মেঘ বৃষ্টি রোদ, পর্ব:১৩

0
497

❤#মেঘ_বৃষ্টি_রোদ
#ত্রয়োদশ_পর্ব ❤
তৃণা কেকটার দিকে বিহ্বল চোখে তাকিয়ে, অস্ফুট স্বরে বিড়বিড় করে কী যেন একটা বলল, সেটা ঠিক স্পষ্টভাবে শোনা গেলনা। ওর এরকম দশা দেখে সৌমাভ এবার তৃণার ধরে থাকা হাতটায় সামান্য চাপ দিয়ে বলল,

-” এই যে! হুঁশে ফেরো এবার। আর কতক্ষণ?”

-” হ্যাঁ? হুমম বলুন, বলুন আমি শুনছি”

-” ওকে। তাকাও আমার দিকে, আগে কেকটা কেটে নাও। তারপর তোমার যা কিছু বলার আছে, অভিযোগ আছে বলতে শুরু করো, আমি শুনব”

-” কিন্তু, মানে….আপনি সব জেনেশুনে ইচ্ছে করেই…. এতদিন ধরে?….”

-” হুমমম। ঠিকই বলছ, তবে আরো কিছু বলার আছে আমার তোমাকে। সেটা পরেই বলছি। কেকটা কালো, মোমবাতির তাপে ক্রিম গলে যাচ্ছে”

আর কোনো কথা না বলে, মন্ত্রমুগ্ধের মতো কেকের পাশে সাজানো মোমবাতির আলো গুলো নিভিয়ে, ছুরি দিয়ে কেকটা কাটল তৃণা। ভীষণ সংকোচের সাথে সেটার একটু অংশ ভেঙে এগিয়ে দিল সৌমাভর দিকে। এই প্রথম এত কাছাকাছি, পাশাপাশি বসে চোখে চোখ রেখে তাকালো ওরা। তবে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলনা তৃণা ওভাবে, তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে, কেকটা সৌমাভর মুখের সামনে আরেকটু এগিয়ে দিল সে। সৌমাভও কোনো কথা না বলে, কেকটায় অল্প একটু কামড় বসিয়ে আবার সেটা এগিয়ে দিল তৃণার দিকে। মাথা নীচু করেই বসে বসে কেকটা খেল তৃণা। নিজের আচরণে আবারও নিজেই অবাক হয়ে গেল সে, এত লজ্জা যে তার মধ্যেও উপস্থিত ছিল, এটা তো আজকের দিনটা না এলে জানতেই পারত না ও। সৌমাভ নিজেও ভীষণ বিস্মিত ভাবে তৃণার এই অদ্ভুত আচরণ পরিবর্তনটা দেখতে লাগল। হাতের উপর হাতের রাখা হাতটার জন্য তৃণা আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে, এরকম ভাবে আগে কেউ কখনো স্পর্শ করেনি ওকে, বিশেষ করে এমন একটা মানুষ, যার প্রতি সে আলাদাই একটা আকর্ষণ অনুভব করে। খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর, সৌমাভ বলে উঠল,

-” বলো এবার, মৌলি তোমাকে ঠিক কী কী কথা বলেছে? মানে ও তোমাকে, বলেছে তো নিশ্চয়ই, তাই না?”

-” হুমম বলেছে, এবং আজকেই বলেছে। বেশ সুন্দর একটা ঘটনা দিয়ে আজকের দিনটা শুরু হয়েছে।”

-” আজকেই ফোন করেছে?? অদ্ভুত! ও তো অনেক আগেই ব্যাপারটা জেনে গিয়েছিল, তাহলে এতদিন অপেক্ষা করল কেন?”

সৌমাভ অবাক হয়ে গেল, আজকের দিনেই মৌলি যে এরকম কিছু কথা বলবে তৃণাকে এটা সে আশা করেনি একদমই। মনটা প্রচন্ডভাবে খারাপ হয়ে গেল ওর, না জেনেই আজ সকালে সে নিজেও তো কতগুলো কথা শোনালো মেয়েটাকে। তৃণা অবশ্য এখন আর সেই ব্যাপারটা নিয়ে মনখারাপ করে বসে নেই, সৌমাভর কথা শুনে ও বলল,

-” হয়তো, আজ আমার জন্মদিনের অপেক্ষা করছিল। তাতে কষ্টটা আরো বেশি দেওয়া যায়, সে যাই হোক। আমার সত্যি কিছু বলার নেই, আপনি বলুন যে আপনি এতকিছুর পর নিজের সপক্ষে কী বলতে চান?”

