মোনালিসা
মৌমিতা_দত্ত
পর্ব ১২
দেখতে দেখতে কেটে গেছে বেশ কয়েক মাস। আর এই কয়েক মাস ধরেই চিঠিতে চিঠিতে মনের ভাব বিনিময় চলছে দুই প্রতিবেশীর। যা তাদের দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তবে অবশ্যই এক্ষেত্রে তা ব্যতিক্রমী নিয়মে।
নিয়মটা ব্যতিক্রমী এই কারণে – কারণ, এখানে দুইজনই চিঠি লিখে চলেছে নিজেকে উদ্দেশ্য করে কিন্তু বার্তার ইঙ্গিত অন্য প্রতিবেশীর প্রতি নির্দেশ করে।
পুরনো সময়ের মত এই ফোরজি যুগেও দুই প্রতিবেশীর এই উদ্যোগ যেন পুরনো খামে নতুনভাবে নব প্রেমের জালে জড়ানোর নব প্রয়াস।
আর অদ্ভুত ভাবে এই অভ্যাস বিগত কয়েক মাস ধরে এমন এক নেশায় পরিণত হয়েছে রাজীবের যে, আর সমস্ত যান্ত্রিক জিনিসের প্রতি আকর্ষণ তার ক্ষীণ হয়ে এসেছে।
এই যেমন – এর আগে প্রতিদিন গভীর রাত অবধি ল্যাপটপ নিয়ে বসে থাকা, মোবাইলে সারা দুনিয়ার খবর নিয়ে মেতে থাকা, হোয়াটস অ্যাপে নতুন নতুন মিম শেয়ার করে বন্ধুদের সাথে হাসি – ঠাট্টায় সামিল হওয়া, সপ্তাহ শেষে একটু নেশা করা।
এ সবের থেকেও এখন তার জীবনের প্রধান গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল – আড়ালে থেকে একজনকে লক্ষ্য করা, গভীর রাতে প্রতিবেশীর ঘরে সন্তর্পণে হানা দিয়ে নতুন চিঠি আবিষ্কার করা, কাজের সময়টুকু বাদে বাকি সময় প্রতিবেশীর দরজা পাহারা দেওয়া।
এরকমই এক গরমের দুপুরে অফিসে চিলড রুমে বসে কাজ করছে রাজীব। এমন সময় টেবিলে রাখা ফোনটা ভাইব্রেট হতে শুরু করে। ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখে আবীর কলিং…..। এবার ফোনটা কেটে একটা ম্যাসেজ ছেড়ে দেয় – ‘ওয়ার্ক প্রেসার হাই। কল ইউ লেটর।’
এই একই মেসেজ কয়েক সপ্তাহ ধরে আবীর ফোন করলেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে করছে সে।
আসলে আবীরের অনুরোধ কখনো তার পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই এতোদিন পর বন্ধুর অনুরোধে বার্ বা ডিস্কো তে গিয়ে বা বন্ধুর বাড়িতে পার্টি করে এনজয় করে সময় কাটাতে এই মুহূর্তে তার মন প্রস্তুত নয়।
তাই একরকম বাধ্য হয়েই আবীরের ফোন সে ধরছে না।
ফোন কেটে ম্যাসেজটা পাঠানোর পর ঘড়িতে টাইম ৩টে দেখে চেয়ার ছেড়ে ক্যান্টিনের দিকে পা বাড়ায় সে। ফিফথ্ ফ্লোরে থাকা সাজানো সুন্দর ক্যান্টিনের কর্ণারের একটা টেবিলে নন ভেজ একটা থালি নিয়ে দুপুরের লাঞ্চে বসে রাজীব। লাঞ্চ করতে করতে জানলার ট্রান্সপারেন্ট গ্লাস দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে আকাশের পূর্ব দিকে আলকাতরার মত কালো মেঘ জড়ো হয়েছে। খুব শিগগিরই হয়তো কালবৈশাখী শুরু হবে।
প্রকৃতির পাগলামির সাক্ষী থাকবে আবারও শহরবাসী। একথা মনে হতেই এক মুহূর্তের জন্য মনটা তার নেচে উঠলেও পরক্ষণেই তার মনে হয় ,নাহ্ তাকে তো সেই চিলড রুমে কম্পিউটারের সামনে বসে ধৈর্যের পরীক্ষাই দিয়ে যেতে হবে। তার আর লাভ কী!
