মন শুধু মন ছুঁয়েছে
তামান্না জেনিফার
পর্ব ৫
__________________
সুস্মিতা বসে আছে চেয়ারে , তার সামনে চারটে চেয়ারে চারজন ছেলে বসে আছে ৷ এই ছেলেদের একজন হলো সোহেল ৷ সুস্মিতা ঘুনাক্ষরেও জানে না এই ভ্যাগাবন্ড ছেলেটাকেই মন দিয়ে বসে আছে আর কিশোরী কন্যা ৷ সুস্মিতা খুব মনোযোগ দিয়ে ছেলেগুলোকে দেখে ৷ এদের বয়স কতই হবে , পঁচিশ থেকে সাতাশ এর মধ্যে হয়তো ৷ এই বয়সে এদের অফিস করার কথা , অথচ এরা তার অফিসে এসেছে চাঁদা কালেক্ট করতে ৷
সুস্মিতা একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলের এসিসটেন্ট হেডমিসট্রেস ৷ এসিসটেন্ট হলেও হেডমিসট্রেসের সকল দায়িত্বই তার পালন করতে হয় ৷ স্কুলটার প্রতিষ্ঠাতার স্ত্রী নামে মাত্র হেডমিসট্রেস ৷ সাঁজগোজ করে স্কুলে আসা ছাড়া আর কোন কাজ তাকে দিয়ে হয় না ৷ তাও যদি নিয়মিত আসতো ! একদিন আসলে আর একমাস তার কোন খবর থাকে না…
কিছুদিন আগে থেকেই স্কুলে এই ছেলেপেলের দল আসছিলো , তাদের দাবীর লিস্টটা অনেক লম্বা ৷ তারা নাকি সমাজের নানা উন্নয়নমূলক কাজ করছে , সেসব কাজের জন্য তাদের অর্থের প্রয়োজন ৷ যেহেতু এটা একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুল , এখানে ছেলে মেয়েরা অনেক টাকা বেতন দিয়ে পড়ে … এখানেও তাই চাঁদা দাবী করাই যায় ৷
সুস্মিতা প্রথমদিনেই না করে দিয়েছে ৷ কোন ধরনের চাঁদা তারা দেবে না , কিন্তু তথাকথিত সমাজসেবী চাঁদাবাজের দলটা পিছু লেগেই আছে ৷ ফলাফল , তারা আবার এসেছে …
সুস্মিতা এসবে ভয় পায় না ৷ দেশে আইন কানুন এখনো আছে , যদিও আইন নাকি আজকাল এদের পকেটেই থাকে… তারপরও একজন শিক্ষক হিসেবে , একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে অন্যায়ের সাথে আপোষ সে করতে পারে না … সুস্মিতা একটু গলা খাঁকাড়ি দিয়ে বলে “আমার ক্লাস আছে ৷ তোমরা এখন যেতে পারো ৷ আমার যা বলার আমি বলে দিয়েছি ৷ ”
সোহেল একটু নড়ে চড়ে বসে ৷ তারপর কুৎসিত একটা হাসি দিয়ে একটা সিগারেট ধরায় …সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়াটা সে ছাড়ে ঠিক সুস্মিতার মুখে ৷ তার কান্ড দেখে বাকীরাও হাসতে শুরু করে ৷
—ম্যাডাম , আপনার কথা তো শেষ , এবার আমার কথা শুরু ৷ ভালোভাবে আপনাকে অনেকবার বলেছি , আপনার মনে হয় ভালো কথা ভালো লাগে না …. যাই হোক , ঘরে নাকি আপনার দুটোই মেয়ে ! ধরেন , হাজার পঞ্চাশেক টাকা দিলে ব্যাপারটা সুন্দরমতো মিটে যেতো …. না দিলে হয়তো পত্রিকায় এলো “মেডিকেল কলেজে পড়া মেধাবী শিক্ষার্থীকে ধর্ষন করে খুন করেছে আততায়ীরা…” বা “স্কুলের পড়ুয়া ষোড়শীর মুখে এসিড নিক্ষেপ করেছে দূর্বৃত্তরা… ”
—তুমি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছো !
—না না ম্যাডাম , ভয় দেখাবো কেন ! কত রকম দূর্ঘটণাই তো ঘটে তাই না বলেন … এমন তো হতেই পারে তাই না !
—মুখ সামলে কথা বলো ৷ আমি তোমাদের সবার নামে মামলা করবো ৷ জেলখানাই তোমাদের প্রাপ্য ঠিকানা
—আরে আরে আরে ! ম্যাডাম দেখি রাগ করতেছেন ৷ রাগ করে তো লাভ নেই ম্যাডাম ৷ এরচেয়ে শান্তভাবে বসেন ৷ চুপচাপ টাকা দেবার ব্যবস্থা করেন , আপনিও আরামে থাকেন আর আমাদেরও থাকতে দেন ৷ পুলিশ আমাদের কিচ্ছু করবে না ম্যাডাম ৷ আর আপনি এত হাইপার হচ্ছেন কেন ? টাকা তো আপনার পকেট থেকে দিতে হবে না ৷ টাকা দিবে স্কুলের মালিক ! এই যে বাচ্চাদের অ আ শিখায়ে লক্ষ লক্ষ টাকা উনি পকেটে ভরতেছে , এর উপর দেশের জনগনের একটা হক আছে না ! টাকাটা নিয়ে আমরা জনগনের কাজেই লাগাবো ৷ বিশেষ ব্যক্তিগত কারনে আপনার সাথে এখনও আপোষে কথা বলছি , আমাকে আমার রূপে আসতে বাধ্য করবেন না ম্যাডাম …
—ইউ স্ক্রাউনডেল !
