ভালোবাসি_প্রিয়_সিজন_টু পর্ব_১৩

0
1387

ভালোবাসি_প্রিয়_সিজন_টু
পর্ব_১৩
#সুলতানা_সিমা
[কপি করা নিষেধ। শেয়ার করা যাবে]

গাড়ি চলছে নীলের দেওয়া গতিতে। শা শা বাতাসের শব্দ। পৃথিবীটা কুয়াশার চাদর বিছিয়ে আঁধার করে রাখছে চারদিক৷ চাঁদের আলো চাদর ভেদ করে ছুঁতে পারছেনা কুয়াশায় আচ্ছন্ন এই শহরকে। তাইতো সেও ব্যর্থ হয়ে বসে আছে আকাশের বুকে। ভুবনে তাঁর আলো থেকেও যেন নেই। গাড়ির গ্লাস লাগানো থাকার পরেও ঠান্ডা লাগছে সবার। নীলের পাশের সিটে বসেছে রুহান। সে ঘুমিয়ে গেছে অনেক্ষণ হলো। ইশি দিশা লুপা ও দিয়া পিছনে পাশাপাশি বসেছে। দিয়া দিশার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। দিশা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কি যেন ভাবছে সে। লুপা কানে হেডফোন গুঁজে সিটে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে গান শুনছেন ইশির ঘুম পাচ্ছে। বার বার হাই তুলছে। মাঝখানে দিহান আর তার দাদী বসেছে। তাঁর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছেন শান্তি চৌধুরী। আর দুই-তিন ঘন্টার রাস্তা তাঁরা ঢাকায় পৌঁছে যাবে। দিহান হাত ঘড়িতে টাইমটা দেখে নিলো রাত তিনটা বাজে। এখন মনে হয় অরিনকে ফোন দিলে পাবেনা। ফোন দেওয়ার ইচ্ছা হলেও দিহান নিজেকে দমিয়ে নিলো। অরিনের ঘুম ভাঙাতে ইচ্ছে করছে না। আর একেবারে ঢাকায় গিয়ে ফোন দিবে। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারলো না দিহান। অরিনের জন্য মনটা ছটফট করছে তাঁর। একবার পিছনে তাকিয়ে দেখল দিয়া ইশি ঘুমিয়ে গেছে দিশার মুখটা খুব বিষন্ন লাগছে। মনে হয় দাদীর অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেছে। লুপা গান শুনছে। দিহান নীলকে বলল,”নীল তোর ফোনটা দে তো?” নীল কোনো কথা না বলে ফোন বের করে দিলো। দিহান ফোন নিয়ে দুটো ফোন দিলো অরিনকে৷ অরিনের ফোন বন্ধ বলছে। দিহানের কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো। সে যখন অরিনের হাতে ফোন তুলে দিছিলো, তখন ফোনে তো full চার্জ ছিলো। দিহান মেসেজ দিলো,”বউ তোমাকে বলে আসিনি বলে রাগ করেছো? সরি বউ। আমি জ্ঞানশূন্য হয়ে গেছিলাম। কেমন আছো তুমি? ঢাকা গিয়ে ফোন দিবো। দাদুমনির জন্য দোয়া কইরো আর নিজের খেয়াল রেখো।” দিহান মেসেজ সেন্ড করে নাম্বারটা ডিলিট করে নীলের কাছে ফোনটা দিয়ে দিলো। নীল ফোন হাতে নিয়ে পিছনে তাকালো। দিহান মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে আছে। নীল ফোনের ডায়েল চেক করলো। নাম্বার নেই দেখে সে বুঝে গেলো দিহান অরিনকেই ফোন দিয়েছে। দিহান ফোনটা রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। দিহানের আর শাওনের জন্য খুব চিন্তা হয় তাঁর। কে জানে এই সুন্দর সম্পর্কটা আর কতোদিন থাকে।

