❤#মেঘ_বৃষ্টি_রোদ
#চতুর্দশ_পর্ব❤
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পরে, সৌমিক উত্তর দিল,
-” হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি, বলো’
-” তাহলে,কিছু কথা বলছ না যে? আমি এতগুলো কথা তখন থেকে বলে যাচ্ছি।”
-“সরি, একটু আউট অফ মাইন্ড হয়ে গিয়েছিলাম। আসলে এই তৃণার ব্যাপারটা নিয়ে এতটাই ভেবে ফেলছি, যে মাথা ঘেঁটে যাচ্ছে। আমার কেন জানিনা মনে হচ্ছে ওর জীবনে কেউ রয়েছে। কিন্তু তুমি ওর,প্রিয়বন্ধু, তুমি যখন বলছ নেই, তাহলে সেটাই সঠিক হবে।”
সৌমিকের কথাটা শুনে পর্ণাও একটু চিন্তায় পড়ে গেল। এই কথাটা যে ওর মাথাতেও আসেনি যে তা নয়, কিন্তু তৃণা তো নিজেই বলল এরকম কিছু ব্যাপার নেই। অথচ আজকাল ওর হাবভাব, চালচলন দেখে স্পষ্টই যেন বোঝা যায়, যে কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে। পর্ণার মনে হল ব্যাপারটা তৃণার একার উপরে ছেড়ে না দিয়ে, তারও দেখা উচিত খোঁজখবর নেওয়া। বলা তো যায়না, কোনো বিপদ-আপদও তো হতে পারে। হয়তো তৃণা কিছু কারণের জন্য তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে, বলতে চাইছে না। তবে বন্ধু হিসেবে তার তো পাশে থাকা অবশ্যই উচিত সবসময়।
-” হ্যালো, পর্ণা। তুমি কোথায় গেলে আবার?”
এতকিছু ভাবতে ভাবতে পর্ণা ভুলেই গিয়েছিল, যে ফোনের ওপাশে সৌমিক রয়েছে এখনো। তাড়াতাড়ি করে সে বলল,
-” হ্যাঁ, শুনছি বলো। আসলে আমিও তোমার বলা কথাটাই ভাবছিলাম, মানে তৃণার ব্যাপারটা। ও আমাকে সবটা না বললেও, আমারও মনে হচ্ছে, যে ওর কারোর প্রেমে পড়েছে, নিশ্চয় পড়েছে। কিন্তু সেটা খুঁজে বের করব কীভাবে, বুঝতে পারছিনা”
-” আমি যদি তোমাকে সাহায্য করি? মানে, আমরা একসঙ্গে মিলে খুঁজে বের করার চেষ্টা করব, যে তৃণার সাথে আসলেই কার সম্পর্ক শুরু হয়েছে। এটা কেমন আইডিয়া?”
-” হুমমম আইডিয়া তো ভালোই, কিন্তু তোমার খারাপ লাগবে না যদি, জানতে পারো, তৃণা অন্য কাউকে ভালোবাসে?”
পর্ণার কথাটার শুনে একটু থেমে থেমে সৌমিক বলল,
-‘খারাপ একেবারেই লাগবেনা তা নয়, তবে কেন জানিনা হঠাৎ করেই, আমার ব্যাপারটা ভাবলে আর তেমন মনখারাপ হচ্ছেনা। কী যে হচ্ছে মনের ভিতরে মনই জানে”
-” তুমি নিজের মনটাকে শান্ত করো, নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করো, দেখো কী উত্তর পাও।”
-‘হ্যাঁ কী করব, সত্যি বুঝতে পারছিনা। যাই হোক, তাহলে তৃণার ব্যাপারে খোঁজখবরটা তাহলে কাল থেকেই শুরু করা যাক?? আমি শুধু ভাবছি, কে সেই ভাগ্যবান, যাকে তৃণা এত সহজেই পছন্দ করে ফেলল, একটু টিপস নিতে হবে তার কাছ থেকে”
ঠাট্টার মেজাজে, কথাটা বলতে বলতে হেসে উঠল সৌমিক। ওদিক থেকে পর্ণা হেসে উঠলেও,মনের খুব গভীরে একটা সূক্ষ্ম কষ্ট রয়েই গেল। মুখে স্পষ্ট ভাবে স্বীকার না করলেও, তৃণার ব্যাপারে সৌমিক যে এখনো ওর প্রতি দুর্বল, তা কথাবার্তা শুনলেই বোঝা যায়। সৌমিক আবার মজার ছলে বলে উঠল,
-‘পর্ণা, তোমার সেই পছন্দের মানুষটার কথাও কিন্তু আমাকে বলতে হবে এবারে, এখন আমরা যথেষ্ট ভালো বন্ধু হয়ে গেছি। সুতরাং তুমি কাকে মনে মনে পছন্দ করো, সেই খবরও আমার চাই, বুঝলে,?’
