ভালোবাসি_প্রিয় পর্ব_২১

0
1877

ভালোবাসি_প্রিয়
পর্ব_২১
#সুলতানা_সিমা

সেই কাক ডাকা ভোর থেকে এখন রাত আটটা পর্যন্ত শান্তি নীড়ের কারও মনে না আছে শান্তি না যাচ্ছে তাদের পেটে খাবার। মান সম্মানের কথা ভেবে দিহানের কথায় রাজি হয়েছিল তারা। কিন্তু এটা যে তাদের কাল হয়ে দাঁড়াবে কে জানত? আগে যদি তারা অনুষ্ঠান বাতিল করে দিত আজ তাদের এতটা অপমানিত হতে হতনা। সব হয়েছে অরিনের জন্য অরিন এভাবে না আসলে তাদের এভাবে অপমানিত হতে হতনা তাই অরিনের উপর সবার অনেক ক্ষোভ। দুনিয়া উলট পালট হয়ে গেলেও তারা অরিনকে কোনো দিনই মেনে নিবেনা। যদি দিহান কখনো অরিনকে বউ বলে মেনে নেয় তাহলে এই শান্তি নীড়ে দুটি পরিবার হবে। দিহানকে সবাই আলাদা করে দিবে তার সাথে সবার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।

সবাই যে যার রুমে বসে আছে হানিফ চৌধুরী ছেলের ওপর যতটা রেগে আছেন ততটা কষ্ট পাচ্ছেন আজকের এই অপমানে। উনি বেঁচে থাকার স্বাদ হারিয়ে ফেলেছেন। বার বার কানে বাজছে “আমাদের কী এখানে তামশা দেখানোর জন্য ডাকা হইছে?” হানিফ চৌধুরী চোখের চশমা টা খুলে চোখের পানিটা মুছে শুয়ে পড়লেন। সুমনা অনেকক্ষণ ধরে শুয়ে আছেন। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরছে। ফুঁপিয়ে কান্না করার শব্দ পাচ্ছেন হানিফ কিন্তু কিছু বলছেন না। কী বলবেন একই আগুনে যে তিনি নিজেও পুড়ছেন।

দিহানের বড় চাচ্চু রেগে আছেন সবার ওপর উনি আগেও সবাইকে না বলছিলেন যে দরকার নেই এসব কিছু করার তন্দ্রার মাকে ফোন দিয়ে না বলে দিব কিন্তু সবাই দিহানের সাথে পাগল হয়ে গেছিল। এতদিনে অর্জন করা সম্মান আজ এভাবে নষ্ট হয়ে গেল? রাত পোহালে বাইরে যাবেন কী করে? মুখ দেখিয়ে হাঁটার মত সম্মানটা কী আর রয়েছে। রাগে গিজগিজ করছেন তিনি কিন্তু কিছু বলতে পারছেন না। উনার নিজের ছেলেও যে এই কুকাজ করে বসে আছে।

