#যখন_তুমি_এলে।
#পর্ব- ১৯।
#লেখা- জাহান লিমু।
তানিম আংটি পরাতে রোহানীর হাত ধরতে যাবে,আচমকায় রোহানী হাত ছিটকে সরিয়ে নিলো। তানিম হতভম্ব হয়ে গেলো পুরো। প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে রোহানীর দিকে তাকিয়ে রইলো।
কিন্তু রোহানী একটা কথাও না বলে চলে যেতে উদ্বত হলে,তানিম পথ আগলে দাঁড়ায়। রোহানী কাঁদছে।
তানিম কিছু বুঝতে পারছেনা।
হঠাৎ এমন কি হলো যে, রোহানী এমন অদ্ভুত আচরন করছে।
তানিম রোহানীর গালে হাত রাখতে চাইলে সে ছিটকে সরে যায় আবারো। তানিম এবার চূড়ান্ত আশাহত হয়।
কিন্তু রোহানীর এমন আচরণের হেতু খুঁজে পাচ্ছে না সে। হ্যাঁ,একটা কারন পেয়েছে বটে। কিন্তু প্রপোজের পর তো সে কারনটা আর থাকার কথা না।
তাহলে কি?
রোহানী একটু দূরত্বে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সেটা তানিমকে আরো পোড়াচ্ছে।
মেয়েটা কেন এমন করছে?
এমন একটা মুহুর্তে কেউ এমন উদ্ভট আচরণ করে?
তানিমের যে কষ্ট হচ্ছে, সেটা কি বুঝতে পারছেনা মেয়েটা?
হ্যাঁ,তানিম হয়তো এতোটা নাটক না করলেও পারতো। জীবনটাই তো একটা নাটক। আর আমরা একেকজন সে নাটকের অভিনেতা,একেক রুল প্লে করি। তবে একটু বেশিই করে ফেলেছে বোধহয় সে। এতোটা প্রেসারে রাখা হয়তো ঠিক হয়নি। কিন্তু সবটুকু সুখ দিবে দেখেই,একটু কষ্টে রেখেছে এ কয়দিন। সেটা কি খুব বেশি অপরাধ হয়ে গেছে?
যদি হয়েই থাকে,তবে তার দন্ড প্রদান করুক।
কিন্তু এভাবে নিজেও কষ্ট পাচ্ছে, আমাকেও কষ্ট দিচ্ছে।
এটার কোন মানে হয়?
তানিম দূর থেকেই মলিন কন্ঠে বললো,
” আমি সরি রুহী। তানিম রোহানীকে রুহী ডাকে। আমার এমনটা করা উচিত হয়নি। এতোদিন তোমার সাথে যোগাযোগ না করে থেকে আমি ভুল করেছি। কিন্তু আমি কেন করেছি,সেটা জানার পর তুমি রাগ করে থাকতে পারবেনা। তানিমের কথা রোহানীর কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে কিনা, সেটা তানিমের জানা নেই। কারন রোহানী কেমন পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। তবুও সে নিজের মতো করে বলে যাচ্ছে।
কখনো কখনো নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে নিজের বক্তব্য জোর করে হলেও বলতে হয়। বিশ্বাস-অবিশ্বাস করাটা একান্তই সামনের ব্যাক্তির কাছে৷ কিন্তু নিজের কাছে তো নিজে সন্তুষ্ট থাকা যাবে।
না বলে অপরাধী সাজার চেয়ে,বলে শাস্তি পাওয়াও বলে।
কিন্তু রোহানী ভাবলেষহীনভাবে দাঁড়িয়ে আছে। যেন তার কোন হুঁশ জ্ঞান নেই। তানিম আবার বলতে লাগলো,
” প্লিজ,রুহী। মজা করো না। এটা মজা করার বিষয় না। আর আমি মজা করার মুডে নেই। আই অ্যাম সিরিয়াস। প্লিজ,ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড। আমিতো তোমাকে সা……
তানিম কথাটা বলে শেষ করার আগেই রোহানী প্রস্থান করলো৷ তানিম মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো৷ আর একবারও পিছু ডাকলো না,বা পথ আগলে দাঁড়ালো না। যে চলে যেতে চায়,তাকে ফেরানোর সাধ্য কার!
সারপ্রাইজ দিতে চাওয়াটা কি খুব বেশি ভুল হয়ে গেলো?
তানিম হাঁটু চেপে ধরে উপুড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তখন হন্তদন্ত হয়ে সোহানী ছুটে এলো। কারন সে দূর থেকে দেখেছে, তার বোন চলে যাচ্ছে। কিন্তু সে একা কেন চলে যাচ্ছে, সেটার মানে বুঝতে পারলোনা। তাই তানিমের নিকট ছুটে এলো। এখানে এসে দেখে তানিম বিষন্ন,মনমরা।
হলোটা কি দুজনের?
এমন নয় যে,দুজন দুজনকে ভালোবাসেনা।
তাহলে?
