মিঠা রোদ পর্ব ৫১

0
1397

#মিঠা_রোদ
#পর্ব:৫১
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া

তোশামণি কবীর শাহ সিনড্রোমে ভুগছে।তামাটে পুরুষটির সব ভালো লাগে তার।এইযে অসুস্থতায় মলিনতা ভরা চেহারায় যে গাম্ভীর্য ভাবখানা ফুঁটে উঠেছে এটাও তোশার কাছে ভালোবাসাময় লাগছে।এই অপ্রতিরোধ্য সিনড্রোমের কথা কবীরকে জানালে সে সবথেকে মিষ্টি সুরে হেসে বলল,

“তাহলে তুমি অবসেসড আমার প্রতি?”

“হ্যাঁ।সব ভালো লাগে আপনার।”

“তোমারও সব ভালো লাগে আমার।লাল শাড়ীতে সুন্দর পুতুল লাগছে।তুমি বিয়ের পর রোজ শাড়ী পরবে।”

তোশা লাজুক হাসে।কোমড়ে শাড়ীর আঁচল গুঁজে পুরো রুম ঘুরে।গুণগুণ করে গানে ভেসে যায় বাতাবরণ।কবীরের সুবিন্যস্ত রুমটাকে অহেতুক এলেমেলো করলো সে।আবার নিজেই গুছাতে লাগলো।কবীর মায়া ভরে মেয়েটিকে দেখছে।সব ঠিক থাকলে আজকে কী সে তোশাকে কাছে রাখতে পারতো না?বুকের ভেতর মিশিয়ে দিতো একদম।কবীর পুরুষ মানুষ।যা তার কঠোর ব্যক্তিত্ব অস্বীকার করলেও ভেতরে নরম ভঙ্গুর মনটা স্বীকার করতে বাধ্য।সে নিজের ভেতর চলতে থাকা উত্তাল ঢেউকে দমিয়ে রেখেছে বহু বছর ধরে।এই প্রায় একুশ বছরের তরুণ ফুলকে সে মলিনতা নিয়ে কখনো স্পর্শ করেনি।

“বাসায় তো আহনাফ ও কাজের খালা বাদে কেউ নেই।তুমি ঢুকলে কীভাবে?”

“আহনাফ ঢুকিয়েছে।”

“বেশ।তাহলে বাবাকে প্রেমে সাহায্য করছেন তিনি।”

“হু।”

“তোমাকে কী বলে ডাকে?মা?”

তোশা চকিতে কবীরের দিকে তাঁকালো।ভাবনায় বিমূঢ় হয়ে বলল,

“এখনও বলেনি।ইনফ্যাক্ট আমাদের সম্পর্কটাকে কীভাবে নেয় সেটা বুঝতে একটু সময় লাগছে আমার।আপনার রুমে ওটা কীসের দরজা?”

“আমার ছোটখাটো নিজস্ব একটি জিম আছে।একদিন ঘুরিয়ে দেখাবো।”

তোশা আরো কতোক্ষণ বিচ্ছিন্ন ঘুরে কবীরের পাশটায় বসলো।হসপিটাল থেকে লোকটা ফিরেছে গতকাল।আজ তোশা দেখা করতে আসতে পেরেছে।পরন্ত বিকেলের সময়।কুসুম রঙা হলদেটে আলোয় উদ্ভাসিত পুরো কক্ষ।

“কবীর শাহ।”

তোশা লোকটার বৃহৎ হাতটি নিজের করপুটতলে নিয়ে নেয়।চোখে একরাশ মায়া ফুটিয়ে বলল,

“আপনাকে আমি অনেক ভালোবাসি।যাই হোক শুধু সেটা মনে রাখবেন।”

“আজ এতো সিরিয়াস?কারণ কী ছোট পাখি?”

কবীর বহুদিন পর তোশাকে নতুন নামে ডাকলো।মানুষটা ভিন্ন নামে ভিন্ন অনুরাগ দেখায়।

“কারণ কিছু নেই।জানেন উল্লাসের বিশেষ একটি নাটক আজ রাতে প্রচার হবে।গত দুদিন ধরে খুব প্রমোশন চলছে।আপনি দেখবেন না?”

“দেখবো।ও কল করেছিলো সকালে।পরিবার সহ দেখতে বলেছে।এখন জিজ্ঞেস করলাম রোমান্টিক বা ইরোটিক কিছু কীনা?উত্তর দিলো না।অদ্ভূত কিছু হলে মা,বাবার সামনে লজ্জা পাবো।”

“আমি জানি কী সেটা।”

“কী?”

“আপনি ঠিক বলেছেন।অদ্ভূত কিছু।তবে দেখার আগে বলে দিলে কী মজা?”

