মিঠা রোদ পর্ব ৪৯

0
1914

#মিঠা_রোদ
#পর্ব:৪৯
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া

“আমি তো বিচ্ছেদ চাইনি।কিংবা উপন্যাসের শুরুতে বিয়োগান্ত অধ্যায় শুরু হোক সেটাও চাইনি।তাহলে কবীর শাহ সাথে এরকম হলো কেন?”

তোশার মনে এমন হাজারও প্রশ্ন উত্থিত হচ্ছে।কিন্তু জবাবের আশায় কারো কাছে তা ব্যক্ত করতে পারছেনা।হসপিটালের নিচ তলায় সকলে বসে আছে।মায়ান অবশ্য উপরে গিয়েছে।তোশার খুব করে নিজ বাবার সাথে যেতে মন চাইলো।ক্ষণবাদে মায়ান হন্তদন্ত করে নেমে এলো।কবীরের বাবা সেলিমকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“কবীর সুস্থ আছে আঙকেল।গু’লিটা বাহুতে লেগেছিল ভাগ্যিস।ডক্টররা তো এমনিতে আইসিউ এর ভেতরে দিয়েছিল।”

“দেখা করা যাবে?”

“কেবিনে শিফট হোক আগে।”

সুখবর এলো তোশার জন্য।এখনও কান্না পাচ্ছে তার।অধরযুগল দ’ং”শ’ন করে তা থামানোর চেষ্টা করলো।মায়ের বাহুতে আস্তে করে মাথা ঠেকালো।তাহিয়া মেয়েকে যত্নে আগলে নিয়ে বলল,

“খারাপ লাগছে তোশামণি?বাড়ী যাবে?”

“দেখা করে যাই আম্মু।”

“আজ এতো মানুষকে দেখা করতে দিবেনা।পরিবারের মানুষজন দেখা করুক আগে।”

“আমরা পরিবারের মানুষ নই?”

“ফ্যামিলি ফ্রেন্ড।”

তোশা অমীমাংসিত দৃষ্টি নিয়ে তাহিয়াকে দেখছে।সে তো নিজ মা কে জানাতে পারছেনা দুদিন পর কবীরের সবথেকে আপন সে হতো।

“আম্মু,আজকে বাবার বাসায় যাবো না।তোমার কাছে থাকবো।”

“তোমার জিনিসপত্র?”

“থাকুক।কাল তো আবার চলে যাবো।”

“দাদুবাড়ী ভালো লাগেনা তোশা?”

“একটুও না।মা কবীর শাহ ঠিক হয়ে যাবে তো?”

“যাবে।ও অনেক স্ট্রং একজন মানুষ।যখন তোমার বাবা ও আমার সম্পর্ক সকলে জানলেন তখন কতো কথা হতো।সবকিছুর জবাব কবীর নিজে একা দিতো।সেই বেপরোয়া মানুষটিকে এতো সহজে কেউ আঁটকাতে পারবেনা।দেখো না আমাদের মতোন দুজন অসহায় মানুষের সামনে ঢাল হয়ে থাকে সবসময়।তোমার সিয়া ম্যামও কিন্তু কবীরের আপন বোন নয়।এরকম বহু উদাহরণ আছে ওই মানুষটার।সব ভালো কাজের বিনিময় তো পাবে।”

তোশা শক্ত করে মা কে আঁকড়ে ধরলো।শব্দহীন তার ঠোঁট নড়তে লাগলো কবীর শাহ এর সুস্থতার জন্য।

(***)

সারাটি রাত ঘুমাতে পারেনি তোশা।সকালে ফোলা ফোলা চোখ নিয়ে বিছানাতে উঠে বসলো সে।কী অদ্ভূত কাঁদতে না পারার য’ন্ত্র’ণা।হসপিটালের নিয়ম অনুযায়ী সকাল দশটায় দেখা করা যাবে।এখন বাজে সবে সকাল সাতটা।তবুও তোশা রেডি হচ্ছে।মেয়ের এমন উৎসুকতাকে তাহিয়া সাধারণ কৌতুহল কিংবা সম্মান হিসেবে বিবেচনা করে নিলো।

“আম্মু আর কতোক্ষণ লাগবে তোমার?আমি তৈরী হয়ে নিয়েছি।”

