#ভেতরে_বাহিরে
পর্বঃ২৭
লেখিকাঃ #রুবাইদা_হৃদি
চাঁপাফুলে সুবাসে বিমোহিত হয়ে আছে সর্বজায়গা। অন্যকোনো দিন হলে আবেশকে এই সৌরভ আচ্ছাদিত করতে সক্ষম হলেও আজ পারছে না। হালকা কঁপালে ভাজ ফেলে আবেশ বসে আছে দুইহাত কঁপালে ঠেকিয়ে৷ প্রায় ঘন্টাখানেক আগে মাধুর্য ওয়াশরুমে গিয়েছে দশমিনেটের কথা বলে৷ এইদিকে রাতের আঁধার গাঢ় হচ্ছে ৷ পৌনে একটা বাজতে চলেছে৷ চুল গুলোতে আঙুল চালিয়ে বিরক্তি ভঙ্গিতেই ওঠে দাঁড়ালো সে৷ ওয়াশরুমের দরজার সামনে গিয়ে দু-বার টোকা দিয়ে কন্ঠে বিরক্তির আভা ফুঁটিয়ে বলল,
‘ রাত শেষ হওয়ার আগে বের হতে পারবেন তো ,মহারাণী?’
‘ আর পাঁচমিনিট৷’ মাধুর্য তাড়াহুড়ো করে ভেতর থেকে উত্তর দিলো৷
‘ তোমায় পাঁচ ঘন্টা দিলাম৷ ধীরেধীরে কাজ করো৷ ঠিক পাঁচ ঘন্টা পর আবার ডাকবো৷’ আবেশ রাগী সুরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল৷ মাধুর্য ভেতর থেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘ আমার এতো সময়ের দরকার নেই৷ আর এক ঘন্টা দিন তাহলেই হবে৷’
‘ কীইই! আর টু মিনিট’স দিলাম৷ এর মাঝে বের না হলে আমি ঘুমিয়ে যাবো৷ ডাফার একটা৷’ আবেশ রেগে চেঁচিয়ে বলল ৷ মাধুর্র আবেশের ধমকে কেঁপে উঠে বলল,
‘ আসছি তো৷ এতো চেঁচাচ্ছেন কেন৷’
‘ ফার্স্ট৷ আর এক সেকেন্ড লেট হলে খবর আছে তোমার৷ কিন্তু,একটা প্রশ্ন৷ ওয়াশরুমে করছোটা কী তুমি! ‘
‘ কথা বাড়াবেন না৷ আপনার কথার চক্করে আমার পাঁচ সেকেন্ড শেষ৷’
‘ আমার বলা কথা আমাকেই ফেরত দেওয়া হচ্ছে৷’ আবেশ বিরক্তি ভঙ্গিতেই আওড়ালো৷
রুমের চারিধারে চোখ বুলিয়ে বিরক্তিতে মুখ দিয়ে ‘চ’ জাতীয় শব্দ উচ্চারিত করেই থেমে গেলো দরজা খোলার আওয়াজে ৷ রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যই পেছন ফিরে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ এতো দ্রুত৷ তোমার আরো কিছুটা সময় নেওয়া উচিৎ ছিলো৷’
আবেশ যে রেগে আছে বেশ বুঝতে পারছে মাধুর্য৷ তবে সেদিকে পাত্তা না দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় আরেকবার নিজেকে দেখে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলো আবেশের সামনে ৷ ঝুনঝুন আওয়াজ হচ্ছে তার হাটার তালে৷ আবেশের কর্ণকুহরে সেই আওয়াজ পৌছালেও সে কাটখোট্টা ভাবে বলল,
‘ আমি নীচে নামছি৷ জলদি আসো৷’
বলেই সে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়৷ মাধুর্য থমকে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে থাকা মানুষটার দিকে তাকিয়ে ইতস্ততভাবে হাত টেনে ধরলো৷ মাধুর্যের হাত শীতলতায় ঘেরা ৷ মোলায়েম হাতের শীতল স্পর্শ আবেশের ভেতর ঠান্ডা প্রহরের আবির্ভাব ঘটালো৷ থমকে গেলো সে রাগ প্রকাশ পেলো মিশ্রিত অনুভূতিতে৷ মাধুর্য যেন শীতের প্রকোপে কাঁপছে ৷ তার হাত অনবরত কেঁপে কেঁপে উঠছে ।সর্বাঙ্গে থেমে থেমে আসছে হৃৎপিন্ডের কম্পন৷ গলার জোর যেন হ্রাস পেয়েছে অতল গহব্বরে ৷ মাধুর্যের কম্পন আবেশ অব্দি পৌছাতেই চকিত হয়ে ঘুরে তাকালো সে৷
