ভেতরে বাহিরে পর্ব-২৬

0
1060

#ভেতরে_বাহিরে
পর্বঃ২৬
লেখিকাঃ #রুবাইদা_হৃদি
মাঝ রাস্তায় মাধুর্যের হাত পেছনে থেকে আঁকড়ে ধরলো আবেশ৷ মাধুর্য কিছু বুঝার আগেই তার মাথা অতিদ্রুত গিয়ে ঠেকলো আবেশের বুকে৷ বলিষ্ঠ বুকে মাথা বেশ জোরেই আছড়ে পড়েছে মাধুর্যের ৷ মুখ দিয়ে ব্যথাতুর শব্দ ভেসে আসতেই আবেশ রাগী সুরে বলল,

‘ চোখটা কী বাসায় ফেলে এসেছো? এইভাবে কেও রাস্তা পার হয়!’

মাধুর্য নিজের ভুল বুঝতে পেরে নিভু নিভু চোখে আশেপাশে তাকালো৷ দেখলো একটা বাইক থেমে আছে তাদের থেকে একটু দূরেই৷ কোচিং এর গেইটের সামনে গাড়ি থামতেই সে একা একাই বেরিয়ে যায় আবেশকে রেখে ৷ দুই দিকে না দেখেই রাস্তা পার হতে গেলেই ডান পাশে থেকে ছুটে আসে একটা বাইক ৷ ভাগ্যিস আবেশ খেয়াল করে দ্রুত টেনে ধরেছিলো তাকে ৷

‘ তোমার সাথে আমাকেও মারবে তুমি৷’ আবেশ আবারো রাগী সুরে বলল ৷ তার হার্টবিট বেড়ে গেছে হাজার গুণ৷ বুকের ভেতর কম্পনের মাত্রা এখনো কমে নি৷ চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করেছে ৷ মাধুর্য আবেশের দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলল,

‘ আ..আমি খেয়াল করি নি৷’

‘ খেয়াল করো টা কী৷ বুকের ভেতর যন্ত্রণা আমি অনুভব করছি ৷’ আবেশ দাঁতে দাঁত চেপে বলল৷ মাধুর্য থমকে তাকালো৷ চোখে ধরা দিলো মোহময় মায়া ৷

‘ বউকে সাইডে নিয়ে বুঝান৷ রাস্তা ছাড়েন,ভাই৷’ পাশে থেকে বাইকার টা রাগী স্বরে বলল৷ আবেশের খেয়াল হতেই সূক্ষ্ম ভাবে উত্তর দিলো,

‘ অবুঝ তো তাই নিজেও মাঝেমাঝে অবুঝ হয়ে যাই৷ এই ধরুণ আমি বুঝতে পারছি,আমার এখানে থেকে সরে যাওয়া দরকার৷ তবুও দাঁড়িয়ে বুঝিয়ে চলেছি৷’

‘ হা..হা..হা! আই নো দ্যাট৷ইউ ক্যারি অন ব্রাদার৷’

ভদ্রলোক উচ্চস্বরে হেসে বলল৷ তাদের পাশা কাটিয়ে বাইক নিয়ে নিজ গন্তব্যে ছুটতেই মাধুর্য অপরাধবোধ কন্ঠে বলল,

‘ আপনি আমার উপর রাগ করেছেন?’

‘ রাগ তো তুমি করে আছো,অভিমানিনী৷ যার রাগের মাত্রা আমি বুঝেও বুঝতে পারি না৷’ আবেশ হালকা উচ্চারণ করে বলল ৷ মাধুর্যের কর্ণগোচর হতেই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো ৷ তার মাঝেমধ্যে আবেশের প্রতি ক্ষোভ জন্মায়৷ আবার কখনো তীব্র বুকে ব্যথায় ভারী হয়ে উঠে অহেতুক রাগের জন্য ৷ এইসববের কারণের পেছনে সূক্ষ্ম একটা কারণ হচ্ছে,ভালোবাসা ৷ ভালোবাসার মানুষের প্রতি রাগ থেকে অভিমান হয় আর সেই অভিমান গলে সুন্দর ভালোবাসার সৃষ্টি হয়৷

