ভেতরে বাহিরে পর্ব-২৫

0
1126

#ভেতরে_বাহিরে
পর্ব:২৫
লেখিকা: #রুবাইদা_হৃদি
রাতের গভীরতা বাড়ছে।ঘড়ির কাটা নিয়মমাফিক টেনে নিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির নিয়মে সময়ের কাল।ঝিঁঝিঁ পোকারা ঘুমহীন রাত পার করছে।মাঝরাতে এক মানবীর কান্নার আওয়াজ যেন আবেশের ভেতরে উত্তাল ঝড়ের সৃষ্টি করছে।তার বুকের সাথে মাথা এলিয়ে দিয়ে ডুকরে কাঁদছে মানবী। ভিজিয়ে দিচ্ছে তার শার্ট। আবেশ মোলায়েম কন্ঠে বলল,

‘ প্রকৃতির নিয়মের বাইরে কেও এক পাঁ বাড়াতে পারে না।তোমায় ঘুরে দাঁড়াতে হবে,বাঁচতে হবে। কান্না থামাও।’

‘ আমার কোনো দোষ ছিলো না আবেশ । তবুও আমি অন্যের দোষের শাস্তি পেয়েছি। মা’কে হারানোর কষ্টে যতোটা জর্জরিত হয়েছিলাম তার আর বাবা নামক সেই মানুষটার অতীতের কিছু অংশের সত্যতা জেনে অসহায় লাগছে।’

আবেশ তার হাত রাখলো মাধুর্যের মাথায়।শ্লেষ মাখা কন্ঠে বলল,

‘ শাহেদ আঙ্কেল ,মেহরুন আন্টি তারা তাদের শাস্তি পেয়েছে। আর রাব্বী তার শাস্তি পাবে।মাঝে তোমার সাথে করা অন্যায়ের শাস্তি গুলোর ভাগ আমাদের সবার।’

আবেশের কথার প্রত্যুত্তর করলো না মাধুর্য । তার প্রাপ্যতা সে বুঝে নিতে শিখবে। অতীত আঁকড়ে কখনো বাঁচা যায় না৷ সে অতীতকে দুমড়ে মুচড়ে দিবে ৷
আবেশকে ছেড়ে দিয়ে গালের উপর পড়ে থাকা পানি গুলো মুছে নিয়ে বলল,

‘ আমি কাল থেকে কোচিং এ যাবো৷’

‘ কিছুদিন পর থেকে ৷ আগে নিজেকে সামলে ওঠো৷’ আবেশ জোর গলায় বলল ৷ মাধুর্য পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো আবেশের মুখের দিকে৷ গলার স্বর ভেঙ্গে গেছে তার৷ রাব্বীর কাছে থেকে ফেরার পর সে কেঁদেছে,লতা বেগবের জন্য কেঁদেছে,নিজের জীবনের হিসেব মিলাতে গিয়ে কেঁদেছে,শাহেদ আর তার মা মেহরুনের অন্যায় গুলো মনে করে কেঁদেছে ৷ তবে সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

‘ আমি পারবো৷ আপনি যদি না পারেন তাহলে আমি ফয়েজ ভাইয়াকে বলব দিয়ে আসতে৷’

‘ আমিই দিয়ে আসবো,ঠিক আছে?’ আবেশ খানিকটা হেসে বলল৷ মাধুর্য কী ভেবে হুট করে আবেশের হাত তার হাতের মুঠোয় নিতেই হচচকিয়ে গেলো আবেশ ৷ মাধুর্য বিনম্র হেসে বলল,

‘ আমার একটা কথা রাখবেন,আবেশ?’

‘ আমার চেষ্টার ক্রটি থাকবে না৷’ আবেশ ভরসা দিয়ে বলল৷ মাধুর্য ম্লান গলায় বলল,

‘ লতা বেগমকে আর ইকরা ভাবীকে সুন্দর জীবন দিতে চাই৷ তারাও আমার মতো বিনাদোষে শাস্তি পেয়েছে ৷’

‘ বাবার সাথে কথা হয়েছে আমার৷ ইকরা ভাবীকে তার মায়ের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে ৷ আর লতা আন্টিকে কোনো ভালো বৃদ্ধাশ্রমে দেওয়া হবে৷’