-” তোমার কী মনে হচ্ছে, আমি কী বলতে চাই?”

-” জানিনা, এই মুহূর্তে কিছুই মাথায় ঢুকছে না আমার, আপনিই বলুন যা বলার আছে”

-” ওকে বলছি, ওয়েট”

তৃণার হাতের উপর থেকে হাতটা সরিয়ে একবার হাতঘড়িতে সময়টা দেখে নিল সৌমাভ। খানিকক্ষণ থেমে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিল ও। তারপর ধীরে ধীরে তৃণার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

-” প্রথমে একটা সত্যি কথা বলো , তুমি কি আমাকে পছন্দ করো তৃণা?”

-” মা-মানে?”

-” মানে যেটা শুনলে সেটাই, বলো আগে”

-” আ-আপনি এরকম আমার মাথায় বন্দুক রেখে কথা বের করার চেষ্টা কেন করছেন? আমি নিজে থেকে কী বলব আপনাকে? আপনি যেটা বোঝার বুঝে নিন, আমি কিছু বলতে পারব না”

তৃণা প্রায় চিৎকার করে উঠল। লজ্জায় ওর চোখমুখ রীতিমতো লাল হয়ে গেছে, বুকের ওঠানামার গতি হঠাৎ এতটাই বেড়ে গেছে যে, বাইরে থেকেও যেন সেটা অনুভব করতে পারছে সে। ওর চিৎকার শুনে, সৌমাভ দাঁতে দাঁত চেপে নীচুগলায় বলল,

-” এইই চুউউপ….. আমি বলছি, ওয়েট”

-” হুমম বলুন”

-” হ্যাঁ, আমি আমি, ঐ কথাটাই বলতে চাইছি, যেটা জিজ্ঞেস করলাম। দেখো, আমি প্রফেশনাল সম্পর্কে তোমার স্যার হই, তোমার থেকে বয়সেও খানিকটা বড়ো। তাই না,প্রথমে নিজেকে বোঝানোর অনেকরকম চেষ্টা করেছি, কিন্তু লাভ হয়নি তাতে। আমি ক্রমশই তোমার প্রতি, মানে….তোমাকে দেখলে আমার কিছু, অন্যরকম অনুভূতি হত। সেই কারণেই….”

-” হ্যাঁ আমি আপনাকে পছন্দ করি, আর এটাও বুঝতে পারছি, আপনিও আমাকে পছন্দ করেন। সেটাই বলার চেষ্টা করছেন এতক্ষণ ধরে, তাই তো?”

নিজের অজান্তেই সৌমাভকে মাঝপথেই থামিয়ে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হঠাৎ কথাটা বলে ফেলল তৃণা। আর বলে ফেলার সাথে সাথেই লজ্জায় হঠাৎই আবার আগের চুপ হয়ে গেল সে। সৌমাভ বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইল ওর দিকে। কলেজে সে যত বড়োই, গম্ভীর, রাগী স্যার হোক না কেন, এই মুহূর্তে নিজের পছন্দের মানুষটাকে মনের কথা বলতে গিয়ে এরকম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাওয়া তো খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। মুখে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস বজায় রাখলেও, জীবনে প্রথম বার এইরকম একটা কাজ করতে গিয়ে রীতিমত ঘাম ছুটে যাচ্ছিল সৌমাভর। তৃণা আচমকা কথাটা বলে ফেলে একদিকে ভালোই করেছে। ওর ঝামেলাটা অনেকটাই কমে গেল। তৃণার থতমত মুখটা দিকে তাকিয়ে সামান্য দম নিয়ে সৌমাভ বলল,

-” হ্যাঁ, তাই। আমি তোমাকে পছন্দ করি, আই লাইক ইউ, অ্যান্ড আই, আই লাভ ইউ তৃণা…”

-” আর তাহলে মৌলিদি? তোমাদের ছয় মাসের সম্পর্কের কী হল? আমার জন্য মৌলিদিকে, ছেড়ে দিচ্ছেন? এটা কেন?”

-” হুমম, এটা তোমাকে অবশ্যই জানাবো আমি। প্রথমত মৌলির সাথে আমার কোনো সম্পর্ক কখনো হয়নি। ও আমাকে পছন্দ করত, আমি নিতান্তই কোনো সমাধান না পেয়ে, এই সম্পর্কের সাথে নিজেকে জড়িয়েছিলাম। কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে বুঝতে, পারছি যে এই সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় আমার পক্ষে। জোর করে তো আর কিছু টিকিয়ে রাখা যায়না। সেই কারণেই এই সিদ্ধান্ত। এবার বলো, আর কী জানতে চাও?”