“এতো সকালে যাবে তোশামণি?এখান থেকে হসপিটাল কিন্তু বেশী দূরে নয়।”

“চলো না মা।অল্প সময় না হয় বসে থাকবো।”

মেয়ের জোড়াজুড়িতে তাহিয়া রেডি হতে চলে গেলো।নারীটির বয়স একচল্লিশ হবে কয়েকদিন পর।কিন্তু দেখে উপায় আছে?মার্জিতভাবে শাড়ী পরে নিলো।কিন্তু সবথেকে অগোছালোভাবে আজ তৈরী হলো তোশা।ছোটখাটো অভিনেত্রী যাকে বলা যায় তার এমন সাজে বের হওয়া বেমানান লাগে।গাড়ীতে বসে তাহিয়া খেয়াল করলো তোশার মেহেদী ভীষণ লাল রঙ দিয়েছে সারারাত রাখার পর।সে হেসে বলল,

“জানো তো তোশামণি।মা আমাকে বলতো মেহেদীর এতো গাঢ় রঙ হওয়া মানে বিয়ের জীবনে সুখী হওয়া।যদিও কথাটি মিথ্যা।”

তোশা মায়ের বুকের দীর্ঘ শ্বাস উপলব্ধি করতে পারে।বিরস মুখে জানালার বাহিরে তাঁকালো।হসপিটালে পৌঁছানোর জন্য প্রত্যকটি সময় গুণছে সে।

(***)

“তোর এতো বড় শত্রু কে কবীর?একদম সিনেম্যাটিক স্টাইলে কাজ সেরে নেওয়ার চেষ্টা করেছে।আমার মাথায় অবশ্য একজনের নাম আছে।”

“তুই যার নাম বলবি মায়ান।সেটা আমিও ভাবছি।ফ্রান্সিসকো!ও বলেছিল জেল থেকে বের হওয়ার পর আমি যেখানে থাকি দেখে নিবে।”

“ভাগ্য ভীষণ সদয় ছিল তোর উপর।আন্টির দোয়া গুলো কাজে লেগেছে।তা নয় তোকে মীরা আপু হঠাৎ ডাকবে কেন?আর তুই পিছনে তাঁকাবি।”

“ঠিক।মা কোথায়?এখন যদি আসতে চায় বলবি ঘুমাচ্ছি।”

“বাড়ীতে পাঠিয়েছি।যদিও আমার ছোট্ট মা তোশামণি তোকে দেখার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছে।সেই ভোর পাঁচটায় আসতে চেয়েছিল।”

“কখন আসবে?”

কবীরের কণ্ঠে উত্তেজনা কিন্তু মায়ানের চোখ এড়ায় না।মৃ’ত হয়ে যাওয়া অভিশংকা সজীব হতে শুরু করে।

“আসছে বলল।”

কবীরের সঙ্গে আরো টুকটাক কথা হলো মায়ানের। পুরোটা ফ্রান্সিসকো কে নিয়ে।বছর পনের আগে কবীর যখন বিদেশে ছিল তখন লোকটার সাথে দেখা হয়। অনেক প্রাণবন্তু ও খোশমেজাজের লোক ছিল।এলাকার সকলের ভীষণ প্রিয়ও ছিল।কবীরের সাথে ভালো বন্ধুত্ব হওয়ায় ফ্রান্সিসকো এর বাড়ীতে যাতায়াত ছিল।একদিন সেখানে গিয়ে কবীর দেখতে পায় লোকটা যদিও তখন যুবক ছিল এক শিশু কন্যাকে নি’র্যা’ত’ন করছে।সে তৎক্ষনাৎ পুলিশকে ফোন দিয়ে ধরিয়ে দেয় লোকটাকে।ফ্রান্সিসকো কবীরকে অনেক অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছিলো।তাই গ্রেফতার হওয়ায় মনে করলো কবীর বেইমানি করেছে।সেদিন বলে গিয়েছিলো যেদিন সুযোগ পাবে দেখে নিবে কবীরকে।হয়তো এতো বছর পর সুযোগটা পেয়েছে।মায়ান চলে যাওয়ায় নির্জন কেবীনে এসব ভাবছিলো কবীর।দরজায় শব্দ হওয়ায় সেদিকে তাঁকালো।তাহিয়া ঢুকলো প্রথমে তার পিছনে চাঁদের আলো হয়ে এলো তোশা।মলিন মুখ,শুষ্ক অধর,ফোলা চোখ,ক্লান্ত তনু।তবুও যেন চাঁদের সব থেকে উজ্জ্বল আলোকরেখাটি।

