মন শুধু মন ছুঁয়েছে, পর্ব:২

0
568

মন শুধু মন ছুঁয়েছে
তামান্না জেনিফার
পর্ব ২
__________________

সকাল থেকেই পেটে ব্যথা হচ্ছে অদিতির ৷ দশটা থেকে পরীক্ষা ৷ অদিতি ভেবেছিলো ব্যথাটা ঠিক হয়ে যাবে , তাই গুরুত্ব দেয়নি ৷ গোসল করে এসে স্কুল ড্রেস পরে ফেললো ৷ ব্যথাটা তখন আরো বেড়েছে ৷ হাতঘড়িতে সময় দেখে নিলো অদিতি , নয়টা পনেরো বাজে , এবার বের হতে হবে ৷ বের হতে গিয়েও আবার বিছানায় বসে পড়লো অদিতি ৷ ব্যথাটা আর সহ্য করা যাচ্ছে না ৷ বাসায় কাজের লোক ছাড়া কেউ নেই , মা চলে গেছে স্কুলে আর বাবা ব্যাংকে ৷ বোনটা তো হোস্টেলে থাকে ৷ অদিতি আবার উঠে স্কুলে যাবার চেষ্টা করে , কিন্তু আর সহ্য করতে না পেরে মাটিতে পড়ে যায় ৷ আর চিৎকার করতে থাকে ৷

রহিমা রান্নাঘরে কাজ করছিলো , অদিতিদের বাড়িতে দীর্ঘদিন কাজ করছে সে ৷ অদিতির চিৎকার শুনে ঘরে গিয়ে দেখে মেয়েটা মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে ! এক মুহুর্তের জন্য রহিমা বুঝে উঠতে পারে না কি করবে … তার মাথা কাজ করছিল না ৷ সে অদিতিকে রেখে প্রথমেই যায় পাশের বাসায় ৷ সেখানে গিয়ে অদিতির অবস্থার কথা বলে তাদের অদিতির কাছে যেতে বলে নিজে দৌড় দেয় অদিতির মায়ের স্কুলের দিকে ৷ বাড়ি থেকে স্কুল বেশি দূর না ৷ দুই মিনিটেই পৌছে যায় সেখানে রহিমা ৷ সুস্মিতাকে খুঁজে পেতে তার সময় লাগে ৷ ক্লাস চলছে , কোন ক্লাসে যে তার আপা আছে সে জানে না , কাকে জিজ্ঞেস করবে তাও বুঝে উঠতে পারে না … অবশেষে স্কুলের একজন ছাত্রীকে জিজ্ঞেস করতে সে দেখিয়ে দেয় সুস্মিতা ম্যাডাম কোন ক্লাসে আছে !

মেয়ের অবস্থা শুনে সুস্মিতা এক মুহূর্তও দেরী করে না , তার একজন কলিগকে বলে সাথে সাথেই বাড়ির দিকে দৌড় দেয় ৷

ততক্ষনে অদিতি অজ্ঞান হয়ে গেছে , পাশের বাড়ির একরাম সাহেব এম্বুলেন্স কল করেছে আর তার বউ অদিতির মাথায় পানি ঢালছে …

এম্বুলেন্সে অদিতিকে শুইয়ে দিয়ে টাকা নিতে আবার ঘরে আসে সুস্মিতা ৷ ঘরে ঢুকে তার মনে হয় অদিতির দুটো কাপড় নেওয়া দরকার , গায়ের জামাটা পানিতে ভেজা…. অদিতির ঘরে ঢুকতেই পায়ের সাথে কিছু একটা লেগে ব্যথা পান সুস্মিতা , খেয়াল করে দেখেন অদিতির জ্যামিতি বক্স ৷ পায়ের সাথে বাড়ি লেগে বক্সটা খুলে গেছে , সেই খোলা বক্সের ভেতরে একটা সাদা কাগজ ৷ সুস্মিতা সেই কাগজটা হাতে নেন ৷ কাগজে কি লেখা পড়ার সময় এখন তার নেই , কাগজটা ব্যাগে রেখে দ্রুত অদিতির কাপড় নিয়ে এম্বুলেন্সে উঠে বসলেন ৷ সাথে আসলো পাশের বাসার একরাম সাহেব ৷ ততক্ষনে অদিতির বাবাকেও খবর দেওয়া হয়েছে ৷

হাসপাতালে পৌছাবার সাথে সাথেই যেন একটা হুলস্থুল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়ে গেলো ৷ দ্রুত একজন ডাক্তার চলে আসলেন অদিতিকে দেখার জন্য ৷

ডাক্তার দেখলেন বাচ্চা একটা মেয়ে নিথর হয়ে শুয়ে আছে ৷ মুখটা কাগজের মতো সাদা , যেন একবিন্দু রক্ত নেই ওর শরীরে ৷ ঘোলা চোখে কি যেন দেখছে ৷ ডাক্তার অদিতির পালস দেখার জন্য হাত তুলে নিলেন। তন্নতন্ন করেও পালস পেলেন না তিনি। তার মুখে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। পেটে হাত রাখতেই মেয়েটা চিৎকার করে উঠলো ৷ পেটটা শক্ত হয়ে আছে ৷ অভিজ্ঞতায় তিনি বুঝলেন সমস্যাটা কি ৷ তিনি চিৎকার করে বললেন, “সিস্টার, পেশেন্ট শকে আছে! দ্রুত স্যালাইন দিতে হবে! এক্ষুণি চ্যানেল ওপেন করেন!”

