মন শহরে তোর আগমন পর্ব – বোনাস_পর্ব

0
1087

#মন_শহরে_তোর_আগমন
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#বোনাস_পর্ব

নাতাশা পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখতে চাইলো, আমিও আর আপত্তি করলাম না। সবশেষে আমাদের রুমে নিয়ে এলাম নাতাশাকে। এই রুমে ঢুকেই এদিক ওদিক কি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলো মেয়েটা

“এটা সত্যিই তোমাদের রুম?

“হুমম। কেনো?”

“না মানে, জাফরানের রুমে সবসময় ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট কালারের জিনিস থাকতো। কার্টন, বেডশিট সব। কিন্তু এখন তো দেখছি কালারফুল জিনিস”

“ঠিকই বলেছেন। আগে তেমনি ছিলো কিন্তু আমার ওইসব কালার ভালো লাগেনা তাই বদলে দিয়েছি। জাফরান ও কোনো আপত্তি করেনি”

নাতাশা কিছুটা অসন্তুষ্ট হলো। জাফরানের সাথে দু বছরের সম্পর্ক থাকা সত্বেও ওকে একটুও বদলাতে পারেনি ও, সেখানে মাত্র অল্পকিছুদিনের বিয়ে করা বউ এসে জাফরানের পছন্দ বদলে দিয়েছে? মানতে পারছে না নাতাশা!

“ওহ! সময়ের সাথে জাফরানের টেস্ট ও বদলে গেছে হয়তো। এনিওয়ে রুমে কোনো ওয়েডিং ফটো দেখছি না যে”

নাতাশার প্রশ্নে মনে পড়ে গেলো আমাদের বিয়ের দিনের কথা, বিয়েটা তো হয়েছিলো একরকম দায়সারা ভাবে। না ছিলো কোনো আনন্দ না ছিলো নিজের সম্মতি! সেখানে দুজনের বিয়ের ছবি থাকাটা তো বিলাসিতা সম। কিয়ৎক্ষণ ভেবে মুচকি হেসে বললাম

“সবকিছু কি ফ্রেমবন্দি করার দরকার পরে? কিছু স্মৃতি এমন থাকে যা মনের মধ্যে এমনভাবে সেটে যায় যে যখন ইচ্ছে চোখ বন্ধ করেই অনুভব করার যায়। আমাদের বিয়ের ব্যাপারটাও তেমন”

নাতাশা ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো আমার দিকে, অদ্ভুত এক চাহনি। রাগ না ক্ষোভ বুঝলাম না তবে আমার উত্তরে যে সে খুশি হয়নি এইটুকু নিশ্চিত

“খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারো দেখছি তুমি। জাফরানকে এভাবেই ইমপ্রেসড করেছো বুঝি?”

“মানে?”

“না মানে, জাফরান গুছিয়ে কথা বলা পছন্দ করে। মানুষটাই তো পুরো গোছানো স্বভাবের, তুমিও সুন্দর কথা বলো। মে বি তোমরা দুজনই একে অপরের জন্যে পারফেক্ট”

“পারফেক্ট কিনা জানিনা, তবে জাফরানের উপযোগী হবার পুরো চেষ্টা করছি”

“জাফরানের মনের মতো হওয়া অতো সহজ না, আমি দু বছর ট্রাই করেও পারিনি। অ্যাডজাস্ট করতে পারছিলাম না আমরা দুজনে, তাইতো ব্রেকআপ হয়ে গেছিলো আমাদের”

“একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে চাইলে অ্যাডজাস্টমেন্ট করতেই হয়। আপনাদের সম্পর্কে সেটার কমতি ছিলো তাই আজ আপনারা আলাদা হয়ে গেছেন। আলহামদুলিল্লাহ আমাদের মধ্যে সেটার কমতি নেই”

“বেশ কনফিডেন্স আছে দেখছি তোমার, নিজের আর জাফরানের সম্পর্কের ওপর এতো ভরসা?”