ঢাকা পৌঁছে দিহান শান্তি চৌধুরীকে নিয়ে হসপিটাল গেলো। এখনো তাঁদের বাসার মানুষ জানেনা উনার কথা। জানলে সবাই চিন্তা করবে তাই জানানো হয়নি। মিহান ইশিকে ফোন দিয়েছিলো। ইশি মিহানকে কথায় কথায় বলে দেয় তাঁর দাদীর কথা। মিহান কথাটা শুনেই সে চলে আসছি বলে। দিহান ইশি দিশা সবাই আসতে না বলে কিন্তু মিহান ফোন কেঁটে দেয়। কোনো উত্তর দেয়নি। হয়তো সত্যিই চলে আসছে। তাঁদের দাদী যে তাঁদের কলিজার টুকরা।

দাদীকে হসপিটালে রেখে দিহান গিয়ে আগে ফোন কিনলো। ফোন কিনে অরিনকে আগে ফোন দেয় । অরিনের ফোন এখনো বন্ধ৷ দিহানের ইচ্ছে করছে উড়ে তমালপুর চলে যেতে। তারপর তাঁর বউকে নিয়ে চলে আসতে তাঁর কাছে। শান্তি চৌধুরীর জোরাজোরির কারণে দুপুরের দিকে বাসায় আসে সবাই। শান্তি চৌধুরীর অসুস্থতার বিষয়টা বাসার সবার কাছে চেপে যায় দিহানরা। উনি নিষেধ করেছেন জানাতে। নীল হসপিটাল থেকে চলে গেছে বাসায় আসেনি। লুপা আগে থেকেই জানতো নীল আসবে না। কারণ এখানে লুপা থাকে।

শান্তি চৌধুরীকে ধরে ধরে এনে সোফায় বসানো হয়। সোফায় বসেই উনি সোফায় হেলান দিয়ে চোখ নিবুনিবু করে সবদিকে তাকাচ্ছেন। উনার বড় বউ আর মেজো বউ দৌঁড়ে এগিয়ে আসেন। সুমনা চৌধুরী বললেন ,”আম্মা। আম্মা আপনি সুস্থ আছেন তো? ” শান্তি চৌধুরী ম্লান হেসে বললেন,”
_হ্যাঁ বউমা। জার্নি করে এসেছি তো তাই এমন লাগতেছে।” সুমনা চৌধুরী [দিহানের মা] আর দিলারা চৌধুরী [দিহানের বড় মা] দিহানের মাথায় ব্যান্ডেজ দেখে একশোটা প্রশ্ন করেন। দিহান বলে,”ছোট খাটো এক্সিডেন্ট আম্মু তেমন কিছুনা। দাদুমনিকে দেখো তো।” বলেই দিহান চলে যায় উপরে। এক কথায় পালালো সে। শুধু শুধু সবাইকে টেনশনে ফেলে কি লাভ?

সুমনা আর দিলারা মিলে শান্তি চৌধুরীকে ধরে উপরে উঠাতে লাগলেন। [সায়রা চৌধুরী] লুপার মা চুল মুছতে মুছতে রুম থেকে বের হলেন। শান্তি চৌধুরীকে এভাবে ধরে ধরে রুমে ঢুকাচ্ছেন দেখার পরেও উনি নিজের মতো করে চুল মুছতে থাকেন। এমন ভাব যেন শান্তি চৌধুরী এতো বাসায় ছিলেন কোথাও জাননি। সব ঠিকঠাক আছে। সুমনা চৌধুরী চাপা স্বরে দিলারা চৌধুরীকে বললেন,”দেখছো? একবারও জিজ্ঞেস করলো আম্মার কি হইছে, বা আম্মা কখন আইছেন?” শান্তি চৌধুরী রাগান্বিত চোখে সুমনার দিকে তাকালেন। সুমনা চুপসে যান। শান্তি চৌধুরীর কড়া আদেশ কেউ কারো আড়ালে কাউকে নিয়ে কিছু বলবেনা এতে সংসারে ঝগড়া লাগে। মনমালিন্যতা বাড়ে। শান্তি চৌধুরীকে রুমে শুইয়ে ভাত নিয়ে আসেন দিলারা। শান্তি চৌধুরী খাওয়ার পরে নিচে আসলেন সুমনা। এসে দেখলেন দিহান সোফায় বসে আছে। কাকে জানি বার বার ফোন দিচ্ছে। সুমনা কিচেনে গেলেন। সবাই এসে বলছে খিদায় তাঁদের পেট চোঁ চোঁ করছে। সুমনা চৌধুরী টেবিলে খাবার রাখতে রাখতে বললেন,”দিহান সবগুলারে ডাক দে। দেখ ওরা ফ্রেশ হয়েছে কিনা। দিহান কোনো জবাব না দিয়ে উপরে চলে গেলো। অরিনের সাথে কথা না বলা পর্যন্ত তাঁর গলা দিয়ে কিছুই নামবে না। যতক্ষণ অরিনের সাথে কথা হবেনা সে ভালো থাকতে পারবে না।

