#মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং
#লুৎফুন্নাহার_আজমীন(#কন্ঠ)
#পার্ট৩
(অনুমতি ব্যতীত কপি করা নিষেধ)
বিছানায় হেলান নিয়ে এক দৃষ্টিতে শুভ্রর সাথে কাটানো বিশেষ মুহুর্ত গুলোর ফ্রেমবন্দী চিত্র দেখছিলো মেঘ।এই স্মৃতিগুলো কত সহজেই তৈরি হয়েছিলো।কিন্তু এই স্মৃতি গুলোই আজ মেঘের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।কিছু স্মৃতি তৈরী করা খুব সহজ। কিন্তু বয়ে বেড়ানো বা ভুলে যাওয়া খুব কঠিন।শুভ্রের সাথে কাটানো মুহুর্ত গুলো মেঘের সেইরকমই স্মৃতি।প্রাইভেট থেকে বাসায় যাওয়ার সময়টুকুকেই মেঘ শুভ্র রঙিন করে সাজিয়ে নিয়েছিলো।অনেকটা লং ডিস্টেন্স রিলেশনের মতোই ছিলো ওদের সম্পর্ক।মেঘ টাংগাইল আর শুভ্র ঢাকায়।যদিও শুভ্রও টাংগাইলের ছেলে।কিন্তু বাবার চাকরি সুত্রে শুভ্রের শৈশব কৈশর সব ঢাকাতেই।মাসে একবার করে শুভ্র কিছুদিনের জন্য টাংগাইল আসতো।মেঘের চাচাতো বোনের বিয়েতে শুভ্রের সাথে মেঘের পরিচয়।শুভ্রের ফুফাতো ভাইয়ের সাথে মেঘের চাচাতো বোনের বিয়ে হয়।ঝগড়া দিয়ে শুরু হয় শুভ্র মেঘের গল্প।তারপর বন্ধুত্ব,ভালোলাগা,ভালোবাসা আর সর্বশেষে বিচ্ছেদ।
মেঘ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এমন সময় ফুচকা নিয়ে শান্ত মেঘের ঘরে প্রবেশ করে।বিছানার পাশে টেবিলে ফুচকার প্যাকেট রেখে বলে,,
-ছাগল একটা।ব্রেকাপ হয়েছে।জেদে উনি জ্বর বাধিয়ে বসেছেন।অন্যের জন্য নিজেকে কষ্ট দিবি কেন?
-তোকে এইসব কে বললো?
-জ্বরের কথা খালামুনি বলেছে।আর কারণটা আমি নিজে থেকেই আন্দাজ করতে পেরেছি।
-বড্ড বেশি বুঝিস তুই।
-বেশি বুঝলে যদি তোর জন্য ভালো হয় তাহলে তাই সই।তুই বস।আমি বোল নিয়ে আসছি।
শান্ত বেরিয়ে যায়।কিছুক্ষণ বাদে বোল নিয়ে আসে শান্ত।ফুচকায় ভর্তা আর তেঁতুলজল ভরে মেঘের মুখের সামনে ধরে শান্ত।মেঘ মুখ ফিরিয়ে নেয়।
-ব্রেকাপ হয়েছে তাই খাওয়া দাওয়া বাদ দেওয়া লাগবে?কোথায় তুই অন্যদের মতো এক্সকে গালি দিবি।তা না দেবদাসের মতো ঢং ধরে বসে আছিস!
শান্তর কথা শুনে মেঘ শান্তর দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়।
-তোর কি মনে হয় আমি ওকে গালি দিতে পারবো?হয়তো সে আমায় ঠকিয়েছে।কষ্ট দিয়েছে।কিন্তু হাজার হলেও এটা সত্য যে আমি ওকে একসময় ভালোবেসেছি।ইভেন এখনো বাসি।ওর জন্য আমার অনুভূতি কখনো শূন্য হবে না।আর হতে দেবোও না আমি।
-আর নিজে যে কষ্ট পাচ্ছিস!
-কপালে থাকলে কি আর করার!
তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে মেঘ।শান্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে।বিশ্বাস হচ্ছে না তার যে এই সেই মেঘ যে একসময় একটু ব্যথা পেলেই কেঁদে পুরো বাড়ি মাথায় তুলতো।আজ সেই মেয়ে এক আকাশ ভরা কষ্ট নিজের মাঝে লুকিয়ে দিব্যি হাসছে।মেঘ অবশ্য ভুল কিছু বলে নি।মানুষ কিভাবে পারে তার প্রাক্তনকে গালি দিতে।যাকে একসময় সে ভালোবেসেছিল। সত্যিই মানুষ বড়ই অদ্ভুত।
★
-আচ্ছা শুভ্র তুমি সব সময় মাস্ক পড়ে থাকো কেন?
