ভ্রমর (পর্ব – ৭)

0
559

ভ্রমর (পর্ব – ৭)
সুমাইয়া আক্তার
__________________
খোলা আকাশ, মৃদুমন্দ বাতাস, ধূ-ধূ প্রান্তর, হৃদয়ে হওয়া কিছু তোলপাড় আর পাশাপাশি স্নিগ্ধা-মিন্টু। প্রকৃতিও মুচকি হেসে আড়াল করছে ভয়ঙ্কর প্রণয়ে আটকে পড়া দু’জনকে। স্নিগ্ধার কান এখনও তৃষ্ণায় ধুঁকছে। মিন্টুর মুখে ‘ভালোবাসি’ কথাটি যে শোনা হয়নি! অপলকভাবে মিন্টুর চোখে তাকিয়ে আছে স্নিগ্ধা৷ দেখে চলেছে চোখের মনির পাশে কালো তিলটিকে। কখনো-বা কিছু বলার জন্য মিন্টুর উদ্যত ঠোঁটের দিকে তাকাচ্ছে সে—এই বুঝি অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সে ভালোবাসার কথা বলল। কিন্তু না, মিন্টুর সে সাহস হলো না। যখন’ই মনে পড়ল, যার স্নিগ্ধ, সুন্দর, কোলম হাতে সে হাত রেখে আছে; তাকে ছোঁয়ার অধিকার বা যোগ্যতা কোনোটাই নেই। চট করে হাত সরিয়ে ফেলল মিন্টু। অল্প দূরে সরে বসল। স্নিগ্ধা হতাশ হলো না। সে জানে, মিন্টুর অগোছালো ভাবনাগুলো কী৷ এসব ভাবনা নিয়েও যে সে একবার ইচ্ছাকৃতভাবে ছুঁয়েছে—এটাই অনেক।
মিন্টু যে ভালোবাসে স্নিগ্ধার প্রতি দুর্বল সেটা ভালোভাবেই বুঝতে পারল স্নিগ্ধা। আনন্দে গুনগুন করে উঠল। মিন্টু দূর বহূদূরে তাকিয়ে শুনতে লাগল স্নিগ্ধার গুনগুনানো, ‘ভাইবের আঁধার ও মন বলে শোন রে কানেইয়া, নেভা ছিল মনের আগুন রে… কে দিল জ্বালাইয়া রে ভ্রমর কইও গিয়া।’

‘কৃষ্ণ রাধার মনে আগুন জ্বালিয়ে দিল।’
হঠাৎ মনির দুষ্টু কথায় চমকে উঠল মিন্টু-স্নিগ্ধা দু’জনে। মিন্টু একেবারে নৌকার কোণে গিয়ে বসল। এতক্ষণে সে দেখল, নৌকা আপনা-আপনি পুকুরের ধারে এসে দাঁড়িয়েছে। লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করল স্নিগ্ধা।
মনি নৌকায় উঠতে উঠতে বলল, ‘সব’ই বুঝলাম, কিন্তু ভ্রমরটা কে?’
হেসে ফেলল স্নিগ্ধা৷ ঠোঁট চেপে বলল, ‘তুমি।’
‘ও আচ্ছা। তারমানে মিয়া-বিবির মাঝে যেমন ঘটক থাকে, আমি তেমনি তোমাদের মাঝে ভ্রমর?’
‘হুম, হুম।’
অট্টহাসি হাসল দুই বোন’ই। মিন্টু চিকন গলিতে আটকে পড়ার মতো অবস্থা নিয়ে দুই যুবতীর হাসি শুনতে লাগল। কিন্তু মনে হচ্ছিল স্নিগ্ধার হাসি শুধু তার কানে ঢুকে হৃদয়ে গিয়ে থামছে। আটকে পড়া পাখির মতো সেই হাসির শব্দ ডানা ঝাপ্টে উড়ছে, বর্ষার প্রথম কদম হয়ে ফুটছে। কখনো-বা রিনরিনে চিকন কণ্ঠে হৃদয়ে কেউ গান গেয়ে উঠছে।
__________