-” কিন্তু কখনো, আমার সাথে সম্পর্কে যাওয়ার পরেই আপনার যদি এরকম মনে হয়, যে এই সম্পর্কটা আর টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, তখন আমি কী করব? আপনার মুডের উপর নির্ভর করে থাকব? ”

-” তৃণা, ব্যাপারটা বুঝতে তুমি ভুল করছ। মৌলির সাথে আমার সম্পর্কটা নিজের ইচ্ছেতে হয়নি। ওর প্রতি কোনো টান আমি কখনো অনুভব করিনি, যেটা তোমার প্রতি করেছি। পার্থক্য এটাই, আমি তোমাকে পছন্দ করার কোনো আলাদা কারণ দেখাতে পারবনা। কেন ভালোলাগে, ঠিক কখন থেকে ভালোলাগার শুরু বলা সম্ভব নয়, শুধু যে ফিলিংসটা রয়েছে, সেটাই বলার চেষ্টা করলাম। বাকিটা তোমার সিদ্ধান্ত।”

-‘ভালোবাসার এসব কিছু আমি বুঝিনা, সত্যিই বুঝিনা। শুধু এটুকু বলতে পারি, মৌলিদির সাথে আপনার ছবিটা দেখে প্রচন্ড খারাপ লেগেছিল, আর আজ যখন আপনি আমার জন্মদিনটাকে ইগনোর করছিলেন, তখনও সেই একইরকম মনে হচ্ছিল”

-” সরি ফর দ্যাট।

-‘হুমম। কিন্তু একটা কথা, আজ কি আপনি মৌলিদির সাথেও দেখা করবেন বলেছিলেন?”

-” কই না তো, কেন? ও বলেছে এরকম কিছু?”

-” হুমমমম”

-” না, এরকম কিছু আমি বলিনি। সত্যিই বলিনি। বাট এখনও আমার প্রশ্নের উত্তরটা তুমি দাওনি”

কথাটার মানে বুঝতে পেরেই, একটু থমকে গেল তৃণা। একসাথে এতগুলো ঘটনা হজম করতে তার কষ্ট হচ্ছে বৈকি। মাথাটা নীচু করেই, সে ধীরে ধীরে বলল,

-” মি টু। আই লাভ ইউ টু।

কথাটা বলে চোখের দৃষ্টি দৃষ্টি রেখে অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল তৃণা। বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। সৌমাভ চেয়ারে বসে তৃণার অলক্ষ্যে ভালোভাবে ওর দিকে তাকালো, আজকে ভীষণ ভীষণ, অদ্ভুত রকমের যেন সুন্দর লাগছে ওকে। এরকম একটা দিন যে কখনো আসবে এটা কি কখনো কল্পনা করেছিল সৌমাভ? দু’জনের কেউই আর কোনো কথা বললনা। কেকের বাকি অংশটা অল্প অল্প করে খেতে খেতে ওরা নিজেদের ভাবনায় ক্রমশ যেন ডুবে গেল। ভবিষ্যতে কী হতে চলেছে, তা কেউ জানেনা, ওরাও জানেনা…. তবে যাই ঘটে যাকনা কেন, আজকের দিনটা ওদের জন্য নিঃসন্দেহে একটা স্মরণীয় দিন হয়ে থাকবে।

************
পর্ণা ভেবেছিল, আজ সন্ধ্যাবেলায় একটু তৃণার বাড়ির দিকে আবার যাবে। দু’জনে মিলে কোথাও একটা ঘুরে আসবে। কিন্তু এমন অসময়ে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল যে কিছুই আর করা হবেনা। অথচ হাতে এখন অখণ্ড অবসর। অলসভাবে ফোন ঘাঁটতে ঘাঁটতে ফোনের মেসেজের কাছে চোখ পড়তেই, চমকে উঠল ও। সৌমিকের মেসেজ। তাড়াতাড়ি করে সেটা খুলে পড়া শুরু করল পর্ণা, ওখানে লেখা আছে,

-” আজ বিকেলের দিকে যদি ফ্রি থাকো তো, একবার ফোন করতে পারি? মানে কিছু বলার ছিল তোমাকে, সেই জন্য”