__________

সময়ের পাতা উল্টাচ্ছে৷ কালচক্রের নিয়মে সময়ের প্রহর একে একে টেনে নিয়ে গিয়েছে একমাস৷ এই একমাস প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী দিনের আলো শুষে নিয়ে রাতের আঁধার নেমেছে৷ মাধুর্যের জীবনচক্রের বেশ খানিকটা পরিবর্তন এসেছে৷ তবে দূরত্ব ঘুচে নি আবেশের সাথে ৷ স্বাভাবিক নিয়মে সব চললেও দিনশেষে মাধুর্য গুটিয়ে যায়৷
মাধুর্য নিজস্ব পড়ার টেবিলে বসে ঘড়িতে সময় দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ৷ রাত প্রায় ১১ঃ১২৷ আবেশ এখনো অফিস থেকে ফেরে নি। মাধুর্য মাথা এলিয়ে দিলো টেবিলে।
তার সাথে লতা বেগমের অনেক সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।রাব্বী এখনো জেলে । তার রায় জানানো হয় নি। এই সব দেখছে মোহসীন। আবেশ বেশ নিশ্চিন্ত আছে মোহসীনের উপর দায়িত্ব দিয়ে। শাহেদের লাশ এর পরেই উদ্ধার করা হয়েছিলো,রাব্বীর কথা অনুযায়ী। মাধুর্য দেখতে যায় নি। সে পাষাণহৃদয় লালন করছে।
তবে লতা বেগম রুম থেকে বের হয় না। ইকরা নিজের মতো গুছিয়ে নিচ্ছে নিজেকে। তার বাবার খুনিও রাব্বী। ইকরা এইজন্যই মানতে পারতো না রাব্বীকে। যার দরুন রাব্বী তার অধিকার ফলাতে গিয়ে হাত তুলতো।
অতীতের হাতছানি বর্তমান,ভবিষ্যৎ সব ক্ষেত্রেই টেনে যেতে হবে। নানাকিছু ভাবতে ভাবতেই মাধুর্যের চোখে ঘুম নেমে এসেছে ।
মাথার পাশের টেবিল ল্যাম্প নিভু নিভু করছে। হয়তো ব্যাটারি নেই। দক্ষিণা জানালা দিয়ে মৃদু হাওয়ার রেশ এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে মাধুর্যের সর্বাঙ্গ।শাড়ির আচল লুটিয়ে আছে মেঝেতে।এলোমেলো লম্বা চুল গুলো ফর্সা গাল,গলায় লেপ্টে আছে সযত্নে।
আবেশ ক্লান্ত শরীর নিয়ে রুমে ঢুকলো। কাজের পরিমাণ বেড়েছে। সকালে মাধুর্যকে,কোচিং ক্লাসে দিয়ে অফিসে চলে যায় এরপর রাত দশটা পার হয়ে যায় বাসায় ফেরে সে। নিত্যদিনের রুটিন। এর বাইরে পা বাড়াতে চাইলেও পারছে না সে। মাধুর্যের সাথে দিনে দুবার কথা হয় আর সেটা সকালে আর রাতে ঘুমে।
মেয়েটা ঘুমের মাঝে কথা বলে। বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টিয়ে। আবেশের ক্লান্তি ছুটে গেলো সামনে তাকিয়ে। ঠোঁট ভেঙ্গে আফসোসের সুর তুলে বলল,

‘ আজও ঘুমিয়ে গিয়েছে।’

বলেই পা টিপে সামনে এগিয়ে গেলো।হাতে থাকা ঘড়িটা আলতো শব্দে টেবিলের উপর রেখে হাটু মুড়ে বসলো মাধুর্যের সামনে। কানের পাশের চুলগুলো গুজে দিতেই অল্পবিস্তর নড়ে উঠলো মাধুর্য। সাথে সাথে আবেশ মাধুর্যের চুলে আঙ্গুল ডুবিয়ে দিয়ে নির্বাকচিত্তে বসে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘ কখনো রাত জেগে,অপেক্ষা করেছো প্রেয়সী? হয়তো না ! কখনো আমার ফেরার জন্য অপেক্ষায় প্রহর গুনেছো? হয়তো না ! তবে আমি সেই মুহূর্ত দেখার অপেক্ষায় গুমরে মরছি। কবে হবে তুমি আমার চঞ্চলতা? তোমার কথার ফুলঝুরি তে কবে আমায় ভাসাবে? কবে সেই প্রাণখোলা হাসিতে আমার মন কাড়বে? তবে আমি অপেক্ষায় থাকবো,আছি যখন তুমি লাল শাড়ি পরে,হাত ভর্তি কাচের চুরি নিয়ে ঝুনঝুন শব্দে যখন আমার ঘর ভরে ওঠবে তখন আমি নিজেকে তোমার মাঝে বিলিয়ে দিবো।’