শফিক বেশ হাশিখুশি আজ। বাড়ির সবচেয়ে ছোট সদস্য রফিকের ছেলে ফাইয়াজকে ডাকলেন তিনি। নয় বছরের ছেলেটি দৌঁড়ে সামনে এলো।
রফিক হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘আমার চশমা কোথায় দাদু?’
ফাইয়াজ তার হাত থেকে শফিকের হাতে চশমা তুলে দিল। শফিক চোখে চশমা দিয়ে হাসলেন। ফাইয়াজ প্রায়’ই তার চশমা নিয়ে খেলে। রাগান্বিত হোন না শফিক। মাথায় হাত বুলিয়ে ফাইয়াজকে বিদায় দিলেন তিনি। টেবিল থেকে ফোনটা হাতে তুলে কল করলেন আতিককে। চশমা ছাড়া নামগুলো দেখতে পাওয়া বড় দুষ্কর।
ওপাশ থেকে আতিক ফোন উঠিয়ে সালাম দিল।
শফিক সালামের উত্তর দিয়ে হেয়ালি ছাড়াই মূল কথা বললেন, ‘তোমার ছেলেকে নাতজামাই করা যায়। কবে গ্রামে আসবে শাওন?’
খুশিতে কিছু মহূর্ত চুপ থাকল আতিক, পরক্ষণে বলল, ‘আমি ওর থেকে জেনে আপনাকে জানিয়ে দেবো আব্বাজান।’
‘শাওন রাজি তো?’
‘হ্যাঁ অবশ্যই। স্নিগ্ধার ছবি দেখেছে ও। গ্রামে এলেই তাহলে বিয়ে, কী বলেন?’
‘হ্যাঁ, তা’ই হবে। আজ তাহলে রাখি।’
শফিক ফোন রাখতে যেতেই আতিক বলে উঠল, ‘আব্বাজান, স্নিগ্ধা রাজি তো?’
উল্লাসিত হাসিটা কেমন মিইয়ে গেল শফিকের। চশমাটা ঠিক করলেন তিনি। বললেন, ‘স্নিগ্ধা জানে আমি ওর জন্য খারাপ কিছু চাইব না।’

ফোন রাখলেন শফিক। স্নিগ্ধাকে একবার জিজ্ঞাসা করার দরকার ছিল কি না ভাবতে লাগলেন তিনি। উঠে দাঁড়ালেন। এক্ষুণি স্নিগ্ধার সাথে কথা বলতে হবে। স্নিগ্ধার ঘরের সামনে গিয়ে দেখলেন দরজার দুই পাল্লা হা করে খোলা। ডেকেও স্নিগ্ধাকে পেলেন না তিনি। চিন্তিত হয়ে নিচে নামলেন শফিক। তাওহিদা অস্থির বাবুই পাখির মতো কাজ করে বেড়াচ্ছেন। এত কাজ করেন এই নারী, তবুও যেন কাজের প্রতি বিরক্ত আসে না।

তাওহিদার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন শফিক। তাওহিদা দাঁড়ালেন। শফিক বললেন, ‘আমার একটা কথা রাখবে মা?’
‘বলুন বাবা।’ মনে ধড়ফড় বোধ হচ্ছে তাওহিদার। তিনি ভয়ে আছেন, তার শ্বশুরমশাই আবার সিকিন্দারের সাথে কথা না বলতে বলেন!
তাওহিদার ভাবনা সত্যি করে শফিক বলে উঠলেন, ‘সিকিন্দারের সাথে আরেকবার কথা বলো।’ তাওহিদার মাথায় হাত রাখলেন তিনি, ‘আমার সামনে এখন’ই কথা বলো মা। এবার হয়তো ও কিছু বলবে।’
বারণ করতে চাইলেন তাওহিদা, কিন্তু শফিকের কথার উপর কথা বলার অভ্যাস কিংবা কখনো কোনো কথা বা কাজে বারণ করার অভ্যাস নেই বলে পারলেন না। হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়িয়ে ঘরের দিকে পা বাড়ালেন তিনি। ঘরে ঢুকে ফোনটা হাতে নিতেই বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে এলো তাওহিদার। মুখ ওপরে তুলে তিনি মনে মনে বলতে লাগলেন, ‘হে আল্লাহ্, আর কত পরিক্ষা আসবে জীবনে?’
বেশ কিছুক্ষণ কাঁদলেন তাওহিদা। না কাঁদলে বুকটা ভারী হয়ে থাকে, কষ্ট হয়। তার থেকে বরং কান্না করে কষ্ট কমানোই ভালো। সহসা শফিকের কথা মনে পড়তেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন। চোখ মুছে, ফোন হাতে বেরিয়ে এলেন বাইরে।

