ভালোবাসি বলে দাও পর্ব ১৭

0
365

#ভালোবাসি_বলে_দাও
#আরিশ❤আরু
#Suraiya_Aayat

17.

নানাভাইয়ের সামনে বসে আছি বিগত এক ঘন্টা যাবৎ আর ওনার পাশে বসে আছেন ওনার বয়সী একজন মুরব্বী মানুষ। নানাভাই বসে আছে ঠিকই কিন্তু তার থেকে সামনের বয়সজেষ্ট মানুষটা প্রশ্ন করছেন বেশি। আমার সারা শরীর দরদর করে ঘামছে ফ্যানের নীচে বসেও। ওনার এমন প্রশ্ন শুনে আমার এই মুহূর্তে ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে আর আরিশ ভাইয়ার সামনে গিয়ে কান ধরে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘আপনার কথা আমি আর কখনো অমান্য করবো না। ‘

চাইলেও সে সুযোগ আমার কাছে নেই। মামী নাস্তাপানি রেখে গেছেন অনেক আগেই আর যাওয়ার আগে বলে গেছেন যে ভয়ের কোন কিছু নেই। তারা যে এভাবে মিথ্যা বলে আমাকে এখানে আনবে জানলে আমি কখনোই এখানে আসতাম না।

মুরব্বি মানুষটার প্রশ্ন গুলো শুনে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। যেমন-
‘রান্না বান্না কিছু পারো? ‘

‘অতিথি আপ্যায়ন? ‘

‘স্বামীর সেবা যত্ন? ‘

ওনার এমন উদ্ভট প্রশ্ন শুনে আমার শ্বাস আটকে আসতে চাইলো, আমি মুখে হাত দিয়ে বমি করার মতো একটা ভাব করে বললাম,
‘ আমি একটু ওয়াশরুমে যাচ্ছি। আমার শরীরটা খারাপ লাগছে। ‘

আমার এমন কথা শুনে সত্যিই সেই মুরব্বী মানুষটা নাক মুখ কুঁচকে নিলেন, আমি ওঠার জন্য পা বাড়াতেই উনি বলে উঠলেন,
‘মাইয়া কি আদব কায়দা কিছু জানে না? এ কেমন নাতনি আপনার? ‘

কথাটা শুনে নানাভাই বললেন,
‘বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে গা।’

আমার চোখে জল টলটল করতে লাগলো, আমি মুখে হাত দিয়ে দৌড়ে ছুটলাম ওয়াশরুমের দিকে, আমার এখন সত্যিই খুব বমি পাচ্ছে। আমাকে দৌড়াতে দেখে মামী আমার পিছন পিছন এলেন। বেসিনে গিয়ে অনর্গল বমি করতে লাগলাম আমি। আমার শরীরে আর দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। বেসিন থেকে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই আয়নায় মামীর প্রতিবিম্ব দেখতে পেলাম। সবকিছু ঘোলাটে হয়ে আসছে চোখের সামনে। আমি মাথা ঘুরে পড়ে যেতে নিলেই মামী আমার হাত ধরে আটকে নিলেন। মামীর মুখ ভয়ে লাল আভা ধারন করেছে, আমার সাথে উনিও কাপছেন। ওনার শাড়ীর আঁচল দিয়ে উনি আমার মুখটা মুখিয়ে দিয়ে কোনরকমে ওনার ঘর অবধি নিয়ে গেলেন আমাকে। মুরব্বী মানুষটা নাকি দুপুরে খাবেন তাই মামাকে একটা এলাহী বাজারের লিস্ট ধরিয়েছেন নানাভাই কারন লোকটা নাকি বরপক্ষ তাই তাদের আপ্যায়নের কোনরকম ক্রুটি চাইনা তিনি। এসে এবধি এইসব কথায় আমার কানের কাছে বাজছে, মামী নিজেও দু দন্ড বসার সুযোগ অবধি পাননি।

মামী আমাকে এনে বিছানায় আধশোয়া করে বসিয়ে আতঙ্কিত হয়ে বললেন,
‘ দাঁড়াও আমি তোমার মামাকে ফোন দিয়ে ডাক্তার আনতে বলি। ‘

আমি মামীর হাত ধরে আটকালাম, বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগে আমাকে কিছু একটা করতে হবে না হলে নানাভাইয়ের মতি গতির ঠিক নেই, পারলে উনি আজকেই আমার সাথে অন্য কারোর বিয়ে দিয়ে দেন। আমি মামীর হাত ধরে আধো আধো কন্ঠে বললাম,

‘মামী তুমি কাওকে কিছু বলো না, আমি ওনাদের সামনে একটু নার্ভাস হয়ে গেছিলাম। এমনিতেই উঠে আসায় লোকটা আমাকে বেয়াদপ ভেবেছেন তারপর এখন যদি শোনে যে অসুস্থ তাহলে তোমাদেরকেও অপমান করবে। তুমি শুধু আমার ফোনটা একটু এনে দাও প্লিজ। ‘