______________________________

বাড়ির পিছনের পুকুর পাড়ে বসে হাঁটুতে মুখ গুঁজে কান্না করছে অরিন। কাল রাতে দিহান যাওয়ার আগে একটাবারও তাঁর দিকে তাকালো না৷ অরিন কাতর চোখে তাকিয়ে ছিলো একবার যদি দিহান তাকায় সে আশায়। কিন্তু দিহান একবারও তাকায়নি। দিহানের কথা ভাবতে ভাবতে সারারাত অরিন ঘুমাতে পারেনি। সকালে ঘুম থেকে উঠেই চলে এসেছে কিছুই খায়নি। শায়লা বেগম অনেকবার বলেছেন, না হলে এক কাপ চা খেয়ে যা। কিন্তু অরিন খায়নি। বাড়িতে এসেও খেতে পারেনি কিছু। দিহানের সাথে কথা না হলে আর কিছুই খেতে পারবে না সে। দিহান তাঁর স্বামী তাঁর প্রাণের স্বামী। দিহান ছাড়া কেমনে ভালো থাকবে সে? কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি ওঠে গেছে অরিনের। দিহানের কি একটাবার ইচ্ছে করছেনা ফোন দিতে? এতো নিষ্ঠুর কেন সে? খুব তো বলেছিলো কথা না হলে মরে যাবো। এখন কই গেলো তাঁর কথা?

কাঁদো কেন অরিন?” হঠাৎ পুরুষের কণ্ঠ কানে আসতেই কেঁপে উঠে অরিন। এরকম একটা নিরিবিলি পরিবেশে এভাবে কারো গলা শুনলে কে না কেঁপে উঠে? অরিন চোখ মুখে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালো। বাবুল মিয়ার ভাতিজা ইমন দাঁড়িয়ে আছে। শ্যামবর্ণ গায়ের রং ছেলেটার। ফিগারটা বেশ ভালো। সাদা রংয়ের একটা শার্ট পড়েছে,কালো ট্রাউজার। দেখতে ততটাও খারাপ লাগছে না। অরিন বাড়িতে আসার পরে আমিরুন নেছা তাকে ডেকে নিয়ে বলেছেন কাল রাতে নাকি বাবুল সাহেব ও মেম্বার সাহেব এসেছিলেন। উনি উনার ছেলের জন্য নিতে পারেন নি তো কি হয়েছে উনার ভাতিজার বউ বানিয়ে অরিনকে নিবেন। লোকে যা বলার বলুক তাতে নাকি উনার কিচ্ছু আসে যায়না।

অরিন উঠে দাঁড়িয়ে কোনো কথা না বলে চলে যেতে লাগে। ইমন পথ আটকে দাঁড়ায়। অরিন ঝাঁজালো গলায় বলে, “পথ আটকাচ্ছেন কেন? পথ ছাড়ুন।
_কাঁদলা কেন তুমি?
_সেটা আপনাকে বলতে হবে?
_না বলতে হবেনা। কিন্তু আমার জানতে ইচ্ছে হলো আরকি।
_পথ ছাড়ুন।
_হুম ছাড়ছি তো। আসলে চাচা আমাকে পাঠিয়েছিলেন তোমার মায়ের সাথে কথা বলতে। তোমার মা নাকি আমাকে কি বলবেন। কিন্তু উনি ঘরে নাই৷ তোমার চাচাতো বোন বলল তুমি পুকুর পাড়ে আছো।
_যার সাথে কথা বলতে এসেছেন তার সাথে কথা বলে যান আমার সাথে কথা বলছেন কেন যত্তসব।” অরিন ইমনের পাশ কেটে চলে গেলো। ইমন কিছু না বলে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকল। অরিনের এতো রাগ সেটা জানা ছিলোনা ইমনের।

