মেঘ বৃষ্টি রোদ, পর্ব:৫

0
556

❤#মেঘ_বৃষ্টি_রোদ
#পঞ্চম_পর্ব❤
প্রায় এক সপ্তাহ কেটে গেছে। ভয়ে ভয়ে পুরো সপ্তাহটা কাটিয়ে দিলেও, তৃণা দেখল না শাস্তি দেওয়া তো দূর, সৌমাভ এখন ক্লাসে ঘুমোলেও তাকে আর কিছু বলেনা। অন্যদের বলে খুব স্বাভাবিকভাবেই, মানে তৃণা বোস বলে যে কেউ ক্লাসে পড়ে, সেটাই বোধহয় উনি ভুলে গেছেন। একদিক থেকে ভালো হলেও, এই ব্যাপারটা খুব একটা সুবিধার লাগছেনা তার। এই নিয়ে পর্ণার সাথেও কথা হচ্ছিল কালকে। পর্ণাও তেমনি, কোনো ভালো কথা তো বলেনা কখনো, সবসময় ওর মুখে উল্টোপাল্টা কথা লেগেই আছে। বলে কিনা,

-‘ দেখ, তোকে হয়তো সৌমাভর পছন্দ হয়ে গেছে, তাই আর কিছু বলেনা।”

আর পর্ণার এই মজা করে বলা কথাটা শোনার পর থেকেই, তৃণার মনে অদ্ভুত কয়েকটা ভাবনা উঁকি মারছে। ওর বার বার সৌমাভর কথাই ঘুরেফিরে মনে চলে আসছে। সেই প্রথম দিনে ক্লাসে আসা, একের পর এক ঝামেলায় জড়িয়ে যাওয়া, ক্লাসে বকাঝকা করা, ইত্যাদি ইত্যাদি। কতই বা হবে বয়সের পার্থক্য? বড়জোর ছয় সাত বছর হবে, ওটা কোনো ব্যাপারই না। ধীরে ধীরে ক্লাসে বাকি সবার মত সৌমাভর প্রতি একটা ভালোলাগা যেন তৃণার মনটাকেও ছেয়ে ফেলছে। কিন্তু সমস্যা হল, সৌমাভ তো আর কোনোভাবে পাত্তা দেয়না তৃণাকে, কথাও বলেনা। তৃণা অনেক চেষ্টা করেছে, ইচ্ছে করে ক্লাসে ঘুমিয়ে পড়ে, কথা বলে, বিভিন্ন রকম ভাবে, কিন্তু ঐ…. এমন ভাবে এড়িয়ে চলছে সৌমাভ তাকে যে কোনো সমাধানই মাথায় আসছেনা।

হঠাৎ ফোনের ভাইব্রেটের শব্দে চমকে উঠল তৃণা। সৌমিক ফোন করছে। উফ এই এক জ্বালা, দাদার কথা ভাবতে বসলেই ভাই ফোন করে, ভাই এর বলতে গেলে দাদা চলে আসে। সেদিন সৌমাভর কাছে বকা খাওয়ার পরে, কিছুদিন সৌমিককে এড়িয়েই চলছিল, তৃণা। কিন্তু ছেলেটা এমন পাগল, যে বেশিদিন এড়িয়েই থাকা যায়না। কথা বলে বলে মাথা পাগল করে দেয়। তবে অল্প বিরক্তি লাগলেও, এই জিনিসটা একদিক থেকে ভালো লাগে তৃণার। বাড়িতে সে পুরোপুরিই একা, বাবা মা নিজেদের মত ব্যস্ত যে যার কাজে। কথা বলার মানুষ বলতে একজনই ছিল, সেটা হল পর্ণা। কিন্তু একজন ছেলেবন্ধু হিসেবে এই প্রথম সৌমিকের সাথেই এত বেশি কথা বলে সে। ওদের একটাই মিল, সেটা হল তৃণার বিভিন্ন দুষ্টুমি বুদ্ধি, প্ল্যানগুলোর ভালো একজন বুঝদার সঙ্গী হল সৌমিক। তৃণার যেসব কথাকে কেউ পাত্তা দেয়না, হেসে উড়িয়ে দেয়, সেই পাগলামির কথাগুলোকে ও গুরুত্ব দেয় সৌমিক। দুজনের বয়সের পার্থক্যটা অনেকটাই কম হওয়ায়, এই অল্প দিনে বন্ধুত্বটা যে কীভাবে গড়ে উঠেছে তা ওরা কেউই জানেনা।
ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বেশ উৎসাহ পূর্ণ গলায় বলে উঠল সৌমিক,

-‘হ্যালো হ্যালো, তৃণা”

-‘হুমম বলো। এত লাফাচ্ছ কেন? কী হয়েছে?”