“ভরসা আর বিশ্বাস দুটোই আমাদের একে অপরের প্রতি আছে। যেখানে ভরসা বিশ্বাস থাকে সেখানে কনফিডেন্স ও আপনা আপনি এসে যায়! যাই হোক আসুন, দুপুরের লাঞ্চ করে যাবেন আজ”

মাথা নাড়লো নাতাশা, যদিও খাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। ইচ্ছে করছে এখনি সুরভীকে এখান থেকে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দিতে, সেটাও তো পারবে না। সুরভী কিচেনে দাড়িয়ে খাবার গরম করছিলো, নাতাশাও ওর সাথে দাড়িয়ে টুকটাক কথা বলছিলো। সুরভীর সামনে যথেষ্ট ভালো থাকার নাটক করে যাচ্ছে ও, কিন্তু এই ভালো আচরণের পেছনের উদ্দেশ্য তো অন্য!

“আপনি গিয়ে বসুন না, আমি এগুলো নিয়ে আসছি”

“ইটস ওকে! আমি একা একা ওখানে বসে কি করবো? এখানেই থাকি তোমার সাথে। আচ্ছা জাফরান কি দুপুরে খেতে আসে বাড়িতে?”

“যেদিন আসেন সেদিন আগেই বলে যান। অবশ্য দুপুরে খুব কমই বাড়ি আসেন উনি”

নাতাশা কিছু বললো না। আমি খাবার গরম করে নিয়ে একে একে টেবিলে রেখে আসলাম। এদিকে সুরভীকে যতো দেখছে ততই নাতাশার মাথায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠছে! রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ও নিজের ভ্যানিটি ব্যাগে কিছু খুঁজতে শুরু করলো, আর ছোটো একটা গ্লিসারিনের বোতল পেয়ে গেলো। সুরভীর দৃষ্টির অগোচরে রান্নাঘরের সামনের ফ্লোরে বোতল আস্তে আস্তে ঢালতে শুরু করলো ও। আজ নিজের চোখেই সুরভীর যন্ত্রণা দেখার লোভ জেগেছে নাতাশার মনে। আনমনে কাজ করে যাচ্ছিলো সুরভী, নাতাশা এসে ততক্ষণে চেয়ারে বসে পড়েছে। ঠোঁটের কোণে শয়তানি হাসিটা চিলতে ফুটে উঠেছে। রান্নাঘরের দরজার সামনাসামনি আসতেই পায়ের নিচে পিচ্ছিল কিছুর আভাস পেলাম। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পা স্লিপ করে দরজার কোণে মাথায় বাড়ি খেলাম। সঙ্গে সঙ্গে কপাল ধরে নিচে বসে পড়লাম আমি। নাতাশা দুর থেকে সব দেখেও কিছুক্ষণ চুপ রইলো তারপর মেলোড্রামা করতে ছুটে এলো সুরভীর কাছে

“কি হলো সুরভী! পরে গেলে কিভাবে?”

“জানিনা। স্লিপ করে গেলাম কিভাবে!”

মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে, কপালের এক সাইডে হাত দিয়ে ভেজা অনুভব করলাম। একটু রক্ত বেরিয়েছে, মানে ভালোই চোট লেগেছে। নাতাশা বাঁকা হাসলো

“ঠিক আছো তো তুমি? দেখি ওঠো!”

নাতাশা আমায় তুলে চেয়ারে নিয়ে বসিয়ে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো। আমি পানি খেয়ে ফ্লোরের দিকে তাকালাম, আজ তো ঘর সেই সকালে মোছা হয়েছে, পানিও পড়েনি। তাহলে পা কিসে স্লিপ করলো?

“ঠিক আছো সুরভী?”

“হ্যা, আমি ঠিক আছি। কিন্তু ওখানে পা কিসে স্লিপ করলো আমার?”

আমি উঠে দেখতে চাইছিলাম কিন্তু মাথাটা প্রচুর ব্যথা করছে। আচমকা ব্যথা পেয়েছি বলে হয়তো! নাতাশা ও আমায় বাধা দিয়ে বললো

“মে বি পানি পড়েছে কোনোভাবে। তাতেই তোমার পা স্লিপ করে গেছে”

“কিন্তু পানি কিভাবে পড়বে? আমি তো পানি পড়বে এমন কোনো কাজ করছিলাম না”

“আচ্ছা যা হবার হয়ে গেছে। বাদ দাও এসব! বসো এখানে, দেখো মাথায় চোট লেগেছে তোমার। ফাস্ট এইড বক্স কোথায়?”

