মেঘ বৃষ্টি রোদ, পর্ব:৬

0
552

❤#মেঘ_বৃষ্টি_রোদ
#ষষ্ঠ_পর্ব ❤
-‘হ্যাঁ, এতক্ষণে ফোন করার সময় হলো তোর? কতবার মেসেজ করেছি? চেক কর একবার। দেশের মন্ত্রীরাও তো এত ব্যস্ত থাকেনা সবসময়”
ফোনটা ধরেই স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিল মৌলি। ও নিজে অনেকবার এইরকম কাজ করেছে, মানে দরকারের সময় এরকম ফোন না রিসিভ করা, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু অন্য কেউ এটা করলেই মাথা গরম হয়ে যায় ওর। সৌমাভ ওর চিৎকার শুনেও প্রথমে কিছু বলল না, কারণ এখন কথা বাড়ানো মানেই আরো ঝামেলা বেড়ে যাবে। কিন্তু হাতে বিপরীত হল বাস্তবে। অপর পক্ষ থেকে উত্তর না পেয়ে রাগটা আরো এক ধাপ বেড়ে গেল মৌলির। সে গলার আওয়াজটা আরো বাড়িয়ে আবার বলে উঠল,

-‘ কী হল, কথার উত্তর দেওয়া যাচ্ছে না? এর বেলা বোবা হয়ে গেলি? রিলেশনের শুরুতেই এরকম, তাহলে পরে কী করবি বলতো?”

-‘ আরেহ্, কী বলব? কিছু বললেই তো চিৎকার করবি তুই। তাই চুপ করেই আছি।”

-‘ কোনো মেয়ে ছিল তোর সাথে? যার জন্য ফোনটা ধরিসনি? সত্যি বল সৌমাভ”

-‘তোর মাথাটা কি খারাপ হয়ে গেছে? কী বলছিস ভেবে বল, মৌলি প্লিজ। সারাসপ্তাহ কলেজ করে, খেটে ইজ বাড়ি এসেছি একটু, মুড খারাপ করিসনা দয়া করে”

-” আমি মুড খারাপ করে দিই তোর? তাই তো? মানে দু’দিন ঘুরে নিয়ে, আমার প্রয়োজন এখন শেষ?”

-‘মৌলি তুই ফোনটা রাখ এখন, পরে কথা বলব, বাই”

ক্লান্ত গলায় কথাগুলো একনিঃশ্বাসে বলে ফোনটা কেটে, সুইচড অফ করে দিল সৌমাভ। মৌলি তো ইতিমধ্যেই এই সম্পর্কটা নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবনাচিন্তা শুরু করে দিয়েছে। অথচ সৌমাভ এখনো এটাই বুঝে উঠতে পারল না যে এই সম্পর্কে এসে আদৌ ঠিক না ভুল হল ! যদি সত্যি কথা বলতে হয়, তাহলে মন থেকে মৌলির জন্য কোনো আলাদা অনুভূতি সে অনুভব করতে পারেনা। কাউকে ভালোবাসলে, প্রেমে পড়লে আলাদা কী কী অনুভূতি যে আসলে হয়, সে ব্যাপারে কোনো ধারণাই নেই সৌমাভর।

মৌলি তার অনেকদিনের বন্ধু, একসাথে কলেজে পড়া থেকে শুরু করে, একই সাবজেক্টে এম.এস. সি করা, কোনো সমস্যার সমাধান হিসেবে, কথা শেয়ার করা এসব মৌলির সাথে খুব ভালোভাবে যায়, অর্থাৎ দুজন ভালোবন্ধুর মধ্যে যে যে গুণ থাকা আবশ্যক, তা ওদের মধ্যেও আছে। কিন্তু ভালো বন্ধু মানেই যে ভালো জীবনসঙ্গী হয়ে ওঠা যায় এমন ধারণাটা বোধহয় ভুল। মৌলিই নিজে থেকে ভালোবাসার প্রস্তাব নিয়ে আসে সৌমাভর কাছে। তখনই প্রথমে ওকে এসব নিয়ে আর ভাবতে বারণ করে দিয়েছিল সৌমাভ। সেদিন নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকলে হয়তো আজকে এরকম দিন আসতো না। সৌমাভ বারণ করার পরেও মৌলি হাল ছাড়েনি।বন্ধুমহলে সবার কাছে জিজ্ঞাসা করে বেড়িয়েছে যে সৌমাভর কোনো গার্লেফ্রন্ড আছে কিনা এই নিয়ে, তারপর কান্নাকাটি, কখনো কথা না বলার হুমকি, এসব তো আছেই। শেষ অবধি মৌলি ওকে একটা কথা বলেছিল, আর সেই কথার পরেই সৌমাভ এই সম্পর্কে আসার চেষ্টা করে চলেছে একটু একটু করে। মৌলি বলেছিল,

