মোনালিসা পর্ব ৪

0
1784

মোনালিসা
মৌমিতা_দত্ত
পর্ব ৪

রেঁস্তোরায় মধ‍্যাহ্ন ভোজের খাবারের অর্ডার দেওয়ার পর সরাসরি আবীরের দিকে তাকিয়ে রাজীবের প্রশ্ন, ” তুই যে কলকাতায় আসছিস আমাকে আগে থেকে কিছু জানালি না কেনো? বিশেষ কোনো কারণ!”

“বিশেষ কারণ ঠিক নয় , আবার বিশেষ কারণ বলতেও পারিস।”

আবীরের এরকম উত্তরের ধোঁয়াশা রাজীব কাটিয়ে ওঠার আগেই, তার মুখে বিস্ময়ের ছাপ দেখে আবীর নিজেই বলে ওঠে, “আরেহ, তেমন কোনো ব‍্যাপার নেই। আমি আমার কারেন্ট প্রোজেক্ট ফিনিস করে কলকাতায় পোস্টিং নিয়েছি বছর দুইয়ের জন‍্য। আর আমার বাবার সম্পত্তি বিষয়ক কিছু কাজ বাকি আছে সেই সূত্রে কলকাতায় আসতেই হতো ,তাই চলে এলাম। ভেবেছিলাম তোকে সারপ্রাইজ দেবো। তাই তোকে আগে থেকে কিছু বলিনি।”

“ওহ , আচ্ছা।” শুধু এটুকু বলে রাজীব অন‍্যমনস্ক হয়ে পড়ে। এই প্রথম আবীরের কথাগুলো বিশ্বাস করতে তার মন যেন তাকে বাধা দেয়। তবুও নিজের মনকে বুঝিয়ে নিজের ব‍্যক্তিগত চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়ে সে।

এবার রাজীবের হাতের উপর হাত রেখে আবীর বলে ওঠে, “কী হয়েছে তোর ? এতো অন‍্যমনস্ক কেনো তুই? কোনো সিরিয়াস কিছু ? ”

ইতিমধ্যে অর্ডার দেওয়া খাবার নিয়ে হাজির হয় খাবার পরিবেশক। খাবার পরিবেশন করে চলে যাওয়ার পর নিজের প্লেটের খাবারগুলো চামচ দিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতেই রাজীব বলে ওঠে, “তোর উর্বশী কে মনে আছে?”

খাবার খেতে খেতেই কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে আবীর বলে ওঠে , “ওহ মনে পড়েছে। আমি বিদেশে যাওয়ার পর যার তোর আলাপ হয়েছিল। তোর বান্ধবী উর্বশী তো!”

“হ‍্যাঁ, সেই উর্বশী।”

“হঠাৎ উর্বশীর কথা বলছিস! তোর সেই বান্ধবীর সাথে কোনো গোলমাল বা কথা কাটাকাটি হয়েছে, নাকি তোর বান্ধবীর কোনো বিপদ ঘটেছে।” স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞাসা করে আবীর।

কিন্তু আচমকা রাজীবের মুখে যেন কালো ছায়া নেমে আসে। আনমনেই সে বলে ওঠে, “নাহ্, তার থেকেও অনেক বেশি কিছু।”

এবার একটু বিরক্ত হয়েই আবীর বলে ওঠে, “এতো ভনিতা না করে সরাসরি বল না কি হয়েছে! এতো সাসপেন্স আর ভালো লাগছে না।
কোথায় এতো বছর পর এলাম তোর সাথে দেখা করতে আর তুই কিনা হেজাচ্ছিস।”

এরপরেও রাজীবকে চুপ থাকতে দেখে গলার স্বর নরম করে আবীর বলে ওঠে, “এনিথিং সিরিয়াস!”

এবার স্থির চোখে আবীরের দিকে তাকিয়ে রাজীব বলে ওঠে, “তুই এখানে ছিলিস না। আর তোকে সবটুকু জানানোও হয়নি । আসলে উর্বশী শুধু আমার বান্ধবী ছিলনা। বান্ধবীর থেকেও একটু বেশি কিছু ছিল।
আমি উর্বশীকে ভালোবাসতাম। কিন্তু, বিশ্বাস কর !কখন যে ভালোবাসতে শুরু করি তা আমি নিজেই জানি না।
যখন বুঝলাম ভালোবাসি তখন সে ভালোবাসা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব ছিলনা।”

আবীরের খাওয়া ততোক্ষণে থেমে গেছে। একাধিক প্রশ্নে চোখ স্থির। সে শুধু বলে ওঠে, “তাহলে বিয়ে করলি কেনো ?”

