মন শুধু মন ছুঁয়েছে, পর্ব:১

0
1177

মন শুধু মন ছুঁয়েছে
তামান্না জেনিফার
পর্ব ১
_______________________

বইয়ের ভাজে থাঁকা চিঠিটাকে আবার লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে অদিতি ৷ মায়ের ভয়ে জীবনে প্রথম পাওয়া প্রেমপত্রটা এখনো খুলে দেখার সাহস হচ্ছে না ৷ বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে , আগামীকাল অংক পরীক্ষা ৷ একটা অংক মাথায় ঢুকছে না তার ৷ যদি কোনভাবে অংক পরীক্ষা খারাপ হয় মা যে তাকে কুরবানি দিয়ে দেবে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই ৷ কিন্তু মাথা থেকে চিঠির ব্যাপারটা বের হচ্ছে না .. আবার স্কুলে যাবার রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে থাকবে সোহেল ভাই ৷ বলেছে কাল জবাব নিয়ে যেতে ! কি জবাব দিবে সে , চিঠিটাই তো পড়তে পারলো না !

অদিতি ক্লাস নাইনে পড়ে , বাবা অলিউর রহমান ব্যাংকার আর মা সুস্মিতা রহমান স্কুল শিক্ষিকা ৷ অদিতির বড় বোন অহনা মেডিকেল কলেজের ছাত্রী ৷ চারজনের ছোট্ট পরিবার ৷

যে ছেলেটির চিঠি অহনা বইয়ের ভাজে লুকিয়ে রেখেছে , তার নাম সোহেল ৷ বাবা মারা গেছে , ভাইয়ের সংসারে অবহেলিত ভাবে থাকে সোহেল আর তার মা ৷ সোহেল বাড়ি তেমন যায় না , পার্টি করে , এলাকার ছেলেপেলের সাথে আড্ডা দেয় , নেশাপানি খায় মাঝে মধ্যে আর ঘুমায় একটা রিকশার গ্যারেজে ৷ গ্যারেজের মালিক তার বন্ধু ৷ বাড়ি ফিরে ভাবীর মুখ ঝামটা খাবার চেয়ে রিকশার গ্যারেজের একপাশে থাকা একটা শক্ত চৌকি তার কাছে বেশি আরামদায়ক ৷ সোহেলের বড়ভাই রুবেল গার্মেন্টস এ কাজ করে ৷ খুব কষ্ট করেই সংসারটা চালাচ্ছে ৷ এত বড় একটা ছেলে কোন কাজ না করে ধেই ধেই করে বেড়ালে তাকে ভালোবাসার মতো কিছু নেই , এই সত্যটা সোহেল বোঝে ৷ ভাইয়ের উপর তাই তার কোন রাগ নেই ৷

কিছু করে না ব্যাপারটা ঠিক এমন না ৷ সে চাইলেই ভাইয়ের মত গার্মেন্টস এ ওয়ার্কার হিসেবে চাকরি করতে পারে না , এলাকায় তার একটা সম্মান আছে ৷ পার্টি অফিসে তার নিত্য যাতায়াত ৷ আর ভালো চাকরি পাবার জন্য দরকার শিক্ষাগত যোগ্যতা , সেটাও তার নেই ৷ দুইবার ইন্টার পরীক্ষা দিয়েও পাশ করতে পারেনি ৷ তার ভাই তাকে আর পড়াতে নারাজ , আর তারও পড়তে ইচ্ছে হয়নি ৷ পড়ালেখার পাট তাই ওখানেই চুকেছে ৷

সোহেল গ্যারেজে শুয়ে শুয়ে সিগারেট খাচ্ছিলো ৷ তার পায়ের কাছে বসে আছে আলিম , এই ছেলেটা সোহেলের সাগরেদ ৷ সারাদিন সোহেলের সাথে সাথে ঘোরে , রাতে সোহেল ঘুমিয়ে গেলে তারপর চলে যায় , বেশি রাত হয়ে গেলে এখানেই মাটির উপর মাদুর বিছিয়ে শুয়ে পড়ে ৷

—আলিম

—জি ভাই

—আজকে এত মশা কই থেকে আসছেরে , দেখতো কয়েল পাস নাকি আশেপাশে

—জি ভাই দেখতাছি

—বস , পরে দেখিস

—জি ভাই

—মাস্টারনীর বেটির হাবভাব কি মনে হয় ? জবাব কি দিবো মনে হয় ?

—হ্যাঁ কইবো ভাই , আপনে যারে ভালোবাসছেন হ্যায় আপনেরে ভালো না বাইসা থাকতে পারবো না , আপনের মত মানুষ মাস্টারনীর বেটি পাইবো কই ?

—তুই আমারে ভালোবাসিস এই জন্য এই কথা কইলি

—ভাই , আপনে মিলায়া নিয়েন , ভাবি হ্যাঁ ই কইবো !