-” দেখ, সৌমাভ…জীবনে কাউকে না কাউকে বিয়ে তো তুই করবিই। মানে তুই রাজি না থাকলেও বাড়ি থেকে চাপ দেবেই। আর তুই মেয়েদের সাথে যেভাবে কথাবার্তাও বলিসনা, ইনফ্যাক্ট তোর ক্লোজ কোনো মেয়েবন্ধুই নেই আমি ছাড়া। তারমানে তুই সেই বিয়ে করবি অচেনা একটা মেয়েকে, সেটা কি তুই মানিয়ে নিতে পারবি? তার থেকে ভালো একবার চেষ্টা করেই দেখনা! আমি কি এতটাই খারাপ? যেখানে একটা অচেনা মেয়েকে ভবিষ্যতে সারাজীবনের মতো নিজের জীবনে জায়গা করে নিতে দিবি, সেখানে সেই দায়িত্বটা যদি আমি নিজেই নিই, তাহলে ব্যাপারটা কি খুব খারাপ হবে?? ভেবে বল তো??”

মৌলির এই কথাটাই তখন ভীষণ সঠিক বলে মনে হয়েছিল সৌমাভর। সে খুব ভালো করেই জানে ইচ্ছে না থাকলেও, ছোটোমা তার বিয়ে না দিয়ে ছাড়বেনা। মা চলে যাওয়ার পরে, এই ছোটোমা-ই তার জীবনের সমস্ত সিদ্ধান্ত নেয়। বাবা নিজের মতো নিজে থাকে, এসব সাংসারিক ব্যাপারে নাক গলান না। সেখানে অন্য কেউ স্ত্রী হয়ে আসার থেকে যদি মৌলিই আসে, হয়তো সেটাই ভালো হবে। কিন্তু এখন এই মুহূর্তে সৌমাভর মনে হচ্ছে পুরো ভাবনাটাই ভুল ছিল। মৌলির এই কথায় কথায় সন্দেহ, এত অভিযোগ, অভিমান,এত ব্যক্তিগত প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে পড়ছে সৌমাভ। সম্পর্কে জড়িয়ে নিজের জীবনে নিজের মতো করে নিঃশ্বাস টুকুও নিতে পারছেনা সে। অথচ এই কথাগুলো কখনো বুঝতেই চায়না মৌলি, এসব বললে উল্টে আরো রাগ দেখায়।
মাথায় হাত রেখে সোফায় বসে শরীরটা এলিয়ে দিল সৌমাভ, এখন তার একটু বিশ্রামের প্রয়োজন…. শারীরিক এবং মানসিক দুটোরই….

*************
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বাজতে যায়। সৌমিকের এখনো ফেরার নাম নেই, কে একটা বন্ধু ডাকছে বলে বেরোলো, বলল নাকি গুরুতর দরকার, কারো কোনো অ্যাকসিডেন্ট বা এরকম কিছু হয়েছে বোধহয় সেই ব্যাপারে। এরকম অবস্থায় কিছু বলার যায়না। অথচ এদিকে তৃণার দেরীও হয়ে যাচ্ছে। সৌমিকদের বাড়িটা এমনই দিকে, যে ডাইরেক্ট বাস, অটো কিছু তোমাদের ওদিকে যাবেনা। ভেঙে ভেঙে যেতে হবে। আর নিজে থেকে কখনো এই রাস্তায় আসেওনি তৃণা, তাই সাহস করে বেরিয়ে ও পড়তে পারছেনা। অনেকক্ষণ এভাবে অপেক্ষা করে বসে থাকার পর সৌমিকের মা, সর্বাণী দেবী নিজে থেকেই বললেন,

-” দাঁড়াও আমি সৌমাভকে বলছি, তোমাকে একটু বাড়ি অবধি দিয়ে আসতে, আর চিন্তা করতে হবেনা।কেমন?”