পেছনে দাঁড়ানো লাল রঙে রক্তিম আভা ছড়ানো মানবীটাকে দেখে বারদুয়েক নিজের নিয়ন্ত্রণ হারালো আবেশ৷
মোহময় আবেশে জর্জরিত হলো তার নয়ন ৷ স্তব্ধতায় ছেয়ে গেলো সে৷ আবেশের অবাকতা মেশানো আচ্ছাদিত দৃষ্টি যেন,দম বন্ধ করা রুদ্ধশ্বাস অনুভূতি মাধুর্যের কাছে। লজ্জায় রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো মাধুর্যের ফোলা গাল৷ সাথে সাথেই চোখ বোজে শ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে রইলো সে৷
আবেশ বিনম্র চোখে,অবাক চিত্তে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছে টকটকে লাল রঙের আটপৌরে শাড়ি পরিহিতা রমণীরর দিকে৷ যার সর্বাঙ্গে ছড়াচ্ছে জ্যোতি ৷ ফর্সা হাতে তার কালো রঙের দু মুঠো কাঁচের চুড়ি,কঁপালে তার কালো টিপ৷ মুখে অপার্থিব সৌন্দর্য ভীড় করেছে লজ্জায় মন্ডিত হওয়ার দরুণ ৷
লিপস্টিক বিহীন ওষ্ঠদ্বয় অনবরত কেঁপে কেঁপে উঠছে ৷ আবেশ ঘোরে চলে গেছে৷ নির্বাক ভঙ্গিত ডান হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলো মাধুর্যের গাল৷ আরেকদফা কম্পিত হলো মাধুর্যের শরীর৷ আবেশ মোহাচ্ছন্ন কন্ঠে বলল,
‘ মাধবীলতা৷’
থেমে গেলো আবেশ৷ কন্ঠস্বরের খেই হারালো৷ গলা শুকিয়ে এলো তার৷ মাধুর্যের মন চাইছে আবেশ প্রসংশা করুক,তাকে আরো লজ্জায় রাঙিয়ে দিক৷ বাঁধন ছাড়া কিছু ইচ্ছা প্রকাশ হোক ৷ আবেশের সাড়াশব্দ না পেয়ে চোখ বোজে থাকা অবস্থায় মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে ছোট করে বলল,’ হুম৷’
সাথে সাথেই আবেশ মাধুর্যের গালে হাত রেখে জোরে জোরে শ্বাস টেনে ক্ষীণ স্বরে বলল,
‘ আমার ঘরের জ্যোৎস্না,আমার মনের রাজ্যের রাণী,আমার অমোঘ আকাশের বাণী,আমার বৃষ্টিস্নাত সকাল,আমার চাঁদনী রাতের চাঁদ ,আমার প্রত্যেকটা দিনের আলোক ছটাক,আমার সব অনুভূতি আজ তোমার নামে দলিল করে দিলাম।’
মাধুর্যের গলা কাঁপছে। থরথর করে কাঁপছে সে। চোখের পাতা দ্রুত ওঠানামা করছে। লজ্জায় লালাভ হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। আবেশের প্রথম হৃদয় কাঁপানো অনুভূতি যেন তার ভেতর নিগড়ে বহিঃপ্রকাশ হতেই পাথর সম অভিমান আরো একবার গলিত হয়ে মাধুর্যের টানা টানা চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে। আবেশের হাত ভিজে যেতেই সাথে সাথেই মুছে দিলো মাধুর্যের চোখের পানি। আচ্ছাদিত কন্ঠে বলল,
‘ কান্না করে কাজল লেপ্টে দিলে।এখন বাচ্চা পেত্নীর মতো লাগছে।’
আবেশের কথা শুনে চোখ নামিয়ে ফেললো,মাধুর্য। একহাত দিয়ে ঢেকে ফেললো চোখ। তাকে নিশ্চয় বাজে দেখাচ্ছে। তাই তো,আবেশ পেত্নী বলল। ভেবে খানিক মন খারাপ এসে জমা হলো হলো মনে। মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলল,
‘ আমি চোখ মুছে আসছি।’
‘ না।’ আবেশ বাঁধা দিয়ে বলল। মাধুর্য প্রশ্নসূচক চোখে তাকিয়ে বলল,
‘ কেন ? দেরি হবে না। আপনি একটু অপেক্ষা করুন।’
‘ থাক না কিছু অগোছালো,কিছু অগোছালোতে সুন্দর অনুভূতি মিশ্রিত গোছালো থাকে।’
মাধুর্য ঘুরতেই আবেশ হাত টেনে ধরে গোছালো ভাবে বলল। ক্রমেই মাধুর্যের হৃৎপিন্ডের কম্পন থমকে থমকে যাচ্ছে। এতো সুন্দর গোছালো অনুভূতি আবেশের যা মাধুর্যকে আবেশিত করছে।