-” আরেহ্, বাড়িতে বিরিয়ানি হবে আজকে সেই আনন্দে চিৎকার করছি। বলো তুমি কী করছ?”

এই হল সৌমিক। এমনভাবে একটা কথা শুরু করবে যে মানুষের মনে হবে কী না কী, তারপর জানতে পারবে বাড়িতে বিরিয়ানি হচ্ছে। একটুও সিরিয়াসলি কোনো কথা বলতে পারেনা। তৃণা ঈষৎ বিরক্তি দেখিয়ে বলল,

-‘আমি তাতে কী করব? নাচ করব? তোমার বাড়ির বিরিয়ানি আমাকে কি দিয়ে যাবে?”

– ” চলে আসো, এসে খেয়ে যাও, নো প্রবলেম। মাকে তোমার কথা বলার পর, মা অনেকবার আসতে বলেছে তোমাকে। আর তার মধ্যে আজকে আরো একজন আসবে, তুমি আসলে ব্যাপারটা জমে যাবে পুরো।”

-‘কে আসবে? আর আমি হঠাৎ করে কেন খেতে যাব তোমাদের বাড়ি? আগে থাকতে তো বলোনি। আমি বললাম বলে বললে”

-‘আরেহ্ ভুল বুঝছ। আমি ফোন করলাম তোমাকে সেই কারণেই, আমি নিজে থেকেই বলতাম। তুমি তো তার আগেই বলে দিলে। এখন পাঁচটা বাজে, যদি আসতে চাও বলো, আমি গাড়ি নিয়ে আসছি”

-‘কে আসছে সেটা বললে না তো?’

-‘সেটা এলেই দেখতে পাবে, ওকে,রেডি থাকো। আমি আধঘন্টার মধ্যে আসছি”

***************

সৌমিকদের বাড়িটা দেখে সেই প্রথমদিনেই ভীষণ পছন্দ হয়ে গিয়েছিল তৃণার। এরকম বড়ো, একান্নবর্তী পরিবার তার বরাবরের ভালোলাগার তালিকায়। মা-বাবার সাথে কাকা, কাকিমা, জ্যেঠু, ভাই বোন দিদি…. প্রত্যেকের এই একসাথে থাকাটা যেন একটা জন্মপ্রদত্ত উপহারের মতো। বাড়ি বসে বসে এমনিতেই ভালো লাগছিল না, সেই কারণেই সৌমিক একবার বলতেই ওদের বাড়িতে আসতে রাজি হয়ে গিয়েছিল তৃণা। প্রথম প্রথম বাড়িতে ঢুকে একটু লজ্জা লাগছিল বটে, তবে এখন বাড়ির সবার সাথে কথা বলতে বলতে সেই জড়তাটা কেটে গেছে ধীরে ধীরে। এ বাড়ির প্রত্যেকেই বেশ মিশুকে, ভীষণ ভালো ব্যবহার সবার। তৃণার মনে হতে লাগল যেন কত দিনের চেনা ওরা একে অপরের। বারান্দার কাছে দাঁড়িয়ে ফুলগাছ গুলোর দিকে একভাবে তাকিয়ে ছিল তৃণা, তার বারবার মনে হচ্ছে আজকে এই বাড়িতে আবার স্যার, মানে সৌমাভ আসবে নাতো? ওনার কথাই হয়তো বলছিল সৌমিক। ভাবতে ভাবতেই ঠোঁটের কোণে অজান্তে একটা মুচকি হাসি চলে এল তৃণার….। হঠাৎ করে কী যে হল তার!

-‘এখানে একা একা দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
সৌমিকের ডাকে পিছনে ফিরে তাকালো তৃণা। দেখল হাতে একটা কোল্ড ড্রিংকস এর বোতল নিয়ে এসেছে হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে সৌমিক। তৃণাও তাড়াতাড়ি আনমনা ভাবটা কাটিয়ে বলে উঠল,

-‘না না এমনি দাঁড়িয়ে আছি। ফুল গুলো দেখছিলাম, কি সুন্দর দেখতে।…

-‘এগুলো কে লাগিয়েছে বলোতো?”

-‘কে ? তোমার মা?”

