#মায়া
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-০৫:
দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ করে শুভ্রা শেফাকে ঘুম পাড়িয়ে নিচে এলো। তারপর ডাইনিং এর জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলো।
সীমান্ত অফিস থেকে এসে খুব ক্লান্ত ছিল, তাই সে খাওয়া দাওয়া করেই ঘুমিয়ে পড়েছে। শিশির বসে বসে টিভি দেখছিল।
কাজ শেষ করে শুভ্রা সোফায় এসে বসলো। শিশিরের দিকে চোখ পড়তেই গতকাল রাতের ঘটনাটি তার আবার মনে পড়লো। শিশির মনোযোগ দিয়ে টিভি দেখছে। এখন তাকে দেখতে স্বাভাবিক লাগছে। তাহলে গতকাল রাতে তার চাহনি?
গতকাল রাতের ঘটনাটি আদৌ সত্য ছিলো নাকি পুরোটাই তার স্বপ্ন?
এই বাড়িটিতে আসার পর থেকেই অদ্ভুত কিছু হচ্ছে তার সাথে। পুরো বাড়িটির দিকে ভালোভাবে একবার তাকিয়ে দেখলো শুভ্রা। প্রথম দিন থেকেই বাড়িটির প্রতি তার খুব মায়া জন্মে যায়। এই বাড়ির প্রতিটি কোণ শুভ্রার কাছে খুব আপন মনে হয়। যেন বহু পরিচিত এই পরিবেশ, বহু পরিচিত এই বাড়ির মাঝে বিচরণ করা আলো-ছায়ার খেলা, বহু পরিচিত সেই স্পর্শ জাগিয়ে দেওয়া শীতল হাওয়া। তবুও কেন এতো অচেনা লাগছে! চেনা অচেনার ভীড়ে শুভ্রা নিজেকে গুলিয়ে ফেলছে।
শুভ্রা মনে মনে ভাবছে,
শুভ্রা: প্রথম কোনো নতুন পরিবেশে আসলে সব কিছুই নতুন মনে হয়। কিন্তু এই নতুন পরিবেশটি আমার কাছে কেন লাগছে পুরোনো? কেন মনে হচ্ছে, আমি আগেও এসেছি এখানে? আমি যদি আগেও এসে থাকি, তাহলে আমার মনে পড়ছে না কেন কিছু?
এসব ভাবতে ভাবতে শুভ্রা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলো। ডানপাশের রুমগুলোর সাথে যে বারান্দাটি লাগানো আছে সেখানে গিয়ে দাঁড়ালো।
এই বাড়িতে আসার পর থেকে শুভ্রা মাঝে মাঝেই এ বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। শুভ্রার কাছে এই বারান্দার হাওয়া খুব মিষ্টি মনে হয়।
এর নিচের দিকে খানিকটা জঙ্গলাকীর্ণ। বাউন্ডারি দেয়ালের ঠিক পেছনে শূন্য মাঠ। চাষাবাদের জন্য অনেক চাষা কাজ করছে এখন মাঠে। খোলা মাঠের হাওয়া শুভ্রার চুলগুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে। চোখ বন্ধ করে প্রকৃতির স্নিগ্ধতা অনুভব করছে সে।
শুভ্রার খুব অস্বস্তি লাগছে এখন। মনে হচ্ছে তার ঠিক পাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। শুভ্রার চোখ খুলতে ইচ্ছে করছে না। চোখ বন্ধ করে হাওয়া উপভোগ করতে তার ভালোই লাগছিলো। কিন্তু মনের মধ্যে যে অজানা ভয় চেপে বসেছে সেটি দূর করার জন্য জোর করেই চোখ খুলে পাশ ফিরে দেখলো। কিন্তু কোথাও কেউ নেই। এটিও মনের ভুল ভেবে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললো শুভ্রা।
শিশির অনেক দিন ধরে বলছে কেক খাবে। চকোলেট কেক শিশিরের খুব প্রিয়। সীমান্তকে আনতে বলেছিলো প্রয়োজনীয় জিনিস যা লাগে। কিন্তু যেই ব্যাগে করে এনেছিল সেটি কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না শুভ্রা।
শুভ্রা: এই শিশির। তোমার বাবা আজ একটা ব্যাগ এনেছিলো না সাথে? সেটা কোথায়?