____________
নিভু নিভু ল্যাম্পপোস্টের হলদেটে বাতি । অর্ধচন্দ্র ঢাকা পড়েছে মেঘের রাজ্যে।ঝিরঝির বৃষ্টি বাতাসের সাথে ভেসে আসছে। প্রবাহিত পশ্চিমা হাওয়ার তালে দুলে উঠছে হালকা ভেজা বৃক্ষরাজী।ল্যাম্পপোস্টের হালকা আলোয় চিকচিক করছে পাকা রাস্তা।
পাহাড়ি এলাকা। দূর থেকে ভেসে আসছে শেয়ালের ডাক। ঝিঁঝিঁ পোকা ঝোপঝাড়ের ভেতর থেকে শেয়ালের ডাকের সাথে তাল মিলেয়ে ডেকে চলেছে। ঢাল বেয়ে নামছে দু-একটা যাত্রীবাহী গাড়ি। ঠিক ঢালের নীচু দিকে, ঝুপড়ির মতো একটা ছোট দোকান। ভেতর থেকে হেরিক্যানের উজ্জ্বল আলো সুশৃঙ্খল ভাবে ঠিকরে বাইরে আসছে। সাঁই সাঁই শব্দে পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়া গাড়ি গুলোর দিকে তাকিয়ে মাধুর্য উৎফুল্ল ভাবে বলল,
‘ কতো সুন্দর পরিবেশ।’
‘ দিনের আলোয় মানুষের সমাগম অনেক থাকে। কারণ এই ঢাল বেয়ে উপরে উঠলেই বড় একটা রিসোর্ট।’ আবেশ গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে হাতে হাত গুজে মাধুর্যের দিকে তাকিয়ে বলল। আবেশের কথা অনুযায়ী মাধুর্য উপরের দিকে তাকালো। দেখলো পাহাড়ের খাঁজ কেটে সিড়ি বানানো হয়েছে। উপর থেকে রঙিন আলো ভেসে আসছে। মাধুর্য অবাক হয়ে বলল,
‘ ওপর থেকে নীচে আরো সুন্দর দেখা যায়,তাই না?’
‘ উঁহু! কৃত্রিম সাজসজ্জায় মন্ডিত সব।আমি দিনে কখনো আসি না। রাতের আঁধারে,মানুষের কোলাহল থেকে ছুটে পালাতে এখানে এসে বসে থাকি।’
‘ সব সময়?’ মাধুর্য প্রশ্ন করে বলল। আবেশ হেলান ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মাধুর্যের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। সে তার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো। আবেশ যে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সে দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তার। কিছুক্ষণ পূর্বেই আবেশ তাকে নিয়ে বাসা থেকে বেশ দূরে এসেছে। চারদিকে সুউচ্চ পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। সেইসব পাহাড়ের দানবীয় রুপে আচ্ছাদিত হয়ে আছে মাধুর্যের নয়ন। আর আবেশের দৃষ্টি নিবদ্ধ তার প্রেয়সীর দিকে। মাধুর্য অনমনা হয়েই বলল,
‘ আমি কখনো পাহাড় কাছে থেকে দেখি নি। দেখুন,তাদের দেখে মনে হচ্ছে,মেঘের সাথে আলাপ করছে।’
‘ পাহাড়ের চূড়ায় উঠলে তুমিও মেঘেদের সাথে আলাপ করতে পারবে,মাধবীলতা।’
‘ সত্যি!’ খুশিতে মাধুর্যের চোখ চিকচিক করে উঠলো। আবেশ সেই চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ তাদের তুমি ছুঁতে পারবে,তারা তোমায় বরণ করে নিবে নিজেদের মতো।’
‘ কী ভাবে।মেঘ আবার বরণ করতে পারে না’কী।’
‘ অবশ্যই পারে।’ আবেশ মাধুর্যের একদম কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বলল। মাধুর্যের চোখেমুখে ছেলেমানুষি । সে ঠোঁট উল্টে ফেললো। আবেশ সূক্ষ্মতার সাথে তার পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ মেঘ বরণ দেখবে,মাধবীলতা?’
