ভেতরে বাহিরে পর্ব-২৮

0
1706

#ভেতরে_বাহিরে
পর্ব:২৮
লেখিকা: #রুবাইদা_হৃদি
আকাশ জুড়ে সূর্যের উজ্জ্বল ঝলকানি। ঝিমিয়ে থাকা পরিবেশের সাথে তাল মিলাচ্ছে এহসান বাড়ির সদর।সবার চোখেমুখ চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে। মাহমুদ দুইহাতে মুখ ঢেকে বসে আছে। কেঁপে কেঁপে উঠছে তার শরীর। মাধুর্য সেদিকে তাকাতেই তার বুক ধ্বক করে ওঠলো। আবেশ তখন ফোনে কারো সাথে উচ্চস্বরে কথা বলতে ব্যস্ত। মাধুর্য ধীরপায়ে আবেশের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে আবেশের হাতের ভেতর দিয়ে তার হাত দিয়ে হালকা পেঁচিয়ে ধরে অস্থির কন্ঠে বলল,

‘ মাহমুদ ভাইয়া কাঁদছেন।’

আবেশ মাধুর্যের শীতল কন্ঠ শুনে মোবাইল নামিয়ে বলল,

‘ আপাকে দুলাভাই বড্ড বেশি ভালোবাসেন। আমার আপা কেন বুঝলো না। মানুষটাকে কষ্টের মাঝে রেখে উধাও হয়ে গেলেন।’

‘ আপার দিক থেকে আপা যে প্রতিনিয়ত ভাঙ্গছিলো।সমাজের নিয়মের বেড়াজাল সহ্য কর‍তে পারে নি।’

‘ চিন্তা করো না। আপাকে ঠিক ফিরিয়ে আনবো আমরা।’ আবেশ আশ্বস্ত করে বলল। তার চোখ লাল হয়ে উঠেছে। গলা কাঁপছে। শুধু দূর্বলতা প্রকাশ কর‍তে চাইছে না। উষ্কখুষ্ক চুলগুলোতে হাত দিয়ে ব্রাশ করে ফয়েজকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘ ভাই আমি মোহসীনের সাথে যাচ্ছি। তুই তোর মতো কাজে লেগে যা। যে করেই হোক আপাকে ফিরিয়ে আনবো।’

‘ আমার মেয়ে অভিমানী। ও যদি নিজেকে শেষ করে দেয়।’ মাহফুজা আর্তনাদ করে বলল। নজরুল ধমকে উঠে বললেন,

‘ আমার ছেলেমেয়েদেরা লড়তে শিখেছে,মরতে নয়।নাবিহা বুদ্ধিমতী হয়ে সমাজ থেকে কী করে হেরে যেতে পারলো ! তাকে আমি এই শিক্ষা দেই নি।’

‘ আপু নিজের ভেতর নিজে গুমরে মরছিলো,বাবা।সেটা কেও উপলব্ধি করতে পেরেছিলে?’ নাজিফা কান্নারত সুরে বলল ।
মাধুর্য আবেশের হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,

‘ আপুকে আমরা সবাই একা করে দিয়েছিলাম। তার একরোখা স্বভাবের জন্য। যখন তাকে কেও বাচ্চা নিয়ে কথা শোনাতো সে ছুটে আসতো বাড়িতে। রাতভর কান্না করতো। তার কষ্টটা কেও বুঝি নি আমরা।’

মাধুর্যের কথা শোনে সবাই চুপ হয়ে গেলো। সবার দুনিয়া নিয়ে সবাই ব্যস্ত ছিলো মাঝে থেকে সে একাই লড়াই করে গিয়েছে। মাহমুদ সেইসব কথা শোনে বলল,

‘ বাঁচতে হলে আমার নাবিহাকে চাই। কোনো বাচ্চা না। এই সমাজ আমার চাই না। যারা যারা আমার অবর্তমানে ওকে কষ্ট দিয়েছে তাদের আমি দেখে নিবো। মুখ ফুঁটে সব না বলেই আমাকে ফেলে চলে গেছে। সে কী একটা বার আমার কথা ভাবলো না !’