চাঞ্চল্য কন্ঠে বলে মেঘ।মেঘ যেমন চঞ্চল শুভ্র ঠিক তার বিপরীত।অপ্রয়োজনীয় একটা কথাও বলবে না সে।আর মেঘ কথা না বলে থাকতেই পারে না।শুভ্র বেশ লম্বা।কিন্তু মেঘ খাটো।প্রায়ই সে লাফ দিয়ে শুভ্রের সমান হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে।এত দিনের রিলেশন হলেও মেঘ শুভ্রের ধুসর চোখজোড়া ছাড়া কিছুই দেখে নি।নিজেকে কেমন যেন আড়াল করে রাখতে চায় সে।বেশ অনেক সময়ই পাড় হয়ে গেছে।কিন্তু শুভ্র মেঘের কথার কোনো উত্তর দেই নি।মেঘ আবার প্রশ্ন করে,,,,
-শুভ্র আমি তোমায় দেখবো।
-বিয়ের পর একেবারেই দেখিয়ো।
মেঘ এবার রেগে যায়। জেদে রাস্তার মধ্যেই দাঁড়িয়ে পড়ে সে। শুভ্র তা খেয়াল করে নি।সে আনমনে সামনে তাকিয়ে এগিয়ে চলছে।হঠাৎ খেয়াল করে তার হার্টবিট মাপার মেশিন তার সঙ্গে নেই।পিছনে ঘুরে দেখে তার হার্টবিট মাপার মেশিন রাস্তার এক পাশে রাগ করে দাঁড়িয়ে আছে।শুভ্র মেঘের কাছে যায়।
-এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছো কেন?
মেঘ চুপ।সে কোনো কথা বলে না।শুভ্র বুঝতে পারে মেঘের অভিমান হয়েছে।চোখে পানি ছলছল করছে।মেয়েটার একটু রাগ অভিমান হলেই চোখে পানি চলে আসে।এত সেনসিটিভ কেউ হয়?শুভ্র শান্ত গলায় বলে,,
-মেঘ কান্না করার কিছু হয় নি।চলো।দেরি হলে আবার তোমার মা বাবা টেনশন করবেন।
-Don’t talk to me!
কান্নাভেজা কন্ঠে বলে মেঘ।শুভ্র মেঘের বাচ্চামোতে হেসে দেয়।হাসতে হাসতে বলে,,
-বুঝেছি মহারাণী! আপনার রাগ হয়েছে।বলুন কিভাবে আপনার রাগ ভাঙাতে হবে।
-অন্যান্য মেয়েরা বয়ফ্রেন্ডের সাথে কত কি করে!স্ন্যাপচ্যাটের বিড়াল ফিল্টারে ঢং করে ছবি তোলে।কাপল পিক তুলে।আর আমার কপাল!দেড় বছর হলো তোমার সাথে রিলেশনে গিয়েছি।অথচ আমি তোমার মুখটাই দেখতে পেলাম না।
অভিমানী কন্ঠে বলে মেঘ।শুভ্রের আরও হাসি পাচ্ছে। এই সামান্য ব্যাপারটা নিয়েও রাগ করতে হয়?অবশ্য মেঘের ভালো লাগা খারাপ লাগা সব সামান্য কিছু নিয়েই!সামান্য কিছুতে মেয়েটা যেমন আকাশ সমান খুশী হয় ঠিক তেমনই সামান্য কিছুতেই কষ্ট পেয়ে মেয়ে কেঁদে বুক ভাসিয়ে দেয়।মেঘের কথা শুনে শুভ্র ভেংচি কেটে বলে,,,
-অন্যান্য ছেলেদের গার্লফ্রেন্ডও তো বয়ফ্রেন্ডের কাছে কত কি চায়!কত কি গিফট নেয়!আর আমার কপাল!আমার গার্লফ্রেন্ড এখন পর্যন্ত আমার কাছ থেকে শুধুমাত্র একটা কাজল নিয়েছে।তাও সেটা আমি জোর করে দিয়েছি।
-I’m different… কিন্তু আজ যা চেয়েছি তা দিতে হবে!
-কি চেয়েছো?
-ওই যে আমি তোমার মুখ না দেখে যাবো না।
-মেঘ দেখো তুমি বড় হয়েছো।রাস্তার মধ্যে এভাবে সিনক্রিয়েট করো না।
-কই বড় হয়েছি?তোমার পাশে দাঁড়ালে তো আমি লিলিপুট।
শুভ্র হেসে দেয়।বলে,,
-দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু মেঘ!তোমার বাবা মা চিন্তা করবেন তো!