মামী প্রথমে ভয়ে কিন্তু কিন্তু করলেও পরে রাজী হলেন কারন উনিও চান না বিয়েটা হোক। উনি দ্রুত পাশের ঘর থেকে আমার ফোনটা আনলেন। ওনাকে দেখে নানাভাই হাক ছাড়লেন,
‘ কই তোমার ভাগ্নীকে জলদি আসতে কও! আর কতো দেরি লাগাইবো? ‘

কথাটা আমার কানে এলো, আমার বুকের ভিতর ধুকধুক করছে। খারাপ কিছু না হয়ে যায় সেই আশঙ্কায় আছি আমি। মামী ঘরে এসে আমার হাতে ফোন গুজে গিয়ে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
‘আরু তোমার মামা তোমার নানাভাইয়ের কথার খেলাফ করতে পারবে না, আমি ওনাকে ভালোভাবে চিনি। খারাপ কিছু হওয়ার আগে তুমি একবার বাসায় কল দিয়ে সব জানাও ততখন আমি দেখছি।’

আমার চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে অনবরত। মামী চলে যেতে নিলেই আমি ওনার হাত ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম,
‘ তোমরা জেনে শুনে কেন আমাকে এখানে নিয়ে এলে মামী? কেন? ‘

মামীর হাত ধরে কাঁদতে লাগলাম, ওনারও গলা ধরে এলো। উনি আমার কপালে চুমু দিয়ে বললেন,
‘ আচ্ছা তুমি কাওকে ভালোবাসো আরু? ‘

আমি ফুঁপিয়ে উঠছি কান্নার তোড়ে, উনি আমার চোখ মুছিয়ে বললেন,
‘ না মানে এমন কেও যাকে তুমি পছন্দ করো, যাকে তুমি চাও। যদি তেমন কেও সত্যিই থাকে তাহলে ফোন করো আর বলো এখান থেকে তোমাকে অধিকার সহ নিয়ে যেতে নাহলে সারাটা জীবন আফশোষ থেকে যাবে তোমার এবং আমাদেরও। ‘

কথাটা বলে মামী চলে গেলেন। আমি এখনো কেঁপে কেঁপে উঠছি। মামীর কথা শুনে আমি কয়েক সেকেন্ড নিরব হয়ে গেলাম যেন। আমার তো আরিশ ভাইয়া ছাড়া তেমন কোন মানুষ জীবনে নেই। ছোট থেকে ওনার সাথেই আমার বড়ো হয়ে ওঠা এমনকি ওনার জন্য কখনো কোন ছেলের সাথে ঠিকভাবে কথাও বলতাম না। সেখানে উনি ছাড়া আমর জীবনে আর কে ই বা থাকবেন?

আমি কিছু না ভেবে ওনাকে কল করতে গেলেই আমি পুনরায় ভাবলাম,
‘উনি কাওকে ভালোবাসেন, ওনার একজন মায়াবতী আছে। উনি তাহলে কেন আসবেন ? তার উপর উনি তো বলেছেন যে এখানে এসে কোনরকম কোন সমস্যা র মুখোমুখি হলে উনি কোনভাবে হেল্প করবেন না আমাকে। ‘

কথাটা ভাবতেই আমি কেঁদে উঠলাম। আজ হিংসা হচ্ছে ভীষনরকম সেই মেয়ের প্রতি যিনি ওনার মায়াবতী। আজ যদি আমি ওনার সেই মায়াবতী হতাম তাহলে উনি তো ঠিকই আসতেন।

কথায় বলে বিপদে বাবা মা ছাড়া কেও পাশে থাকে না। কথা গুলো অনবরত আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন ধরালাম বাবার কাছে।
একবার কল ধরতেই আমি বাবাকে কম্পিত কন্ঠে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলাম,
‘ বাবা তুমি আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও। এরা নাহলে আমাকে অন্য কারোর সাথে বিয়ে দিয়ে দেবে। তোমরা তাড়াতাড়ি এসো। ‘

কথাটুকু বলতে না বলতেই মামী কোনরকম দৌড়ে ঘরে ঢুকে বললেন,
‘আরু তোমার নানাভাই আসছে, জলদি কান্না থামাও। ‘

