ভালোবাসি_প্রিয়_সিজন_টু
পর্ব_২১
#সুলতানা_সিমা
তীক্ষ্ণ চোখে টিশার্টের দিকে তাকিয়ে আছে শাওন। তার স্পষ্ট মনে আছে জহুরা বেগম বলেছিলেন উনি মাত্র সেলাই শেষ করে এসেছেন। কিন্তু টিশার্টে কোনো সেলাই নেই। যদিও শাওন এটা সেলাই করার জন্য দেয়নি। কিন্তু জহুরা যখন মিথ্যে বলেছেন তখন নিশ্চয়ই এখানে কোনো কারণ লুকিয়ে আছে। শাওনের মনের সন্দেহ আরো বেড়ে গেলো। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। মাগরিবের নামাজ শেষে আসার সময় সে অরিনদের বাড়ি যাবে। আচ্ছা ততক্ষণে দেরি হয়ে যাবে নাতো? মগজে প্রশ্নটা উঁকি দিতেই শাওনের মন অস্থির হয়ে গেলো। টিশার্ট টা খাটের উপর রেখে নিচে আসলো সে। শায়লা বেগম জিজ্ঞেস করলেন,”কি রে কই যাস?” শাওন নামাজে বলেই সদর দরজা খুলে বের হলো। বাইরে অনেক বৃষ্টি হচ্ছে। এই বৃষ্টি আবার কখন থেকে শুরু হলো? ভিতরে থেকে সে বলতেই পারেনি বৃষ্টি হচ্ছে। হঠাৎ এতো বৃষ্টি হওয়ার মানে কি? বৃষ্টিও অরিন আর জহুরাকে সাথ দিচ্ছে। রাগে শাওন দরজায় একটা লাত্তি দিলো। হঠাৎ মাথায় এলো বৃষ্টি হলে তো আরো ভালো। ওদের বাড়িতে উঠতে অন্য কোনো অজুহাত লাগবে না। শাওন ছাতা নিয়ে আসলো। বের হতে যাবে তখনই বাঁধ সাধেন শায়লা বেগম। তিনি কিছুতেই এই বৃষ্টির মধ্যে শাওনকে বের হতে দিবেন না। শাওন কখনোই মায়ের অবাধ্য হয়না। সে চলে গেলো রুমে। অপেক্ষা করতে লাগলো কখন বৃষ্টি থামবে আর কখন সে বের হবে অরিনের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
______________________
টিনের চালে বৃষ্টির ঝনঝন শব্দ। চারদিকে কনকনে ঠান্ডা। ঘরের বাতি নেই। আধো আলোতে পরিবেশটা রোমাঞ্চকর হয়ে উঠেছে। গায়ে কম্বল মুড়িয়ে শুয়ে আছে দিহান ও অরিন। তাদের সম্পর্কের পূর্ণতা পেলো আজ। ভালোবাসার মানুষের হাতে নিজের সর্বোচ্চ সঁপে দেওয়ার মাঝে অনেক সুখ লুকিয়ে আছে। আজকের দিনটা না আসলে হয়তো অরিন তা অনুভব করতে পারতো না। দিহানের বুকে মাথা রেখে সুখটা অনুভব করছে অরিন। আর তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে দিহান। মাত্র আদর মাখানো বউটাকে ইচ্ছে করছে আরো আদর মাখাতে। অরিনের মাথায় হাত বুলিয়ে ঘোর লাগা গলায় ডাক দিলো,”বউপাখি।
_হুম।
_জানো,শীত আর বৃষ্টি এই দুটো জিনিস মনে সব অনুভূতি গুলা জাগিয়ে তুলে।” অরিন দিহানের বুক থেকে মাথা তুলে বলল,”কে বলেছে?