এদিকে লুপার মা সেই কখন থেকে লুপার বাবাকে বুঝিয়ে যাচ্ছেন এতো টেনশন না করতে উনার এমনিতেই হাই প্রেশার এভাবে টেনশন করলে হিতে বিপরীত হবে। ডাঃ উনাকে টেনশন করতে নিষেধ করে আর উনি সেই সকাল থেকে টেনশন করেই যাচ্ছেন। লুপার মা বিরক্ত হয়ে বললেন”
_আচ্ছা টেনশন করলে কী সব কিছুর সমাধান হয়ে যাবে? যা হওয়ার তা হয়ে গেছে আমাদের কী করার ছিল বল? কে জানত আজ এই দিনটা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল?
_তুমি বুঝবেনা সায়রা এটা ছোট খাটো বিষয় নয়। আমার বাবা অনেক কষ্ট করে এই সম্মান অর্জন করেছেন। আর আমরা সেটুকুই ধরে রাখতে পারিনি। আজ জিহান দিহান এমন করেছে কাল যে আমাদের ছেলেও এমন করবেনা এটার তো কোনো গ্যারান্টি নাই।
_আমাদের ছেলে এখনো অনেক ছোট। ওকে আমরা নিজের মতো করে গড়ে তুলবো। তুমি প্লিজ নিজেকে শান্ত করো। আমাদের রুহান এমন কিছু করবে না। এখন চল কিছু খাবে প্লিজ। ভাইয়ারা কেউ কিচ্ছুটি মুখে তুলছেন না।
_আমি খাবো না। আর ভাইয়াদের এই অসহায় মুখের দিকে তাকাতেও পারব না। তুমি লাইটটা অফ করে আসো আমি একটু শোবো।
_এভাবে টেনশন করে অসুস্থ হলে বড় ভাইয়া মেজো ভাইয়াকে কে সামলাবে?
_হুম।যাও লাইট টা অফ কর” লুপার বাবা শুয়ে পড়লেন। লুপা মা লাইট অফ করে তিনি এসে খাটের বসে থাকলেন কী আর করবেন সবাই যেন কেমন জীবন্ত লাশ হয়ে গেছে। কারও মুখে কোনো কথা নেই।

বারান্দায় বসে সিগারেট ফুঁকছে দিহান। সে অতটা সিগারেট খায়না। অতিরিক্ত কষ্ট বা টেনশনে থাকলে তবেই সে সিগারেট খায়। আজ তার খুব কষ্ট হচ্ছে নিজের পরিবারের এমন পরিনতি তার চোখের সামনে হল। আর সবকিছু কিনা তার জন্য হল? সব সময় নিজের বাপ চাচাকে সবার সাথে মাথা উঁচু করে কথা বলতে দেখেছে। কখনো কাউকে মাথা নিচু করে কথা বলতে দেখেনি। আজ কিনা তার পরিবারের সবার মাথা নিচু হয়ে গেল? অরিনের প্রতি প্রচুর ঘৃণা জন্মেছে মনে। আজ এতোকিছু হল শুধু মাত্র অরিনের জন্য। কিন্তু দিহানের মনে অরিনকে দিয়ে যতই ঘৃণা থাকুক সে পারেনা অরিনের কান্না সয্য করতে। কেন জানি অরিনের জন্য তার খুব মায়া হয়। সে চায় কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি দিতে কিন্তু পারেনা। অরিনের মায়া ভরা চোখে যখন পানিতে ছলছল করে তখন তার ভেতরে মোচড় দিয়ে ওঠে। কিন্তু এত মায়া থেকে কী হবে? অরিনতো তার পরিবারের শত্রু। তার বাবা মা সবার ছোট হওয়ার পিছনে অরিন দায়ী। হাতের সিগারেট টা শেষ করে সামনে রাখা গিটার নিয়ে সেটা বাজাতে লাগে।

গিটারের টুংটাং ধ্বনি তোলে চোখ বন্ধ করে নেয়। তার চোখে ভেসে ওঠে অরিনের সাথে প্রথম দেখা হওয়ার দৃশ্যটা। তারপর চোখে ভাসে সেই রেস্টুরেন্টের টয়লেটের দৃশ্য, দিহানের পা ধরে অরিনের জুতা খুলে দেওয়ার দৃশ্য। অরিনকে কোলে নিয়ে গহীন বন থেকে বের হওয়ার দৃশ্য। দিহানের হাত আর চলেনা এইটুকুতেই থেমে যায়। খুব কষ্ট হচ্ছে তার। অরিনের কান্নারত চেহারা চোখে ভেসে উঠছে। দিহান গিটার রেখে কিচেনে যায়। বাসনের ঢাকনা সরিয়ে দেখল সবকিছু যেমন রান্না হয়েছে তেমনই আছে। এত এত খাবার এগুলা সব নষ্ট হবে। সবাই এতো জ্ঞান শূন্য হয়েছে যে এগুলা গরিব মানুষদের দিয়ে দেওয়ার কথাটাও মাথায় আসছে না। একটা প্লেটে বিরিয়ানি নিল। কিছুটা সালাদও নিল। তারপর সেটা নিয়ে আসল লুপার রুমে। লুপা হাঁটুতে মুখ গুঁজে কান্না করছে দিহান এগিয়ে গিয়ে লুপার পাশে বসল। কারও উপস্থিতি পেয়ে মুখ তুলে তাকাল লুপা। কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ লাল করে ফেলছে। দিহানকে দেখে যেন তার কান্না আরো বেড়ে গেল কেঁদে কেঁদে দিহানকে জড়িয়ে ধরে বলল”