একথা ভেবেই এতক্ষণ ধরে আনমনে চামচ দিয়ে নাড়াচাড়া করা খাবার মুখে চালান করার পর আচমকা তার মনে হয়, সে তো অফিসে দিব্যি অনেক জনের সাথে ,কাজের সাথে সময় কাটাবে। কৃত্রিম এসিতে ঠাণ্ডা হয়ে।
কিন্তু, একজন যে বাড়িতে একা! ঝড়বৃষ্টি একবার শুরু হলে, সে কী করবে ? একা একা। এই কথা মনে হওয়ার সাথে সাথে কোনরকমে লাঞ্চ শেষ করে সে দৌড়ায় এইচ. আর রুমের দিকে আরলি লিভের জন্য।
এদিকে নিজের ঘরে দুপুরে শরীর এলিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে লিসা। চোখ বন্ধ করে একই ছবি যেন সে মনের চোখ দিয়ে দেখতে ব্যস্ত। প্রতি রাতে তার ঘরে হানা দিচ্ছে একজোড়া পা। সেই নিঃশব্দ পদচারণার শব্দও যেন তার কান শুধু অনুভব করতে পারে। যে পা – জোড়া বারংবার চুরি করতে আসে নিঃশব্দে এক ঝাঁক শব্দ। যে শব্দগুচ্ছকে মনের সবটুকু দিয়ে সে সাজিয়ে রাখে সাদা পাতায়।
বন্ধ চোখেও কত কিছু স্পষ্ট দেখা যায় ,ভাবলেই এখন অবাক লাগে তার!
বন্ধ চোখেই এ সমস্ত কিছু ভাবার সাথে সাথে তার মুখে হাসির রেখা ফুটে ওঠে।
আচমকা একটা ঝনঝন আওয়াজে কিছু ভেঙে পড়ার শব্দে ধরফরিয়ে বিছানায় উঠে বসে লিসা।
সামনের জানালার দিকে চোখ যেতেই দেখে এলোমেলো অবাধ্য হাওয়ার দাপটে জানালার পাল্লাগুলোর করুণ অবস্থা! ছটফট করে কাতরাচ্ছে পাল্লাগুলো, আর পাল্লার কাঁচগুলো হার স্বীকার করে ঝরে পড়ছে। তবুও অবাধ্য হাওয়া তাদের ধোলাই করতে ব্যস্ত।
একমুহূর্তও আর সময় নষ্ট না করে নিজের ঘরের জানালার পাল্লাগুলো টেনে বন্ধ করে দেয় সে। তারপর ছুট লাগায় অন্যান্য ঘরের জানালা – দরজাগুলো বন্ধ করার জন্য।
এদিকে রাজীব যখন অফিস থেকে বেরোলো, তখন বেলা চারটে বাজে।
প্রকৃতির উন্মাদনার সূচনা ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে। এলেমেলো হাওয়ার দাপটে চেয়ে থাকা দায়।
কোনরকমে গাড়িতে উঠে সিটবেল্ট লাগিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয় রাজীব।
এলেমেলো হাওয়ার দাপটে যখন প্লাস্টিক প্যাকেট, রাস্তার ময়লা আবর্জনা, কাগজ সবকিছুই নতুন পাখনা গজানোর মত হাওয়ায় ভেসে এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের ঠিকানায় স্থানান্তরে ব্যস্ত।
তখন এই সবকিছুকে পিছনে ফেলে নিজের ঠিকানায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছানোর চেষ্টা চালাচ্ছে রাজীব চালকের আসনে বসে।
এসি গাড়িতেও চিন্তায় তার কপালে জমা বিন্দু বিন্দু ঘাম আর দুশ্চিন্তার ভাঁজ কোথাও গিয়ে যেন বুঝিয়ে দিচ্ছে, এই মুহূর্তে প্রকৃতির পাগলামির অস্থিরতা আর তার মনের অস্থিরতা কোথাও দাঁড়িয়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।
আকাশও প্রকৃতির এই পাগলামির দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেতে এবং পৃথিবীকে শান্ত করতে জলকণা এক দু’ফোঁটা করে ছড়াতে ব্যস্ত।