মাহমুদের কন্ঠে বিষাদের ছায়া। বাড়ির প্রত্যেকটা সদস্য জানে,মাহমুদ কতোটা চায় তাকে। যখন প্রথম জানতে পারলো নাবিহার দূর্বলতার কথা,তখন কেউ তার পাশে ছিলো না । মাহমুদ একা হাতে সামলিয়েছে।
তার ভেতর পুড়ে কয়লা হচ্ছে। সে তো আর পাঁচটা স্বামীর মতো বলে নি,বাচ্চা চাই। তবে কেন ! নাবিহা তাকে ফেলে চলে গেলো। শুধুমাত্র সমাজের মানুষের কথায়? দরকার নেই তার এই সমাজের। যেখানে সে তার অর্ধাঙ্গিনীকে সাথে নিয়ে শান্তিতে নিঃশ্বাস ফেলতে পারে না।
মাহমুদ উঠে দাঁড়িয়ে হুড়মুড় করে বেরিয়ে গেলো এহসান বাড়ি থেকে। নজরুল ফেরাতে চাইলে আবেশ খানিক গম্ভীর স্বরে বলল,

‘ যেতে দেও বাবা। ভাইয়া পারবেন। আপার জন্য আমাদের থেকে তার ভালোবাসা বহুগুণ। আপার সাথে সে আছে এবং থাকবে।’

____________

নিয়মমাফিক ঘড়ির কাটা ঘুরে চলেছে। মাহমুদ ক্লান্ত শরীরে বাড়িতে ঢুকতেই বুকের ভেতর ব্যথার আভাস পেলো। তার সুবিশাল বাড়ি আজ ফাঁকা। বুকের ব্যথা তীব্রতর হতেই দু চোখ বেয়ে নেমে এলো কান্নারা। সারাদিন সব জায়গায় খুজেছে তার,নাবুকে। কিন্তু পায় নি।
তাদের রুমে ঢুকতেই কান্নারা হেঁচকি তে পরিণত হলো। সে খুব করে বুঝতে পারছে,হয়তো তার মা আবারো নাবিহাকে চলে যেতে বলেছেন। প্রায় আট বছরের সংসার তাদের। বিয়ের পর দুই বছরের মাথায় সুখের সংসারে ভাটা পড়ে,একটা রিপোর্টের জন্য। সেইথেকে হাসিখুশি নাবিহা হয়ে যায় রাগী,রগচটা। তবে,মানুষের কথার পৃষ্ঠে জবাব দেওয়াটা তার নাবু শেখে নি।
হন্তদন্ত হয়ে ফোন লাগালো,তার মায়ের নাম্বারে। ফোন রিসিভ হতেই রাগী কন্ঠে বলল,

‘ তোমার প্রতি আমার দায়িত্ব আছে মা। কিন্তু নাবিহা,ওর প্রতিও আমার দায়িত্ব। আমি জানি তুমি ওকে আবারো অপমান করেছো। যার জন্য আমার নাবু চলে গেছে।’

‘ ওই মেয়ের বুদ্ধি খুলেছে।হ্যাঁ করেছি অপমান। আমার বংশ ধরে রাখার ক্ষমতা যার নেই তার আবার কীসের সম্মান।’ মাহমুদের আচমকা কথায় ভরকালেন না নাজনীন। সে স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলো ছেলের কথার পৃষ্ঠে। এতে যেন মাহমুদ রেগে গেলো আরো। রাগ ধরে রেখেই বলল,

‘ তুমিও একজন মেয়ে,এরপর মা। তোমার বিবেকে আটকায় নি।কেন করলে এমন।’