_আমাদের সাথে এমন কেন হল ভাইয়া? যে মানুষগুলার ক্ষমতা নেই আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার আজ তারা আঙুল তুলে কথা শুনিয়ে গেল। ভাইয়া অরিন কেন এমন করল বলো? কেন ওকে যেতে দিলানা রাখলা কেন?
_কী করতাম আর বল? শুনিসনি ওর মা কী বলে গেছিল? আমি সেটা শুনার পরেও ওকে যেতে দিতাম কিভাবে? ও শুধু এই বাড়িতে এসেছে কিন্তু এই খেলটা খেলেছে অন্য কেউ তুই একবার ভাবতো। অরিন বন্দি ছিল। আর এই ঘটনা আমরা ছাড়া কেউ জানেনা তাহলে এটা তন্দ্রার মা জানল কেমনে? কেউ তো আছে যে আমাদের পরিবারেরই হয়ে আমাদের শত্রু।” লুপা দিহানের বুক থেকে মাথা তুলে বলল”
_এসব কি বলছ ভাইয়া কে এমন হবে?
_হ্যাঁ লুপা কেউ তো আছে এমন যে আমাদের ক্ষতি চায়।
_কিন্তু আমাদের পরিবারের কেউ আমাদের ক্ষতি করবে কেন?” দিহান লুপার কথার জবাব দিতে পারেনা। কারন নিজেরও মনে হচ্ছে তার পরিবারের কেউ তাদের পরিবারের ক্ষতি চাইবে কেন? দিহান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে লুপাকে বলল”

_এখন ওঠ ওকে এই খাবারটা খাইয়ে আয়।
_না ভাইয়া আমি যাবনা।
_প্লিজ লুপা। ও কিছু খায়নি দেখলেও মনে হয় অনেক দূর্বল এভাবে না খেয়ে তাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বে।
_তাতে আমাদের কী ভাইয়া? কেন এত মায়া করছ ওকে ও এসবের যোগ্য নয়।
_লুপা প্লিজ।
_তুমি যাও ভাইয়া প্লিজ আমায় যেতে বলনা। এর মুখটা দেখতে ইচ্ছে করছেনা আমার [একটু থেমে কেঁদে কেঁদে বলল ] সারাটা জীবন কষ্ট করেছে। ছোট বেলা থেকেই সৎ মায়ের অত্যাচার সয্য করে করে বড় হয়েছে। সৎ বোন নাকি অনেক মারধর করত [তাচ্ছিল্য হেসে] আমি জানতাম না ওর এই সৎ বোন টা তন্দ্রা আপু। ও কখনো আমায় নিজে কিছু বলেনি অন্য একটা মেয়ে আমায় এসব বলতো মেয়েটা তাদের ফ্লাটেই থাকত। জানো ভাইয়া একদিন নাকি ওর সৎ বোন মানে তন্দ্রা আপু ওকে গলায় ওড়না দিয়ে ফাঁস লাগিয়ে দিচ্ছিল শুধুমাত্র অরিন দেরিতে ঘুম থেকে ওঠেছিল সেই অপরাধে”

দিহানের বুকের ভেতর ছেৎ করে ওঠে। তন্দ্রা এতটা নিচু কাজ করেছে? অরিনকে তারা মা মেয়ে এত কষ্ট দিত? লুপা আবার বলতে লাগে”