-‘উঁহু… দাদাভাই, মানে তোমার ভীষণ অপছন্দের সেই স্যার। আর যার ঘরের সামনে তুমি দাঁড়িয়ে আছো, ওটাও দাদাভাই এর ঘর, ও আসবে আজকে, ঐ জন্যই এত আয়োজন, তোমাকে ওর কথাই বলছিলাম। বলো এবার রেগে গেলে তো??”

সৌমিক হাসতে হাসতে বলে উঠল কথাটা। ও ভেবেছিল কথাটা শুনে তৃণা প্রচন্ড রেগে যাবে। আবার আগের মত কথা বলা বন্ধ করে দেবে ওর সাথে। কিন্তু বাস্তবে তার কোনোটাই হলনা। সৌমিক দেখল, কথাটা বলার সাথে সাথে যেন একটু চমকে উঠল তৃণা। অবাক হয়ে সে আবার বলল,

-‘কী ব্যাপার? অন্যমনস্ক আছো নাকি কোনো কিছু নিয়ে?”

-‘না না তেমন কিছু নয়, চলো ভেতরের যাই, ওখানে সবাই আছে, এভাবে আলাদা দাঁড়িয়ে কথা বলাটা ভালো দেখায় না”

এই বলে সৌমিককে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে, হনহন করে হেঁটে ভেতরের ঘরের দিকে চলে গেল তৃণা। সৌমিক বুঝতে পারল কিছু একটা এড়িয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। কিন্তু সেটা কী? যাই হোক, নিশ্চয় ব্যক্তিগত কিছুই হবে, যেটা তাকে বলা যাবেনা বলেই বলছেনা, এই নিয়ে আর জোর না করাই ভালো। ওর কথা শুনে তৃণা আজ যে এখানে এসেছে, এতেই খুশি সে, আর বেশী কিছু চাওয়ার নেই। মেয়েটার সাথে কথা বললে একটা অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করা শুরু করে মনের মধ্যে। এমন এমন কান্ড করে বসে, কথা বলে, যে মন খারাপ থাকলেও ভালো হয়ে যেতে বাধ্য। তৃণার দেখার পর, সেই প্রথম দিনের মুগ্ধতায় এখনো আটকে রয়েছে সৌমিক। ও যা বলে, সবটুকুতে রাজি হয়ে যেতে ইচ্ছে করে তার, তৃণা মাঝে মধ্যেই রাগ করে ভীষণ ছোটো ছোটো কথায়….সেগুলো কমাতেও যথেষ্ট বেগ পেতে হয়, তবু সেই কষ্টগুলো বেশ উপভোগই করে সৌমিক। এতদিনের স্রোতহীন জীবনে, এরকম কিছু ঘটনা যেন আবার নতুন করে ছন্দ বয়ে আনে। এই সম্পর্কের পরিণতি যাই হোক না কেন, এই বন্ধুত্বটুকু একদমই নষ্ট করতে চায়না সে, একেবারেই না।

*************
সাড়ে ছটা বাজে। দরজায় বেলটা বাজতেই আবার খানিকটা চমকে উঠল তৃণা। বুকটা একটা অজানা ভয়ে যেন ধুকপুক করতে লাগল। এই প্রথম বোধহয় কলেজের বাইরে, এরকম ঘরোয়া ভাবে সৌমাভর সাথে দেখা হতে চলেছে। সৌমিকের মা গিয়ে দরজাটা খুলে দিলেন। আর তার কিছুক্ষণের মধ্যেই, দরজা দিয়ে সৌমাভ ভেতরে ঢুকল। একটা হালকা হলুদ রঙের টি শার্ট আর জিন্সে ওর বয়সটা যেন আরো এক ধাপ কম লাগছে। তৃণা একটু নড়েচড়ে বসল সোফায়। ঘরে ঢুকেই সামনে হঠাৎ এভাবে তৃণাকে দেখে সৌমাভ নিজেও খানিকটা অবাক হয়ে গেল। কোনো কথা না, হাতের ব্যাগটা টেবিলে রেখে, নিজের ঘরের দিকে চলে গেল সে।

-” তুমি এখানে?”
ঘরের সামনের বারান্দার কাছে আচমকা এভাবে তৃণাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু ভয়ই পেয়ে গিয়েছিল সৌমাভ প্রথমে। এই মেয়েটা নিশ্চয় সৌমিকের সাথে এসেছে, আজ এতদিন পর বাড়ি ফিরল সে, আর আজকেই আসতে হল একে।