-” হুমমম বলব খন একদিন। তবে আমি যাকে পছন্দ করি, তাকে হিংসে করে বুঝি তোমার কখনো বলতে ইচ্ছে হবেনা? যে সে ভাগ্যবান, কারণ আমি তাকে পছন্দ করেছি? হুমম? ”
-” মা-মানে??”
সৌমিক হাসতে হাসতেও একটু থমকে যায়। পর্ণার বলা কথাটার অন্তর্নিহিত মানেটা বুঝতে খানিক টা সময় লেগে গেল ওর। পর্ণা অবশ্য খুব বেশি সময় দিলনা ওকে বোঝার জন্য, হাসথে হাসতে সেও এবার মজার ছলে বলে উঠল,
-” আরেহ্! মজা করছিলাম। বাদ দাও ওসব। তারপর বলো, তৃণাকে নিয়ে আর কী কী মনের ভেতরকার দোলাচল আছে তোমার?”
-” না না, বাপরে! তুমি তো পুরো মনোবিদ হয়ে যাচ্ছো ধীরে ধীরে। না মানে, সিরিয়াসলি তোমার সাথে কথা বলে এখন মনটা অনেক হালকা লাগছে। আসলে এই ব্যাপারটা নিয়ে বন্ধুবান্ধব কারোর সাথেই কথা বলতে পারিনা তো, তাই আর কি”
-” কী? আমি মনোবিদ? সত্যি?? হাঃ হাঃ হাঃ”
-‘সত্যি বলছি, ইয়ার্কি নয়।”
-” আচ্ছা? তাহলে তুমি কী?”
-” আমি? আমি ঐ হবো কিছু একটা, তবে পর্ণা, সত্যি তোমার মত মনের উপর এত প্রভাবশালী নই”
-” হিঃ হিঃ হিঃ হিঃ হিঃ, সৌমিক, তুমি দেখছি পুরো পাগল, উফফফ”
…….. এভাবে নানান কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে কখন যে অল্প কিছুক্ষণের কথোপকথনটা প্রায় ঘন্টাখানেক সময়ের সীমা পার করে ফেলেছে, তা ওরা কেউই টের পেল না। যত দিন গড়িয়ে চলেছে , সময় এগিয়ে চলেছে ততই সৌমিক আর পর্ণা যে নিজের অজান্তেই একে অপরের সাথে খুব সূক্ষ্মভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে, তা আশেপাশের কেউ বুঝতে পারলনা, এমনকি ওরা নিজেরাও না……
***************
ধীরে ধীরে কেটে গেছে বেশ কয়েকটা দিন। আজকের সকালটা বেশ সুন্দর। রোদ ঝলমলে, মিষ্টি, সতেজ একটা সকাল। এরকম ভাবে কোনো দিনের শুরুটা হলে, বাকি সময়টুকু একটা অদ্ভুত ভালোলাগায় মোড়া থাকে। কলেজের ক্লাসরুমের বাইরে করিডোরের কোণের দিকে দাঁড়িয়ে, তৃণা আনমনে বাইরে তাকিয়ে আছে। পর্ণাকে সৌমাভর ব্যাপারে সবকিছু খুলে না বলা পর্যন্ত ওর মনে শান্তি হচ্ছেনা। এবার ওকে সবটা বলতেই হবে, কারণ এরপরে যদি অন্যকারো থেকে জানতে পারে এসব, তাহলে ভীষণ রাগ করবে, অভিমান করবে। তবে এই মুহূর্তে তৃণার মাথায় আরো একটা দুষ্টুবুদ্ধি ঘোরাফেরা করছে। এটা নিয়ে পর্ণাকে একটা সারপ্রাইজ দিলে কেমন হয়? সৌমাভর সাথে সম্পর্কের কথাটা শুনে, পর্ণা যে বিস্ময়ে ভালো মত একটা ধাক্কা খাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