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হতে হতে এক সময় যখন বৃষ্টির বেগ বাড়তে শুরু করে সেই সময় নিজের বাড়ির কাছে এসে পৌঁছায় রাজীব।
বাড়ির কাছে আসতেই গাড়ি থেকে নেমে প্রথমেই দরজা খুলে সে ছুট লাগায় দোতলার ঘরের দিকে। কিন্তু, উপরের ঘরে পৌঁছনো মাত্রই প্রথম ধাক্কা খায় তার মন। দোতলার ঘরে যার উপস্থিতি লক্ষ্য করবে বলে তার ছুটে আসা,সে ঘরই তো ফাঁকা। কেউ কোথাও নেই।
এক নিমিষে কোনও অজানা বিপদের কথা ভেবে তার বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যায়।
যত কুচিন্তা মনের আনাচে কানাচে ঘুরতে থাকে।
কলকাতা শহরে দিনে রাতে কত ক্রাইম হয়ে চলেছে। সেরকম কিছু যদি লিসার সাথে হয়ে থাকে ! নাহ্ , আর কিছু ভাবতে পারেনা সে।
তন্ন তন্ন করে উপরের সব ঘর খুঁজেও যখন লিসাকে না পেয়ে তার নাজেহাল অবস্থা। তখন মাথা চেপে একটা চেয়ারে বসে পড়ে সে।
বাইরে প্রবল দুর্যোগের মাঝে বেরোনোয় সম্ভব নয়। আবার ঘরে চুপচাপ বসে থাকাও উচিত নয়!
যদি ভয়ানক কোনো বিপদ লিসার সাথে ঘটে থাকে , তাহলে কী করবে সে!
এসব ভাবনার মাঝে বুকের ভেতর এক চরম শূন্যতা আর অপরাধবোধ মিশে তার চোখের কোণ সূক্ষ জলবিন্দুতে ভরাট হয়ে ওঠে।
এমন সময় আচমকা ছাদের সিঁড়ির দিক থেকে একটা চেনা গলার আওয়াজ পেয়ে ,মুহূর্তের মধ্যে তার মনে হয় বাড়ির সব জায়গা খুঁজলেও ছাদটা তো সে খুঁজে দেখেইনি এতক্ষণ।
ক্রমে আওয়াজটা স্পষ্ট হলে সে দেখতে পায় – আধভেজা শরীরে একটা পাখির বাচ্চার সাথে কথা বলতে বলতে নিজের ঘরের দিকে ভাবলেশহীন ভাবে ঢুকছে লিসা।
এদিকে ,তাকে দেখতে না পেয়ে এতোক্ষণ রাজীবের মনে যে প্রবল ঝড় উঠেছিল সেদিকে তার ভ্রূক্ষেপও নেই।
সে শুধু একমনে পাখির বাচ্চাটাকে শাসন করতে ব্যস্ত।
এবার কিছুটা অধৈর্য্য হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় রাজীব। তারপর কিছুটা এগিয়ে লিসার হাত ধরে এক টান মেরে নিজের সামনে সে দাঁড় করায় ।
এরকম অদ্ভুত পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলোনা লিসা। অবাক হয়ে তার দুচোখ শুধু তখন রাজীবের এরকম আচরণের কারণ খুঁজতে ব্যস্ত।
প্রচন্ড রাগের বহিঃপ্রকাশ যখন ঘটে ,তখন যে তা জীবনের সব তাপমাত্রাকে হার মানায় তা বলাই বাহুল্য। ঠিক যেমনটা রাজীবের হচ্ছিল।
নিজের অজান্তেই নিজের অধিকারের সীমারেখা সে নিজেই পার করে ফেলে। দিকবিদিক জ্ঞানশূন্যের মতো শক্ত হাতে লিসার বাম হাতের বাহু ধরে চিৎকার করে বলে ওঠে, “কী ভেবেছ তুমি নিজেকে ? যেখানে যখন ইচ্ছা চলে যাবে। যা খুশি করবে ,কেউ কিছু বলবে না! কী করছিলে এই ঝড় জলে ছাদের উপর! কার জন্য উঠেছিলে ছাদে? বলো, উত্তর দাও?
বাড়ির মধ্যে না থেকে ,ছাদে উঠেছিলে কেনো ?”