আবেশ বলেই টুপ করে একটা চুমু বসিয়ে দিলো মাধুর্যের মাথায়। ওঠে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। সাথে সাথেই মাধুর্যের গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো অশ্রুকণা। আবেশ যখন রুমে ঢুকেছে তখুনি তার ঘুম ছুটে গেছে।যখন তার কানের পাশে হাত রেখেছিলো তখনি সুপ্ত প্রেমের হাওয়া ছুঁয়ে গেছে তাকে। আবেশের আক্ষেপের কথাগুলো হীমশীতল ভাবে তার হৃদয়ে ঠান্ডার অনুভূতিতে গ্রাস করেছে।সে যে ইচ্ছা করে দূরত্ব বাড়াচ্ছে না। হুট করে সব ঠিক করতে চাইলেও পারছে না। তবে সবার ক্ষেত্রে নয়। এইটা শুধু আবেশের ক্ষেত্রে হচ্ছে।
ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দে ওইভাবেই শুয়ে রইলো মাধুর্য।
আবেশ মাথা মুছতে মুছতে এগিয়ে এসে মোলায়েম কন্ঠে বলল,

‘ মাধুর্য..এই মাধুর্য উঠো।’

‘ হু।’ মাধুর্য ইচ্ছা করেই গম্ভীর কন্ঠে বলে থেমে গিয়ে আবার ওইভাবে শুয়ে থেকেই বলল,

‘ আপনি এসেছেন।’

‘ না,আসি নি।আসবো এখন।’ আবেশের কন্ঠে ফাজলামো রেশ।মাধুর্য মুখ চেপে হাসলো। মাথা তুলে বসে চোখ মুছে বলল,

‘ আচ্ছা তাহলে এসে আমাকে ডেকে তুলে দিয়েন। আমি ঘুমাবো।’

‘ ভ্যাট লাগবে ডেকে দিতে।’ আবেশ খানিক মজা করে বলল। মাধুর্য প্রত্যুত্তর না করে সত্যি সত্যি আবার মাথা এলিয়ে দিয়ে বলল,

‘ খেয়েছেন?’

‘ না।’ আবেশ হতাশ ভাবে উত্তর দিলো। মাধুর্য চট করে মাথা তুলে বলল,

’ আমি খাবার বেড়ে দেই?’

‘ নিজ হাতে খেতে পারো না,সে আবার আমাকে খাবার বেড়ে দিবে।’ আবেশ তোয়ালে নিয়ে বারান্দায় যেতে যেতে বলল। মাধুর্য উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত হেটে আবেশের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

‘ কে বলেছে পারি না? অবশ্যই পারি। শুধু আপনি জানেন না।’

মাধুর্যের একটু চঞ্চলতা দেখে মুখে হাসি ফুঁটে উঠলো আবেশের। তার সামনে কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। আবেশ হাত দিয়ে মাধুর্যের কঁপালে আলতো টোকা দিয়ে বলল,

‘ বাসায় খাবার আছে?’

‘ জানি না তো।’ মাধুর্য মুখ কাচুমাচু করে বলল। আবেশ কিছু একটা ভেবে বলল,

‘ জানতে হবে না। দ্রুত রেডি হয়ে নাও।’

‘ কেন ! রেডি হবো কেন?’

‘ এতো প্রশ্ন করো কেন? রেডি হতে বলেছি হয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াবা।’

মাধুর্য কিছুক্ষণ ভেবে বলল,

‘ আচ্ছা ঠিক আছে।’

বলেই আবেশের সামনে থেকে কাবার্ডের সামনে চলে যায়। আবেশ মাথা দুলিয়ে আফসোসের শিষ তুলে বলল,

‘ বাচ্চা বউ পেয়েছিস আবেশ।যাকে তোকেই তোর বানাতে হবে।’

চলবে….

[ ঈদের আমেজ পড়েছে তিনদিন ধরেই।লেখার সময় পেলেও হাত টানছিলো না। আর বড় করতেও পারলাম না কারণ বাসায় একটু ব্যস্ত। তার উপর এর পরের লাইন গুলো স্পেশাল। তাড়াহুড়োতে নষ্ট করতে চাই না।ঈদের দিন সুন্দর হাসি-খুশি পর্ব দিয়েছি। যাই হোক,আমার পাঠকদের ঈদ মুবারক❤️অপেক্ষারত যারা ছিলেন অবশ্যই রেসপন্স করবেন। পরিশেষে ভালোবাসা,আর ঈদ মুবারক]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here