শিশির: আমি শেফাকে দেখেছি ওটা নিয়ে খেলতে।
শুভ্রা: তুমি নিয়ে নাও নি কেন? ওসব খেলার জিনিস? মেয়েটাও না। কোথায় রেখেছে এখন? ঘরেও তো নেই।
শিশির: উপরের ওই ঘরটায়।
শুভ্রা: ওই দরজা তো বন্ধ।
শিশির: শেফা যখন খেলছিল তখন তো খোলা ছিল।
শুভ্রা: তুমি খুলে দিয়েছো?
শিশির: না তো, মা।
শুভ্রা খানিকটা অবাক হলো। তবুও ভাবলো হয়তো শেফা ধাক্কা দিয়ে খুলেছে। ধাক্কা দিয়ে খুলে দিলে এখন বন্ধ কেন দরজাটা? শেফা কি দরজাটা আবার বন্ধ করেছে? কিন্তু এতোটুকু বুদ্ধি তো মেয়েটির মাথায় আসবে না। এসব ভাবতে ভাবতে দরজাটা খুলে সেই ঘরের ভেতর ঢুকলো শুভ্রা।
ঘরের ভেতর ঢুকেই খুব শীতল হাওয়া অনুভব করলো শুভ্রা। ঘরটির দিকে ভালোভাবে চোখ বুলিয়ে নিলো সে। তারা এখন যে ঘরটিতে থাকে সেই ঘরটিও ঠিক এমন। প্রথমদিন যখন তারা এসেছিলো, শুভ্রা প্রতিটি ঘর একবার উঁকি দিয়ে এসেছিলো। কিন্তু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কিছু দেখে নি। কারণ সীমান্ত মানা করে দিয়েছিলো এখানের জিনিসপত্র নিয়ে যাতে ঘাটাঘাটি না করে। কম দামী বাসা খুঁজে পেলে তার এই বাড়ি ছেড়ে দেবে। তাই শুভ্রাও কখনো কোনো জিনিসে হাত দেয় নি।
শুভ্রা ভাবছে,
ঘরের দরজা জানালা বন্ধ তবুও এতো ঠান্ডা কেন এই ঘরটা? নিচে তাকিয়ে দেখলো যেটি খুঁজতে এসেছিলো সেটি নিচে পড়ে আছে৷ শুভ্রা মাথা ঝুঁকিয়ে ব্যাগটা নেওয়ার সময় খেয়াল করলো খাটের নিচে একটা সিন্দুক পড়ে আছে।
শুভ্রা ব্যাগটা নিয়ে চলে আসার সময় আবার পেছন ফিরে তাকালো। এক অদৃশ্য মায়া আটকে দিচ্ছে তাকে৷ শুভ্রার মন চাইছে সিন্দুকে কি আছে তা দেখার, আবার বিপরীত মন চাইছে, মায়া কাটিয়ে এই ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার।
এভাবে মনের সাথে যুদ্ধ না করে শুভ্রা শেষমেশ মায়ার বাঁধনকেই সায় দিলো।
দরজাটা আস্তে করে ঠেলে দিলো শুভ্রা। পুরোপুরি বন্ধ করার সাহস হচ্ছে না। হাতে থাকা ব্যাগটি একটি টেবিলের উপর রাখলো। তারপর ধীরে ধীরে খাটের নিচে ঝুঁকলো। সিন্দুকটিতে হাত দিতে খুব ভয় লাগছে তার। খাটের নিচে তেমন আলো না যাওয়ায় ভালো ভাবে বোঝা যাচ্ছে না সিন্দুকটি কেমন। কিন্তু খুব কারুকাজ করা আছে।
শুভ্রা ভাবছে এই বাড়ির মানুষগুলো খুব রুচিশীল হয়তো।
এরপর সে হাত দিয়ে সিন্দুকটি টেনে বের করে আনলো খাটের নিচ থেকে। তারপর মাথা তুলে সিন্দুকটির দিকে তাকানোর পর ভয়ে তার গলা শুকিয়ে গেলো।
সে বসা থেকে উঠে কয়েক পা পিছিয়ে যায়।
শুভ্রা দৌঁড়ে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় দরজাটা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
শুভ্রা: আমি তো হালকা চাপিয়ে দিয়েছিলাম। এভাবে দরজাটা কিভাবে বন্ধ হয়ে গেলো নিজ থেকে?