ও কখনো পেট ভরে ভাত খেতে পারেনি ভাল একটা জামা পড়ার শখ হলে সেটা কিনতে পারেনি। নিজের টাকা দিয়ে সব করেছে। পরিক্ষার ফি দেওয়ার জন্য মায়ের শেষ স্মৃতি স্বর্নের দুল জোড়া বিক্রি করে দিছে। কতটা কষ্টে জীবন পার করেছে বুঝেছ ভাইয়া? শেষমেষ কিনা এমন কিছু করল সারাজীবন তাকে কষ্ট পেতে হবে। জানো ভাইয়া খুব রাগ হয় ওর প্রতি কিন্তু ওই যে মায়া? এই মায়াটাই তো কাঁটাতে পারিনা।” বলেই লুপা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। দিহানেরও কান্না পাচ্ছে। অরিনের জীবনটা এতো কষ্টের? সারাজীবন নিজের ঘরে দাসি হয়ে থেকেছে আর এখন সে দাসি বানিয়ে দিল? কী বা করত আর সে? এ ছাড়া অরিনকে আঁটকানোর উপায় ছিলনা। অরিন কেন এমন করল যদি এমন না করত দিহান তাকে মাথায় তুলে রাখত। দিহানের চোখ ভিজে এল। চোখ মুছে প্লেট নিয়ে রুম থেকে বের আসল। অরিনের জন্য খুব খারাপ লাগছে দিহানের। আচ্ছা অরিন কারও চাপে পড়ে এমন করছে না তো? কার চাপে পড়ে এমন করতে পারে? দিহানের মাথা ভনভন করছে সবকিছু কেমন ঘুলিয়ে যাচ্ছে। অরিনকে যে রুমে রাখা হয়েছে ওই রুমে দরজায় এসে দ্বিধায় পড়ে গেল রুমে ঢুকবে কী না। চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা দম নিয়ে নিজেকে শক্ত করে দরজা খুলল দিহান।

অন্ধকার রুমের এককোণে হাঁটু গুঁজে বসে আছে অরিন। দিহান লাইট জ্বালাতেই অরিন কিঞ্চিৎ কেঁপে ওঠল। কান্না করছিল অরিন দিহানকে দেখে তৎক্ষনাৎ চোখের পানিটা মুছে ফেলল। দিহান রুমে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। রুমে একটা তোশক ছাড়া আর কিছু নেই। এটা তো কাজের লোকদের রুম? ভেতরটা ছেৎ করে ওঠল দিহানের। এই অবস্থায় রাখা হয়েছে অরিনকে? ” “ও কখনো পেট ভরে ভাত খেতে পারেনি ভাল একটা জামা পড়ার শখ হলে সেটা কিনতে পারেনি।” দিহানের কানে এসে কথাটা বেজে কষ্ট টা দিগুণ হয়ে গেল। শুকনো এক ঢোক গিলে কষ্ট চেপে রাখল দিহান। প্লেট নিয়ে এসে অরিনের সামনে বসে অরিনের সামনে প্লেট রেখে গম্ভীর গলায় বলল ”

_খেয়ে নাও।” অরিন ছলছল চোখে তাকাল দিহানের দিকে। এই দেড় মাসে মানুষটাকে সে অনেক ভালোবেসে ফেলেছে। নিজের স্বামী বলে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে নিয়েছে। আর আজ কিনা নিজের স্বার্থে সে এই মানুষটাকে কষ্ট দিল? ঠোঁট কামড়ে কেঁদে উঠে অরিন। মাথা নিচু করে নিরবে কেঁদে যায়। দিহান অরিনকে এভাবে কাঁদতে দেখে নিজেরও কান্না পাচ্ছে। কিছু তো একটা কষ্ট আছে অরিনের যা তাকে খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে। কাঁপা কাঁপা হাতটা অরিনের দিকে বারিয়ে দিল। অরিনের চোখের পানিটা আলতো করে মুছে দিল। অরিন দিহানের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখল সকালের যে তীক্ষ্ণ চোখ তাকে খুন করেছিল সে চোখে এখন গভীর মায়া জড়িয়ে আছে। দিহান হাত ধুয়ে এক লোকমা বিরিয়ানি নিয়ে অরিনের সামনে তুলে বলল”