‘ আমি চাই সে আমার কাছেই এই বাড়িতে থাকুক৷ তার কোনো দোষ নেই৷’ মাধুর্য স্থিরচিত্তে বলল৷ আবেশ অনুমতি দিয়ে বলল,

‘ তুমি যা চাইবে সেটাই হবে৷ ‘

আবেশের কথা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মাধুর্য৷ লতা বেগমের শেষ সম্বল রাব্বী ৷ রাব্বী যতোটা খারাপ তার সাথে করেছে কিন্তু, সে তার মা’কে পাগলের মতো ভালোবাসতো৷ মাধুর্য মাঝেমধ্যে অবাক হতো রাব্বীর পাগলামো দেখে৷ পাষাণ মানুষের ভেতর মায়ের জন্য এতো ভালোবাসার কারণের পেছনে নিকৃষ্ট এক অধ্যায়কে ভুলানোর চেষ্টায় ছিলো ৷ জেল থেকে আসার আগে বারবার রাব্বী বলেছে,’ আমার মা’কে কিছু করিস না৷’
এই একটা কথাতেই মাধুর্য থমকে গেছে৷ মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও সে মায়ের কথাই ভাবছে ৷ যে ছেলে মায়ের জন্য সব বিসর্জন দিতে পারে,হাতে অস্ত্র তুলে নিতে পারে,সে নর্দমার কীট হলেও অতি পবিত্র৷
মাধুর্য ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো৷ তাদের জীবনের মাপকাঠি নিধার্য করেছিলো শাহেদ নামক মানুষটা৷ যেই মানুষটা নিজের পাপের শাস্তি নিজ ছেলের হাতেই পেয়েছে৷
কিছুক্ষণ বাদে,মাধুর্য আবেশের হাত ছেড়ে দিয়ে নির্মল হেসে বলল,

‘ আমাকে বুঝার জন্য ধন্যবাদ৷’

আবেশের বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো৷ মাধুর্যের দিকে নির্ণিমেষ চোখে তাকিয়ে বলল,

‘ পরিস্থিতির উপর ডিপেন্ড ছিলাম আমি৷ হঠাৎ করে তোমাদের খবর না পাওয়াতে অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম৷ তবে মেহরুন আন্টি বাবার কাছে এসেছিলেন আমরা যখন হোস্টেলে ছিলাম সেই কারণে আমরা এই ব্যপারটা কিছু জানি না ৷ এরপর তোমাদের হারিয়ে যাবার পর হঠাৎ একদিন খবর নিয়ে আমার দেওয়া একটা চিঠি ফেরত আসে নি৷ জেনেছিলাম, চিঠি কেউ একজন নিয়েছে পোস্ট অফিস থেকে ৷ তবে কে নিয়েছে সেটা জানি না ৷ দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো হয়তো তুমি নিয়েছো ৷ এর পরেই চিঠি দিয়ে অপেক্ষায় ছিলাম,তার কিছুদিন পর তোমার নামকরে চিঠি এলো প্রেরকের ঠিকানা বিহীন৷ উপরে শুধু তোমার নাম লেখা ছিলো৷ চিঠিটা বাসায় এসে এক লোক দিয়ে গিয়েছিলো ৷ আমি চিঠিতে তোমার নাম পড়ে বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছিলাম সেটা তোমার লেখা৷ চিঠির মাঝে রাব্বী জঘন্য কিছু লেখেছিলো যা ওই মুহূর্ত দাঁড়িয়ে বিশ্বাস না করা ছাড়া উপায় ছিলো না ৷ সব কিছুর জন্য আমি অনুতপ্ত৷’

মাধুর্য চুপ করে শুনে দৃঢ়তার সাথে বলল,

‘ আমি বাঁচতে চাই নতুন দিগন্তের সাথে৷ সব ভুলে যেতে চাই৷ ভুলে যেতে চাই আমার অতীত৷’

মাধুর্যের খানিকটা অস্থিরতা দেখে আবেশ বলল,

‘ মাধুর্য বাঁচবে৷ সে ভয় কাটিয়ে বাঁচবে সাথে সবাইকে নিয়ে বাঁচবে৷’