মাধুর্য অবাক চিত্তে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিতেই আবেশ তার বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে নিলো তাকে। বাতাসের শীতলতায় ঠান্ডা হয়ে আছে আবেশের হাত। সেই হাত মাধুর্যকে আঁকড়ে ধরতেই ধড়ফড়িয়ে ওঠলো সে। সাথে সাথেই পেছনে, মাথা ঘুরিয়ে কাঙ্খিত মানুষের গভীর দৃষ্টি দেখেই থেমে গেলো সে। তীব্রতর হলো ভেতরে কম্পন। আবেশ তখন শক্ত করে ধরে আছে তাকে। বিনম্র কন্ঠে বলল,
‘ ঠিক এভাবেই। তোমার শরীরের যেমন শীতলতা বইছে মেঘবরণ করলে এভাবেই শীতল হবে তোমার সর্বাঙ্গ।’
‘ আ..বেশ আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে।’ এইকথাটুকু মুখ দিয়ে উচ্চারিত হলো না তার। আবেশ শান্ত স্বরেই বলল,
‘ চলো।’
‘ কোথায়?’
মাধুর্য বহু কষ্টে উচ্চারণ করতেই আবেশ তাকে ঘুরিয়ে নিয়ে মজা করে বলল,
‘ আপাতত খেতে যাবো। এরপর আবার রোম্যান্স করবো।’
আবেশের স্বাভাবিক কথায় হার্টবিট গণহারে ধ্বক ধ্বক শব্দে ছন্দ ছাড়ালো। একরাশ লজ্জারা এসে ভীড় হলো মুখশ্রীতে।
হাওয়ার তালে উড়ে যাওয়া আঁচল,সেইসাথে কিছু খুলে যাওয়া অবাধ্য চুল লজ্জা প্রকাশ করতেই আবেশ হু হা করে হেসে উঠে বলল,
‘ তোমায় লজ্জা পেলে ভ্যানিলা লাগে।’
‘ আ..মার খিদে পেয়েছে।’
‘ দাঁড়িয়ে আছো কেন? আরো লজ্জায় রঞ্জিত হতে!’ আবেশ ঠাট্টা করে বলল। মাধুর্য মাথা নীচু করে লম্বা হাসি টানলো সরু অধরে। তার আজ বড্ড বেশি ভালো লাগছে।
__________
‘ বিয়া করছো,মামা।’
‘ জ্বী।কতোকাল আর একা থাকবো বলো ,মামা। আমার মামী তো আছে এইবার তোমার মামীও বানিয়ে ফেললাম।’
বলেই আবেশ হাসলো। সাথে বৃদ্ধ ও হাসলো। কুঁচকানো চামড়া,ঝকঝকের সেই সরল হাসি মাধুর্য তাকিয়ে দেখলো। বৃদ্ধের মাথায় কাঁপড় পেঁচানো টুপি। শরীরে ঢিলেঢালা ফতুয়া। হেরিক্যানের আলোতে চকচক করছে তার ফর্সা শরীর। মাধুর্যের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
‘ আমার এইহানে আসার জন্য আমি বড় খুশি হয়েছি।’
‘ আমিও।’ মাধুর্য মুখে হাসি টেনে বলল। আবেশ বলল,
‘ মাধুর্য,উনি হচ্ছেন মায়াং চাকমা। মানে আমার মামা। দারুন বিরিয়ানি রান্না করে মামা।সারাদিন খদ্দের সেই সাথে রাতেও মামার দোকানে ভীড় লেগে থাকে।আমার ইচ্ছা হয় মামাকে বাড়িতে নিয়ে বেঁধে রেখে দেই।’
‘ তাহলি তোমার মামীর কী হবে।’ বৃদ্ধা হেসে বলল। আবেশ নিজেও হেসে মাথা ঝাকালো।
মাধুর্য বেশ উপভোগ করছে। বৃদ্ধার সাথে কথা শেষ হওয়ার,পূর্বেই সার্ভেন্ট বিরিয়ানি সার্ভ করতেই আবেশ তার হাত ধরে একটা বাশের বানানো টেবিলে বসিয়ে প্লেট থেকে বিরিয়ানি নিয়ে মুখের সামনে ধরে বলল,
‘ খাও।’
‘ আমি হাত দিয়ে খেতে পারবো।’
‘ তোমাকে বলতে বলেছি?’ আবেশ সরু চোখে তাকিয়ে বলল। মাধুর্য কী বলবে ভেবে পেলো না। আবেশ আবারো ধমক দিয়ে বলল,’ হা করো।না হলে আমাকে খাইয়ে দাও।’
আবেশের কথা শুনে চটজলদি হা করলো মাধুর্য। আবেশ হাসছে। সেই হাসি যেন প্রাণবন্ত। মাধুর্য চুপিসারে সেই হাসি দেখে নিজেও হাসলো। ভুবন সেজেছে নিজ রুপে,তবে মাধুর্য আজ চিনেছে অন্য এক আবেশকে। যার মনে ভালোবাসার এক সমুদ্র আছে।
_____________
এহসান বাড়ির পরিবেশ আজ ঠান্ডা। চিন্তিত মুখ গুলো হাঁসফাঁস করছে। কাল রাতে এতো সুন্দর অনুভূতি সংরক্ষণ করার পর সকালে ওঠে সব এক নিমিষেই বিষিয়ে গেলো মাধুর্যের। মাহফুজা কাঁদছেন। নজরুল নির্বাক হয়ে বসে আছেন। নাজিফা ঢুকরে কেঁদে উঠলো আবার।
ফয়েজ ফোন হাতে ব্যস্তভাবে বিভিন্ন জায়গায় ফোন দিচ্ছে। ইরা সবার জন্য পানি নিয়ে এলো।
মাধুর্য নাজিফার কাছে বসে চুপ করে আছে। সামনে তাকিয়ে দেখলো,মাহমুদের লাল হয়ে যাওয়া মুখ। চোখ মুখ অসম্ভব লাল হয়ে আছে। হয়তো কেঁদেছে!