“আমি ব্যান্ডেজ করে নিতে পারবো! আপনি বসুন, খেয়ে নিন”

নাতাশা আমার কথা শুনলো না, ফাস্ট এইড বক্স খুঁজে আমার ক্ষত পরিষ্কার করে ওয়ান টাইম ইউজড ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিলো। কিন্তু আমার নজর তো ফ্লোরের দিকে। এদিকে কিছু দেখতে পেলাম না, তাহলে কি রান্নাঘরের সামনে সত্যিই পানি পড়েছে? এতদিন হয়ে গেলো কোনোদিন এরকম হয়নি তাহলে আজই কেনো হলো? কিছু সময় পর নাতাশা চলে যায়। ওর যাওয়ার পর আমি রান্নাঘরের সামনে এসে দেখতে শুরু করি কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হলো এখানে এখন কিছুই নেই, অথচ একটু আগেই এখানেই পা পিছলে পড়েছিলাম আমি। স্যান্ডেল খুলে ওই জায়গার ফ্লোরের ওপর একটু জোরে পা ঘষা দিতেই বুঝলাম এখানে পিচ্ছিল কিছু একটা ছিলো, কিন্তু মুছে ফেলা হয়েছে! মাথা কাজ করছে না আমার। কি থেকে কি হয়ে গেল বুঝতে পারছিনা
______________________________

বিছানায় উবু হয়ে আধশোয়া অবস্থায় আছে নাতাশা, সামনে বালিশের ওপর জাফরানের ছবি রেখেছে। আজ খুব শান্তি লাগছে ওর। সুরভীকে কষ্ট পেতে দেখে এক পৈচাশিক আনন্দ পেয়েছে ও! আসার আগে আবার রান্নাঘরের সামনে থাকা কাপড়টা দিয়ে মুছে দিয়েছিলো জায়গাটা, বিধায় সুরভী ওখানে কিছু দেখতে পায়নি। জাফরানের ছবির ওপর আলতো করে হাত ছুঁইয়ে দেয় নাতাশা

“জাফরান, তুমি আমায় ওই মেয়েটার জন্য নিজের লাইফে ব্যাক করতে দেবে না বলেছ তাইনা। আজ ওই মেয়েটা না থাকলে আমি তোমাকে কোনো না কোনোভাবে কনভিন্স করতে পারতাম, আবার আমরা আগের মতো হতে পারতাম কিন্তু সুরভীর জন্য সেটা হলো না। মেয়েটা তোমার টেস্ট অব্দি বদলে দিয়েছে, আমি মানতে পারছি না জাফরান! কষ্ট হচ্ছে আমার। এতো সহজে তোমাকে আমি ওর সাথে সংসার করতে দেবো না”

আনমনে কথাগুলো বলে জাফরানের ছবিতে ঠোঁট ছোঁয়ালো নাতাশা!
____________________________

গত আধ ঘণ্টা ধরে আমায় বকাবকি করে যাচ্ছে জাফরান! অফিস থেকে এসে যেই মাথায় ব্যান্ডেজ দেখেছে তখন থেকে শুরু করেছে বকাঝকা! একটা কথা বলার সুযোগ দিচ্ছেনা আমায়! ভীষণ রেগে গেছেন উনি!

“দেখেশুনে কাজ করতে পারো না তুমি? কতোটা কেটে গেছে! এখন থেকে সার্ভেন্ট কে আরেকদিন আগে পাঠিয়ে দিয়ে যদি একা একা কিচেনে মাতব্বরি করতে যাও খবর আছে তোমার”

ঠোঁট উল্টে মিনমিন করে বললাম

“জাফরান, আমি ইচ্ছে করে তো এমন করিনি। আমি নিজেই বুঝতে পারিনি কিভাবে কি হয়ে গেলো। এভাবে বকছেন কেনো আমায়?”