-” না না কাকিমা, ওনাকে বলতে হবেনা। একটু পরে তো সৌমিক চলেই আসবে, তখনই না হয় যাব”
তৃণা আঁতকে ওঠে, ওনার কথা শুনে। কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে সর্বাণীদেবী বললেন,

-“আরে ও তো এখানে আর তোমার স্যার নয়। কোনো ভয় নেই, আমি বলে দিচ্ছি ও না করতেই পারবেনা”

-‘আচ্ছা কিন্তু, আপনি বলে দেবেন, পরে আমাকে রাস্তায় একা পেয়ে যেন বকাবকি না করেন তাহলে ”

-‘আরেহ্ বাবা না, কিছু ভেবো না’
এই বলে কথাটা বলার জন্য, সৌমাভর ঘরের দিকে রওনা দিলেন সর্বাণী দেবী। আর এদিকে তৃণা মনে মনে একটু খুশিও হল, আবার একটা ভয়-আতঙ্কও তাকে ঘিরে ধরল ধীরে ধীরে…..

-” বাড়ির অ্যাড্রেস টা বলো আরেকবার”

-” হ্যাঁ??”

-” বললাম বাড়ির ঠিকানা বলো, কানে কি শুনতে পাওনা?”

-” ওহ হ্যাঁ বলছি।”
এমনিতেই বাইকে ওঠার পর থেকে ভয়ে ভয়ে ছিল তৃণা, এখন আবার সৌমাভর বিরক্তিপূর্ণ গলা শুনে সেই ভয়টা আরো একটু যেন বেড়ে গেল। ওর বারবার মনে হতে লাগল, যে এত সন্ধ্যাবেলায় ওকে বাড়ি ছাড়তে যেতে হচ্ছে বলেই এত বিরক্তি সৌমাভর। আসল কারণটা তবে একেবারেই তা নয়। বরং বাড়িতে বদ্ধভাবে বসে না থেকে, একটু বাইরের হাওয়া গায়ে লাগতে মনটা বেশ ফুরফুরেই লাগছিল সৌমাভর। সন্ধ্যার দিকে এভাবে শহরের রাস্তায় গাড়ি গুলো বেশ সুন্দর লাগছিল দেখতে। বাইকের স্পিডটা হালকা বাড়াতে বাড়াতে লুকিং মিররে একবার তৃণার মুখটা দেখে নিল সৌমাভ। মাথার থেকে বড়ো সাইজের একটা হেলমেট পরে থাকায় মুখের অর্ধেক অংশই ঢেকে গেছে। তবু অল্প ফাঁকা অংশ দিয়ে চোখ দুটো দেখা যাচ্ছিল। সৌমাভর হঠাৎ করেই কেন না জানি এই ব্যাপারটা গমখূব ভালো লাগতে লাগল। গাড়ি চালানোর ফাঁকে মাঝে মাঝেই, সে এভাবে আড়াল থেকে তৃণার দিকে তাকাতে লাগল। মেয়েটা একভাবে তখন থেকে চুপ করে রয়েছে। বোধহয় ভয়ে। মনে মনে একটু হেসে নিল সৌমাভ।

কিছুটা রাস্তা যাওয়ার পরেই, হঠাৎ ওরা বুঝতে পারল আকাশ থেকে জলের বড়ো বড়ো ফোঁটা পড়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে, যে প্রচন্ড গরম থেকে মুক্তির সময় হয়ে এসেছে এবার। চলমান বাইকে জলের ফোঁটা সোজাসুজি মুখের কাছে এসে পড়ছে। বাধ্য হয়ে একটা ছায়া এলাকা দেখে বাইকটা থামাল সৌমাভ। তৃণা তো ভাবতেই পারছেনা এমন সময়ে এরকম হঠাৎ বৃষ্টি আসার কথা। কত দিনের স্বপ্ন ছিল এরকম একটা দিনের, সেটা যে এভাবে পূরণ হবে তা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। এদিকে বাইক থামানোর পরেও, তৃণা না নেমে চুপ করে বসে আছে দেখে সৌমাভ ঘাড়টা ঘুরিয়ে ওকে বলল,

-‘ কী হল, নামবে না? নাকি বসেই থাকবে?”