সুস্মিতা আকুল হয়ে কাঁদছে , এখনও তার স্বামী এসে পৌছায়নি ৷ তার ভীষণ ভয় হচ্ছে , সকালেও মেয়েটাকে সুস্থ দেখে গিয়েছিলেন তিনি , এখন হঠাৎ কি হলো ৷ ডাক্তারকে এই প্রশ্নটা করার শক্তিও তার মধ্যে নেই …. প্রশ্ন করলেন একরাম সাহেব

—ডাক্তার সাহেব সমস্যাটা কি ?

—যতটুকু বুঝছি , সম্ভবত এপেনডিক্স বার্স্ট করেছে ৷ আমি টেষ্ট লিখে দিয়েছি কতগুলো ৷ আপনাদের একজন একটু নিচে গিয়ে রিসেপশনে দেখান ৷ আমি সব লিখে দিয়েছি ওরা দ্রুত ব্যবস্থা করবে ৷

—স্যার , অপারেশন লাগবে ?

—হুমম , অপারেশন লাগবে ৷ মেয়েটার ব্লাডগ্রুপ জানেন ? রক্তের ব্যবস্থা করে ফেলেন ৷

একরাম সাহেব সুস্মিতার দিকে তাঁকালেন ,সুস্মিতা বললো “বি পজিটিভ” , ওর বাবাই ডোনেট করতে পারবে , সে দশ মিনিটের মধ্যেই পৌছাবে..

*****

অপারেশন থিয়েটারের বাইরে বসে আছে সুস্মিতা , অলিউর রহমান আর একরাম সাহেব ৷ সুস্মিতা এখন আর কাঁদছে না , স্বামীর কাঁধে মাথা রেখে চুপচাপ শুয়ে আছে ৷ অদিতির এপেনডিক্স বার্স্ট করেছে , মেয়েটা কিছুদিন ধরেই পেট ব্যথা করে বলছিলো ৷ সুস্মিতা ভেবেছে পরীক্ষা চলে তাই বাহানা দিচ্ছে না পড়ার ! মেয়ের ব্যথাকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দেননি তিনি ৷

এর মধ্যেই একজন নার্স এসে একটা বিল ধরিয়ে দিয়ে বলে টেষ্টের বিলগুলো সাথে সাথে পেমেন্ট করে দিতে হয় ৷ অলিউর রহমান স্ত্রীর দিকে হাত বাড়ালেন টাকার জন্য ৷ সুস্মিতা ব্যাগ থেকে টাকা বের করতে গিয়ে আবার কাগজটা ফেলে দিলো ৷ কাগজটা এবার সে আর ব্যাগে না রেখে হাতেই রাখলো ৷ অলিউর রহমান নার্সের সাথে চলে গেলেন বিল পরিশোধ করতে , একরাম সাহেবও সাথে গেলেন ৷ এই হাসপাতালের মালিক তার বন্ধুর বড়ভাই , এই পরিচয়ে যদি কিছু টাকা কমানো যায় আর কি !

সুস্মিতা কাগজটা খুলে ফেললেন , ছোট্ট একটা লাইন সেখানে লেখা ! মাত্র তিনটা শব্দ ! কিন্তু সেই তিনটা শব্দ পড়ে তার মাথা পুরো ঘুরে গেলো ! তার বাচ্চা মেয়েটা যে কি না এখন অপারেশন থিয়েটারে শুয়ে আছে , সে কাউকে লিখেছে ভালোবাসি ! মাত্র তিন মাস আগে তার পনেরো বছর শেষ হলো , এই মেয়ে কাউকে লিখেছে ভালোবাসি ! সুস্মিতার পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে যায় …

অপারেশন শেষ হয় ভালোভাবেই , এখনো জ্ঞান ফেরেনি ৷ মেয়েটা পোষ্ট অপারেটিভে আছে , সেখানে কারো যাবার অনুমতি নেই ৷ সুস্মিতা দূর থেকে দেখছে , কাছে যেতে পারছে না , ছুঁতে পারছে না ! এ এক অসহ্য কঠিন সময় ..