তোশার কথায় প্রহেলিকা জুড়ে আছে।কবীর এতোক্ষণ পর নিজের প্রেমিকাকে ভালো করে অবলোকন করলো।পরিপাটি সাজ ও পুতুল চেহারার পিছনে খুব সন্তপর্ণভাবে ক্লান্তিকর,ভীত এক দুঃখী চেহারা লুকানোর চেষ্টা করেছে সে।

“কী হয়েছে তোশা?কেউ কিছু বলেছে?তোমাকে ভীষণ মিস্টিরিয়াস লাগছে এখন।”

“নাহ তো।আপনার অসুস্থতা আমাকে দূর্বল করে দিয়েছে।”

“এদিকে এসো।”

তোশা বাধ্য মেয়ের মতোন কবীরের সাথে মিলেমিশে বসে।পুরুষটির শরীর থেকে আসা সুগন্ধ তার মস্তিস্কের নিউরন গুলো সজাগ করে দেয়।ঠিক প্রথম দিনের মতোন মনে কম্পন তৈরী করে।মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে কবীর বলল,

“তুমি অনেক বোকা সেটা জানো লিটল চেরী?”

“এমনটা মনে হলো কেন?”

“হলো।এমনকি একটুও ম্যাচুরিটি নেই।তা নয় আমাকে নিজের জীবন সঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে না?”

“বলছেন ম্যাচিওর কোনো মেয়ে আপনার প্রেমে পড়তো না?”

“তোমার বয়সী।”

“কী করবো বলেন আপনি তো ভীষণ সুন্দর তাই এই হার্টে ব্যাথা হয়।সেটা কমানোর জন্য ভালোবাসি।”

তোশা বুকের ডান পাশে হাত রেখে হার্টের ব্যাথাকে নির্দেশিত করলো।কবীর আস্তে করে মেয়েটির হাতটি তুলে বলল,

“হার্ট বামপাশে থাকে।”

“উহু,বামপাশে যেটা থাকে তা হলো রক্ত সঞ্চালনকারী একটা যন্ত্র।ডানপাশে যেটা আছে তা হলো ভালোবাসার জন্য সুন্দর মন।ডক্টররা সেটা খুঁজে পায়না।অদৃশ্য অঙ্গ।”

কবীর উচ্চ শব্দে হেসে ফেললো।মেয়েটির এহেন বহু বোকা বোকা কথা প্রায় শুনতো আগে।কিন্তু মাঝে এতোটা কী নিয়ে চিন্তিত ছিল কে জানে?

“তোশা তুমি মাঝেমধ্যে খুব বাচ্চার মতোন কথা বলো। অবাক হয়ে যাই আমি।তোমার সাথে প্রেম করছি।”

থমথমে মুখে তোশা শুধালো,

“আমি কী কুষ্ঠো রোগী?আমার সাথে প্রেম না করলে কী এমন হতো আপনার?”

“বিয়ে।এতোদিনে হয়তো দুটো বাচ্চা হয়ে যেতো।”

“সত্যি বলছেন?”

“অবশ্যই।কেন মনে নেই তোমার আন্টির সাথে বিয়ের কথা হয়েছিল।যদি না মন তোমার কাছে থাকতো তাহলে হয়তোবা..।”

কবীর যা বলছে হয়তোবা সত্যি।কিন্তু তোশার মেনে নিতে বড় কষ্ট হচ্ছে।স্মরণ হলো সেই দিনের কথা।যেদিন কবীর তার আন্টিকে দেখতে গিয়েছিল। বিয়েটাও ঠিক হয়েছিল।তখনকার অনুভূতির কথা মনে হতে তোশার মনটা কেঁদে উঠলো।সে অভিমানে উঠে দাঁড়ালো।

“চলে যাচ্ছি আমি।”

“হঠাৎ কী হলো?”

“জানিনা।”

তোশার বড় খারাপ লাগছে।কতোটা ভালোবাসা নিয়ে সে এসেছিল তা কী পা’ষা’ণ পুরুষটি জানে?তোশা দরজায় কাছে চলে যাচ্ছে দেখে অকস্মাৎ বিছানা থেকে উঠে প্রায় কয়েক লাফে মেয়েটিকে ধরে ফেললো কবীর।হাতটা ব্যাথায় কেমন করে উঠলো।তোশাকে দেয়ালের সঙ্গে মিশিয়ে চোখ বন্ধ করে নিজের ব্যাথাকে সহ্য করে নিলো।জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে।উষ্ণ শ্বাসে শিহরণ জাগে তোশার।একটু ধাতস্থ হয়ে তোশার চোয়াল চে’পে ধরলো কবীর।

“তোমার মনে হয়না তোশা একটু বেশী রাগ করো?আমি এখন যা বলেছি তাতে ভুল নেই।তুমি যখন স্কুলে ছিলে দিশা কোন জিনিসটা বলে বেশী য’ন্ত্র’ণা দিয়েছে তোমাকে?আমার আগ্রাসী ভালোবাসার কথাগুলো তুলে।তাইতো?সেই পুরুষ যখন একাকিত্বে ছিল তখন একটা টিনেজ মেয়েকে পছন্দ করে তার কষ্ট হবে দেখে কোনো পার্টনার গ্রহণ করেনি।তুমি কী ভেবেছো তোমাকে ম্যানিপুলেট করা কঠিন?বরং অনেক সহজ।যদি আমি না নিজেকে সামলে নিতাম তবে এতোদিনে..।”