_হা করো।” অরিন দিহানের দিকে তাকিয়েই তাকল দিহান আবার বলল”
_খাও।” অরিন মুখে নিল। আসতে আসতে চিবুচ্ছে। গিলতে গেলে তার কষ্ট হয় গলায় ব্যথা জমে আছে। অরিন হাত দিয়ে গলা চেপে চোখ খিঁচে ফেলে। তারপর খাবারটা গিলে চোখ খুলে। দিহান ব্যাপারটা লক্ষ্য করে। অরিনের জিজ্ঞেস করে”
_গলায় কী হয়েছে তোমার?
_ক ক কই না না নাতো কিছু না।
_দেখি।” বলে দিহান অরিনের হাত সরাল গলা থেকে। অরিনের গলায় জখম হয়ে আছে যেন কেউ তার গলা টিপে ধরছিল? দিহান কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল ”

_এসব কিভাবে হল অরিন?” অরিন কিছু বলল না চুপ হয়ে থাকল। দিহানের স্পষ্ট মনে আছে সকালে অরিনের গলায় এই দাগ দেখেনি সে। এখন তাকে কে আবার টর্চার করেছে? দিহানের মনে একটা প্রশ্ন জাগতেই দিহান অরিনকে বলল”
_এসব কেন করছ অরিন?” অরিন চমকে উঠে। দিহান আবার বলে”
_বল অরিন কেন করছ এমন?” অরিন কথা ঘোরাতে বলল”
_খাওয়ান না খুব মজা হয়েছে।” দিহান আরেকটু অরিনের মুখে দিল। তারপর আবার প্রশ্ন করল”
_বল অরিন কেন এমন করছ?
_আপনি খাবেন না? আপনিও খান।” দিহান কিঞ্চিৎ ধমক দিয়ে বলল”
_আমি তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করছি। “দিহানের ধমকে কেঁপে ওঠে অরিন। কী বলে দিহানকে চুপ করাবে তার মাথায় আসছে না। এই কঠিন সত্যি কী করে বলবে সে?
_কী হল বল।
_আ আ আ আমি আপনাকে ভা ভা ভা ভালোবাসি তাই।” দিহান চোখ বড় বড় করে অবাক হয়ে তাকাল। অরিন শুকনো এক ঢোক গিলে ভিতু চোখে দিহানের দিকে তাকাল। আপাতত এমন উত্তর ছাড়া কোনোকিছু তার মাথায় আসছে না। দিহান মনে হয় অনেক বড় শকড খেয়েছে। এখনো হা হয়ে আছে। অরিনের ভয় লাগছে ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে। অরিন ভয়ে ভয়ে বলল”

_পা পা পানি দেন।” দিহান হুসে এল। ইতস্তত হয়ে গেল। গলা একটু ঝেড়ে বলল”

_উহুম। আব,,,তু তুমি খে খেয়ে নিও আমি যা যাচ্ছি।” দিহান প্লেট রেখে চলে গেল। অরিন ভয়ে আরেক ঢোক গিলল। আল্লাহ জানে এর শাস্তি কী দেয় দিহান। এদিকে দিহানের কানে বার বার এসে বিকট শব্দে বাজছে”আমি আপনাকে ভালোবাসি তাই”। আসলে কি সত্যি অরিন তাকে ভালোবাসে? নাকি অন্যকিছু? নিশ্চয়ই এটাও এই মেয়ের আরেকটা ছাল । না না এই মেয়ের জালে কোনো ভাবেই ফাসা যাবেনা। নিজেকে আরও কঠিন করতে হবে আরও কঠিন। এভাবে দেখলেই দূর্বল হয়ে গেলে চলবে না। দিহান নিজের রুমে গিয়ে খাটের উপর বসে পড়ল। এভাবে অরিনের প্রতি নিজের দূর্বলতা থাকলে চলবে না। নিজেকে শক্ত করে চলতে হবে। এই প্রতিক্ষা মনে মনে করতে লাগল।