*********

সোহেল স্কুলের দেয়ালে হেলান দিয়ে সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে , একটার পর একটা ৷ আলিম গুনছে , এটা ছাপ্পান্ন নাম্বার সিগারেট খাচ্ছে তার ওস্তাদ ৷ সেই সকালে এসে স্কুলের পাশে দাঁড়িয়েছে , এরপর সন্ধ্যা হয়ে এলো মানুষটা এখান থেকে নড়েনি ৷ সারাদিন সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়া আর কিছু খায়নি ৷ আলিম অনেকবার বলেছে , ওস্তাদ চলেন , আজকে মনে হয় ভাবি আসবে না ৷ সোহেল কোন উত্তর দেয়নি , কিন্তু সেখান থেকে এক পা ও নড়েনি ৷

অদিতির পরীক্ষা চলছে যেহেতু , তার মানে অদিতি অবশ্যই এসেছিলো স্কুলে ৷ কিন্তু খুব সাবধানে তাকে আড়াল করে চলে গেছে ৷ এতই সুক্ষভাবে যে সোহেলের অনুসন্ধানী চোখকে সে ফাঁকি দিয়েছে ৷ সোহেলের এখন ভীষণ রাগ হচ্ছে ৷ মনে হচ্ছে অদিতিকে হাতের কাছে পেলে সে প্রথমেই কষে একটা থাপ্পর লাগাতো , মেয়েটা অতি ধুরন্ধর ৷ এতদিন এমন ভাব করছে যেন সে ও সোহেলকে পছন্দ করে , আর আজকে চিঠি পড়ে তাকে এড়িয়ে চলে গেলো !

সাতান্ন নাম্বার সিগারেটটা ধরিয়ে সোহেল সোজা সামনের দিকে হাঁটা দেয় , নদীর পাড়ে যাবে সে ৷ আলিম তার পিছু পিছু রীতিমত ছুটছে , এতই জোরে হাঁটছে সোহেল !

নদীর পাড়ে বসে আলিমের দিকে তাঁকিয়ে সোহেলে বলে “বানা” , আলিম একবার ভাবে সোহেলকে বলবে “ওস্তাদ আগে কিছু খায়া নেন…তারপর এইসব , সারাদিন না খাওয়া আপনি” .. আলিম কিছু না বলে খুব দক্ষতার সাথে হাত একটু আড়াল করে সিগারেটের ভেতরের তামাকগুলো ফেলে দেয় , তারপর আবার তারমধ্যে গাজা ভরে সোহেলের হাতে দেয় ৷ সোহেল সেটা হাতে নিয়ে লম্বা টান দেয় ৷ নদী পাড়ে এই দিকটায় কেউ আসে না ৷ জায়গাটা ভীষণ নীরব ৷ পরপর তিন চারটা টান দিয়ে সোহেল সিগারেটটা আলিমের হাতে দেয় ৷ আলিম মুখটা আড়ালে নিয়ে দুটা টান দেয় ৷ দুই টান দিতেই তার পেটের ভেতর মোচর দিয়ে উঠে, মনে হয় বমি হয়ে যাবে ৷ আজ সারাদিন তারও কিছু খাওয়া হয়নি এই কথাটা তার এখন মনে পড়লো …

নদী পাড়ের ব্লকের উপর শুয়ে আছে সোহেল আর আলিম ৷ আকাশ ভরা তারা , মিটমিট করে জ্বলছে … সোহেল কিছুক্ষন পরপর তারার দিকে আঙ্গুল তুলে কি যেন বিরবির করছে .. আলিম অবাক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে “ওস্তাদ , তারা গুনতাছেন ? ”

সোহেল খানিকক্ষন অপ্রকৃতস্থের মতো হাসে সেই কথা শুনে ৷ তারপর বলে ” মাস্টারনীর মাইয়্যাটারে সাইজ করার প্লান করতেছি… আমার ভালোবাসার দাম দিলো না , এত ভালোবাসছিলাম বুঝলোই না …এইবার ওরে ওর মতো কইরা বুঝামু …ঐ আসমানে পাঠাই দিমু … ঐখানে গিয়া দেমাগ দেখায় কেমনে মাস্টারনীর মাইয়্যা এইটাই দেখমু !…”

আবার পাশবিক হাসি হাসতে থাকে সোহেল , অপ্রকৃতস্থের মতো হাসি …আলিমের মাথায় কিছুই ঢোকেনি সোহেল কি বলেছে , তার মাথার ভিতরে কেমন যেন নদীর ঢেউয়ের মতো ঢেউ হচ্ছে … ছোটবেলায় কলাগাছের ভেলায় শুয়ে থাকলে যেমন একটা ঢেউ পুরো শরীরে দোলা দিয়ে যেতো ঠিক সেই রকম একটা ঢেউ…

আলিমের ভালো লাগছে ! কি হচ্ছে হোক ! এই মুহূর্তে আলিম তার শৈশবে , তার জীবনের সবচেয়ে ভালো সময়টায়…

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here