#যখন_তুমি_এলে।
#পর্ব- ২০।
#লেখা- জাহান লিমু।
সকালের মিষ্টি হাওয়াতে বসে জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসেব কষছিলো আরাদ। কিন্তু প্রাপ্তির খাতাটা যেন বরাবরই শূন্য তার। জীবনের সকল সমীকরনের মান, তার অসম। যতই হিসেব মিলাতে যায়,ততই সব বিগড়ে যায়। আরাদ ভেবে পায় না,তার ত্রুটিটা কোথায়!
তার কি অপরাধ?
সে কেন শাস্তি ভোগ করছে?
কিসের শাস্তি ভোগ করছে?
আরাদের এতো এতো প্রশ্নের উত্তর কে দিবে?
আর কয়টা স্বাভাবিক মানুষের মতো,কেন নয় তার জীবনটা?
কেন সে এমন কাঠখোট্টা হয়েছে,কেউ কি জানে তা?
এই নশ্বর পৃথিবীতে কে কার খোঁজ রাখে!
যার কাছের মানুষই কাছে থাকেনা,সে কি করে দূরের মানুষকে কাছে টানার দুঃসাহস করবে।
কখনো কখনো জীবন যে কাউকে দেয়ার চেয়ে, বেশি কেড়েই নেই। আরাদ বোধহয় সেই দলের অন্তর্ভুক্ত লোক।
আরাদ আগেই জানতো যে, তাকে এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। সে আরো আগেই আশঙ্কা করছিলো, এরকম কিছুর।
বরং সে অবাক হচ্ছিল, এতোদিনেও লাভগার্লকে দেখতে না পেয়ে। একহালি থাপ্পড় খাওয়া স্বত্বেও, আরাদ সাচীর নাম দিয়েছে লাভগার্ল। সেটার কারন অবশ্য ভিন্ন। সারাক্ষণ একটা উৎকন্ঠায় ছিলো এ কদিন,এই বুঝি লাভগার্লের সামনে পড়ে গেলো সে। আর ঠিক এ কারনেই, সে এখানে আসতে চাইছিলোনা।
কিন্তু এদের জোরাজুরিতে আসতে বাধ্য হলো। যেহেতু নিজেরও কোন পিছুটান নেই। ফোনটাও বন্ধ করে রেখেছে সে,যেন কেউ খোঁজ না নিতে পারে। অবশ্য খোঁজ নেয়া ব্যাক্তির তালিকায় দুজন মানুষই আছে। আর কেউ রেগুলার খোঁজ নেয় না। দাদী আর রোহানী ছাড়া।
রোহানী অবশ্য ক্ষেপে আগুন হয়ে যাবে,আরাদের এমন কার্যের কারনে। রোহানী যে কি বিপদে আছে,সেটা যদি আরাদ জানতো, তাহলে হয়তো এই অবস্থার মধ্যেও ওর সাথে দেখা করতো। কিন্তু আফসোস,ফোন বন্ধ রাখার কারনে সে কোনকিছু সম্পর্কেই অবগত নয়।
গত কয়েকমাস যাবত দাদীও অসুস্থ, সে কারনে আরাদের কাছেও আসেনা। নিয়মিত ফোনও দেয় না।
আরাদকে ওর চাচার বাসায় গিয়ে থাকতে বলে,কিন্তু সে যায় না। নিজের বাসায় একাই থাকে। কোন একটা সুপ্ত আশায়।
জানেনা সে আশা কখনো সত্যি হবে কিনা।
গত ছয়বছর ধরে সে একা জীবনের যাত্রী।
মা,বাবা থাকা স্বত্বেও নেই।
সাচী কিছু বলতে চেয়েও পারছেনা। কারন ওর মাথায় প্রথমত এটা ঢুকছেনা,আরাদ এখানে কি করে!
দ্বিতীয়ত পেটে বেল্ট বাঁধা কেন?
এবং আরাদের চেহারা উস্কোখুস্কো,মলিন। মাথার চুল স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকটা বড়। মুখের দাঁড়ি-গোফও অনেক লম্বা হয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে সে অসুস্থ অথবা কোন ঝড় বয়ে গেছে তার উপর। কিন্তু অসুস্থ অবস্থায় এখানে কেন আসবে সে? সেটাই সাচীর মাথায় ঢুকছেনা।
তবে আরাদের অবস্থা দেখে রাগ দেখানোর বদলে,কেমন যেন মায়া লাগছে সাচীর। তবে বিষয়টা ঠিক কি,সেটাতো বুঝতে হবে। যখন সাচী প্রশ্ন করতে যাবে,তার আগেই সেখানে বিরুনিকা এসে উপস্থিত। বিরুনিকাকে দেখে সাচী অবাক না হলেও,অবাক হলো বিরুনিকা যে কথাটা বলতে বলতে এখানে এসেছে। সে আরাদকে ডাকতে ডাকতে এখানে আসলো। বিরুনিকা আরাদকে চিনে কি করে?