—আচ্ছা যা কয়েল ধরা , না থাকলে মফিজের দোকানে গিয়া দুইটা লাথ্থি দিবি , দোকান খুললে কয়েলের সাথে এক প্যাকেট সিগারেট আনিস ৷

—জি ভাই

আলিম চলে গেলে সোহেল অদিতির চিন্তায় ডুবে যায় ৷ এই মেয়েটা যতবার তার সামনে দিয়ে যায় তার বুকের মধ্যে মোচর দিয়ে উঠে ৷ মেয়েটাও আঁড়চোখে তার দিকে দেখে , সেই চাহনি দেখে তার মনে হয় অদিতিও তাকে ভালোবাসে ৷ কিন্তু ভয়ও লাগে ৷ যে সোহেলকে এলাকার সবাই মোটামুটি ভয় পায় সেই সোহেল ক্লাস নাইনে পড়া এক বাচ্চা মেয়ের সামনে দাঁড়াতে ভয় পায় ! যে চিঠিটা সে অদিতিকে দিয়েছে , ওকে দেবার আগে অন্তত এক মাস বুক পকেটে নিয়ে ঘুরেছে ৷ দেবার সাহস পায়নি ৷ অবশ্য সোহেলের ধারনা অদিতি যদি চিঠিটা মন দিয়ে পড়ে তাহলে না করার কোন সম্ভাবনাই নাই ৷ চিঠিটা নিয়ে তার আত্মবিশ্বাস অনেক কারন চিঠিটা সে লিখিয়ে নিয়েছে তার বন্ধু তুরাগের কাছ থেকে ৷ তুরাগ আর সে স্কুল কলেজে এক সাথেই পড়েছে ৷ তুরাগ ভালো ছাত্র ছিল , লেখাপড়ায় মনোযোগী ছিল , সে তড়তড় করে উপরের দিকে উঠে গেছে ৷ এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে , অনার্স শেষ বর্ষে ৷ এত বুদ্ধিমান একটা ছেলে যে চিঠি লিখেছে সে চিঠি পড়ে যেকোন মেয়ে বুদ্ধিমান হলে সাড়া দেবার কথা ৷ চিঠিটা অদিতির হাতে দেবার আগে অসংখ্যবার পড়েছে সোহেল ৷ যতবার পড়েছে তার চোখ ভিজে গেছে ৷ এত দরদ দিয়ে লেখা চিঠিটা … চাইলে সে অদিতিকে যেকোন সময় তুলে আনতে পারে , কোন অসুবিধাই হবে না ৷ কিন্তু সোহেল এই দুরন্ত মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেছে ৷ এই মেয়েকে সে তুলে আনতে চায় না , সে চায় মেয়েটি তার ভালোবাসা বুঝুক…

অদিতির মা এসেছিলো একটু আগে অদিতির রুমে ৷ অংকগুলো সব করা হয়েছে কি না খোঁজ নিয়ে গেছে ৷ অদিতি মিথ্যা কথা বলেছে যে তার সব অংক করা শেষ ৷ এদিকে তার ভেতরে শুধু একটাই চিন্তা কি লেখা আছে ঐ চিঠিতে ! সোহেল ছেলেটাকে তার বেশ ভালো লাগে ৷ যেদিন থেকে সোহেল ছেলেটা তার স্কুলের সামনে দাঁড়ানো শুরু করেছে সেদিন থেকে পাড়ার বখাটে ছেলেগুলো তাকে আর ডিস্টার্ব করে না ৷ নয়তো আগে স্কুল যাওয়া আসার পথে একদল ছেলে তাকে খুব জ্বালাতন করতো ৷ সোহেল ভাই ঐসব বখাটে গুলোর মতো না , তাকে দেখলে কখনো শীষ দেয় না বা ভুলভাল উচ্চারনে হিন্দী গান গায় না .. মাঝে মধ্যে অদিতিকে জিজ্ঞেস করে পড়াশোনা কেমন হচ্ছে ,কোন অসুবিধা হচ্ছে কি না ! অদিতি তার গলার স্বর শুনেই কেমন যেন ভেতর থেকে কেঁপে উঠে ! এত দুরন্ত মেয়েটা তার সামনে এলেই কেমন যেন শান্ত হয়ে যায় … সে মাথা নিচু করে বলে পড়াশোনা ভালো হচ্ছে , কোন অসুবিধা হচ্ছে না …তখন সোহেল ভাই একটা হাসি দেয় , সেই হাসিতে অদিতির হৃদয়ে যেন বুলডোজার চলে ! অদিতি তার সামনেও থাকতে পারে না , তার কাছ থেকে দূরেও যেতে পারে না ! এই ছেলেটা তাকে একটা চিঠি দিয়েছে , অথচ অদিতি সে চিঠিটা এখনও পড়তে পারলো না ! অদিতির নিজের উপর ভীষণ রাগ হয় …

অবশেষে বাড়িটার সব গুলো লাইট নিভে যায় ৷ অদিতি তখন ধীরে ধীরে উঠে বইয়ের ভেতর থেকে চিঠিটা বের করে বাথরুমে নিয়ে যায় … বাথরুমে আলো জ্বালিয়ে সে পড়তে শুরু করে তার জীবনের প্রথম চিঠি , যা তাকে কেউ ভালোবেসে দিয়েছে..