শফিক তাওহিদার মুখের দিকে একবার তাকাতেই বুঝে গেলেন, তার স্নেহের বউ-মা কাঁদছিলেন। মন খারাপ হলো শফিকের। মাথা নিচু করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি। নিজের অর্ধাঙ্গিনীর সাদা-কালো ছবির দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ গলায় বললেন, ‘আমরা কোন পাপা করেছিলাম শিউলি? কেন সিকিন্দারের মতো এক ছেলের জন্মের মাধ্যম হলাম আমরা? তাওহিদার এক একটা দীর্ঘশ্বাস, চোখের জল আমাদের জীবনে অভিশাপ না নিয়ে আসে!’
‘বাবা—’ তাওহিদার দিকে তাকালেন শফিক। তাওহিদা সামনে বসলেন, ‘আপনার ছেলের সাথে কি আপনি কথা বলবেন না?’
‘আগে কল করো ওকে। দেখ কী বলে। প্রয়োজন হলে আমি কথা বলব।’

সিকিন্দারের নতুন নাম্বার তাওহিদার ফোনে নেই৷ গতকাল স্নিগ্ধার ফোন থেকে কী এক আশায় নাম্বারটা মুখস্ত করে নিয়েছিলেন তিনি। সেই নাম্বার তুলে কল করলেন। রিং হচ্ছে। রিং-এর শব্দে অন্তরটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে তাওহিদার। আবারও সেই গম্ভীর কণ্ঠস্বর না জানি কানে বাজলো কখন!
সিকিন্দার ফোন ধরলেন না। পর পর প্রায় চারবারের চেষ্টায় ফোন ওঠালেন তিনি। ওপাশ থেকে গম্ভীর গলার আওয়াজ এলো, ‘হ্যালো, কে বলছেন?’
শফিকের ইশারায় লাউড-স্পিকার দিলেন তাওহিদা। সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেমন আছেন? চিনতে পেরেছেন?’
সিকিন্দার চুপচাপ। শুধু তার নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে; তারপর কানে এলো মেয়েলি কণ্ঠ, ‘তুমি থাকো, আমি চট করে নুডুলস বানিয়ে নিয়ে আসছি।’
বুকটা মুচড়ে উঠল তাওহিদার। ওই গলা যে তামান্নার, তা বুঝতে বাকি রইল না।
অতঃপর ওপাশ থেকে সিকিন্দার বলল, ‘ভালো আছি তাওহিদা৷ কেন ফোন করেছ?’
‘যাক, চিনতে পেরেছেন তাহলে!’
‘না চিনতে পারার কোনো কারণ নেই। বলো কেন ফোন করেছ।’
শফিকের দিকে তাকালেন তাওহিদা। শফিক স্নিগ্ধার বিয়ের কথা বলার জন্য ইশারা করলেন। তাওহিদা কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে লাগলেন স্নিগ্ধার বিয়ের কথা। এটাও বললেন, ইতিমধ্যে বিয়েটা ঠিক হয়ে গেছে। এই মাসেই বিয়ে হওয়ার সম্ভাবনা।
সব শুনে হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন শফিক, ‘স্নিগ্ধা আমার মেয়ে। ওর বিয়ের কথা ভাবার দরকার তোমাদের নেই। আর তোমার শ্বশুরকে বলে দিও, এমন আজেবাজে কথা দ্বিতীয়বার শুনলে আমি স্নিগ্ধাকে নিতে যাব।’
‘তুই যেমন ওর বাবা, আমি তেমন ওর দাদু।’ বলে উঠলেন শফিক, ‘ওকে বিয়ে দেওয়ার অধিকার আমারও আছে।’
ওপাশ থেকে সিকিন্দারের রাগান্বিত গলা, ‘আমার জীবন নষ্ট করে শান্তি হয়নি আপনার? আমার মেয়ের জীবন নিয়ে পড়েছেন এখন। আমি আগামী সপ্তাহেই আমার মেয়েকে আনতে যাব। বারণ করার দুঃসাহস দেখাবেন না।’
‘এসে জামাইসহ মেয়েকে নিয়ে যাস।’ বলে কেটে দিলেন শফিক।