“কেমন আছো কবীর এখন?সরি রাতে দেখা করার সুযোগ মিলেনি।”

“এখন ভালো।কিন্তু বহুদিন জিম করতে পারবো না।”

“আশ্চর্য।এই অবস্থায় জিমের চিন্তা আসছে কীভাবে?আহনাফ ফিরেছে সিলেট থেকে?”

“নাহ।ওকে বৃষ্টি আনতে গিয়েছে।আমার এই খবরটা জানেনা।”

“খুব কাঁদবে ছেলেটা।”

কবীরের স্বল্প দৃষ্টি তখন তোশার উপর।যে মেয়েটা অভিমানে শুভ্র দেয়ালের দিকে তাঁকিয়ে আছে।যুবতীর উদ্দেশ্যে কবীর শুধালো,

“কী খবর তোশামণি?অসুস্থ লাগছে তোমাকে।”

তাহিয়া মেয়ের হয়ে জবাব দিলো,

“তোমার জন্য ভীষণ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল।দেখো না সকাল সকাল এসে পড়েছি।”

“মায়ানেও সেটা বলছিলো।”

“সে এখানে?”

“বাহিরে গিয়েছে।এক ঘন্টার মধ্যে চলে আসবে।”

তাহিয়া এবার নড়েচড়ে বসলো।কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে চলে যেতে চাইলো।কিন্তু তোশা বেঁকে বসলো।কবীরও সায় দিয়ে বলল,

“তোশা থাকুক। আমার সঙ্গ হবে।তাছাড়া মায়ান এসে পড়বে একটু পর।”

“আচ্ছা।নিজের খেয়াল রেখো কবীর।তোশামণি আসছি আমার অফিস আছে।”

তাহিয়া চলে গেলে তোশা নিজের জায়গাতেই বসে থাকলো।কবীর মেয়েটার হাত দেখছে।শুভ্র হাতে থোকায় থোকায় গোলাপ ফুঁটেছে।

“কাছে এসো বেলাডোনা।এখন সিনেমার মতোন বলো না সব দোষ আমার।নিজের খেয়াল রাখিনি তাই এমন হয়েছে।”

“সেটা বলবো না।কিন্তু আমার খুব কান্না পাচ্ছে।ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ হয়ে যাচ্ছে তাইনা?”

কবীর মাথা এপাশ-ওপাশ দুলিয়ে বলল,

“না বেবি গার্ল।”

তোশা নিজ জায়গা থেকে উঠে অতি সন্তপর্ণে কবীরের পাশটায় বসলো।কতো আশংকা, কতো ভয়।এখনও যে শেষ হচ্ছে না।বাম হাতে ক্ষ’তটি হয়েছে মানুষটির।শুভ্র ব্যান্ডেজটা র’ক্তি’ম হয়ে আছে।

“আমি একটু স্পর্শ করি?”

“করো।”

তোশা আস্তে করে সেখানে স্পর্শ করে নিজে উহু করে উঠলো।যেন ব্যাথা সে পেলো।

“গু’লি লাগলে অনেক ব্যাথা করে তাইনা?”

“নো।ইঞ্জেকশনের অনুরুপ হালকা লাগে।”

“মিথ্যা।আপনার মনটা লোহা হলেও শরীরটা তো নয়।বাজপাখি কোধাকার।”

“কমপ্লিমেন্ট দিলে?”

“নাহ।খুব ভয় পেয়েছিলাম আমি।”

কবীরের ঘাড়ে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেলে তোশা।সে এতো তাড়াতাড়ি ম’র’ণ নামক বিচ্ছেদের অংশীদার হতে চায়।কবীর ঘাড়ে সিক্ততার ছোঁয়া পেলো।মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

“আমাদের কাহিনী এতো সহজে শেষ হয়ে যাবেনা বেলাডোনা।এখনও সুন্দর একটি সংসার হওয়া বাকী।”

চলবে।

Photo copy unknown

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here