কবীরের ভারী অস্বস্তি অনুভব হচ্ছে।এতোগুলো গভীর কথা সে বলছে অথচ তোশা নির্বিকার।কবীর নিজে সাধারণ মানুষ।সহজাত বৈশিষ্ট্য অনুসরণ করে তার সবদিক থেকে সঙ্গী পাওয়ার কথা ছিল।অথচ সেই সময়টা সে ত্যাগ করেছে বিশ বছরের প্রেমিকার জন্য।হঠাৎ তোশার উপর ভীষণ রাগ হলো তার।একটু মাথা ঝুঁ’কে ফর্সা চিতল মাছের পেটের মতোন গলায় কা’ম”ড় দিলো।তোশা চোখ বন্ধ করে অনুভূতি হজম করে নিলো।ক্ষণবাদে কবীর ছাড়লো।মেয়েটির ঘাড়ে নাক ঠেকিয়ে সুবাসে মাতোয়ারা হলো।জড়ানো তবে বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলল,

“আই লাভ ইউ তোশা।আই লাভ ইউ।নেভার লিভ মি।আই উইল গিভ ইউ অল দ্য হ্যাপিনেজ অব লাইফ।মাই লাভ,নেভার লিভ মি।”

কবীরের ভেতর জ্ব’ল’ন্ত উন্মাদনা প্রথমবারের মতোন উপলব্ধি করতে পারলো তোশা।কতো ভালোবাসা লুকিয়ে রেখেছিল মানুষটা নিজের মধ্যে।যেখানে কামুকতা নেই।আছে শুধু স্বার্থহীন এক চাওয়া।

(***)

রাত আটটায় উল্লাসের বহুল আলোচিত নাটকটি শুরু হবে।সাধারণত উল্লাস নাটক করেনা।তবুও হঠাৎ এতো গোপনে কী স্ক্রিপ্টে নাটক করলো তা সকলের মধ্যে কৌতুহলের সৃষ্টি করেছে।বাড়ীর সবাইকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে বসে আছে কবীর।বৃষ্টি ও তার মা ভারী উত্তেজিত।পক্ষান্তরে আহনাফ চুপচাপ বসে ড্রয়িং করছে।ওদিকে কবীর বিকালে কাঁটানো মুহুর্ত গুলো থেকে নিজেকে বের করতে পারছেনা।তোশা কী রাগ করেছে তার উপর? যাওয়ার আগে এতোটা নিশ্চুপ কেন ছিল?বৃষ্টির উত্তেজনা বশত চিৎকারে ভাবনা থেকে ফিরে এলো কবীর।শুরু হচ্ছে নাটকটি।একই সাথে ইউটিউবেও সম্প্রচার হবে।

নাটকের শুরুতে খুব সুন্দর করে লেখা বাস্তব ঘটনার উপর নির্মিত।

শুরুর পাঁচ মিনিটে একজন কিশোরীকে দেখা যাচ্ছে যে বিয়ে বাড়ী থেকে হুট করে উধাও হয়ে গিয়েছে।মেয়েটির মা বেশ চিন্তিত হয়ে কাওকে কল করছে।কবীরের মনে হলো খুব কাছ থেকে ঘটনাটি দেখেছে সে।তার মনে একটা অদ্ভূত ভাবনা তৈরী হলো।সেটা বাস্তব রুপ নিলো যখন স্ক্রিনে উল্লাস ত্বকের রঙ তামাটে ও পোশাকের ভাবভঙি অবিকল কবীরের মতোন করে সামনে এলো। কবীরের মা তো বলেই ফেললো নায়কটাকে তার ছেলের মতোন দেখাচ্ছে।এখন কবীর কীভাবে বলবে তার হবু বউ যে কীনা দস্যুদের জাহাজের কান্ডারী সে তার আর নিজের প্রেমিকের প্রেমকথা সকলের সামনে নাটকের সামনে উপস্থাপন করছে হয়তো।এই কারণে সে চায়নি উল্লাসের সাথে পরিচয় হোক মেয়েটির।কারণ দুটো মানুষই পাগল।উদ্ভট কান্ড করে।এখন সকলে জেনে যাবে বিষয়টি।তাতে কবীরের ভয় নেই।কিন্তু জানার ধরণটা ঠিক নয় এটা যা তাকে ভাবাচ্ছে।

হুট করে কবীরের বুকটা ভীষণ ব্যাথা করছে।মনে মনে সংকল্প নিলো,”বিয়ের পর এই মেয়েকে ছয় মাস বাবার বাড়ীতে রাখবে সে।থাকবে মায়ের দু’ষ্ট মেয়ে মায়ের কাছে।”

চলবে।

এডিট ছাড়া পর্ব।অবশেষে বহু কাঙ্ক্ষিত পর্ব যে পর্বে সকলে জানবে তোশা-কবীরের সম্পর্কের কথা।মায়ান-তাহিয়ার রিয়াকশন কেমন হবে?কমেন্টে জানান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here