-‘ওহ হুম, নামছি ।”

নামার জন্য সেরকম কোনো ধরার জায়গা পেয়ে, আচমকাই অজান্তে সৌমাভর কাঁধে হাতটা রেখে দেয় তৃণা। পরমুহূর্তেই অবশ্য হাতটা সরিয়ে নেয় সে। এদিকে আবার মাথা থেকে বেঢপ আকারের হেলমেটটা বহু চেষ্টা করেও খুলতে পারেনা তৃণা। এমন পরিস্থিতিতে পড়ে গেল সে, কিছু বলতেও পারছেনা, কিছু করতেও পারছেনা। সৌমাভ না দেখলেও ব্যাপারটা খানিক বুঝতে পারছিল। শেষ অবধি থাকতে না পেরে, বাইকের স্ট্যান্ডটা ফেলে নিজেই আগে নামল সৌমাভ। জামার হাতাটা কনুই অবধি গুটিয়ে, তৃণার সামনে সে এবার একটু জোর গলায় বলল,

-“এই দাঁড়াও। চুপ করে বসো, একদম নড়াচড়া করবেনা।”

-” উমমম, খুলতে পারছিনা, স্ট্র্যাপটা। হেল্প”

অনবরত চেষ্টা করতে করতেই কথাটা বলল তৃণা। সৌমাভ আর কোনো কথা না বলে, আরেকটু এগিয়ে গেল তৃণার দিকে। তারপর নীচু হয়ে, আস্তে করে হেলমেটটা ধরে, স্ট্র্যাপটা টেনে খুলে দিল সে। চুলের সাথে আর জামার হুকের সাথে আটকে গিয়েছিল সেটা। হেলমেটটা খোলার সঙ্গে সঙ্গে, তৃণার এলোমেলো চুলগুলো ওর মুখের কাছে এসে পড়ল। বৃষ্টির জলের ভিজেভাবের জন্য, মুখের সাথে সেগুলো লেপ্টে রয়েই গেল। হঠাৎ করে এই দৃশ্য দেখে, সৌমাভ যেন কীরকম একটা হকচকিয়ে গেল। কোনো কথাই বলতে পারলনা প্রথমে । তৃণার অবিন্যস্ত মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল সে।

-” কী দেখছেন ?”

-” হ্যাঁ! কই কিছু না। চুল গুলো ঠিক করে নাও, ঘেঁটে গেছে। আর বাড়িতেও পারলে জানিয়ে দাও, যে যেতে একটু দেরী হবে।”

-” হ্যাঁ দিচ্ছি।”

ক্লিপ দিয়ে চুলটা ভালো করে বেঁধে, ফোনটা ব্যাগ থেকে বের করল তৃণা। তারপর ফোনটা কানে দিয়ে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে। সৌমাভ কিছুদূর হেঁটে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। মনে হঠাৎ করেই একটা ভীষণ আনন্দ হচ্ছে তার। এই আনন্দের উৎস কী তা সে জানেনা। সৌমাভ লক্ষ্য করেছে, এই মেয়েটার সাথে থাকলেই একটা অদ্ভুত ভালোলাগা ছেয়ে থাকে মনের মধ্যে। মোটকথা একটু আগের সেই কষ্টটা আর একদমই নেই….কোনো এক মন্ত্রবলে যেন সেটা উধাও হয়ে গেছে। বৃষ্টির জলের দিকে আনমনে তাকাতে তাকাতে, আড়চোখে একবার দূরে দাঁড়িয়ে থাকা তৃণার দিকেও দেখেও নিল সৌমাভ। এই প্রথমবারের জন্য মেয়েটাকে একদম অচেনা লাগছে তার, কিন্তু কেন?
(ক্রমশ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here