সারপ্রাইজটা ঠিক কবে, কীভাবে দেওয়া যায়, তা নিয়েই ভাবনা চিন্তা করতে লাগল তৃণা । কিন্তু হঠাৎই পাশ থেকে একটা গম্ভীর কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে ঘুরে তাকালো ও। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা, কালোশার্ট পরা, দীর্ঘকায় চেহারার মানুষটা কে দেখার সাথে সাথেই মনের ভেতরে এতক্ষণের চাপা মেঘটা যেন হঠাৎ করেই উবে গেল তৃণার। বড়ো বড়ো চোখের পলক মেলে ও তাকিয়ে রইল সৌমাভর দিকে। সৌমাভ বোধহয় অন্য ক্লাসের দিকে যাচ্ছিল, তবে সেসব ক্লাসে যাওয়ার জন্য আরো অনেক রাস্তা আছে। এখন ও ইচ্ছে করেই, তৃণার জন্য এই রাস্তা বেছে নিয়েছে কিনা তা বোঝা গেলনা, কারণ মনের রাস্তা বড়োই জটিল। কোন মুহূর্তে কার মনের ভিতরে কী যে চলছে, তা বোঝা দায়! সৌমাভ তৃণার দিকে তাকিয়ে, একটু যেন বেশিই গম্ভীর গলায় বলল,
-” এখানে দাঁড়িয়ে কী করছ?”
-” এমনিই, দাঁড়িয়ে আছি। কেন?”
-” যাও ক্লাসে যাও, আর তোমার রেজিস্ট্রেশন নিয়ে মে বি কোনো সমস্যা হয়েছে, একবার অফিসে দেখা করে নিও। ‘
-“ওকে, কিন্তু আপনি এরকম রেগে রেগে কথা কেন বলছেন?”
-” এটা কলেজ, এখানে তুমি জাস্ট আমার স্টুডেন্ট, এর থেকে বেশি আর কিছু না বুঝেছ?”
সৌমাভর কথাটা শুনে তৃণা আর কিছু বললনা। ও লক্ষ্য করেছে, যে প্রপোজ করার ঐ দিনটাতেই, একমাত্র সৌমাভকে অত বেশী হাসিখুশি লাগছিল। তৃণা ভেবেছিল, হয়তো ওর জন্য নিজেকে আস্তে আস্তে বদলে ফেলছে সৌমাভ। কিন্তু না, কিছুই পরিবর্তন হয়নি। সব কিছু আগের মতোই আছে। সৌমাভ যেন সবসময়ই ওদের মধ্যেকার বয়সের পার্থক্যটার সদ্ব্যবহার করে চলে। উনি নিজে কলেজের স্যার সেটা সবসময় মনে না করালে বোধহয় পেটের খাবার হজম হতে চায়না। মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে তৃণা চুপ করে রইল। কলেজের মধ্যেই তৃণার এরকম এড়িয়ে যাওয়ার আচরণ দেখে সৌমাভর মাথাটাও সামান্য গরম হয়ে গেল। তৃণার মুখের সামনে দাঁড়িয়ে সরাসরি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে সে বলল,
-” তৃণা ডোন্ট ক্রস ইওর লিমিট। এরকম করছ কেন? এটাকে অসম্মান করা বলে, সেটা কি বোঝো?”
-” আপনি তাহলে এরকম বকা দিয়ে কথা বলছেন কেন? আমি কি খারাপ কিছু কথা বলেছি? এখন তো ক্লাসেও যথেষ্ট ভালোভাবে থাকি। তাহলে? তাহলে কী করেছি?”