______________

গোধূলির সিক্ততা প্রকাশে মেতে উঠেছে প্রকৃতি৷ নতুন আলোয় নিজেকে রাঙাচ্ছে আকাশ৷ বিশালতার মাঝে শুভ্র নীলে ঘেরে থাকা মেঘের আড়ালে উঁকি দিচ্ছে কাঁচা হলদে রঙের আলোকছটা ৷ তবে সেই মাধুর্যতা ভেঁস করে কান্নার স্বর মাধুর্যের ভেতর নাড়িয়ে দিচ্ছে৷ লতা বেগম তাকে ধরে কাঁদছে৷ আজ রাব্বীর ফাঁসির আদেশ কার্যকর হবে ৷ একটু আগে আবেশ গিয়ে লতা বেগমকে নিয়ে এসেছে তার সাথে করে৷ রাব্বী সকল পাপ নিজ মুখে স্বীকার করেছে বলেই সব দ্রুত হয়ে যাচ্ছে৷
লতা বেগম রাব্বীর হাল জানার পর থেকেই কাঁদছে৷ আবেশের সাথে সে আসতে চেয়েছিলো না৷ তবে,আবেশ একপ্রকার মিথ্যা বলে নিয়ে এসেছে৷ তাকে বলেছে,’রাব্বীর সাথে দেখা করাবে৷’
তাদের বাড়িতে আনার পর সব জেনে মাধুর্যকে ধরে বারবার প্রলাপ করছে,

‘ রাব্বীর দোষ নেই৷ ওকে ছেড়ে দিতে বল মাধুর্য৷ আমার ছেলেটাকে ছেড়ে দিতে বল৷’

‘ রাব্বীকে তার শাস্তি পেতেই হবে এটাই বাস্তবতা৷’ আবেশ শান্ত স্বরে ঘরে ঢুকে বলল৷ বাসায় আপাতত মাহফুজা,আর ফয়েজ ছাড়া কেউ নেই৷ মাহফুজা চিন্তায় হাঁসফাস করছে নজরুল এসে কী বলবে ভেবে৷
তবে ফয়েজ বেশ খুশি হয়েছে মাধুর্যের এমন কাজে৷ আবেশের বলা কথায় কান্নার মাত্রা বাড়িয়ে দিলেন লতা বেগম৷ মাধুর্য বলল,

‘ আমি আপনাকে আশ্বাস,ভরসা কিছু দিতে পারবো না৷ তবে রাব্বীর শাস্তি তাকে পেতেই হবে৷’

‘ মাফ করা যায় না মা? ও মা৷ আমার ছেলেরে ফেরত এনে দে না রে৷ আমি ভিক্ষা চাচ্ছি৷ ও হিংস্র হয়ে উঠেছিলো ৷ আমি শিক্ষা দিতে পারিনি৷ যখন শিক্ষা দেওয়ার কথা ছিলো ও তখন ওর মার সংসার ভাংতে দেখেছে৷ মার খেতে দেখেছে৷’

লতা বেগমের বিলাপে ভরে উঠলো মাধুর্যের চোখ৷ তবুও নিজেকে সামলে বলল,

‘ আমি আমার ছোটবেলা হারিয়েছি৷ আমার মা’কে হারিয়েছি৷ সব পাপের ক্ষমা হয় না৷ আমি এতোটাও মহান নই মা ৷ আপনি আমার সাথে আমার মা হিসেবে থাকবেন৷ যদি সম্ভব হয় আমি ফাঁসির আদেশ না হয়ে কারাদণ্ড হয় সেই চেষ্টা করবো৷’

‘ মাধুর্য..যা বলছো ভেবে বলছো তো?’ আবেশ খানিক রাগীসুরেই বলল৷ মাধুর্য মাথা ঝাকিয়ে বলল,

‘ সম্ভব হলে সেটাই করুন আবেশ৷’

লতা বেগমের মুখে খুশি ধরা দিলো৷ তার ছেলে বেচে থাকবে এইটাই অনেক ৷ মাধুর্য উঠে চলে এলো তার কাছে থেকে৷ লতা বেগম ঠাই বসে রইলেন ৷

_____________
নজরুল বাড়ি ফিরেই চলে এলেন মাধুর্যের ঘরে৷ মাধুর্য তখন বসে ছিলো সোফায়৷ নজরুল কে দেখে উঠে দাঁড়াতেই তিনি বললেন,

‘ লতা বেগমকে বাসায় এনেছো,মা?’