সবকিছু সাচীর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। সকাল সকাল একের পর এক শক খাচ্ছে সে। বোকার মত দাঁড়িয়ে রইলো সে।
আরাদ বুঝতে পারলো সাচীর অবস্থাটা। বেচারী হয়তো কোনকিছু ভেবে কূল কিনারা করতে পারছেনা। অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক। সাচীর জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও, একইভাবে শক খেতো। তবে আরাদের এটা ভেবে স্বস্তি লাগছে যে,সাচী এখনো তার গালে আর দুইটা বসায় নি। কারন সাচীর সামনে আসলেই,আরাদের চিনচিন ব্যাথা করে। বুক নয়,গালটা চিনচিন ব্যাথা করে।
আর সেখানে সাচীর সামনে এভাবে সর্বক্ষণ থাকতে হবে,সেটা সে কস্মিনকালেও ভাবেনি। যদিও সেটা কিছুদিনের জন্য, তবুও। কিন্তু বিগত দিনগুলোতে সাচীকে দেখতে পাইনি কি করে,সেটা আরাদের মাথায় আসছেনা। প্রতিদিন সকালে সে এই জায়গাটাতে বসে থাকে। একটু একটু হাঁটার চেষ্টা করে। মা, মেয়ে যে পাগল,পুরোপুরি সুস্থ না হলে ওকে ছাড়বে বলে মনে হয় না। অনেকটাই সুস্থ হয়ে গেছে অবশ্য। আর সপ্তাহখানেকের মধ্যে সুস্থ হয়ে যাবে হয়তো। ডাক্তার সেরকমই বলেছে। সবকিছু নিয়মমত করাতে,দ্রুতই ঠিক হয়ে গেছে সে।
ঠিক না হয়ে যাবে কোথায়। এরকম পরিচর্যাতে আরো সিরিয়াস রোগীও সুস্থ হয়ে যাবে, তাও সময়ের আগে।
সাচী বিরুনিকার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
” তুমি উনাকে চিনো কি করে?”
সাচীর প্রশ্ন শুনে বিরুনিকা পাল্টা প্রশ্ন করলো,
” কেন? তুমিও চিনো নাকি?”
সাচী আরাদের দিকে তাকিয়ে বিরুনিকার প্রশ্নের উত্তর দিলো।
” হ্যাঁ,চিনি।খুব ভালো করে চিনি।”
আরাদ সাচীর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মাথার চুল কাঁটা দিয়ে উপরে বাঁধা। ছোট ছোট চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। কফি কালার স্কার্ট আর সাদা টি-শার্ট পরে আছে সে। গলায় স্কার্ফ পেঁচানো।
হাফহাতা টি-শার্ট পরার কারনে,প্রায় পুরো হাত উন্মুক্ত হয়ে আছে। সাচীর হাতের লোমগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মেয়েদের হাতের লোম এতো বড় হয় নাকি?
অবশ্য লোমগুলো কালো নয়,সোনালী রংয়ের।
সেজন্য গায়ের রংয়ের সাথে মিশে গেছে প্রায়। তাই দেখতে ভালোই লাগছে। আরাদ আগে কখনো খেয়াল করেনি। অবশ্য খেয়াল করার কথাও না।
আরাদকে সাচীর দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে, বিরুনিকা বেশ অবাক হলো। তারমানে কি এরা দুজন পূর্ব পরিচিত?
কিন্তু কি সূত্রে?
বিরুনিকার মাথায় ঠিক খেলছেনা বিষয়টা। কিন্তু এখানে দুজনের সামনে দাঁড়িয়ে কাউকে কোন প্রশ্ন করতেও মন চাইছেনা বিরুনিকার। পরে সাচীর কাছ থেকে জেনে নেওয়া যাবে।
এখন আরাদকে রুমে নিতে এসেছে। নাস্তা করে ঔষধ খেতে হবে। বিরুনিকা আরাদকে ভেতরে আসার জন্য বললো। আরাদ সামনে এগুতে নিয়ে হুঁট করে পড়ে যেতে নিলে,সাচী আরাদের হাত চেপে ধরে। আরাদ শরীরের ভর সাচীর উপর ছেড়ে দেয়। হঠাৎ মাথা চক্কর দিয়ে উঠেছিলো ওর। শরীর এখনো যথেষ্ট দুর্বল। সময় লাগবে এটা কাঁটতে। বিরুনিকা সাচীর একটু পেছনে দাঁড়িয়েছিল। আচমকা পড়ে যেতে নিলে,বিরুনিকা ঘাবড়ে যায়। কাছে এসে জিজ্ঞেস করে,
” তুমি ঠিক আছো আরাদ?”
বিরুনিকা আরাদকে তুমি করে বলছে শুনে, এবার সাচীর ভাবনারা থেমে গেলো। সে বেশ বুঝতে পারছে,তার অনুপস্থিতিতে এখানে কোনকিছু ঘটেছে। তবে সেটা ঠিক কি,তা বিরুনিকার সাথে কথা বলার আগ পর্যন্ত জানা যাবেনা। তাই এখন আর কিছু না বলে সাচী চুপচাপ রুমে ফিরে গেলো। আরাদও বিরুনিকার সাথে চলে গেলো।
সাচীর অবস্থা যে এলোমেলো সেটা ওর চেহারা দেখেই বুঝা যায়। তবে আরাদ অবশ্য ভয়ে ছিলো,এখানে এসে আরো চড়-থাপ্পড় খেতে হয় কিনা। সেরকম কিছু হয়নি দেখে, বেশ অবাকও হলো বটে।
কারন সেদিনের পর সাচীর দেয়া থাপ্পড়গুলো সে স্বপ্নেও দেখতে লাগলো প্রতিদিন। ঘুমের মধ্যে হুঁট করে উঠে বসে, এই স্বপ্ন দেখে। উঠে দুইহাত দিয়ে গালে চেপে ধরে রাখে।
কতক্ষণ এভাবে থাকার পর সে বুঝতে পারে যে,এটা স্বপ্ন ছিলো। কি একটা ভয়াবহ অবস্থা!
ঘুমিয়েও শান্তি নেই।
থাপ্পড়ের কি জোর!
#চলবে…