‘ মাহমুদ ভাই।’ আবেশ বাসায় ঢুকতে ঢুকতে জোরে ডেকে বলল। সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো তার দিকে। সেইদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে মাহমুদকে বলল,
‘ আপার চিঠিটা কোথায়?’
মাহমুদের চোখ বেয়ে পানি গড়ানোর আগেই পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে মুছে বলল,
‘ তোমার আপা কী করে পারলো আমাকে রেখে চলে যেতে।’
‘ দুলাভাই ভেঙ্গে পড়বেন না। আপাকে আমরা খুজে বের করবোই।’
ইরা বলতেই ফয়েজ বলল,
‘ চিঠিটা দিন দুলাভাই।’
মাহমুদ হাতের মুঠোয় থেকে মুচড়ানো এক সাদা রঙের কাগজ বের করে আবেশের হাতে দিলো। আবেশ চিঠিটা নিয়ে ভাজ খুললো । সবাই উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে। আবেশ বিষাদের চোখে চোখ বুলালো চিঠিতে। সেখানে স্পষ্ট ভাবে লেখা,
মাহমুদ,
তোমার স্ত্রী আমি হয়ে উঠতে পারি নি। আমি সমাজের চোখে বিষ। তোমার সুখ কেড়ে নেওয়া জঘন্য মানুষ। তোমাকে বাবা ডাক থেকে বঞ্চিত করা বন্ধ্যা নারী।
আমার জন্য তুমি,অফিসে মুখ দেখাতে পারো না। সেদিন তোমার মা ফোন করে কেঁদেছিলেন আমার কাছে তোমাকে ভিক্ষা চেয়েছে। আমি না’কী মা হতে পারি নি তাই মায়ের কষ্ট বুঝবো না। বিশ্বাস করো,আত্মহত্যা পাপ না হলে আমি নিজেকে শেষ করে দিতাম। তোমার জীবন আর নরক বানাতে চাই না। সাথে আমার পরিবারকেও আর কষ্ট দিতে চাই না। এই সমাজ আমাদের জন্য না মাহমুদ। তোমার ভালোবাসা আমার কাছে মূল্যবান। আমি তোমার ভালোবাসা রক্ষা করতে পারলাম না। এই সমাজে,মায়েদের জায়গা আছে,সন্তান জন্মদান করা মহিলায় জায়গা আছে তবে আমার মতো বন্ধ্যা নারীর নয়। এই অঘোষিত,জঘন্য নিয়ম যখন যাবে,আমার মতো অনেকে বাঁচতে শিখবে। আমি চাই না আর এই সমাজে থাকতে। যেখানে আমার সম্মান নেই। পদে পদে যেখানে আমার দূর্বলতা নিয়ে হাসাহাসি করা হয়। আমার প্রতি তোমার ভালোবাসার মূল্য টা হয়তো সমাজ রক্ষা করতে দিবে না,মাহমুদ। আমি না হয় হারিয়ে যাই এই নিয়ম বাধা সমাজ থেকে।
ইতি,
সমাজের চোখে বন্ধ্যা নারী
চলবে…..
[ মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম। গল্পের যেখানে পরিপূর্ণতা আমি সেখানেই সমাপ্তি টানবো এই নিয়ে আমি এত প্রেশার আর নিতে পারছি না।]
চলবে….