________________

রাত নয়টায় জিহানের গাড়ি এসে থামে শান্তি নীড়। গাড়ি থামিয়ে দুবার হর্ণ বাজাল। প্ররিবারই বাড়িতে আসার পরে সে হর্ণ বাজায়। হর্ণের শব্দ শুনে যখন দিশা, ইশি, লুপা,দিয়া ভাইয়া এসেছে ভাইয়া এসেছে বলে দৌড়ে আসে তখন তার সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। মনে হয় যেন হাতের মুঠোয় পৃথিবীর সব সুখ। জিহান কিছুক্ষণ গাড়িতে বসে থাকল তার বোনেরা আজ আসছে না হয়তো সে তাদের না জানিয়ে বিয়ে করেছে বলে এত রাগ তাও আবার আজ দিহানের বিয়ে ছিল সে সময় মতো এসে পৌছাতে পারেনি তাই বলে হয়তো রাগটা আরো বেড়ে গেছে তাদের। জিহান গাড়ি থেকে নেমে পিছন থেকে নিজের লাগেজ টা নিয়ে সদর দরজার দিকে পা বাড়াল। কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে তার মনে পড়ল সে একা না তার সাথে লারাও আছে। জিহান আবার পিছন ফিরে আসল গাড়ির গ্লাসে ঠকঠক শব্দ করে নক করল। লারার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে নিচু হয়ে গাড়ির ভেতর তাকাল। তাকাতেই তার চোখ আঁটকে গেল লারার ঘুমন্ত চেহারার দিকে।

আকাশে এক তালা চাঁদ উঠেছে আর তার আলো এসে পড়ছে লারার মুখে। কালো রংয়ের একটা শাড়ি পড়েছে লারা ধবধবে ফর্সা লারার উপর চাঁদের আলো এসে পড়ায় তাকে পৃথিবীর সব থেকে সুন্দরী নারী মনে হচ্ছে। তার এই গুল ঠোঁট গুল মুখ সবার কাছে কেমন তা জানা নেই তবে জিহানের কাছে এই মূহুর্তে অনেক আকর্ষণীয় লাগছে। জিহান হাত বারিয়ে দিল লারার একটু ছুঁয়ে দিতে। পরক্ষণে কি মনে করে আবার হাত ফিরিয়ে নেয়। ঘুম থেকে জাগাতে হবে। কিন্তু কি বলে ডাক দিবে? কখনো এই মেয়ে ছাড়া কোনো কিছু বলে সম্মোধন করেনি সে। ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে লারাকে ডাক দেয়”

_এই মেয়ে উঠো।” লারা শুনেনা। জিহান আবার ডাকে তখনও লারা শুনেনা। জিহান আস্তে আস্তে হাতটা বারিয়ে দেয় লারার দিকে লারাকে আলতো করে ছুঁয়ে ডাক দেয়”

_ও হ্যালো।” লারা একটু নড়ে ওঠে জিহান বলে”
_এই যে আমরা এসে গেছি।” পিটপিট করে চোখ খুললো লারা। চোখ খুলতেই জিহানের মুখ দেখতে পেল জিহান তার দিকে ঝুঁকে আছে। লারা কিঞ্চিৎ কেঁপে ওঠে। জিহান বলে”