-” হ্যাঁ আমি, কেন কোনো অসুবিধা আছে? এখানে আপনি আমার স্যার নন, ওকে? ”
আসলে তৃণা জেনে বুঝেই এই জায়গাটায় এসে দাঁড়িয়েছে। যাতে কোনো না কোনো ভাবে কথা শুরু যায় সৌমাভর সাথে। সে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক সুরে কথা বলার চেষ্টা করল। সৌমাভ অবশ্য তৃণার এই কথাটায় তেমন গুরুত্ব দিলনা। সে আগের মতই গম্ভীর গলায় বলল,

-‘সেটা আমি জানি। আর দেখছ দেখো, ঠিক আছে।কিন্তু গাছে হাত দেবেনা, মনে থাকবে?”

-” হুমম।…..আচ্ছা একটা কথা বলব আপনাকে?”

-” কী কথা??”

-” আপনি কি এখনো ঐ ব্যাপারটা নিয়ে রাগ করে আছেন আমার উপর? মানে আমাকে কীরকম একটা এড়িয়ে চলেন দেখি, তাই বললাম আরকি….”

-” তৃণা, এটা আমার বাড়ি, পার্সোনাল স্পেস, এখানে আমি তোমার স্যার নই, রাইট? তাই এই নিয়ে কোনো কথাও হবেনা। আর রাগ আমরা কাছের মানুষের উপরে করি, সবার উপরে না। বুঝেছ?”

এতটা কঠিন উত্তর আশা করেনি তৃণা। এই প্রথম নিজের ইগো, জেদ সরিয়ে সে নিজে থেকে কথা বলতে এল কারো সাথে। আর সৌমাভ কিনা এরকম ব্যবহার করল? কথাটা যে একটু বেশিই রূঢ় হয়ে গেছে সেটা সৌমাভ নিজেও বুঝতে পারল। তাই এবার একটু নরম সুরে সে আবার বলল,

-‘দেখ তৃণা, একজন স্টুডেন্ট হিসেবে যতদিন না ক্লাসে বাধ্যহবে, ততদিন আমার তরফ থেকে এরকমই ব্যবহার পাবে। তুমি নিজেকে ঠিক করো, আমিও স্বাভাবিক ব্যবহারই করব, নিজের ভুলটা বুঝতে পারলে সেটাই অনেক। বুঝতে পেরেছ কী বললাম?”

-‘হুমম বুঝেছি”

-‘ভেরি গুড। তুমি এখানে সৌমিকের সাথে এসেছ তো?

-‘হ্যাঁ, কিন্তু আমি জানতাম না যে আপনি আসবেন”

-‘জানলে কি আসতে না?”

-” না”
একটু রাগ দেখিয়ে কথাটা বলে ওখান থেকে চলে এল তৃণা। এত বেশি ধৈর্য্য নেই তার। এমনিতেই একটুতেই মাথা গরম হয়ে যায় তার, মা বাবাও কখনো এত খারাপ করে কথা বলেনি তার সাথে, আর এ কোথাকার কে, এতগুলো কথা শুনিয়ে দিল? নিকুচি করেছে ওসব ভালোলাগা- লাগির। এত অহংকারী মানুষ তার একদম পছন্দ না। এর থেকে এর ভাই সৌমিক অনেক ভালো ছেলে, কী করে ভাই আর দাদার এত ব্যবহারের পার্থক্য হয় তা কে জানে!
তৃণার ওরকম রেগে চলে যাওয়ার ধরন দেখে মনে মনে, একটু মুচকি হাসল সৌমাভ। এই মেয়েটাকে বিরক্ত লাগলেও, কিছু কিছু কথাবার্তা,ব্যবহার এমন করে যে না হেসে থাকাও যায়না। যতটা খারাপ প্রথমে মনে হত, এখন ততটাও খারাপ মনে হয়না তৃণাকে। দেখতে এরকম হলেও ওর মনটা যে ভালো সেটা কথা বললেই বোঝা যায়। এসব ভাবতে ভাবতেই সৌমাভ দেখল, টেবিলের উপরে রাখা ফোনের স্ক্রিনে আলো জ্বলছে। কাছে গিয়ে সে দেখল, মৌলি ফোন করছে। এর আগেও অনেক গুলো মেসেজ এসেছে মৌলির, তারমানে কোনো গুরুতর দরকারই হবে বোধহয়। ফোনটা হাতে নিয়ে, কল ব্যাক করল সৌমাভ, উল্টোপ্রান্তে তখন রিং হয়েই চলেছে অনবরত……
(ক্রমশ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here