তাওহিদা বিস্মিত, বাকহীন হয়ে শফিকের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। বাবা-ছেলের যুদ্ধ তিনি নীরব দর্শক। কাউকে কিছু বলতে পারেন না, সইতেও পারেন না। নিয়তি তাকে প্রত্যেকবার এমন এক জায়গায় এনে দাঁড় করায়, যখন তিনি চিৎকার করে নিজের ইচ্ছে জানালেও শোনার কেউ থাকে না।
এখন তার ইচ্ছে করছে চিৎকার করে বলতে, ‘স্নিগ্ধা নাড়ি ছেঁড়া সাত রাজার ধন আমার। ওর উপর বেশি অধিকার তো আমার থাকার কথা। মেয়েটিকে আমি আরও কিছু দিন আমার কাছে রাখতে চাই। কেন তাকে আমার থেকে সরাতে উঠেপড়ে লেগেছেন দুই বাবা-ছেলে? কেন?’
মুখে আঁচল চেপে ঘরে ঢুকলেন তাওহিদা। আজকাল কান্না আটকানোর চেষ্টায় প্রতিবার ব্যর্থ তিনি।
__________

সন্ধ্যার একটু আগে বাড়ি ফিরল স্নিগ্ধা আর মনি। মিন্টু দাঁড়িয়ে থেকে স্নিগ্ধার বাড়িতে ঢোকা দেখে পিছু ফিরে চলতে লাগল। ফিরতে হবে তাকে তার ছোট্ট কুঁড়েঘরে। মিন্টুর পাশাপাশি চলতে লাগল কিছু উত্তেজনা, অনুভূতি, উৎফুল্লতা। আজ কোন সাহসে যে সে স্নিগ্ধার নরম হাতের উপর হাত রেখেছিল কে জানে! ওই ঘটনার পর এখনও তার হৃদপিণ্ড শান্ত হতে পারেনি। ধুকপুক করে চলেছে অস্বাভাবিকভাবে অনবরত। বারবার ভাবনা আসছে, এসব হয়তো ঠিক হচ্ছে না কিন্তু মন মস্তিষ্কের সেই ভাবনাকে মেনে নিয়ে চলতে পারছে না। মস্তিষ্কের ভাবনা মেনে নিয়ে মিন্টুও চলতে পারছে না, পারবেও না। এত বছর পরে সত্যি এক ভালোবাসার স্পর্শ, সুঘ্রাণ পেয়েছে সে—কী করে হারানোর শোক মেনে নেওয়া যাবে?

কুঁড়েঘরে ঢুকে ধূলোময়লা নিয়েই চৌকিতে শুয়ে পড়ল মিন্টু। কোমরে গোঁজা বাঁশিটি বের করে তাকিয়ে থাকল। আলতো করে মাঝে মাঝে স্পর্শ এঁকে দিতে লাগল। এই বাঁশির জন্যেই স্নিগ্ধার দেখা পেয়েছে সে! স্নিগ্ধাকে এখন খুব করে কাছে চায় মিন্টু; সারাজীবনের জন্য। স্নিগ্ধাকে ছাড়া একটা দিনের কথা ভাবতে গেলেও মনটা হু হু করে ওঠে এমনভাবে যেন তা পানি ছাড়া উত্তপ্ত মরুভূমি। যেখানে মানুষ নেই, পশু-পাখি নেই, নেই তৃষ্ণা নিবারনের জন্য পানি। এতকিছুর পরও মস্তিষ্কের ভাবনা এসে দোলা দেয়। মিন্টুকে তার নিজস্ব যোগ্যতা দেখিয়ে দেয়। কোথায় মিন্টু আর কোথায় স্নিগ্ধা! এত প্রভেদ তাদের—এক হওয়ার ভাবনা কী শুধু ভাবনাই?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here