শুভ্রা চিৎকার দিয়ে ডাকছে,
শুভ্রা: শিশির, সীমান্ত। আমি আটকে গেছি এই ঘরে৷ দরজাটা খুলে দাও প্লিজ। কেউ কি আছো? আমার খুব ভয় করছে।
শুভ্রা সিন্দুকটির দিকে ভীত চোখে আবার তাকালো। সিন্দুকের উপরের অংশের ডিজাইনটি একেবারে সেই দরজাটির মতো যেটি সে স্বপ্নে দেখেছিল। তাহলে কি সে সিন্দুকটিকে এতো দিন দরজা ভেবে স্বপ্ন দেখেছিলো। কিন্তু তার স্পষ্ট মনে আছে স্বপ্নে যে দরজাটি তার হাতের স্পর্শে আপনা-আপনি খুলে গিয়েছিলো সেটি একটি ঘরের দরজা৷ আর এটি তো একটি সিন্দুক মাত্র। শুভ্রার এখন খুব ভয় লাগছে।
শুভ্রা ভাবছে,
সে সিন্দুকটি বাস্তবে দেখার আগেই কিভাবে স্বপ্নে দেখেছে। শুভ্রা বুঝতে পারছে এই ঘরের সাথে তার স্বপ্নের একটি যোগসূত্র আছে।
অনেকক্ষণ দরজায় আঘাত করার পরও যখন কেউ দরজা খুলছে না তখন শুভ্রা ধীরে ধীরে বুঝতে পারলো এটি কোনো স্বাভাবিক বাড়ি নয়। নয়তো এতো জোড়ে আওয়াজ করছে তবুও কারো কানে যাচ্ছে না? নিচেই তো শিশির আছে, সেও শুনছে না?
এসব প্যারানরমাল ব্যাপারে তার যদিও বিশ্বাস ছিলো না, তবুও এখন বিশ্বাস করতে হচ্ছে।
মনকে খুব শক্ত করে বিসমিল্লাহ বলে সিন্দুকে হাত দেয়। সে ভেবেছে তার স্পর্শে সিন্দুকটি খুলে যাবে। কিন্তু যখন দেখলো সিন্দুকটি খুলে যায় নি তখন শুভ্রা একটু হাসলো আর নিজের কপালে নিজেই হালকা ভারী দিলো।
এখন সে মনে মনে নিজেকেই বকছে,
তুইও না শুভ্রা। সিন্দুকের ঢাকনা কি তোর সাথে ছুঁয়াছুঁয়ি খেলছে যে তোর স্পর্শে খুলে যাবে? এসব ভাবনা নিয়ে কিভাবে বেঁচে থাকিস তুই?
এবার মনের ভয় আর সংকোচ কাটিয়ে সে সিন্দুকটি সামনে নিয়ে বসলো৷ সিন্দুকে একটি তালা ঝুলানো আছে। তালাটি বেশ পুরোনো হয়ে গেছে। ইট বা ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করলেই ভেঙে যাবে। কিন্তু এভাবে অন্যের জিনিস নষ্ট করার ইচ্ছে তার নেই। হ্যাঁ, তার শুধু ইচ্ছে আছে ভেতরে কি আছে তা দেখার। আর কিছুই করবে না সে। আবার আগের জায়গায় রেখে দেবে দেখা শেষ করে৷
শুভ্রা ভাবছে সিন্দুক যেহেতু এই ঘরে আছে, চাবিটিও এখানেই থাকবে। সে প্রথমে ড্রয়ারে দেখলো, কিন্তু পেলো না। তারপর আলমারী খুলে দেখলো এখানে একটা লকারও আছে। আশেপাশে কাপড়চোপড় সরিয়ে ড্রয়ার খুলে কোথাও চাবি না পেয়ে শুভ্রা ভাবলো হয়তো লকারেই রাখা আছে চাবি। আর লকারের পাসকোর্ড তো তার জানাও নেই।
নিরাশ হয়ে শুভ্রা একটু জোরেই আলমারির দরজা বন্ধ করল। আর সাথে সাথেই ভেতরে কিছু পড়ার শব্দ পেলো। আলমারির ভেতর থেকে হয়তো কিছু পড়ে গেছে। তাই সে আলমারিটি আবার খুলে দেখলো আলমারীর নিচের তাকের উপর কাগজ দিয়ে পেচানো কিছু একটা পড়েছে। শুভ্রা সেটি তুলে আলমারির দরজার আশেপাশে ভালোভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। শেষমেশ আবিস্কার করলো আলমারির দরজায় কয়েকটা গর্ত আছে ছোট ছোট। গর্তের উপর এক একটা কাগজ লাগানো আর সেগুলোর রঙ আলমারির দরজার মতো। এতো নিখুঁতভাবে লাগানো আছে এই কাগজগুলো যে কেউ বুঝতেই পারবে না, আলমারির দরজাতেই কোনো রহস্য থাকতে পারে। এই রহস্য শুধু এই বাড়ির মালিকই জানবে।