ফোনটা কাটলাম না আমি তার আগেই ফোনটা ভয়ে হাত থেকে পড়ে গেল। মামী আমার চোখ মুছিয়ে মাথায় ওড়না দিয়ে দিলেন। নিজেকে কেমন পুতুল পুতুল লাগছে। ওপাশ থেকে কেও একজন আমার সাড়া শব্দ না পেয়ে ‘ এই মেয়ে’ বলে চিৎকার করছেন সেটা যদি আমার কান অবধি পৌছাতো তাহলে বোধহয় মনোবল পেতাম। সে সুযোগ টুকুও পেয়ে উঠলাম না আমি। নানাভাই ঘরে ঢোকার আগেই মামী আমার হাত ধরে বাইরে নিয়ে গিয়ে সেই লোকটার সামনে বসালেন। আমার শরীর কাঁপছে আর মাথার ভিতর ঝিমঝিম করছে। নানাভাইয়ের মুখ দেখে বোঝাই যাচ্ছে যে তিনি আমার প্রতি অসন্তুষ্ট। উনি বলে উঠলেন,
‘ মোদের অন্নেক বড়ো পরিবার, পেরায় ১৭ জন মানুষ একসাথে থাকি। তুমি হইবা কি মোদের বড়ো বউ, বুঝতেই পারতেছো তোমার দায়িত্ব সবার সেবা যত্ন করা, আদর আপ্যায়ন করা। তোমার নানভাইয়ের কথা শুনে তো মোর ভালোই লাগসে যে তুমি একটা সংসারী মাইয়া। তা বেশ, তোমারে তো আমাদের পছন্দ হইছে। আমাদের ছেলে হলো কি এলাকার প্রধান।’

আমি নানাভাইয়ের দিক দূর্বল দৃষ্টিতে তাকালাম, তিনি পাকাকথা পেয়ে ভীষন খুশি মনে হচ্ছে। বয়স্ক লোকটা এবার আমাকে উঠে দাঁড়াতে বললেন আমার পায়ের পাতা দেখার জন্য। কথাটা শুনতেই আমি টলমল করে কেঁপে উঠলাম যেন। দূর থেকে মামী চোখ ছলছল করে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার শরীর কাঁপছে। আমি উঠছিনা দেখে নানাভাই বলে উঠলেন,
‘আজকে সন্ধ্যায় তাহলে মোহিতোশের সাথে আরুর আংটি বদলটা কারালেই হয়।

আমি উঠে দাঁড়ালাম, তাদের এই সমস্ত কথা শুনে আমার মাথার ভিতর চক্কর দিয়ে উঠলো। সামনে বসে থাকা দুটো মানুষকে ডবল ডবল অর্থাৎ চারজন হিসাবে দেখতে পেলাম আমি বুঝলাম আমার আর কিছু করার নেই। আমি জ্ঞান হারালাম তারপর আর কিছু মনে নেই।

কতখন পর আমার জ্ঞান ফিরলো আমি জানি না কিন্তু যখন চোখ খুললাম তখন কেঁপে উঠলাম খানিকটা। কারন আমার পরিবারের কাওকেই দেখলাম না আমি। ওরা এখনো এসে পৌছায়নি তাহলে? নাকি তারা অপমানিত হয়ে ফিরে গেছে। কিন্তু নাহ ওনারা আমাকে ফিরিয়ে না নিয়ে যাবেন না। মামী আমার মাথার কাছে বসে আছেন। আমি উঠতে গেলেই ডাক্তার আমাকে বলে উঠলেন,
‘ এই মাইয়া উঠো কিল্লাই, এই অবস্থায় এমন একটু আধটু হয়। ‘

ওনার কথাবাত্রা আর চালচলন দেখেই বুঝলাম যে উনি গ্ৰামের হাতুড়ে ডাক্তার। কিন্তু এই অবস্থায় মানে কোন অবস্থায় বোঝাচ্ছেন উনি? আমি অবাক হলাম, মামীর দিকে তাকাতেই দেখলাম যে তিনি মাথা নীচু করে বসে আছেন, নানাভাইকে ঘরের কোথাও দেখলাম না।

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
‘ এই অবস্থায় মানে? কি হয়েছে আমার? ‘

ডক্টর তার ব্যাগটা গোছাতে গোছাতে বললেন,
‘ অল্প বয়সে এসব অকাল কাম না করলেও তো পারতা। পরিবরের মান সম্মান, তোমার নানার মান সম্মান ডাও তো আর রাখলা না। এই কথা যদি বাইরে পাঁচ কান হয় তো তোমার নানাভাইয়ের সম্মান কোথায় যাইবো জানো? ‘

আমি মামীর দিকে তাকিয়ে ওনাকে ডেকে বললাম,
‘ মামী উনি কি বলছেন এসব। ‘

মামী কিছু বলতে যাবেন তার আগেই ডাক্তার বললেন,
‘ তুমি তো দুই মাসের পোয়াতি সেই কথা কি তোমাকে আবার মনে করাইতে হইবো? ‘

আমি আকাশ থেকে পড়লাম যেন, উনি এসব কি কথা বলছেন। আমি রেগে গিয়ে উঠে বসে ওনার জামার কলার ধরে বললাম,
‘ থাপড়িয়ে আপনার গাল লাল করে দেবো আমি। কি যা তা বলছেন এসব।’

উনি কলার ছাড়িয়ে রাগ দেখিয়ে বললেন,
‘ কার সাথে অকাল কুকাম কইরা এখন আইসে সতী সাজতে। সমস্যা নাই তোমাকে আমি মাইনা নিবো আমর লগে, কাওকে কিছু জানতেইও দিব না।’

আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেল যেন, ইচ্ছে করলো ওনাকে এখানেই শে/ষ করে দিই।

#চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here