মিঠা রোদ পর্ব ১৪

0
2066

#মিঠা_রোদ
#পর্ব:১৪
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া

“আপনি কী নিয়মিত জিম করেন?আমি কিন্তু মটেও স্বাস্থ্য সচেতন নই।এই কারণেও স্বাস্থ্যও বেশী।”

নিজের এই অপারগতা প্রকাশ করতে বিন্দুমাত্র লজ্জা পেলো না কলি।মেয়েটা বেশ স্মার্ট।কথাবার্তায় মেকি ভাব কম।

“সকলে যে স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন হবে এমন নয়।রেস্ট্রুরেন্টের বিজনেস তাহলে চলবে কীভাবে বলেন?”

কলি হাসলো।এতে তার শুভ্র মুক্তার মতোন দাঁতগুলো দৃশ্যমান হলো।

“বাই দ্য ওয়ে আমাদের নামের মধ্যেও কিন্তু মিল আছে ‘ক’ তে।সত্যি বলতে আমি এতো কথা বলিনা কখনো।”

“আমাকে দেখে বলতে মন চাচ্ছে এতো কথা?”

কলি লাজুক হেসে শাড়ীর আঁচল আঙুলের সঙ্গে লেপ্টে দিতে দিতে মাথা দুলালো।

“জি।’

“বেশ।”

কবীরের মটেও আলাপ করতে ভালো লাগছেনা।উল্টো চোরাচোখে দূরে বসে থাকা মিষ্টি কন্যাকে দেখতে ভালো লাগছে।ফোলা ফোলা গালের মধ্যে বিষন্নতা ছেয়ে আছে তোশামণির।এতে যেন আরেকটু সুন্দর লাগছে মেয়েটিকে। সে মাথাটা তুলতেই দুজনের দৃষ্টির মেলবন্ধন ঘটলো ।কবীরকে তার দিকে তাঁকিয়ে থাকতে দেখে মুখটা ঘুরিয়ে নিলো তোশা।

“কী দেখছেন ওদিকে?”

কবীর আস্তে করে জবাব দিলো,

“অভিমান দেখছি।”

“হু?কী বললেন?কে অভিমান করেছে?”

কলি সামনে চোখ তুলে তাঁকিয়ে তোশা ছাড়া আর কাওকে দেখতে পেলো না।সে ধরে নিলো নিশ্চয় এই বাচ্চা মেয়েটির অভিমান কবীর দেখছেনা।

“কলি আমি একটু আসছি।দুঃখিত আপনাকে একা ছাড়ার জন্য।”

কবীরের মিষ্টি হাসিটা সংক্রমিত হয়ে কলির মুখেও ছড়িয়ে গেলো।সে ঋণাত্মক মাথা দুলিয়ে বলল,

“সমস্যা নেই।আমি সেই অবধি তোশার সঙ্গে একটু গল্প করে নেই।”

কবীর সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠার আগে একবার পিছন ফিরে তোশাকে দেখলো।মেয়েটার মাথা থেকে নিশ্চয় এতোদিনে প্রেমের ভূত নেমে গিয়েছে।তা নয় সকালে এসেছে।অথচ একটিবারও তার সঙ্গে কথা বলেনি।উষ্ণ শ্বাস বের হয়ে এলো কবীর শাহ এর পাথর হৃদয় থেকে।

তোশামণির চুলগুলো ইদানীং বেশ বড় হয়েছে।মৃদুমন্দ হাওয়ার সঙ্গে সেগুলো উড়োউড়ি করতে ব্যস্ত।তোশাকে আত্মীয়রাও বেশ আহ্লাদ করে।কলি এসে পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,

“কী ব্যাপার তোশামণি?মনটা খারাপ কেন তোমার?ভালো লাগছেনা এখানে?”

“ভালো লাগছে খালামণি।একটু আগে যারা এলো তারা কে?”

“কবীরের মা-বাবা।আপাতত তারা এসে আমাকে দেখে যাচ্ছে।পরবর্তীতে কথা এগিয়ে গেলে বাড়ীর সকলকে নিয়ে আকদ অনুষ্ঠিত হবে।”

“ওহ।”

শব্দটি অন্তত মনমরা হয়ে তোশার ভেতর থেকে বের হয়ে এলো।যার গভীরতা কলি মাপার প্রয়োজনবোধ করলো না।তোশা পুনরায় ব্যগ্র হয়ে শুধালো,

“তিনি তোমাকে পছন্দ করেছে খালামণি?”

“এখনও বলা যাচ্ছেনা।স্বাস্থ্য একটু বেশী দেখে কতোজন রিজেক্ট করলো।যদি তোমার মতোন সুন্দর থাকতাম তবে বিয়ে এতো দেরীতে হতো নাকী?”

কলির আক্ষেপটা তোশার মনে সুঁ চ হয়ে য ন্ত্র ণা দিলো।এতো রুপের ডালি মেলে ধরেও তো সেই মানুষটার হলো না।কিশোরী তোশার মনে আত্মসম্মান ফুঁটে উঠেছে।ঠিক এই কারণে আজ তেরো দিনেও সে কবীর শাহ এর সঙ্গে কথা বলেনি।থাকুক না দূরে।গোপনে আড়ালে সব বির্সজিত হয়ে যাক।কলি নিজ ফোনে মত্ত্ব হয়ে পড়লো।উষ্ণ শ্বাস ফেলে তোশা উঠে দাঁড়ালো।এই বাড়ীটাও তার নানার।কিন্তু সাভারের দিকে হওয়ায় খুব বেশী আসা হয়না।অনেকটা খোলামেলা বাগান বাড়ীর মতোন।বাড়ীটা নানার হলেও আপাতত এটা তোশার ছোট খালামণির নামে।দুই ধার দিয়ে সিঁড়ি উঠে যায় ছাদের দিকে।তোশা যেদিকে কবীর গিয়েছিল ঠিক তার বিপরীতের দিকে গেলো।পথিমধ্যে বড়দের হাসির আওয়াজ শুনতে পেলো সে।বিয়েটা হয়তো হয়েই যাবে।