—ব্যাস ! বহুত হইচে চুদুর বুদুর আলাপ ! কালকের মধ্যে টাকা না পেলে তোর স্কুল পুরা উড়ায়ে দিবো মাস্টারনী ….এই যে পকেটে দেখছিস কি ! এটারে মেশিন বলে … মেশিন বাইর করলে কিন্তু তোর মেশিন আর ঠিক থাকবো না… ঐ তোরা চল , কাইল এর ব্যবস্থা নিমু ৷
সোহেল তার দলবল নিয়ে চলে গেলো ৷ সুস্মিতা একগ্লাস পানি ঢকঢক করে খেয়ে স্কুলের মালিকের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে ৷ তাকে পাওয়া যায় না ফোনে , সপরিবারে তারা কোথাও বেড়াতে গেছে ৷ সুস্মিতা মেইল করে রাখে ৷ তারপর থানার উদ্দেশ্যে বের হয় ৷
***************
অদিতির শরীর এখন বেশ ভালো ৷ আগের মতো জীবন শুরু হয়ে গেছে ৷ স্কুলে গিয়ে একদিন পরীক্ষা দুটোও দিয়ে এলো ৷ কিন্তু ওর মা ওকে সাথে করে নিয়ে গেছে আবার নিয়ে এসেছে ৷ ইদানীং এক মুহূর্তের জন্যেও তাকে একলা ছাড়ে না মা … স্কুলে কিসব নাকি গন্ডোগল হয়েছে , মা আর স্কুলেও যাচ্ছে না ৷ এখন সারাদিন নজরবন্দী হয়ে থাকে অদিতি ৷
কাউকে কি আসলেও নজরবন্দী করে রাখা সম্ভব পুরোপুরি ! সম্ভব না …. দুদিন আগে বাসায় এসেছিলো সোহেল ৷ একটা ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী আর জিন্সে তাকে দেখাচ্ছিলো রাজপুত্রের মতো ৷ সাথে আরো কয়েকজন এসেছিলো ৷ ড্রইংরুমে মায়ের সাথে কতক্ষন মিটিংও করেছে তারা ৷ অদিতি সারাক্ষন পর্দার ফাঁক দিয়ে তাকে দেখেছে ৷ তারা চলে যাবার পর মায়ের ভীষণ মাথাব্যথা শুরু হয়েছিলো , ঘর অন্ধকার করে শুয়ে ছিল মা … ঠিক তখনি আবার কলিংবেল বাজে ৷ অদিতি দৌড়ে যায় দরজা খুলতে …ওর মন যা বলছিলো ঠিক তাই , সোহেল দাঁড়িয়ে আছে দরজায় ৷ অদিতি একবার আশে পাশে দেখে গড়গড় করে বলতে থাকে “আমার অপারেশন হয়েছিলো , হাসপাতালে ছিলাম …চিঠির জবাব তাই দিতে পারিনি …ভুল বুঝবেন না প্লিজ …”
সোহেল একটা খাম অদিতির হাতে দিয়ে মৃদু হাসে … তারপর বলে “তুমি আগের থেকেও বেশি সুন্দর হয়ে গেছো অদিতি …. শুক্রবার রাতে আমি আসবো , তোমাদের ছাদে থাকবো ৷ সবাই ঘুমালে তুমি এসো , অনেক কথা জমে আছে ৷ এই খামটা আন্টিকে দিও , অফিসিয়াল কাগজ ….”
অদিতি জানলোও না ঐ খামে ছিলো তার মাকে বরখাস্ত করার নোটিশ ! যে স্কুলে তিনি তার পুরো মেধা উজার করে দিয়েছেন , সেই স্কুল কর্তপক্ষ তাকে বরখাস্ত করেছে ….
স্কুলের মালিক সেদিন মেইল পাবার পরই বলে দিয়েছেন টাকা দিয়ে দিতে ৷ রাঘব বোয়ালের সাথে ঝামেলায় যেতে চান না তিনি ৷ সুস্মিতা সেদিন থানায় জিডিও করতে পারেনি ৷ অফিসার বলেছে তারা বিষয়টা দেখবে কিন্তু জিডি এন্ট্রিও করেনি ৷
কর্তৃপক্ষের চাপে বাধ্য হয়ে সুস্মিতা তাদের সেদিন টাকা দিয়েছে নিজের বাসায় ৷ তখনি ভেবেও নিয়েছে এই চাকুরি সে ছেড়ে দিবে, কিন্তু রিজাইন দেবার আগেই বরখাস্তের নোটিশ পেয়ে গেলো সুস্মিতা… সেদিন সুস্মিতা ভীষণ কেঁদেছে অপমানে , অপমানের মত তীব্র দহন আর কিছুতে নেই ….অদিতি মায়ের সে কান্না দেখেছে কিন্তু মায়ের কান্নাকে ছাপিয়ে তার মাথায় শুধু শুক্রবার রাতে কি হবে এটাই ঘুরছে !
ভুল বয়সের ভুল প্রেম অদিতিকে স্বার্থপর করে দিয়েছে ,বোধশূন্য করে দিয়েছে , বিবেকহীন করে দিয়েছে… অদিতির মননে মস্তিষ্কে শুধু সোহেলের রাজত্ব , সেই সোহেল যে তার মায়ের এতদিনের পরিশ্রমে গড়া স্কুল থেকে তাড়ানোর জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী …
অদিতি সেসব জানে না এটা যেমন সত্য , জানার চেষ্টাও করেনি এটা যেন তার চেয়েও বড় সত্য…
চলবে…