_আমি বলেছি। তুমি কাকে জিজ্ঞেস করবা কইরো।” অরিন কিছু না বলে একটু হাসলো। কিছুক্ষণ কথা বলল দুজন। দিহান অরিনের মাঝে আমার নিজেকে হারাতে চায়। অরিনের গলায় মুখ ডুবাতেই মাগরিবের আজানের ধ্বনি কানে এলো। বৃষ্টি থেমে গেছে এখন। তাই আজানের স্পষ্ট ধ্বনি শুনা যাচ্ছে। দিহান তৎক্ষণাৎ উঠে গেলো। দুজন উঠে ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে নিলো। দিহানের ঠান্ডা লাগছে একটু চা হলে মন্ধ হতো না। কিন্তু অরিনকে কিভাবে বলবে এটা ভেবে দ্বিধায় ভুগছে সে। একটু পর পর কাশি উঠছে এটাও রিক্স। বাইরে থেকে কেউ শুনলে কি হবে? অরিন দিহানকে বলল,”আপনি বসুন আমি চা নিয়ে আসছি।
_রং চা হলে ভালো হবে।
_জ্বি।” অরিন রান্না ঘরে চলে গেলো। রান্না ঘরে এসে দেখে দুধ নাই। দিহান রং চা চেয়ে তাকে বাঁচিয়ে দিলো। অরিন দিহানের জন্য চা বানিয়ে ঘরে নিয়ে গেলো।
আমিরুন নেছা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অরিন ঘরে ঢুকার সময় ঘরের ভেতর কিছু দেখতে পেলেন। উনার মনে হচ্ছে এটা মানুষ। উনি শিওর নন। আমিরুন নেছা সেলিনা বেগমকে গিয়ে বললেন,”অরিনের মা তো কোনোদিন অরিনিরে বাড়িত রাইখা বাইরে যায়না। আর গেলেও আমারে কইয়া যায় যেন ঘরের দিকে খেয়াল রাখি। এইবার তো কইয়া গেলোনা। আর অরিনও সারাদিন একলা একলা ঘরে করেডা কি?” সেলিনা বেগমের কপালে বাঁজ পড়ে। উনি এই বিষয়টা এতোক্ষণ ভাবেন নি। পান বানাতে বানাতে বললেন,”ওরা তো মা মেয়ে এমনই কারো সাথে মিশে না। তুমি ঘরে যাও।” আমিরুন নেছা চলে গেলেন। কিন্তু সেলিনা বেগম পান চিবুতে চিবুতে ভাবতে লাগলেন আমিরুন নেছা যা বললেন তা কি যুক্তিসম্মত?
দিহান চা খেয়ে নিজেকে একটু ঝরঝরে অনুভব করলো। অরিনকে পিছনকে জড়িয়ে ধরে অরিনের ঘাড়ে চুমু খেলো। অরিন বলল,”খালি জড়িয়ে ধরার ধান্দা।”দিহান আবার ঘাড়ে চুমু দিয়ে বলল,”হুম।
_আচ্ছা আপনি খালি ঘাড়ে চুমু খান কেন?
_তোমার ঘাড়ের তিলটা আমার অনেক ভালো লাগে।” অরিন অবাক হয়ে থাকালো দিহানের দিকে। তাঁর ঘাড়ে তিল আছে এটা সে জানতোই না। দিহান পুরো কম্বলটা নিয়ে অরিনের আর তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত পুরো শরীর ঢেকে দিলো। অরিন বলল,”আরে এটা কি করছেন। বসা থেকে কেউ এভাবে কম্বল নেয়?
_উঁহু কেউ নেয়না। কিন্তু আমি নেই।” দিহানের হাত অবাধ্য ভাবে ছুটতে লাগে। অরিন কম্বল থেকে বেরিয়ে দিহানকে বলে,”আপনি একটা উচ্চ মাপের লুচ্চা।” দিহান অরিনকে কাতুকুতু দিতে লাগে। অরিন জোরে জোরে হাসতে লাগে। এতো জোরে হাসে যে তাঁর হাসি সেলিনা বেগমের ঘর থেকে আমিরুন নেছার ঘর পর্যন্ত যায়। দিহান অরিনের মাথা থেকে যেন বেড়িয়ে গেছে তারা এখন জোরে কথা বললে বিপদ আসবে। হঠাৎ অরিন মুখ চেপে ধরে। আস্তে আস্তে বলে “আরে কি শুনবে।” দিহান থেমে যায়। সেও হাসছে তবে জোরে নয়। অরিন জোরে জোরে কয়েক শ্বাস ছেড়ে বলল,”অভদ্র লোক।” দিহান একটু এগিয়ে এসে বলে,”আবার?”
_সরিইইইই।
_ঠিক আছে কিস দাও।” অরিন দিহানের ঠোঁটে লম্বা একটা কিস এঁকে বলল, “আপনি বসুন আমি রান্না করে আসি।
_রান্না করবা কেন? তরকারিতো আছেই। এগুলা গরম করে নাও।” অরিন মনে মনে হাসলো। সেতো এই তরকারি গুলাই গরম করতো। রান্না করার জন্য নতুন কিছু আছে নাকি। একটু হেসে বলল,”
_জ্বি আচ্ছা এগুলাই গরম করছি। আর ভাত রাঁধবো আপনি বসুন।” অরিন উঠে টেবিল থেকে তরকারির বাটি হাতে নিলো। দিহান বলল,”বাহ বাহ কি লক্ষী মেয়ে কত সুন্দর কথা শুনে।
_আস্তে কথা বলুন।
_আগে তুমি যে জোরে জোরে হাসলা?