সোহানীর ছোট মাথায় কিচ্ছু আসছেনা। তানিমের সামনে এসে হাঁফাতে হাঁফাতে প্রশ্ন করলো,
” কাহিনী কি ভাইয়া? আপু ঐভাবে কেন চলে গেলো? আর মনে হলো, সে কাঁদছে।”
তানিম মাথা সোজা করে দাঁড়ালো। মুখটা কেমন যেন ভঙ্গি করে বললো,
” আমি বোধহয় কোন ভুল করে ফেললাম। যার শাস্তি এখন ভুগতে হবে।”
সোহানী তানিমের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারলোনা। তাই আবার প্রশ্ন করলো। তানিম কষ্টের হাসি হেসে বললো,
” তোমার বোন আমার প্রপোজ এক্সেপ্ট করেনি। সে আমাকে অন্য কাউকে বিয়ে করে নেয়ার কথা বলে চলে গেছে।”
সোহানী যেন সপ্ত আসমান থেকে পড়লো। প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলো, মানে!”
প্রতিউত্তরে তানিম মলিন হাসি হাসলো। সেটা দেখে সোহানী ক্ষোভে ফেটে পড়লো। উচ্চস্বরে বলতে লাগলো,
” সে বললো,আর অমনি আপনি ওকে চলে যেতে দিলেন?
বাহ! সোহানী হাততালি দিতে লাগলো। তারপর আবার বলতে লাগলো,
” আরে ভালোবাসার যদি কোন জোরই না থাকে,তাহলে ভালোবাসতে যান কেন? এই আপনাদের মত মানুষের কারনেই,দেশে আজকে প্রেজেন্টের চেয়ে এক্স বেশি।
সোহানীর কথাটা শুনে তানিমের সিরিয়াস মুহুর্তেও হাসি চলে আসলো। মেয়েটা রাগে ফুঁসছে। ব্যাপারটা এমন যে,ব্রেকআপটা তার হয়েছে। অবশ্য এই মেয়ের সাথে কোন ছেলে ব্রেকআপ করতে চাইলে,হয়তো তাকে মেরেই একেবারে সারাজনমের ব্রেকআপ করে দিবে। এমন মুহুর্তে তানিমের মুখে হাসি দেখে সোহানী চূড়ান্ত অবাক হলো। রেগে গিয়ে বললো,
” আপনি কি পাগল হয়ে গিয়েছেন? আপনার গার্লফ্রেন্ড আপনাকে ছেড়ে চলে গেছে,আর আপনি খিজাচ্ছেন? সোহানীর ভাব এমন,যে পারলে তানিমকে ধরে কয়েকটা মাইর দেয়। কিন্তু এতোবড় লোকটাকে সম্মান দেখাতেই হয়তো চুপ করে আছে।
আমারতো এখন আপনাকে সন্দেক হচ্ছে। আপনি কি আপুকে প্রপোজ করেছেন,নাকি অন্যকিছু।
” অন্যকিছু মানে?”
মানে আপনিই ব্রেকআপ করেছেন কিনা। না হলে, হাসি আসছে কোথা থেকে। তানিম আবার হাসলো। এবার সোহানী নিজের মেজাজ ধরে রাখতে পারলোনা। সেও রাগে গট গট করে চলে যেতে যেতে বলে গেলো,
” পাবনা আপনার জন্য একটা সিট বুকিং দিতে যাচ্ছি আমি। ইমিডিয়েটলি চিকিৎসা দরকার আপনার। তানিম হতবিহবল চোখে সোহানীর প্রস্থানের পথের দিকে তাকিয়ে রইলো। মাটিতে হাটুঘেরে বসে ভাবতে লাগলো, সবাই ছেড়ে যাওয়ার জন্যই জীবনে আসে কেন? যদি পুরো জীবন না রাঙাতে পারে,তবে ক্ষণিকের জন্য মনে রঙের ছোঁয়া লাগায় কেন?
কেউ কথা রাখেনা,রাখতে জানেনা। শুধু মিথ্যে অভিনয় করতে জানে। জীবন নামক রঙ্গমঞ্চে, সবাই তুখোড় অভিনেতা। সেখানে কে কাকে ছাড়িয়ে যাবে,তার ঘূণ্য প্রতিযোগিতা চলে।
.