“নাহ! এর জন্যে তোমাকে অ্যাওয়ার্ড দেওয়া দরকার। খুব বড় একটা কাজ করে ফেলেছো তুমি। সার্ভেন্ট কেনো রাখা হয়েছে বাড়িতে? তোমাকে আমি সেই শুরুতেই বলেছি এই বাড়িতে কাজ করানোর জন্যে আনিনি তোমায়”

সোফার ওপর বসেছিলাম, জাফরান আমার দিকে রাগী চোখে তাকাতেই চোখ নামিয়ে নিলাম আমি। জলদি একটা কুশন হাতে তুলে নিলাম, আঙ্গুল দিয়ে ওর ওপর আঙ্গুল নাড়াতে লাগলাম। এটা দেখে আরো রেগে গেলেন উনি! হাত থেকে কুশন কেড়ে নিয়ে আমার দিকে ঝুকলেন উনি, বাজখাই গলায় বলে উঠলেন

“আমার কথাগুলো মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে নাও সুরভী, যদি কাজ করার এতোই ইচ্ছে হয় দেখেশুনে করবে নাহলে করার দরকার নেই। ইডিয়ট একটা! যদি চোখে লাগতো, বা মাথায় গুরুতর চোট লাগতো তখন কি হতো?”

“আগে কখনো কি এমন হয়েছে বলুন? এখন একটা অঘটন ঘটলে কি করার আছে বলুন? কিছু না করে বসে থাকলেই যে দুর্ঘটনা ঘটবে না তার কি গ্যারান্টি?”

“মুখের ওপর তর্ক করো না সুরভী! একটা ফোন অব্দি করনি তুমি আমায়, যদি সেন্সলেস হয়ে পড়ে থাকতে তাহলে কি হতো?”

“এতো কিছু হতো না”

“মাথা গরম করিও না আর আমার, চুপ করো”

আরেক সোফায় কুশন ছুড়ে মেরে আমার পাশে বসলেন উনি, আমি ঠোঁট কামড়ে ওনার দিকে তাকিয়ে আছি। সত্যিই ভীষণ রেগে আছেন উনি, কিন্তু এই রাগের মাঝে চিন্তা কেয়ার দুটোরই মেলবন্ধন খুঁজে পেলাম। আমাকে নিয়ে লোকটার এতো চিন্তা? ভেবেই মুচকি হাসলাম! তখনই হুট করে উনি তাকালেন আমার দিকে

“হাসছো কেনো তুমি? কমেডি চলছে এখানে?”

দ্রুত হাসি থামিয়ে না সূচক মাথা নাড়লাম আমি। ওনাকে আর রাগানোর ইচ্ছে নেই আমার, জানিনা আমাকে আবার রাগের পরিণতি হিসেবে কি শাস্তি পেতে হবে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে উনি ঘুরে বসলেন আমার দিকে, কপালে ভালোভাবে নজর বুলিয়ে নিলেন!

“ব্যথা করছে?”

“একটু একটু”

“বেশি ব্যথা করলেও তো বলবে না। তোমার তো আবার হাইড করার অভ্যাস আছে সবকিছু”

“আমি আপনার থেকে কখনো কিছু লুকাইনি”

“থাক! এখন আর কিছু বলতে হবেনা। চুপ করে বসে থাকো আমি দেখছি পেইন কিলার আছে কিনা। একটা খেয়ে নেবে, ব্যথা বেড়ে গেলে রাতে জ্বর আসতে পারে”

জাফরান উঠে দাঁড়াতেই ওনার হাতটা ধরে ফেললাম

“এতো ব্যস্ত হতে হবে না আমাকে নিয়ে, আই অ্যাম ফাইন”

“ব্যস্ত হতে হবে কি হবেনা সেটা আমি বুঝবো”