-” যা কথা বলার পরে বলব, এখন যাও।”
-” ওকে, আমি যাচ্ছি। আপনি থাকুন আপনার ইগো নিয়ে, যত্তসব। ”
রাগে গজগজ করতে করতে তৃণা ক্লাসের দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। আর তার সাথে সাথেই একটা বলিষ্ঠ হাত ওর হাতটা চেপে ধরল শক্তভাবে। বিরক্তি আর বিস্ময়ে পাশে তাকিয়ে তৃণা দেখল, অন্য কেউ নয়, স্বয়ং সৌমাভ ওর হাতটা এইভাবে কলেজ চত্বরের মাঝে চেপে ধরেছে। ভাগ্যিস এই করিডোরের শেষপ্রান্তের দিকে, তেমন কেউ আসেনা। তৃণা আরো অবাক হওয়ার আগেই, সৌমাভ ওকে সামান্য একটু নিজের দিকে টেনে ফিসফিস করে বলল,
-” যা রাগ দেখানোর, কলেজ শেষ হওয়ার পর দেখাবে। এমন কিছু করোনা, যাতে আমি সবসময় তোমার কথা ভাবতে ভাবতে আর ঠিক করে ক্লাসই না করাতে পারি।
আর একটু আগে, মেজাজ দেখানোর জন্য সরি, এবার খুশি,?”
-” হুমমম” মাথাটা নীচু করে, কিছুটা আদুরে গলায় বলে উঠল তৃণা।
-” গুড, এবার যাও ক্লাসে। আর মনে করে অফিসে দেখা করে নিও। ওকে?”
-” হুমম, ঠিক আছে। আপনি এরকম করেই কথা বলবেন, ভালো লাগে আমার”
-” আর তুমিও, আমাকে আপনি বলার অভ্যাসটা ত্যাগ করে তুমি বলার চেষ্টা করো, ভালো লাগবে আমার”
-” হ্যাঁ ঐ করি, বাইরে তুমি বলব, আবার কলেজে আপনি বলব….এই বলে বলে মাথাটা খারাপ হয়ে যাক আমার তাই তো?
তৃণার কথা বলার ধরন দেখে হাসি পেয়ে গেল সৌমাভর, মুখের গাম্ভীর্য আর বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারলনা ও। তৃণার মিষ্টি মুখটার দিকে একটা কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে বলল,
-” তুমি যে হারে কথা বলো, তাতে যখন আমার মাথা খারাপ হয়নি, তখন তোমারও, হবে না”
-” মানে??? আমি কথা বলি, আপনার বিরক্ত লাগে?”
-” সেতো নিজেকে বুঝে নিতে হয়, তাই না?”
-” ওকে,বুঝেছি। আমি, খুব খারাপ, শান্তি??”
-‘আরে সেটা কখন কথা বললাম? উফফ”
-” মানেটা ঠিক ওটাই দাঁড়ায়। আমি বুঝতে পারছি”
-” এই তুমি যাও এখন, যাও। উফফফ, একটা কথা শুরু করলে আর থামবেই না।”
মৃদু ধমকের সুরে কথাটা বলে পেছনে ঘুরতেই সৌমিভ দেখল, কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে কয়েকটা ছেলে ওদের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। ছেলেগুলো এই কলেজেরই। ওদের তাকানোর ধরনটা ঠিক ভালো লাগল না সৌমাভর। তৃণার থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে, দাঁড়িয়ে, ওর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে, সে বলল,
-” তৃণা, আর এখানে দাঁড়িওনা, যাও। ”
-” কেন? তর্ক করার দম ফুরিয়ে গেল?? হুমম??”
-” তুমি যাবে?? এত অবাধ্য কেন কথার ?”
হঠাৎ করেই, সৌমাভর এরকম মৃদু চিৎকার শুনে চমকে উঠল তৃণা। ব্যাপারটা কিছুই বুঝলনা ও, কারণ পিছনের ছেলেগুলোকে তখনও দেখতে পায়নি তৃণা। তবে সৌমাভকে এভাবে হঠাৎ রেগে যেতে দেখে আর কথা না বাড়িয়ে, ওখান থেকে চলে গেল সে। আর সৌমাভও ছেলেগুলোর দিকে, একটা কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে, চলে গেল নিজের ক্লাসের দিকে। ও বেশ বুঝতে পারছে, এই ব্যাপারটা নিয়ে কিছু একটা জলঘোলা হতে চলেছে কলেজে। তার নিজের জন্য চিন্তা নেই, কিন্তু এই কারণে তৃণাকে যদি কোনো খারাপ-ভালো কথা শুনতে হয়, তাহলে সেটা খুব সহজে মেনে নেবেনা সৌমাভ, তাহলে ঐ ঘটনার শেষ অবধি যাবে সে।
(ক্রমশ)