গর্তগুলো থেকে সে মোটামুটি চারটা চাবি খুঁজে পেয়েছে। শুভ্রা আলমারী বন্ধ করে চাবিগুলো একসাথে নিয়ে সিন্দুকের কাছে বসলো।
পর পর দুটি চাবি দিয়েও তালা না খুললে শুভ্রা তৃতীয়টি হাতে নিলো। চাবি ঘুরানোর সাথে সাথেই তালা খুলে গেলো। আর তখনই শুভ্রার বুকের ধুকপুকও শুরু হয়ে যায়।
মনে সাহস নিয়ে ধীরে ধীরে সিন্দুকটি খুলল শুভ্রা। ঢাকনাটি খোলার পর শুভ্রা অবাক হয়ে যায়।
এদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে। ধীরে ধীরে অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে বাড়িটি। বৃদ্ধ লোকটি গেইটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। খবরের কাগজে দেখেছিলো, আজ চন্দ্রগ্রহণ।
পেছন থেকে একজন তাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-চাচাজান, তাদের এই বাড়িতে থাকতে বইলা কি ভালা করছো? আজ রাত্তিরে সুবিধা করতে পারবো না তারা।
বৃদ্ধ লোক: কিছু হইবো না। ঝড়-তুফান আইবো-যাইবো, কিন্তু মরবো না। মরার মানুষ মইরা গেছে। এহন মরলে ওই অভিশাপ মরবো। বিদায় হইয়া জাহান্নাম দেখবো চোখে। আমার ভাইজান গো শান্তি দিবার পারলে শান্তিতে মরতে পারুম। তুই যা, ঘরে গিয়ে আল্লাহ আল্লাহ কর। আজ রাত্তিরে সবাই ঘরে তালা দিয়া রাখবো। আর তুই ডর ভয় থুইয়া বেড়াস।
-ও, চাচা। তুমিও চলো না। একা একা ভয় লাগে তো।
বৃদ্ধ লোক: বড়ো হইছস না? এহন কিসের ভয়?
-আব্বা চইলা যাইয়ার পর তুমিই আমার ঘর। তুমি চলো না চাচা।
বৃদ্ধ লোক: আচ্ছা, চল।
যাওয়ার আগে গেইটের মুখে দাঁড়িয়ে লোকটি মুচকি হাসলো। কি বা কাকে দেখে এই হাসি দিয়েছিলো তা সেই ভালো জানবে। আর আজ হয়তো এটাই তার শেষ হাসি ছিলো।
ছোট ভাতিজাকে নিয়ে আর যেতে পারে নি সে ঘরে। গলায় ভয়ংকর যন্ত্রণা অনুভব করলো সে। মনে হচ্ছে কেউ সব শক্তি দিয়ে তার গলা চেপে ধরেছে। মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বেড়িয়ে আসলো তার।
তার ভাতিজা তার হাতটি শক্ত করে ধরে কান্না করছে আর বলছে,
– চাচা, চাচা কি হইলো? এমন করতাছো কেন?
লোকটা ভাতিজাকে কিছু বলার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু আর পারে নি। চাচার মুখের অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। মনে হচ্ছে কেউ থেঁতলে দিচ্ছে ভারী কোনো জিনিস দিয়ে। ছেলেটি ভয়ে হাত ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে গেলো।
একটি অন্ধকার রাত আর সামনে থাকা অভিশপ্ত বাড়িটি আবার সাক্ষী হলো আরেকটি নিষ্পাপের মৃত্যুর।
চন্দ্রগ্রহণটাও ঠিক এইসময় শুরু হয়ে যায়। এই গ্রহণ বাড়ির ভেতরের মানুষগুলোর বেঁচে থাকায় যাতে কোনো গ্রহণ না লাগায় সেই আশায় বৃদ্ধ লোকটি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো।
একটা মানুষ মৃত্যুর সময়ও অন্যের কথা ভাবতে পারে। এটিই হয়তো মনের মায়া, প্রিয়জনের জন্য। এই মায়া মৃত্যুর পরও থেকে যায়। তাই হয়তো শরীরে পচন ধরলেও আত্মায় পচন ধরে না। তাই হয়তো মায়া বেঁচে থাকে চিরকাল।
চলবে–