কয়েকদিনের জন্য গাজীপুর ফুফুর বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলো সাচী। বাসায় থেকে থেকে একঘেয়েমি চলে আসছিলো। তাছাড়া সাচী এমনিতেও গাজীপুর যায়,সময় পেলেই। কারন ওর ফুফুর বাসা নুহাশ পল্লীর একদম কাছেই। যখন তখন সেখানে যাওয়া যায়। আর নুহাশ পল্লী সাচীর কাছে একটা ভালোলাগার স্থান। ভেতরে গেলেই মনটা অন্যরকম প্রশান্তিতে ভরে উঠে। প্রায় দশদিন সেখানে কাটানোর পর আজ ফিরে আসছে। বাসায় এসেই বাবাকে ডাকতে লাগলো। শফিকুর তড়িঘড়ি করে সিগারেট লুকাতে গিয়েও, পারলেন না। আজকে মেয়ের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে গেলেন। সাচী বাবাকে জোরে ডেকে ডেকে রুমে ঢুকেই থেমে গেল একদম। শফিকুর একবার মেয়ের মুখের দিকে তাকাচ্ছেন,আরেকবার হাতের শেষ হওয়া সিগারেটের দিকে। মনে হচ্ছে এইমুহুর্তে সে কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার অপরাধের জন্য, এখনি হয়তো তাকে ট্রস ট্রস করে দিবে।
সিগারেটটা হাত থেকে ফেলতেও ভুলে গেছেন একদম। সহসাই সিগারেটের আগুন আঙুলে লেগে যায়। মুহূর্তেই হাত ছিটকে সেটা ফেলে দেন। সাচী হাতের ব্যাগটা ফেলে, তাড়াহুড়ো করে ফ্রিজ থেকে বরফ নিয়ে আসে। এনে বাবার হাতে চেপে ধরে। শফিকুরের চোখ দিয়ে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। ভেবেছিলেন মেয়ে হয়তো ইচ্ছেমত ঝাঁড়বে উনাকে।
তিনি অনেক চেষ্টা করেছেন সিগারেট ছাড়ার,কিন্তু কেন যেন একেবারে ছাড়তে পারছেন না। এখনো মাঝে মাঝে খেয়ে ফেলেন। তবে সাচী জানে,ওর বাবা ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু আজ সব ফাঁস হয়ে গেলো। শফিকুর অপরাধীর মত ভঙ্গী করে মাথা নিচু করে রইলেন। সাচীর চোখে চোখ রাখতে পারছেন না। সাচীও মাথা নিচু করেই বলতে লাগলো,
” আচ্ছা, বাবা তোমরা সন্তানদের যেটার জন্য নিষেধ করো,সেটা তাদের ভালোর জন্যই করো। আর সেটা সন্তানরা মেনে চলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। তাহলে সন্তান যদি কোনকিছু নিষেধ করে,তাহলে সেটা কেন তোমরা অভিভাবকরা মানতে পারো না? তারাও তো তোমাদের ভালোর জন্যই বলে।
এখন আবার এটা বলতে এসো না যে,সব সন্তান কথা মানেনা। তাই তোমরাও মানবেনা। শফিকুর মেয়ের কথায় হেসে দিলেন। তারপর মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
এইযে আজ তোকে কথা দিলাম,আর কোনদিনও ঐ জিনিস স্পর্শ করবোনা।
সাচী মুখ ভেঙ্গিয়ে বললো,এরকম কথা তুমি আগেও দিয়েছো। রাখতে পারোনি,হুহ!
ইউ আর অ্যা লায়ার!
শফিকুর এবার কি বলবেন, বুঝতে পারছেন না। কারন সাচী সত্যিই বলছে। আসলে সিগারেট জিনিসটা এমন,যেটা একেতো সহজে ছাড়া যায় না। আবার ছেড়ে দিলেও,কখনো কখনো ভুলে খেয়ে ফেলে। কিছুটা অভ্যাসবশত,আর কিছুটা নেশা।
তবে এবার সত্যি সত্যিই সম্পূর্ণরূপে ছেড়ে দিবেন। নিজের জন্য না হলেও,পরিবারের জন্য। প্রিয়জনদের ভালোবাসার মূল্য দিতে হয়।
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ছাদে গেল সাচী। কিছুক্ষণ শীতল বাতাসের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করলো। ছাদের এক কর্ণারে দাঁড়িয়ে হঠাৎ নিচে ভূত দেখার মত চমকে তাকালো। একটা কেউ বসে আছে সেখানে। এতো সকালে কে হতে পারে?
তাছাড়া লোকটাকে ওদের বাসার কেউ বলে মনে হচ্ছে না।
সাচী ছাদের এদিক-ওদিক দাঁড়িয়ে, একটু দেখার চেষ্টা করলো লোকটাকে। পাশ থেকে দেখে কেমন চেনা চেনা লাগছে। সহসাই কিছু একটা মনে হলো সাচীর। চোখ কঁচলে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। যেটা ভাবছে,সেটা নয়তো!
সাচীদের বাসার সামনে একটু খালি জায়গা আছে। সেখানে বিরুনিকা বেশ কয়েকটা ফুলের টব রেখেছে। আর একটু বসার জায়গা আছে। সেখানেই কেউ বসে আছে। তবে তাতে সাচীর কিছু আসে যায় না। সাচী প্রায় হুঁড়মুড়িয়ে সেখানে গিয়ে দাঁড়ালো। একটু জোরে নিঃশ্বাস ফেললো। নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে বললো,
” স্কিউজমি?”
পেটের বেল্টটা ঠিক করে নিয়ে সে পেছন দিকে ঘুরে দাঁড়ালো।
সাথে সাথে সাচীর মুখটা হা হয়ে গেল।
রোবট এখানে,তাও এতো সকালে!
কিন্তু পেটে বেল্ট বাঁধা কেন?
#চলবে…