‘ তোর ভালোর জন্য।’ নাজনীন বেগম ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললেন। সমাজে মুখ দেখানো যায় না,এই মেয়ের জন্য তাকে আবার সম্মান দিবেন। সেদিন,রাস্তায় ইচ্ছামত কিছু কড়া কথা শুনিয়ে লাভ হয়েছে ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো ফোনের ওপাশে। তার ছেলেকে তিনি আবার বিয়ে দিবেন। সমাজের ভেতরের নিয়ম এইটা।মাহমুদের গলা কাঁপছে। রাগ নিয়ে ঠান্ডা কন্ঠে বলল,

‘ মা তোমায় আমি সম্মান করি,ভালোবাসি। নাবিহাকেও তাই। সে চলে গিয়েছে ভেবে আমি কিন্তু তাকে খোজা বাদ রাখি নি। দ্রুত তাকে খুজে পাবো আর তাকে নিয়ে হারিয়ে যাবো।’

বলেই ফোন কেটে দিলো মাহমুদ। সাথে সাথেই নাজনীন বেগম ফোন দিলেন দেখে হাসলো মাহমুদ। তার নাবিহাকে খোজা বাকি। তারপর সেই মেয়েকে সমাজ শেখাবে সে।তার ভালোবাসাটাকে হেয় করে চলে যাওয়ার জন্য তাকে বকবে,খুব বকবে।
মাহমুদ চিঠিটা বুক পকেট থেকে বের করে বিড়বিড় করে বলল,

‘ বাঁচার জন্য আমার তোমাকে চাই,তোমার দূর্বলতা না,নাবিহা।’

সাথে সাথেই ফোন এলো তার ফোনে। নাজনীন বেগম ভেবে,মোবাইল ছুড়ে মারতে গেলেই আবেশের নাম দেখে থমকায়। তড়িঘড়ি করে ফোন ধরতেই ওইপাশ থেকে আবেশ বলে উঠে,

‘ আমাদের বাসায় আসুন।আপাকে পেয়েছি।’

এই কথাটুকু যেন শীতলতার বর্ষণ করালো মাহমুদের মনে। আবেশকে পাল্টা প্রশ্ন না করেই গাড়ির চাবি হাতে দ্রুত ছুটে গেলো সে।

_____________
ঘরময় নিস্তব্ধতা।উত্তরের জানালা দিয়ে শিরশিরে বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে ঘরের মাঝে। ঘরের প্রত্যেক কোনাচেতে শুষ্ক মুখে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। সবার দৃষ্টি বিছানায় শুয়ে থাকা,অগোছালো মেয়েটির দিকে। চিৎকার করে কাঁদছে সে। তার চিৎকার চার দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে বারেবারে ফিরে আসছে।
নাবিহাকে আবেশ আর মোহসীন পাহাড়ি এলাকায় পেয়েছে। নিজের জীবন শেষ করার মতো সাহসীকতা সে আজ দেখিয়েছে। নাবিহা কাঁদতে কাঁদতেই বলল,

‘ আমাকে কেন নিয়ে এলি আবেশ। আমি থাকতে চাই না। আমি থাকতে চাই না মাহমুদের কাছে। ওর জন্য অভিশপ্ত আমি।’

সবাই নির্বাক।নাহিবা হেঁচকি তুলে বলল,

‘ প্রতিদিন আমাকে ফেস করতে হয়। আমি বাড়ির বাইরে পা দিতে পারি না।সন্তান কেন নেই আমার,কেন! মা’য়ের ধারণা আমি তার ছেলেকে বঞ্চিত করছি।আমার বেঁচে থাকার অধিকার নেই..’