_আমি আছি বলে সবাই জানে কিন্তু আপনি আছেন বলে তো কেউ জানেনা। দরজা বন্ধ করুন আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি।” অরিন বেরিয়ে দরজা এটে চলে গেলো। দিহান দরজা বন্ধ করতে যাবে নীল মেসেজ দিলো। দিহান ফোন হাতে নিয়ে দেখলো নীল বলছে,”দিহান শামু বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে রে। ওর পরিবারকে আজ জানাবে আমাদের কথাটা। কিন্তু আমি বিয়ের জন্য প্রস্তুত নয়। কি করবো রে একটা আইডিয়া দে।” দিহান দরজা বন্ধ না করে মেসেজের রিপ্লাই দিতে লাগলো।
সেলিনা বেগম আর আমিরুন নেছা অরিনের দরজার দিকে তাকিয়ে আছেন। অরিনের হাসির উচ্চ শব্দ তাদের মনকে জানান দিচ্ছে অরিন একা নেই কেউ তো তাঁর সাথে আছে। অরিন যখন রান্না ঘরে কাজে মগ্ন তখন সেলিনা বেগম পা টিপে টিপে অরিনের শুবার ঘরের দিকে গেলেন। আস্তে করে দরজা ধাক্কা দিলেন দরজা খুলে যায়। একটা ছেলে খাটে বসে ফোন টিপছে। সেলিনা বেগম কপালে চোখ তুলে তাকান। অরিনের এতো বড় সাহস? একেবারে বাড়িতে ছেলে নিয়ে ঢুকেছে? দ্রুত পায়ে তিনি ঘরে চলে আসেন। তিনি এসে আমিরুনকে বললেন,”কত্তো বড় খারাপের বাচ্চা। ঘরে ছেলে নিয়ে আছে?”
আমিরুন নেছা বলল,”
_দেখলা আমার কথা বিশ্বাস করো নাই।” সেলিনা ফোন বের করে তানিয়াকে বললেন,”এই বেশ্যার কাছ থেকে জহুরার নাম্বার নিয়ে আয়। আজই এদের বাড়ি থেকে বের করে দিবো। আমার বাড়িতে এতো নষ্টামি চলবে না।” তানিয়ার অনেক ক্ষোভ অরিনের উপর। অরিন তাকে কথা বলতে ফোন দেয়না। সে এই সুযোগে নিজের ক্ষোভ মিটাতে চাইলো। তার মাকে বলল,” মা তাঁরা আমাদের ঘরে থেকে নষ্টামি করবে আর এগুলার কোনো বিচার হবেনা? যাও গিয়ে চেয়ারম্যান মেম্বারকে নিয়ে আসো। সবাইকে দেখিয়ে দাও তাদের কর্মকান্ড। নয়তো দেখবে বের করে দেওয়ার পরে সবাই আমাদের উপর বিচার বসাবে। আমরা কেন বের করে দিলাম। তখন তোমার মুখের কথা মানুষ বিশ্বাস করবে?” সেলিনা বেগম তানিয়ার কথায় ভাবনায় ডুবেন। তানিয়ার কথায় যুক্তি আছে। সত্যিই তো বলছে সে। আমিরুন নেছাকে নিয়ে যেতে চাইলেন চেয়ারম্যান মেম্বারকে আনতে। আমিরুন নেছা বললেন,”ওদের ফোন দিয়া আইতে কও।” সেলিনা বেগম তাদের ফোন দিতে গেলে তানিয়া বলে,”এখন না রাত দু’তিনটার দিকে দাও।” সেলিনা রাজি হলেন। তানিয়া কি একটা ভাবতে ভাবতে বাঁকা হাসলো।
অরিন তরকারি নিয়ে এসে দেখলো দরজা খুলা দিহান ফোন টিপছে। অরিনের বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো। সে তৎক্ষণাৎ আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো কেউ আছে কিনা। কেউ নাই দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। টেবিলে বাটি রেখে এসে দিহানকে বলল,”ওই আপনি তো এখন বিপদ নিয়ে আসতেন?” দিহান ফোন টিপতে টিপতে বলল,”কেন কি হইছে?” অরিন ফোন কেড়ে নিয়ে বলল,”দরজা বন্ধ করতে বলছিলাম না। দরজা খুলা ছিলো কেন?