আমার হাত ছাড়িয়ে জাফরান চললো ওষুধ আনতে, আমিও আর বললাম না কিছু ওনাকে। সেই যে ওষুধ খেয়েছি তারপর আমার সাথে উনি একটাও কথা বলেননি। রাত প্রায় বারোটা বাজতে চললো, এখনও নিশ্চুপ হয়ে নিজের কাজ করে যাচ্ছেন উনি। আমি ওনার সামনে দিয়ে ঘুরঘুর করে কথা বলতে গিয়েও বলতে পারছি না বকাবকির ভয়ে। রোজ ঘুমানোর আগে বারান্দায় এসে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকেন উনি, আজও ব্যতিক্রম তার ব্যতিক্রম হয়নি। এই সুযোগে আমি এসে দাড়ালাম ওনার পাশে, উনি আমার উপস্থিতি টের পেয়েও পূর্বের ন্যায় নিশ্চুপ রইলেন। আমি মজার ছলে বলে উঠলাম

“ব্যথা পেয়েছি আমি, কোথায় একটু সেবা শুশ্রুষা করবেন আমার তা না করে গুক মেরে আছেন কেনো?”

উত্তর দিলেন না উনি, উল্টে মুখটা ৩৬০⁰ অ্যাঙ্গেলে ঘুরিয়ে নিলেন, বুঝলাম রাগটা এখনও পড়েনি

“আপনি এখনও রেগে আছেন আমার ওপর!”

“তোমার রেস্ট করা দরকার, গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। নাহলে মাথা ব্যথা করবে”

“আপনি আগে বলুন, রেগে আছেন এখনও আমার ওপর? আপনি রেগে থাকলে আমি শান্তিতে ঘুমাবো কিভাবে? ঘুম না হলে এমনিতেও মাথা ব্যথা করবে”

সঙ্গে সঙ্গে ফিরে তাকালেন আমার দিকে জাফরান। ওনার তাকানো দেখেও কেমন ভয় ভয় লাগছে আমার!

“সরি”

উত্তর দিলেন না উনি। খানিকক্ষণ চেয়ে রইলেন আমার দিকে, আমি চোখ নামিয়ে নিতে যাচ্ছিলাম তখনই উনি দু হাতে আমার মুখটা তুলে ধরলেন, আমার চোখে চোখ রেখে শান্ত কণ্ঠে বললেন

“আমার তোমার সরি চাইনা সুরভী, একটা কথা জেনে রাখো। আমার লাইফে, আমার নিজের বলতে এখন তুমি ছাড়া কিন্তু আর কেউ নেই। বাবা চলে যাওয়ার পর অনেক কষ্টে নিজেকে সামলেছি আমি, তোমার জন্য সাহস পেয়েছি মুভ অন করার। আরেকবার আমি ওইরকম পরিস্থিতির সামনে পড়তে চাইনা। সব হারিয়ে ফেলেছি, এবার আমার লাস্ট হোপ হারাতে চাইনা”

কথাগুলো শেষ করেই আমায় ছেড়ে রুমে চলে গেলেন উনি, আমি এখনও ঠায় দাঁড়িয়ে আছি বারান্দায়। ওনার চোখে আজ ভয় দেখেছি আমি, আমাকে হারানোর ভয় পান উনি! শুকনো একটা ঢোক গিলে বুকের বামপাশে হাতটা রাখলাম আমি। খুব দ্রুত গতিতে চলছে হৃদপিণ্ডের ওঠানামা। এতদিন আমি ভেবেছি নিজের অনুভূতির কথা, আজ খুব জানতে ইচ্ছে করছে ওনার মনে কি আছে আমার জন্যে?

“জাফরান আমায় হারানোর ভয় পান! উনি কি ভালোবাসেন আমায়?”

আনমনেই কথাগুলো আওড়ে ফেললাম আমি। আজ প্রথমবার নিজের প্রয়োজন অনুভব করলাম, আমার জন্যে না জাফরানের জন্যে। বুঝলাম ওনার জন্যে হলেও নিজের প্রতি যত্নশীল হতে হবে আমায়। দ্বিতীয়বার ওনাকে আর আমার জন্যে এতোটা চিন্তিত হতে দেবো না!
______________________________

আজ সকালে একটু দেরিতে ঘুমটা ভেঙেছে আমার, জলদি জলদি ফ্রেশ হয়ে কিচেনের দিকে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ডাইনিং টেবিলে তাকিয়ে দেখলাম খাবার রেডি!