কথার মাঝেই মাহমুদ এসেই চড় বসিয়ে দিলো নাবিহার গালে।ফয়েজের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো মাহমুদের কাজে। কিছু বলতে গেলেই আবেশ থামিয়ে বলল,

‘ থামো ভাই।সামলাতে দেও।’

ফয়েজ থেমে গেলো।নজরুল আর মাহফুজা নির্বাকচিত্তে বেরিয়ে গেলো। দাঁড়িয়ে রইলো আবেশ,মাধুর্য,ইরা,আর ফয়েজ।
মাহমুদের থাপ্পড়ে নাবিহা লুটিয়ে পড়লো মাহমুদের বুকে। মাহমুদ নিজে তাকে আঁকড়ে ধরে বলল,

‘ তোমাকে আমি ছেড়ে দিয়েছি?’

‘ না।’

‘ তবে আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবলে কী করে নাবিহা ! আমি তোমার কাছে সন্তান চাই না। দিনের পর দিন আমাকে তুমি বুঝাতে চেষ্টা করেছো,সন্তান ছাড়া আমি তোমাকে ভালোবাসছি না। আমার ভালোবাসাকে তুমি অপমান করেছো নাবু।’ মাহমুদের কন্ঠে কষ্টের রেশ। নাবিহা মাথা তুলে বলল,

‘ আমি ভেবেছি,আমি চলে গেলি তোমার জীবনে শান্তি ফিরবে।’

‘ আমার তোমাকে চাই। এই সমাজ নয়,না কলুষিত মনের কাওকে।’

নাবিহা তার মাথা মাহমুদের বুকে এলিয়ে দিতেই মাধুর্য এগিয়ে গেলো। নাবিহার পাশে পড়ে থাকা হাতটা তার হাতে নিয়ে বলল,

‘ দিনশেষে বাহিরের মানুষের কথা ভুলে যাও আপা।অনেক ‘মা’ ‘বাবা’ সন্তান পেয়েও তাদের মূল্য দেয় না। তুমি যেমন একজন নতুন প্রাণের জন্য কাঁদছো তেমনি,অনেক বাচ্চা আছে মা-বাবাকে না পাওয়ার জন্য কাঁদে। তাদের একজন না হয় তোমাদের জন্য খুশি নিয়ে আসুক।’

মাধুর্যের কথায় কান্না থামিয়ে দিলো নাবিহা। সে এইভাবে ভেবে দেখে নি। শুধু কিছু বাইরের মানুষের কথা শুনেছে। নাবিহা থামতেই ফয়েজ আর ইরা সপ্তপর্ণে বেরিয়ে যায়। আবেশ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

‘ মাধুর্য আমার সাথে এসো টায়ার্ড লাগছে খুব।’

‘ আপার কাছে আরেকটু থাকি।’ মাধুর্য রিনরিনে গলায় বলল। আবেশ রক্তবর্ণ চোখে তাকাতেই মাধুর্য কোনো কথা না বলেই বেরিয়ে যায় সাথে আবেশ।

আবেশ বেরুতেই মাধুর্য দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

‘ আপাকে বুঝানোর উচিৎ ছিলো আমাদের।’

‘ মাহমুদ ভাইয়া আছেন।’ আবেশ ভ্রুকুটি করে বলল। মাধুর্যের কন্ঠে মন খারাপের রেশ টেনে বলল,

‘ আমাদেরও বুঝানো দরকার ছিলো। সবাই আপাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন এইজন্যই তো আপা রাতে কান্না করতো।’

আবেশ দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে আছে। নিজেকে যথাসম্ভব স্থির রেখে বলল,

‘ রুমে চলো।’

‘ আগে বলুন,কেন আমাকে থাকতে দিলেন না।’

মাধুর্যের কথা শোনে ক্লান্ত ভঙ্গিতেই আবেশ দুই আঙ্গুল কপালে ঘষে কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে কোলে উঠিয়ে নিলো টেনে। মাধুর্য তার এহেন কাজে ভরকে গেলেও সামলে নিলো নিজেকে। অবাক চাহনীতে তাকাতেই আবেশ বিনম্র কন্ঠে বলল,

‘ এখন বুঝাবো সব ইন ডিটেলস।’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here