প্রিয় চাঁদমুখ ,
কি নামে ডাকবো তোমাকে আমি ভেবেই পাচ্ছি না ৷ কি নামে ডাকলে তোমাকে সঠিক ভাবে ডাকা হবে বলোতো ? লক্ষী সোনা বলবো ? হৃদয়ের রাণী বলবো ? কি বলবো তোমাকে বুঝে উঠতেই আমার দিন সাতেক চলে গেলো ৷ অনেক ভেবে দেখলাম তুমি যা , তোমাকে তাই বলি ৷ তাই বললাম প্রিয় চাঁদমুখ ৷ অবশ্য এতেও কম বলা হলো ! চাঁদের গায়েও তো দাগ আছে , কিন্তু তুমি এতই সুন্দর তোমার গায়ে কোন দাগ নেই …আমি যতবার তোমাকে দেখি আমার হৃদস্পন্দন থেমে যায় , আমার মনে হয় আমি মরে যাচ্ছি ! বুকের মধ্যে কেমন যেন ব্যথা হয় ! মনে হয় রবীন্দ্রনাথ এই ব্যথাকেই সুখের মত ব্যথা বলেছে …

তোমাকে আমার অক্সিজেন মনে হয় ৷ তুমি আশে পাশে না থাকলে আমি যেন অক্সিজেনের অভাবে ভুগি ৷ তুমি পাশে থাকলে আশেপাশে আমি আর কিছুই দেখতে পাই না ! আমার চোখে সারাক্ষন তুমি শুধুই তুমি ৷

রোজ রাত্রে যখন ঘুমাতে যাই , চোখ বন্ধ করলেই তোমার মুখটা আমার চোখের সামনে চলে আসে ৷ সেই তুমিটা ভীষণ দুষ্টু , আমাকে কতকিছু যে বলো ! আমি মুগ্ধ হয়ে তোমাকে দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ি ৷ আবার তোমাকে দেখবো এই আশায় দিন কাটাই ৷

শুক্রবারটা আমার অসহ্য লাগে জানো ! কারন শুক্রবারে একটা মুহূর্তের জন্যেও তুমি বাইরে আসো না ! আমি তোমাকে দেখতে পাই না !

তোমাকে না দেখলে আমার ভীষণ কষ্ট হয় ৷ আমি কোনদিন আপনজনের স্নেহ ভালোবাসা পাইনি ৷ তবে তোমার ভালোবাসা পেলে আমি বদলে যাবো ৷ যেন তোমার বাবা মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে তোমাকে চেয়ে নিতে পারি এতটা যোগ্য হবার চেষ্টা করবো ৷

তুমি আমাকে ভালোবাসবে না অদিতি ?
আমায় একটু সুযোগ দেবে যোগ্য হয়ে উঠার ?

বলো ? ভালোবাসবে না আমাকে ?

তোমার উত্তর আমাকে জানাবে ৷ তোমার উত্তর না হলে হয়তো আমার চলন্ত ট্রেনের সামনে দাঁড়ানো ছাড়া উপায় থাকবে না , তবুও আমি তোমাকে জোর করবো না ৷ আমি তোমাকে পাগলের মত ভালোবাসি বলেই যে তোমারও আমাকে ভালোবাসতে হবে এমন কোন কথা নেই ৷

তবুও একটাবার একটু চেষ্টা করে দেখবে ?

ভালোবাসবে তো আমাকে অদিতি ?

বলো বাসবে ?

ইতি
তোমার পথ চেয়ে থাকা এক অশান্ত হৃদয়

অদিতি কয়েকবার করে চিঠিটা পড়ে ৷ তার দুচোখ বেয়ে জল পড়ছে ৷ একটা মানুষ তার মত একটা সামন্য মেয়েকে এত ভালোবাসে ! অদিতি বাথরুমেই চিঠিটা ফেলে দেয় কমোডের ভিতর ৷ এই চিঠি মায়ের হাতে পড়লে সব শেষ হয়ে যাবে , এই রিস্ক নেওয়া যাবে না …

তারপর ঘরে ফিরে অংক খাতার শেষ পৃষ্ঠাটা ছিঁড়ে সেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখে

“ভালোবাসি , অনেক , অনেক…”

এত বড় চিঠির উত্তরে অদিতি এক লাইনের বেশি কিছুই লিখতে পারলো না ৷ কাগজের টুকরোটা অদিতি জ্যামিতি বক্সে ঢুকিয়ে শুয়ে পড়লো ৷

কিন্তু তার ঘুম এলো না !

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here