোনটা কেটে দিতে নিলো তখনই ওপাশ থেকে লোকটা হেসে বলল,” আরে আরে, রেগে গিয়ে ফোন কাটার আগে আমার নামটা তো জেনে নিবে। আমার নাম ফাহাদ রেজওয়ান আর আমি কে সেটা না হও তুমি নিজেই খুঁজে বের করো।” বলেই ওপাশ থেকে কল কেটে দিলো।

স্নিগ্ধার প্রাথমিক অবস্থায় ভীষন রাগ হলো। কিন্তু এই লোকটার কথা গুলো তার মাথায় বাসা করে নিয়েছে। সত্য চাপা দিতে তাকে ব্যাবহার করছে মানে? আদিল তাকে ব্যাবহার করছে এই কথাটাই যেনো তার মাথায় গেঁথে গেলো। কি আড়াল করতে চাইছে আদিল?

______

জিম বিরক্তি মুখে স্পৃহার কলেজ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। জীবনেও সে এমন কাজ করে নি। কিন্তু এই মেয়ের জন্যে তাকে এই কাজ করতে হচ্ছে। একে একে সব মেয়ে বের হয়েছে স্পৃহার কোনো হদিস নেই।

কলেজ ছুটির প্রায় বিশ মিনিট পর স্পৃহা ঠোঁট টিপে হাসতে হাসতে বের হলো। তার প্ল্যান সফল, এই রবোমানবকে উচিৎ শিক্ষা আজ দেওয়াবে সে। স্পৃহা এসে দাড়াতেই জিম তাড়া দিয়ে বললো,” এতো লেট কেনো? তোমার ক্লাস কি বিশ মিনিট দেরিতে শেষ হয়?”

স্পৃহা মুখ বাঁকিয়ে বললো,” হয়, আমার ক্লাস হয়। আপনার কোনো সমস্যা?”

জিম কথা বাড়াতে চায় না চটজলদি গাড়ীর দড়জা খুলে বললো,” উঠো।”

স্পৃহা ভ্রু কুঁচকে বললো,” আজব গাড়ি সঙ্গে এনেছেন কেনো? আপনার কি পা নেই? হাঁটতে পারেন না। নাকি ব্যাটারি শেষ হয়ে যায় হাঁটলে।”

জিম তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। স্পৃহা দৃষ্টি সরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে বললো,”আমি এমন ঢং করে বাড়ি ফিরতে পারবো না। আমি রোজ যেমন হেঁটে বাড়ি ফিরি আজও সেভাবে ফিরবো।”

জিম ভ্রূ কুচকে বললো,” তুমি হেঁটে বাড়ি ফিরবে? তাহলে আমাকে শুধু শুধু ডেকে আনার মানে কি?”

স্পৃহা রেগে গিয়ে বললো,” আপনাকে ডেকেছি। কিন্তু আপনাকে কোলে করে গাড়ী নিয়ে আসতে বলেছি? আশ্চর্য। আর আপনি না দেখবেন? আমাকে কারা ডিস্টার্ব করে? গাড়িতে করে গেলে আমাকে তারা ডিস্টার্ব করবে কি করে।”

জিম গাড়ীর দরজা সজোরে ধাক্কা দিয়ে বন্ধ করে বললো,” চলো।” অনেক কষ্টে নিজের রাগ সামলে স্পৃহার সঙ্গে হাঁটা দিলো। এই মেয়ে এতো অদ্ভূত কেনো? জিম স্পৃহার পিছে পিছে হাঁটছে। আর আশেপাশে তাকাচ্ছে। কোথায় কেউ তো নেই। শুধু শুধু এই মেয়ে তাকে ঘুরাচ্ছে।

হটাৎ স্পৃহা গোলাপের দোকান দেখে হুট করে এক দৌড় দিলো। জিম তীব্র বিরক্তি নিয়ে পিছু পিছু এলো।এই মেয়ে নিশ্চই এখন বলবে না, যে এই দোকানদার তাকে ডিস্টার্ব করে।

স্পৃহা দোকানদারের সাথে প্রায় দশমিনিট দাম নিয়ে বার্গেনিং করলো তারপর। তিনটা গোলাপ কিনলো। মাঝে জিম বলেছিলো কথা না বাড়াতে, স্পৃহা মুখ বাঁকিয়ে বললো,” এই থামুন তো আপনি। আমি টাকার গাছ লাগিয়েছি তো, যে টানবো আর টপ টপ করে পড়বে।”

জিম এই মুহুর্তে তীব্র বিরক্তি নিয়ে স্পৃহার দিকে তাকিয়ে আছে। স্পৃহা ফুলগুলো থেকে একটা ফুল জিমের দিকে এগিয়ে দিতেই জিম তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললো,” আমার লাগবে না।”

[ #চলবে ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here