(***)

একমনে বাহিরে তাঁকিয়ে আছে কবীর শাহ।বাড়ীর সবথেকে নির্জন ব্যলকনি এটা।বহু বছর আগে মায়ানের সঙ্গে এই বাড়ীতে পিকনিক করতে এসেছিল সে।আজও সেই স্মৃতিগুলো কতোটা রঙিন।যে ছেলেকে বন্ধু হিসেবে সে মানে তার মেয়ের প্রতি অবাঞ্জিত দূর্লভ অনুভূতিকে সে শাসন করতে করতে ক্লান্ত।একদম ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে।এটা তো হওয়ার কথা ছিলনা।হুট করে নাকের ভেতর সুগন্ধীরা এসে ছুটোছুটি করতে লাগলো।Johnson Baby Powder এর।তোশা এখনও এটা গায়ে মাখে।যে মেয়ে ষোল বছরেরও বাচ্চামো ধরে রেখেছে তার সঙ্গে আসলেও তর্ক করে আগানো যায়না।মনের কৌতুহল দমাতে পারলো না কবীর।এগিয়ে গেলো সুগন্ধের দিকে।বাহিরের দিকে মুখ করে কাঁদছে তোশা।একটু পর পর হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে চলেছে।কবীর বাঁকা হেসে দেয়ালে বাহু ঠেকিয়ে দাঁড়ালো।আগমন বুঝতে পেরে তোশা শুধালো,

“কাঁদতে দেখে আনন্দ হচ্ছে?নিষ্ঠুর,পাষাণ,শক্ত হৃদয়ের মানুষ।”

“ভালো লাগছে সুন্দর,কোমল,নরম হৃদয়ের কন্যা।”

তোশা প্রচন্ড তেজ নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো।কান্না করতে করতে চোখ দুটো ফুলে গিয়েছে তার।কবীর হতাশামূলক শ্বাস ফেলে বলল,

“কিশোরী বয়সটা সত্যি ভয়ংকর আবেগের বয়স।যেখানে ভালো মন্দের বিচারে অনুভূতি প্রাধাণ্য বেশী পায়।”

“আবেগ?কেন এই বয়সে কারো মনে চাওয়া পাওয়া তৈরী হতে পারেনা?মানুষের তো ছোটবেলায় বন্ধুত্ব তৈরী হয়।যা পরবর্তী তে ভালোবাসা হয়ে উঠে।সেই বেলায় দোষ নেই।”

“ভীষণ বড় হয়ে যাচ্ছো তোশামণি।”

“হইনা বড়।তবে যদি আপনার মায়া হয়।”

কবীরের চোখ দুটো হেসে উঠলো।সে এগিয়ে এলো তোশার সামনে।মেয়েটি তার থেকে শারীরিকভাবে বেশ ছোটখাটো।নরম তুলতুলে হাত দুটো শক্ত হাতের মধ্যে নিয়ে নিলো সে।খুব ধীর আওয়াজে গেয়ে উঠলো,

ম্যেয়ে শায়ের তো নেহি মাগার এ হাসিন যাবসে দেখা
ম্যেনে তুজকো মুজকো শায়েরী আ গ্যেয়ি
ম্যেয়ে আশিক তো ন্যেহি মাগার এ হাসিন যাবসে দেখা
ম্যেনে তুজকো মুজকো আশিকি আ গ্যেয়ি

গানের লাইন গুলোর সমাপ্তিতে তোশার মাথাটি নিজের বুকের মধ্যে এনে রাখলো কবীর।মেয়েটির কান্না যেন এতে আরো বেশী বৃদ্ধি পেয়ে গেলো।ফিসফিস করে বলল,

“আমি নাটক করিনা কবীর শাহ।সত্যি মন থেকে বলি সব কথা।সকলে বলে খুব সুন্দর দেখতে আমি।তবে রুপের লোভে পড়েই আমাকে একবার পাওয়ার আশা করে দেখুন।”

শান্ত ধীরে তোশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

“পৃথিবীতে এমন জায়গা খুঁজে বের করো যেখানে তোমার অনুভূতিকে অসম্মান করার মতো কেউ থাকবেনা।”

“এমন জায়গা নেই কবীর শাহ।আপনি এইমাত্র যে গান গাইলেন সেখানে আমার প্রতি অনুভূতি খুঁজে পেয়েছি।এটা কী যথেষ্ট নয় সব ঘৃ ণা কে পিছন ফেলে দেওয়ার।আমি এতো বড় বড় কথা বলতে জানতাম না।ধরে নিন শিখছি।”

কবীরকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তোশা।কবীর দুহাত দিয়ে মেয়েটির নরম মুখ উপরে তুলে ধরলো।চোখ দুটো অশ্রুসজল হয়ে আছে।দুহাতের বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে মুছে বলল,

“আমার বুকে মাথা দিয়ে ইচ্ছামতো কেঁদে নাও তোশা।কখনো আর এই সুযোগ পাবেনা।যখন আমার চুল সাদা হওয়া শুরু হবে তখন তুমি পূর্ণ যুবতী হবে।বুঝতে পারবে বৃথায় অশ্রু ফেলেছিলে।”

তোশা কবীরের শক্ত বুকে পুনরায় কপাল ঠেকিয়ে বলল,

“এই কান্না কখনো থামবেনা আমার।কখনো না।”

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here