মাধুর্য ভেবেছিলো নজরুল হয়তো রাগ করবেন৷ কিন্তু তিনি সাবলীল ভাষায় আবার বললেন,

‘ তোমার মানুষিকতার তারিফ করি আমি৷ আমরা হলে,হয়তো তাকে ছুড়ে ফেলে দিতাম৷’

‘ আসলে উনি নিজেও অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন৷ আমি চাই না আর কষ্ট পাক৷ ‘

নজরুল এগিয়ে গিয়ে মাধুর্যের মাথায় হাত রাখলো৷ ম্লানমুখে বলল,

‘ আমার অন্যায় গুলোর জন্য আমি অনুতপ্ত৷ আমি চাই তুমি তোমার সব দায়িত্ব বুঝে নাও৷’

মাধুর্য মলিন হাসলো ৷ তার কিছুই বলার নেই৷ সব সত্য তার সামনে৷ মাধুর্যের মলিনতা দেখে নজরুল অনুতাপ কন্ঠে অনেক ক্ষমা চাইলেন ৷ তবে মাধুর্য স্তব্ধ৷ সে কী করবে! দোটানার বেড়াজালে লিপ্ত৷ একটা চায় সুন্দর,ভয়হীন জীবন সে চায় এর বাইরে কিছু না৷

____________
‘ নাজিফা,তোর ভাবীকে দ্রুত আসতে বল,নাহলে আমি তাকে ফেলেই চলে যাবো।’ আবেশ গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল। মাধুর্য ড্রয়িংরুমে মাহফুজার থেকে বিদায় নিচ্ছিলো। আবেশের কথা শুনে কিছুটা উচ্চস্বরেই বলল,

‘ নাজিফা তোমার ভাইকে বলো,আমি মানুষ রোবট নই।’

‘ অনুভূতি শূন্য,রোম্যান্স বিহীন মানুষ তো রোবট’ই।’ আবেশ নীচু স্বরে বিড়বিড় করে বলল। মাধুর্য ইতিমধ্যেই বাসা থেকে বেরিয়ে হাতে থাকা ফাইল গুছাতে গুছাতে এগিয়ে আসছিলো। আবেশের কথা খানিক তার কর্ণকুহরে পৌছাতেই থমকে দাঁড়ায়। গম্ভীর স্বরে বলল,

‘ কী বললেন ! ‘

‘ কিছু বলি নি । তোমার হয়তো শোনার ভুল।’ আবেশ সহজ ভঙ্গিতে উত্তর দিলো। মাধুর্য সন্দেহের চোখে তাকিয়ে রইলো। আবেশ হেলান ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নির্বিকার ভাবে বলল,

‘ চলুন মহারাণী৷’

মাধুর্য প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে উঠে বসলো গাড়িতে৷ মাঝে কেটে গেছে দুটোদিন৷ এই দুদিন সে নিজেকে সামলেছে ৷ নজরুল এর মাঝে ব্যবসার কাজে কোথাও একটা গিয়েছে ৷
ফয়েজ এখনো বাসায়৷ ইরা হসপিটালে আর নাজিফা পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত ৷ মাধুর্য আজ কোচিং এ যাচ্ছে ৷ ফাইল গুলো আঁকড়ে ধরলো নিজের সাথে৷ তার মনে প্রফুল্লতা বইছে৷ সে আবারো পড়বে ৷ বিষাদ থেকে মুক্তির প্রহর গুনবে৷ ভেবেই এক চিলতে হাসি ফুঁটে উঠলো মুখে৷

চলবে….

[ একটা কথা বলি? এই গল্পটা বাস্তবতা সাথে কাল্পনিক৷ প্রতারণা,পরকীয়া,সম্পদ এই তিনটা জিনিস বাস্তব৷ ভেতরে বাহিরে মানে এই না সবার ভেতরে রহস্য৷ আর গল্পটার শুরু উনিশ দশক এর পর চিঠির পর্বে ২০০০-২০০৬ উল্লেখ আছে৷ সেটা অতীত৷ বর্তমান গল্পটা আছে ২০১৩ তে৷ আমি চাইলে রোম্যান্স এড করতে পারবো না হুট করেই৷ গল্প টানছি না এইটা বারবার বলি৷ রাইটার্স ব্লকে পড়েছি তাই খাপছাড়া বা কাল দেই নি৷]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here