_কি বলো দরজা খুলা ছিলো? সরি বউপাখি। আমি খেয়াল করিনি। ” অরিন কথা বাড়ালো না। সে গিয়ে বাকি বাটিগুলো নিয়ে আসলো। রাতে খেয়ে ধেয়ে শুয়ে পড়লো দুজন। দিহান অরিনকে বুকে নিয়ে বলল,”ভেবেছিলাম কাল চলে যাবো। কিন্তু আমার যেতে ইচ্ছে করছেনা বউপাখি। আর একদিন থাকি প্লিজ।
_হুম আমিও চাই আপনি থাকুন।” ফিসফিসয়ে গল্প করতে করতে দুজন ঘুমিয়ে পড়লো। রাত দুটোর সময় অরিন আর দিহানের ঘুম ভেঙে যায় দরজায় বারির শব্দে। লাফ দিয়ে উঠে বসে দুজন। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে ভয়ার্ত চোখে একজন আরেকজনের দিকে তাকায়। ঠিক তখনই দরজা ভেঙে ঘরে প্রবেশ করলেন চেয়ারম্যান মেম্বার গ্রামের গণ্যমান্য কিছু লোক। অরিন দিহান এখনো কম্বলের নিচে বসে আছে। ভয়ে অরিনের শরীর কাঁপছে৷ দিহানের কপাল ঘেমে গেছে। দিহানের গায়ে কোনো জামা নেই। সেলিনা বেগম জহুরা বেগম এসে ঘরে ঢুকলেন। লজ্জায়,ভয়ে অরিনের মরে যেতে ইচ্ছে করছে। চেয়ারম্যান সাহেব দিহানকে দেখে বললেন,”এই পোলা তো ডাক্তার বাড়ির মেহমান।” মেম্বার সাহেব বললেন,”আরে থাকুক যে কারই মেহমান ওরে ধইরা পিটা লাগাও।” দিহানকে ধরতে গেলে অরিন দিহানের হাত খপ করে ধরে ফেলে। একজন লোক দিহানকে টানতে টানতে ঘরের বাইরে নিয়ে আসেন। ধাক্কা দিয়ে উঠুনে ফেলেন। বৃষ্টি দেওয়ায় উঠুন ভিজা। ঠান্ডায় দিহান জমে এলো৷ কিন্ত এগুলা তার গায়ে লাগছে না। সেলিনা বেগম অরিনকে ধরে ইচ্ছে মতো মারতে লাগেন। ফাঁকে তানিয়াও দুই একটা মেরে দিলো। দিহান একদিকে মার খায় অন্যদিকে সেলিনাকে বলে যায়,”আন্টি ওকে মারবেন না প্লিজ। আমি ওর হাসবেন্ড হই। একটা এক্সিডেন্টে ওর আর আমার বিয়ে হয়েছে। বিশ্বাস করুন।” দিহান আর কিছু বলতে পারেনা একজন তাকে মুখের উপর লাত্তি দেয়। দিহানের মাথা ঘুরে যায়। জুতার মাটি চোখে ঢুকে গেছে চোখ দিয়ে তাকাতে পারছেনা। চেয়ারম্যান সাহেবের হুকুমে দিহানকে কদম গাছের সাথে বাধা হলো। অরিনের চিৎকার করে কান্নার শব্দ আসছে। বার বার শুধু মা বাবা বলে চিৎকার দিয়ে যাচ্ছে। তলপেটটা ব্যথায় জমে আছে আজ। আর তানিয়া শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে অরিনের তলপেটে একটা লাত্তি দিলো। অরিন পুরো বাড়ি কাঁপিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে অজ্ঞান হয়ে গেলো।
ফোনের তীক্ষ্ণ রিংটোনে ঘুম ভেঙে গেলো শাওনের। ফোন হাতে নিয়ে দেখে চেয়ারম্যানের ছেলে ফোন দিছে। সময়টা দেখে অবাক হলো শাওন। রাত তিনটা বাজে। বিকালে শুয়েছিলো সে। বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে গেছিলো। কিন্তু এখন এই সময়ে এ কেন ফোন দিচ্ছে। শাওন কল ধরলে ফোনের ওপাশ থেকে বলে,”শাওন তোর কলিজার অরিনকে একটা ছেলে সহ খুব বাজে অবস্থায় তার ঘরে ধরেছে সবাই। তারাতাড়ি আয়।
চলবে,,,,।
মন ভালো নেই আজ এইটুকুই নেন। কাল বড় দিবো। ইনশাআল্লাহ❤