_গাড়িতেই থাকার ইচ্ছা নাকি ভেতরে যাবে?” লারা তৎক্ষনাৎ সোজা হয়ে বসে। জিহান গাড়ির দরজা খুলে দেয়। লারা গাড়ি থেকে নেমে একবার বাড়ির দিকে থাকায় তাকিয়ে মুখের ভঙ্গি এমন করে যেন সে ৪৪০ ভোল্টের ঝাটকা খেয়েছে। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে দেখে জিহান বলে এভাবে তাকিয়ে আছো কেন গিলে ফেলবে নাকি আমার বাড়ি?” লারা কিঞ্চিৎ কাঁপা গলায় বলল”

_এ এ এটা আপনার বাড়ি?
_না তোমার বাবা এটা আমাকে যৌতুকে দিয়েছে। যাও লাগেজ নিয়ে আসো।” লারা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার শান্তি নীড়ের দিকে তাকিয়ে লাগেজ টা নিয়ে আসে। তারপর দুজন এসে সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। জিহান কলিং বেল বাজায়। দুই,তিন,চারবার কলিং দেওয়ার পড়েও কারো কোনো সাড়াশব্দ নেই। জিহান একটু চিন্তায় পড়ে যায়। বাসায় কি কেউ নেই নাকি? ক্ষানিক পরে ইশি এসে দরজা খুলে দেয়। ইশি সাদা রংয়ের একটা প্লাজু নীল রংয়ের একটা টিশার্ট পড়ছে। চোখ দুটো ফোলে আছে। বিয়ে বাড়িতে ইশির এমন হাল জিহান কিঞ্চিৎ কপাল কুঁচকে ফেলে। হঠাৎ জিহানের মনে পড়ে ইশি তো দিহানকে ভালোবাসতো তাই হয়তো কান্না করতে করতে নিজের এই অবস্থা করছে।

জিহান ইশিকে বলল”
_কী রে জড়িয়ে ধরবি না?” ইশি ভাইয়ের আহ্লাদী কথা শুনে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে জিহানকে জড়িয়ে ধরে। জিহানও ইশিকে নিজের বুকে আগলে ধরল। তারপর বলল”

_কাঁদিস কেন পাগলী? চলে এসেছি তো। একদম কাঁদবি না। নয়তো আবার চলে যাবো।” ইশি কান্না থামিয়ে দেয় কিন্তু ফুঁপানো বন্ধ হয়না। লারা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। এই চোখ দিয়ে যেন খুন করে ফেলবে এই দুই ভাই বোনকে।

ভাইকে ছেড়ে ইশি চোখের পানিটা মুছে লারার দিকে তাকাল। লারা ইশির দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে ছিল ইশি তাকাতেই লারার চোখ নিচে নামিয়ে নেয়। একটু আগে তার যে চেহারা অগ্নি রূপ ধারণ করে ছিল এখন সে চেহারায় আছে এক রাশ নম্রতা। ইশি লারাকে হাসি মুখে বলল”

_কেমন আছো ভাবি?
_জ্বি আলহামদুলিল্লাহ।
_আজ তো দিহানের বিয়ে ছিল বাসা ভর্তি মেহমান থাকার কথা চারিদিকে হৈ চৈ থাকার কথা। কিন্তু সবকিছুতে এমন পিনপতন নীরবতা কেন?
“জিহানের প্রশ্নে ইশি লারার সাথে কথা বলা বাদ দিয়ে ভাইকে বলে”

_তোমরা অনেক দূর থেকে এসেছ আগে ফ্রেশ হয়ে নাও আমি খাবার দিচ্ছি খেয়ে ঘুম দাও সকালে কথা হবে।” বলে ইশি চলে যায়। জিহান অবাক হয়। নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ে। লারা পড়ে মহা বিপদে রুমে একটা সোফা নেই সে ঘুমাবে কোথায়? জিহান লারাকে বলল”
_আলমারিতে কোলবালিশ আছে ওটা এনে মাঝখানে রেখে শুয়ে পড়।” জিহান চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ে। লারা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকে জানালার বাইরের দিকে।

চলবে……।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here