অরিন ঘরে এসে রাগে খাটে একটা লাত্তি দিলো। পায়ে ব্যথা পায় কিন্তু এই ব্যথাটা ব্যথা লাগছে না তাঁর। দিহানের জন্য যে ব্যথা লাগছে সেটার কাছে এটা কিছুই না। তাঁর স্বামীর কোনো খুঁজ নেই,এর থেকে বেশি কষ্ট আর কি হতে পারে। অরিন ফোন হাতে নিলো৷ ফোনটা দেখে তাঁর মা জিজ্ঞেস করেছিলেন ফোন কই পেলো। অরিন বলেছে নানুমনি দিয়েছেন। জহুরাও বিশ্বাস করে নিয়েছেন। দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন করেন নি আর। অরিন ফোনের পাওয়ার জ্বালায়। এখনো একটাও কল আসেনি। রাগে অরিন ফোন রেখে দেয়। ফোনটা রেখে আবার সাথে সাথে ফোন হাতে নেয়। airplane mode করা। অরিন আহাম্মকের মতো হা করে বসে থাকে। এটা এতোক্ষণ ধরে সে খেয়ালই করেনি। আর শুধু শুধু দোষারোপ করছে দিহানকে। নিজের উপর এতো রাগ হচ্ছে তাঁর ইচ্ছে করে কেঁদে দিতে। সে airplane mode অফ করে দিলো। নেটওয়ার্ক পেতেই সাথে সাথে একটা মেসেজ ঢুকলো৷ মেসেজ পড়তে লাগলো মাত্রই কল আসে। অরিন একমূহুর্ত দেরি না করে রিসিভ করলো। অরিন হ্যালো বলতেই দিহান বলল,”ওই তুমি ঠিক আছো তো? ফোন বন্ধ কেন তোমার?” অরিন কিছু বলেনা। দিহান আবার বলে,”জানো টেনশনে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আর তুমি ফোনটা বন্ধ করে রাখছো? আমি বলে আসিনি বলে রাগ করে আছো? তুমি আমার পরিস্থিতিটা বুঝনি?” অরিন ডুকরে কেঁদে উঠে। দিহান নিশ্চুপ হয়ে যায়। অরিন ফ্যাস ফ্যাস করে কাঁদতে থাকে। দিহান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,”সরি বউ।” অরিন চোখ মুছে ভেজা গলায় বলল ”
_কেন?
_দাদুমনির অবস্থা দেখে মাথা কাজ করছিলো না। কি করতাম বলো?
_আমি রাগ করিনি। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আপনাকে খুব মনে পড়ছে। আমি পারছিনা থাকতে।” বলতে বলতে অরিনের চোখ দিয়ে আবার জল গড়িয়ে পরলো। দিহান ভাঙা গলায় বলল ”
_আমারও খুব কষ্ট হচ্ছে তোমাকে ছাড়া। ইচ্ছে করছে চলে যাই তোমার কাছে। তুমি চিন্তা করো না। দাদুমনি পুরোপুরি সুস্থ হোক আমি দাদুমনিকে বলে দিবো সব কিছু। দেখবে খুব শীঘ্রই আমরা এক হয়ে যাবো। দাদুমনি তোমায় অনেক পছন্দ করে আমার বিশ্বাস না বলবে না।” অরিন লজ্জায় লাল হয়ে বলে,
_হুম জানি।”

অরিন আর দিহান অনেক্ষণ কথা বলে। তারপর দিহান ফোন রেখে দেয়। বাইরে থেকে চিল্লাচিল্লি শুনা যাচ্ছে। দিহান বাইরে এসে দেখলো। মিহান চলে এসেছে। দাদীর গলা জড়িয়ে বসে আছে। দিহান হাসলো। এই ছেলেটা দাদী আর বইয়ের পাগল। এই দুইটা ছাড়া সবকিছুই তুচ্ছ তাঁর কাছে।

চলবে,,,,,।

আমার গল্প নিয়ে আড্ডা দিতে গ্রুপ খুলা হয়েছে। সবাইকে এড হওয়ার অনুরোধ করা হলো। link,,,,,, https://facebook.com/groups/248089863499125/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here