“আরে সার্ভেন্ট তো এখনও আসেনি, এগুলো বানালো কে?”

জাফরান তখন কিচেন থেকে বেরোলো, আমায় চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বললো

“আমাকে নজরে পড়ছে না তোমার?”

“আপনি না পরশুদিন রান্না করলেন, আবার আজকে ব্রেকফাস্ট বানাতে গেছেন কেনো?”

“তাতে কি হয়েছে? তুমি মাথায় চোট পেয়েছো। একটু বেশি সময় ঘুমালে ভালো লাগবে ভেবে ডাকিনি। নিজে যখন ব্রেকফাস্ট বানাতে পারি তাই বানিয়ে নিয়েছি”

ভ্রু কুঁচকে তাকালাম আমি, সকাল সকাল কোন হাসবেন্ড তার ওয়াইফকে ব্রেকফাস্ট বানিয়ে খাওয়ায় জানা নেই। জাফরান আমায় দিনদিন অবাক করে দিচ্ছে!

“এভাবে দেখছো কেনো? ব্রেকফাস্ট বানানো একদম ইজি একটা ব্যাপার! ইটস নট আ রকেট সায়েন্স!”

“তাই নাকি? তা কি কি বানিয়েছেন দেখি”

উনি আমার দিকে প্লেটগুলো এগিয়ে একে একে দিতে শুরু করলেন, প্রায় তিনরকম আইটেম বানিয়েছেন দেখছি!

“বাটার টোস্ট, ভেজ স্যান্ডউইচ, ফ্রুট সালাদ আর অরেঞ্জ জুস। এর থেকে বেশি কিছু বানালাম না, তোমার যদি আবার ভালো না লাগে তাই। আগে এগুলো টেস্ট করে দেখো”

“এতোকিছু বানিয়েছেন?”

“ইয়েস, আসলে কানাডায় থাকতে নিজেদেরই তো সব করে নিতে হতো। আমি আবার অন্যের হাতের খাবার খেতে লাইক করতাম না। নিজেই শিখেছিলাম সব”

“পারেন বলেই কি এতকিছু বানাতে হবে? আপনি সকালে ঘুম থেকে কখন উঠেছেন বলুন তো আর এতকিছু কখন করলেন? জগিং এ যাননি নাকি আজ?”

“তোমার এতকিছু জানতে হবেনা। চুপ করে খাওয়া শেষ করো। তারপর মেডিসিন খাবে একটা। আমি সার্ভেন্ট কে বলে দিয়েছি, উনি এসে সব করবেন। আজ তুমি একটাও কাজ করবে না”

সকাল বেলা এগুলো খাওয়ার অভ্যাস নেই আমার, ব্রেড খেতেই তো পছন্দ করিনা তার ওপর এগুলো! কিন্তু জাফরান এতো কষ্ট করে বানিয়েছে বিধায় আর উচ্চবাচ্য করলাম না। টুকটুক করে খেতে শুরু করলাম। খাওয়ার এক পর্যায়ে জাফরান নিজের পকেট থেকে একটা হেয়ার ব্যান্ড বের করে আমার সামনে রেখে বললেন

“ড্রইং রুমে এই হেয়ার ব্যান্ডটা পেয়েছিলাম সকালে! কিন্তু আমার জানামতে তুমি তো এমন হেয়ার ব্যান্ড ইউজ করো না”

খেতে খেতে বাম হাতে হেয়ার ব্যান্ডটা তুলে নিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলাম, আর একটু সময়ের মধ্যে বুঝেও গেলাম এটা কার

“আরে হ্যা, এটা আমার না। কালকে এরকম হেয়ার ব্যান্ড তো নাতাশা পড়ে এসেছিল”

নাতাশার কথা শুনে চমকে ওঠে জাফরান, বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করে বসে

“হোয়াট! নাতাশা এসেছিলো বাড়িতে?”

“হ্যা, ওই গতকাল দুপুরে এসেছিলো। আপনি কালকে এতো রেগে ছিলেন আর এতকিছু হয়ে গেলো। এর মাঝে বলতেই ভুলে গেছিলাম নাতাশার কথা”

চলবে….

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন..!!]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here