“সে কথা বলবো বলেই তোকে ডেকেছি। মনের এই অস্থিরতা আমি আর বয়ে নিয়ে বেড়াতে পারছিনা। কী করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। তাই এই রকম অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে নিস্তার পেতেই তোকে ডেকেছি। ”

আবীর চুপ করে থাকে। রাজীব বলতে থাকে – “তুই বিদেশে যাওয়ার আগেই দিদিও বিদেশে পাড়ি দেয়। বাবা – মা’ র অনুপস্থিতিতে আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলিস তোরা । তাই তোদের দুজনের দু’দিকে পাড়ি দেওয়ার সাথে সাথে কিছুদিন পর থেকে নিজের নিঃসঙ্গতা কাটাতে আমি অফিস থেকে ফিরে গান করতে, গল্পের বই পড়তে থাকি।
তাও যেন নিঃসঙ্গতা আমাকে তাড়া করে বেড়াতো।
তোদের সাথে যোগাযোগের মাধ‍্যম শুধুমাত্র চ‍্যাট ছিল।
সকালে আমার ব‍্যস্ততার সময় তোরা রাতে নিদ্রারত থাকতিস। ফলে দূরত্ব বাড়ছিল। সেই সময় আমি ঠিক করি কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে কাছাকাছি কোথাও ঘুরতে যাবো।
সেই মতো একদিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম মন্দারমণির উদ্দেশ্যে। রিসর্ট বুকিং আগেই করা হয়ে গিয়েছিল। তোকে জানিয়েওছিলাম।
সঙ্গে নিয়েছিলাম কিছু বিয়ারের বোতল, ক‍্যাসুয়াল আউটফিঠ, ক‍্যামেরা , শুকনো খাবার আর কিছু মেডিসিন।
তুই জানিস লং ড্রাইভ করতে আমার সব সময় ভালো লাগে। তাই নিজেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
চেনা ছকের বাইরে একাকীত্ব থেকে মুক্ত হয়ে নিজেকে নতুন ভাবে আবিষ্কারের নেশায়। কিন্তু, আমি জানতাম না, এর পরবর্তী ঘটনা আমার জীবনকে এতোটা অসহায় করে তুলবে‌।” এইবলে কিছুক্ষণ চুপ করে যায় সে।

“তারপর কী হল?” উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞাসা করে ওঠে আবীর………

এদিকে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে । ফ্রিজ থেকে কিছু শুকনো খাবার খেয়ে কখন যে ডাইনিং টেবিলে বসেই চোখ লেগে গেছে তা বুঝতে পারেনি মোনালিসা।
আচমকা ঝনঝন করে কিছু ভাঙার শব্দে চোখ মেলে দেখে ঘড়ির কাঁটা বিকেল চারটের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
শব্দের উৎস অনুসন্ধান করে সে বুঝতে পারে আওয়াজটা রান্নাঘরের দিক থেকেই আসছে।

রান্নাঘরের ভেজানো দরজা খোলামাত্রই সে দেখে একটা সাদা রঙের বিড়াল গুটি সুটি মেরে মেঝেতে বসে আর তার পাশে একটা কাপের ভাঙা টুকরোগুলো মেঝেতে ছড়িয়ে আছে ।
এবার রান্নাঘরের খোলা জানালার দিকে তাকিয়ে তার বুঝতে অসুবিধা হয়না যে, জানালা দিয়েই বিড়ালটার প্রবেশ ঘটেছে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে লিসা বলে ওঠে, “কী করলি এটা তুই? একে অজানা অচেনা বাড়ি এটা আমার কাছে। তার উপর দিলি একটা কাপ ভেঙে। বাড়ির মালিককে কী জবাব দেবো আমি! মানছি তোর খিদে পেয়েছে তাই বলে এরকম ভাবে ক্ষতি করবি!”
তারপর বিড়ালটার শীর্ণ শরীর দেখে মায়া হয় তার। সযত্নে বিড়ালটাকে কোলে তুলে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলতে থাকে – “জানিস আমাদের গ্রামে তোর এক ভাই আছে । আমি আর জোজো ওকে ছোঁচা বলে ডাকি। সবসময় সবার ঘরে খেয়ে বেড়ায় তাই। জেঠিমাকে লুকিয়ে আমরাও ওকে খাবার খেতে দিতাম। ও তোর থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী।” পরক্ষণেই করুণ মুখে বিড়ালটার দিকে তাকিয়ে সে বলে ওঠে, “বুঝেছি তোকে এখানে কেউ খেতে দেয়না । তাই তোর এই হাল । তুই ও একা আর আমিও একা তুই রোজ এখানে চলে আসবি। আমি তোকে খেতে দেবো। ” এইবলে একবাটি দুধ এনে বিড়ালটার সামনে রাখার সাথে সাথে পরম তৃপ্তিতে সবটুকু দুধ খেয়ে গোঁফের রেখায় দুধের অস্তিত্ব রেখে জিভ দিয়ে মুখ চাঁটতে চাঁটতে লেজ উঁচিয়ে মিউ মিউ করতে করতে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ঘর বেরিয়ে যায় বিড়ালটা। সেদিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, “আজ তোর নাম হ‍্যাংলা। আবার আসিস আমার কাছে।”

(চলবে…..)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here