-করলে করুক।আমি তোমার মুখ দেখবো
-পরে একদিন দেখাবো নি।এবার চলো প্লিজ।
মেঘ শুভ্রের সাথে হাঁটা লাগায়।মেঘ বারবার শুভ্রের দিকে তাকিয়ে মুচকী হাসছে।বিড়ালের মতো ধুসর চোখে কি না মায়া জড়িয়ে আছে।মেঘ তো ওই চোখ দুটোরই মায়ায় পড়েছে।মেঘ একপ্রকার ন্যাকামি করেই আজ শুভ্রের মুখ দেখার জন্য বায়না ধরেছিলো।অবশ্য শুভ্রের মুখ দেখতে না পেয়ে মেঘের কোনো আফসোস নেই!কারণ যেই চোখ জোড়ার মায়ায় মেঘ পড়েছে তা সে প্রায় প্রতিদিনই দেখে।মাসে একবার সামনাসামনি অন্যান্য সময় মোবাইলের স্ক্রিনে।ওপর ওয়ালা যেন চোখ দুটোয় বিশ্বের সমস্ত মায়া ঢেলে দিয়েছেন।
মেঘ দীর্ঘশ্বাস ফেলে।চোখ দুটোর মায়া এখনো মেঘকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।শুভ্র যাই করুক মেঘের মনে শুভ্রের স্থান কখনো পরিবর্তন হবে না।কেন যেন মন বারবার বলছে।পাবি মেঘ তুই শুভ্রকে একেবারে নিজের মতো করে পাবি।হয়তো তা সত্যি কিংবা মিথ্যে স্বান্তনা।বিধাতাই ভালো জানেন।
★
একা বসে তুমিই
দেখছো কি একই আকাশ
দিনশেষে তার তারাগুলো দিবে দেখা
মেঘে ঢাকা তারার আলো
দেখে থাকো তুমি দেখো ভালো
হয়তো তার মাঝে খুঁজে পাবে আমায়
সেই দিনে এক গানে
এক গল্পকারের গল্প খুঁজে পাবে
খুঁজে পাবেনা সেই গল্পকার
দিনগুলো খুঁজে পাবে গানের প্রতিটা ছন্দে
শুনতে পাবে মৃত মানুষের চিৎকার
আমার দেহখান
নিও না শ্মশান
এমনিতেও পুড়ে গেছি
গান শুনতে শুনতে চোখের কার্ণিশ বেয়ে অশ্রু কখন গড়িয়ে পড়েছে শুভ্র টেড়ই পায় নি।বাংলা ব্যান্ডের গানগুলোর লিরিক্সের সাথে বাস্তব জীবনের অনেক মিল।প্রতিটা লাইনের মিশে আছে মানুষের জীবন জীবীকার গল্প।ওড সিগ্নেচারে দেহখান গানটা আগে থেকেই শুভ্রের ভীষণ প্রিয় ছিলো।কিন্তু মেঘ চলে যাওয়ার পর গানটা একেবারে হৃদয়ে গেঁথে গেছে।এই গানটা যেন শুভ্রের দুঃখ কষ্টে ভাগ একটু হলেও যেন নিতে পারে।বুঝতে পারে শুভ্রকে।বেঁচে থাকার নতুন ইচ্ছা শক্তি জাগিয়ে দেয়।শুভ্র দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বেলকনির দিকে পা বাড়ায়।দরজা খুলে দিতেই হাড় কাঁপানো উত্তরের হিমেল হাওয়ায় শুভ্র কেঁপে উঠে। শৈত্যপ্রবাহ চলছে।শুভ্র বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমের সাথে জড়িত।প্রতিবছর শীতে সে বন্ধুদের নিয়ে দুস্থ মানুষদের মাঝে কম্বল বিতরণ করে।মেঘের চলে যাওয়ার জন্য এইবার সে ঘরবন্দী।সব কেমন যেন থেমে আছে।কিন্তু এভাবে তো থেমে গেলে চলবে না।সবাই ফোনের ওপর ফোন দিচ্ছে। কবে শুভ্র ক্যাম্পাসে যাবে আর সব কার্যক্রম শুভ্রের নেতৃত্বে শুরু হবে!
হাওয়া কিছুটা কমলে শুভ্র সিগারেট ধরায়।নিকোটিনের ধোঁয়াকে মাধ্যম করে কষ্টগুলোকে খোলা আকাশে উড়িয়ে দেয়।
চলবে,,ইনশাআল্লাহ