অবাক দৃষ্টিতে রাজীবের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে লিসা। রাজীবের ব্যবহারের আকস্মিক পরিবর্তন তার মেনে নিতে পারেনা। তাই বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে সে বলে , “হাতটা ছাড়ুন, আমার লাগছে।” তারপর ডান হাতে থাকা পাখির বাচ্চাটা রাজীবের মুখের সামনে ধরে সে বলে, “ঝড় বৃষ্টিতে বাড়ির সব জানালা ,দরজা বন্ধ করার পর আমি ছাদে উঠেছিলাম। ফুলের টবগুলো সরিয়ে রাখার জন্য। ফুলের টব সরাতে গিয়ে দেখি, দুটো টবের মাঝে পড়ে পাখির বাচ্চাটা ভয়ে কাঁপছে। আর ততক্ষণে বৃষ্টিও শুরু হয়ে গেছে। তাই নিজেরা ঝড় বৃষ্টি থেকে বাঁচতে ঘরের ভেতর থাকবো আর একটা অবলা জীব বাইরে জীবন মরণ লড়াই করবে সেটা আমি চাইনি। তাই একে আনতে গিয়েই দেরি হয়ে গেল।”
এক নাগাড়ে লিসার বলে যাওয়া কথাগুলো শুনে নিজের ব্যবহারের জন্য খারাপ লাগতে শুরু হয় রাজীবের। মন অনুতপ্ত হলেও মুখে কিছু বলার তার আর সাহস হয়না। শুধু মুখ ফুটে দুটো কথা বের হয় ,”ওহ আচ্ছা।”
ঘড়িতে প্রায় রাত একটা। বাইরের ঝড় বৃষ্টি ধরে এসেছে। শুধু ঘরের ভেতর দুটি পৃথক মনে তখন প্রচন্ড ঝড়ের তান্ডব চলছে।
একজন আচরণের ঔদ্ধত্যে নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করে নিজের মনের সাথে যুদ্ধরত ।
আর অপরজন প্রথম তার বাইশ বর্ষীয় জীবনে নিজেকে অন্যের জীবনের চিন্তার কারণ ভেবে মনে মনে আনন্দ পায়।
এই প্রথম কারোর বকুনি খেয়েও মনটা এক অদৃশ্য টানে ভরে উঠছে লিসার। এই প্রথম কারোর স্পর্শ পেয়ে তাকে আঁকড়ে ধরতে চাইছে তার মন। এই প্রথম মনে হচ্ছে, ফোনটা ব্যবহারের সময় হয়েছে তার। এই প্রথম মনে হচ্ছে ,কারোর জন্য অস্থিরতা ,কারোর জন্য আবেগ জড়ো হয়ে তার বাঁচার মানেরা অন্য রাস্তা খুঁজে নিচ্ছে।
ঘুম না আসা রাতে মনের ঝড়ে লিসার হৃদয় যখন তোলপাড় করছে, তখন বিছানার চাদরটাকে আঁকড়ে ধরে নিজের অজান্তেই তার মন যেন বারংবার প্রার্থনা করছে – কোনো প্রবল দাপুটে আবেগী হাওয়া এসে ভেঙে দিক প্রতিবেশীর দেওয়াল। আর ভাঙা দেওয়ালের এপ্রান্ত আর ওপ্রান্তের আশ্রয়স্থলের ঠিকানাটা এক হয়ে উঠুক।
সারারাত নিজের মনের সাথে যুদ্ধে ক্লান্ত সৈনিকের মত ভোরবেলা ঝিম ধরে আসে রাজীবের।
সারারাতের নানান প্রশ্নের উত্তরগুলো এখন তার কাছে পরিস্কার।
তাই এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে চিরকালীন দ্বার রক্ষীর মত প্রতিবেশীর দরজার সামনে গিয়ে সে দাঁড়ায়।
ভোরের সদ্য ফোটা ফুলের মত ঘুমন্ত লিসাকে দেখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে সে।
তারপর কিছুক্ষণ পর ফিরে আসে কিছু ফুল কিনে নিয়ে। ফুল বাইরে থেকে কিনে আনা ফুল আর নিজের আঁকা পুরনো একটা ছবি কাগজে মুড়ে একটা সাদা কাগজে কয়েকটা শব্দগুচ্ছ সাজিয়ে আবারও সে প্রতিবেশীর ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। একইরকম ভাবে তখনও ঘুমিয়ে লিসা।
এবার লিসার মাথার কাছে জিনিসগুলো রেখে নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে সে । নিজের ঘরে এসে তৈরি হয়ে লিসার ঘুম ভাঙার আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে রাজীব।
(চলবে….)