ইশ, এতক্ষণ এটা চোখেই পড়েনি পর্ণার। প্রায় দুপুরের দিকে সৌমিক মেসেজটা পাঠিয়েছে। কিন্তু এখন তো বিকেল হয়েই গেছে, তাহলে কখন ফোন করবে সৌমিক? আর কী কথা বলার চেষ্টা করবে ও? পর্ণার ভাবনাচিন্তার ব্যাপারে, কিছু কি জানতে পেরে গেছে? ঘুম থেকে উঠেই, এসব নানান রকম চিন্তা ভাবনায় অস্থির হয়ে গেল পর্ণা। আর ঠিক তার কিছুক্ষণ পরেই, ওর চিন্তাভাবনার অবসান ঘটিয়ে একটা টুং করে মেসেজ রিংটোনের শব্দ পাওয়া গেল। ব্যস্ত হাতে ফোন হাতে নিয়ে দেখল, যেটার অপেক্ষা সে এতক্ষণ করছিল, সেই প্রতীক্ষিত একটা মেসেজই এসেছে। সৌমিক লিখেছে,

-” ফোন করতে পারি এখন? ফ্রি আছো?”

-” হ্যাঁ, করতে পারো, কোনো অসুবিধা নেই।

দ্রুত হাতে মেসেজ টাইপিং করেই পর্ণা অস্থির মনে অপেক্ষা করতে লাগল, সৌমিকের ফোনের। হঠাৎ করে কী এমন হল যে এত তড়িঘড়ি ফোনের প্রয়োজন হয়ে পড়ল? মিনিটখানেক পরেই পর্ণা দেখল ফোনের স্ক্রিন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, সৌমিকের নম্বরটা ভেসে উঠেছে সেখানে। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা রিসিভ করে পর্ণাই প্রথম কথা বলল,

-” হ্যালো,”

-” হ্যাঁ হ্যালো, পর্ণা, ডিস্টার্ব করলাম না তো?”

-‘না না, ডিস্টার্ব কেন হবে? বলো, আমি ফ্রিই আছি”

-” হুমম, আসলে…আমার কিছু ব্যাপারে সামান্য জিজ্ঞাসা আছে। মানে তুমি আগের দিন ঐ কফিশপে, যে কথাগুলো বলেছিলে। সেটা নিয়েই আমি অনেক ভেবে দেখলাম, আর কি…”

-” কী ভেবেছ? মানে কী ব্যাপারে ঠিক বুঝতে পারছিনা”

-” ঐ যে, ভালোবাসা নিয়ে যে কথা গুলো বলেছিলে, আমার তৃণার প্রতি ফিলিংস নিয়ে যেটা বললে, ওটাই ভেবে দেখলাম। যে কথাটা হয়তো সত্যি। আর এটাই আমি ঠিক মানতে পারছিনা, কষ্ট লাগছে, খারাপ লাগছে। কী করব বুঝতে পারছিনা। একটু হেল্প করবে প্লিজ??”

-“আ- আমি কী বলব, মানে কী ধরনের হেল্প করব?”

-” মানে, আমার কী করা উচিত? তৃণাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করব? নাকি ওকে মানানোর চেষ্টা করব? কোনটা?”

-“আর আমি তোমাকে যে কথাগুলো বলেছি, সেগুলো কখনো কারো প্রতি অনুভব করিনি তুমি? কেউ নেই এমন, মনকে শান্ত করো, চোখ বন্ধ করে ভাবার চেষ্টা করো, কাকে তোমার মন চাইছে। এর থেকে বেশি আর কী করতে পারি আমি!”

নিস্পৃহ গলায় বলল পর্ণা কথাটা। সৌমিক কথাটা শুনে একটু থেমে গেল। কথাটা ভেবে দেখার চেষ্টা করতেই হঠাৎ একটা অদ্ভুত চমক অনুভব হল ওর। একি হল আচমকা ? তৃণা নয়, বরং হঠাৎ করেই চোখ বন্ধ করে, পর্ণার মুখটা ভেসে উঠল সৌমিকের স্মৃতিতে। এর কারণ সৌমিক বুঝতে পারলনা, এই মুহূর্তে ওর সাথে কথা বলছে বলেই কি এমনটা হল? কথা বলতে বলতে সৌমিক আকস্মিক এরকম চুপ হয়ে যাওয়াতে পর্ণা ফোনের ওপাশ থেকে বলে উঠল,

-” হ্যালো, শুনতে পাচ্ছো? সৌমিক?”
(ক্রমশ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here